একবার ভুবনেশ্বরে ছিলাম তিনদিন। গেছি লিঙ্গরাজ মন্দিরে। দেখি মন্দিরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন এক সাধুবাবা। একেবারে আপনভোলা হয়ে। তীর্থযাত্রীরা যাতায়াত করছে। কারও দিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। যাত্রীরা যেমন, সাধুবাবাও তেমন। কেউই কাউকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। যে যার নিজের মতো আছে।
এই সাধুবাবা ফরসা তো নয়ই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণও নয়। কালচে তামাটে বললেই ঠিক বলা হবে। অস্থিচর্মসার দেহ বলব না। সামান্য মাংসের উপর চামড়া লাগানো। না দোহারা, না ছিপছিপে। এর মাঝামাঝি চেহারাটা যেমন দাঁড়ায় তেমনই সাধুবাবার দেহটা। লম্বায় প্রায় পৌনে ছ’ফুট, এটা আন্দাজ। ছোট্ট একটুকরো কাপড় পরা। কাপড়টা বড় কাপড়েরই একটা ফালি। নেমে এসেছে হাঁটুর প্রায় আটআঙ্গুল উপর পর্যন্ত তবে ছেঁড়া নয়। ময়লা, বেশ ময়লা। বহুদিন জলের মুখ দেখেনি। পাশে ছোট্ট একটা ঝুলি। বাইরে থেকে বোঝা যায় ভিতরে কিছু নেই। বাজারে যাওয়ার সময় ব্যাগের চেহারা।
লম্বাটে মুখের গড়ন। ভাঙ্গা চোয়াল। কমনীয় চোখদুটো বসে গেছে। মাঝারি আকারের চোখ। অসম্ভব আকর্ষণীয় মুখমণ্ডল। উজ্জ্বল, এমন উজ্জ্বলতা কোনও প্রসাধনী দ্রব্য ব্যবহারেও হয় না। বেশ বড় জটাটা মাথার মাঝখানে টোপরের মতো বাঁধা। দাড়ি নেমে এসেছে পেটের কাছাকাছি। পাশে চিমটে বা কমণ্ডলু কিছু নেই। বয়েসে বৃদ্ধ। বয়েসের আন্দাজ করতে পারলাম না। যদি কথা হয়, কথায় কথায় জেনে নেব সাধুবাবার বয়েসের কথা।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। দাঁড়ালাম সামনাসামনি। সাধুবাবা বসেছিলেন এক পায়ের উপর আর এক পা তুলে আধমোড়া করে। ঝট করে প্রণাম করতেই পাদুটো টেনে নিলেন একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে। তাকালেন মুখের দিকে। এবার হাতদুটো জোড় করে মুখ বললেন, নমো নারায়ণায়।
বসলাম সাধুবাবার সামনে। বেশ কাছাকাছি মুখোমুখি হয়ে। কোন প্রসঙ্গ নিয়ে কথা শুরু করব ভাবতে ভাবতেই বলে ফেললাম,
– বাবা, ভুবনেশ্বরে কি কোথাও ডেরা আছে আপনার, নাকি শুধুমাত্র তীর্থদর্শনে এসেছেন?
কোনও উত্তর দিলেন না। বসে রইলেন চুপ করে। শুধু আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন, কাটল এইভাবে মিনিটখানেক। আবার ওই একই প্রশ্ন করলাম। এবার মুখ খুললেন,
– নেহি, মেরা কহি ডেরা নেহি হ্যায়। শিউজি কা দর্শন করনে আয়া হুঁ।
সাধুবাবার কণ্ঠস্বর বেশ গম্ভীর। জিজ্ঞাসা করলাম,
– কতদিন আছেন এখানে?
কোনও উত্তর দিলেন না। বসেই রইলাম চাতকের মতো। কাটল আরও মিনিটপাঁচেক। আবার বললাম। কথাটা শুনেও শুনলেন না। তাকিয়ে রইলেন অন্যদিকে। মনে হল কথা বলতে অনিচ্ছুক। তীর্থযাত্রীরা আসছেন অনেকে। পাশ থেকে একনজরে দেখে নিয়ে চলেও যাচ্ছেন। আবারও জিজ্ঞাসা করলাম ওই একই কথা,
– বাবা, কতদিন আছেন এখানে?
সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন। মনে হল অনিচ্ছায়,
– পাঁচ রোজ।
একথার পর ভাবলাম, এদের বিরক্ত করার অধিকার আমার নেই। অথচ না করেও তো উপায় নেই। নইলে জানব কেমন করে? বসে রইলাম। দেখি সাধুবাবা নিজের থেকে কিছু বলেন কিনা? কাটল আরও মিনিট পনেরো। একটা কথাও বললেন না। এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন একবার আবার আমার মুখের দিকে। ভাবে মনে হল, তিনি যেন জানতে চাইছেন আমার উদ্দেশ্য কি? কেটে গেল আরও কিছুটা সময়। একইভাবে স্থির হয়ে বসে রইলেন। দেহের কোনও অংশই নড়ছে না। দুম করে বললেন,
– ভাগ, ভাগ হিঁয়াসে। সাধুর হাঁড়ির খবর নিতে এসেছে? সারাজীবন ধরে কি করলাম এখন তাই বল ওনাকে, কি জন্যে বলব তোকে আমার জীবন কথা?
অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম এককথায়। অন্তর্যামী সাধুবাবা। ধরে ফেলেছেন আমার মনের কথা, তবে মোটেই আমল দিলাম না। বসে রইলাম বোকার মতো। কাটল আরও মিনিটদশেক। এবার একটু ক্ষুব্ধ ভাবেই বললেন,
– কিরে, উঠলি না এখনও? কোনও কথাই বলব না তোকে! যা যা এখান থেকে।
মাথাটা নিচু করেই বসে রইলাম। একটা কথাও বললাম না। দেখি না শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়ায়! কেটে গেল আরও কিছুটা সময়। হঠাৎ গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন,
– কিরে কি ভাবছিস?
মাথাটা তুললাম। ‘কিরে কি ভাবছিস’ কথাটায় এমন একটা সুর, আগের সুরের সঙ্গে কোনও মিল নেই। বিরক্ত মা শিশুর উপরে রাগ করার পর যে সুরে আদর করেন ঠিক তেমন সুরে বললেন। একেবারে অবাক, অভিভূত হয়ে গেলাম। এবার বললেন,
– রাগ করলি? তুই সাধুসঙ্গ করতে এসেছিস। দেখছিলাম তোর ধৈর্য আছে কি না? দেখলাম ঠিকই আছে। এখন বলত কি কি জানতে চাস তুই?
ভাবলাম কত ভাবের, কত বিচিত্র মনের সাধু আছে তার ইয়ত্তা নেই। বাইরে এক ভাব, অন্তরে আর এক। দেখে বোঝার কোনও উপায় নেই। খুব কম সাধুকে দেখেছি যারা প্রথমেই আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। কোনও রূঢ় কথা বলেন না। অধিকাংশই চেয়েছেন সরিয়ে দিতে, বুঝেছেন বিরক্ত করব তাদের। পরে ভাবতে পারিনি এমন সুন্দর উদার অন্তর মানুষের হতে পারে! এমন অবস্থায় বিরক্তই হতাম সাধুদের আচরণে। পরে বুঝেছিলাম ক্রোধ বা গালাগাল অন্তরের নয়। এড়িয়ে যাওয়ার একটা ছল মাত্র। তাই আর বিরক্ত তো হতামই না। বরং বুঝে যেতাম, জানতে পারব অনেক কথা। পেয়ে যাব জিজ্ঞাসার অনেক উত্তর। পেয়েছিও তাই। দার্শনিক এমের্সন বলেছেন, ‘ধৈর্য তিক্ত হলেও তার ফল মিষ্ট।’ কথাটা সত্য, তবে এত বেশি তেতো যে কালমেঘও হার মেনে যায়। ধরা যায় না। এসব কথা ভাবতে ভাবতে বললাম,
– বাবা, জানতে চাই তো অনেক অ-নে-ক কথা। আপনি কি বলবেন দয়া করে?
মুখে হাসি ফুটে উঠল সাধুবাবার। সাজানো দাঁত ফুটফুটে সাদা। হাসিভরা মুখখানা যেন দয়ায় ভরে উঠল। বললেন,
– দয়া বলছিস কেন? দয়া কি মানুষ করতে পারে? ভগবান ছাড়া মানুষের সাধ্য কি যে সে দয়া করে! তোর কি জিজ্ঞাসা আছে বল, সাধ্যমতো চেষ্টা করব উত্তর দিতে।
মনে কিছুটা জোড় পেয়ে বললাম,
– আপনার কথাটা ঠিক। সব সাধুরাই বলেন, ভগবান কাউকে স্বরূপে এসে দয়া করেন না। তাঁর দয়া প্রকাশের মাধ্যমই মানুষ। তিনি মানুষের মধ্যে থেকে, মানুষ শুধু নয়, সমস্ত জীবেই দয়া করেন।
কথাটা শুনে মাথাটা নাড়লেন। জানতে চাইলাম,
– বাবা, সংসার ছেড়ে এক আনন্দময় জীবনযাপন করছেন আপনি। আমরা যারা সংসারে আছি তাদের শান্তি পাওয়ার উপায় কি কিছু বলতে পারেন?
কথাটা শুনে সাধুবাবা মাথাটা বেশ দোলাতে লাগলেন। পরে একটু সোজা হয়ে বসলেন,
– বেশ জব্বর প্রশ্ন করেছিস। সাধুরাও তো শান্তির খোঁজেই বেরিয়ে পড়ে সংসার ছেড়ে। ভগবানকে তো ঘরে বসেও পাওয়া যায় তাহলে আর বেরোয় কেন! তবে শোন বেটা, সংসারে সুখ দুঃখ থাকবেই থাকবে। কোনও না কোনওভাবে দুঃখ বিচলিত করবেই করবে। কোনও মানুষই এর থেকে একেবারে মুক্তি পেতে পারে না। সুখ দুঃখের মধ্যে জীবনব্যাপী দুঃখের ভাগটাই বেশি। মানুষের যেটুকু সুখ, যা কিছু দুঃখ জানবি ভগবানের ইচ্ছা। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে হাত নেই কারও, করা যায় না। এটাই সত্য। এটাই যখন সত্য তখন তাঁর উপরে সব ছেড়ে দে। যেটা হচ্ছে, যা হচ্ছে মেনে নিতে চেষ্টা করবি। এই চেষ্টাই অভ্যাসযোগ। খুব কঠিন। অভ্যাস ক্রমশ দৃঢ় হতে থাকলে মন ধীরে ধীরে হবে নির্বিকার। দেখবি সংসারের কোনও আবিলতা, কোনও অশান্তিই তোকে স্পর্শ করতে পারবে না। সুখ দুঃখ সব অবস্থাতেই মন থাকবে সদা আনন্দময়। এছাড়া বেটা, সংসারে শান্তি পাওয়ার আর কোনও পথ আছে বলে আমার অন্তত জানা নেই।
কথাটা শেষ হতে বললাম,
– ‘সব ছেড়ে দে’ কথাটা তো বললেন বেশ সহজভাবে। দেরি এতটুকু কিন্তু সংসারীদের পক্ষে তা কি সহজেই সম্ভব?
একটু গম্ভীরভাবে বললেন,
– হাঁ বেটা, কথাটা বললাম সহজভাবে। সংসার ছেড়েও অনেক সাধুই তো তা পারেননি। সংসারীদের পক্ষে একাজ তো আরও কঠিন। তবুও থাকলে মন একদিন না একদিন নির্বিকার হবেই হবে। তবে একদিন বা একবার চেষ্টাতে তা হবে না। সব সময় মনে রাখবি, কোনও কিছু পেতে হলে সেই দিকে লেগে থাকতে হবে। হচ্ছে না বলে ছেড়ে দিলে চলবে না। ঈশ্বরের সহায় মানুষের এই চাওয়াটুকু পূরণ হবে না একথা আমি বিশ্বাস করিনা।
কথাটুকু বলে থামলেন। মুখে হাল্কা হাসি ফুটে উঠল বললেন,
– বেটা, সংসারে মেয়েরা মানসিক অশান্তিভোগ করে বেশি। পুরুষ রোপণ করে সৃষ্টির বীজ। তা ধারণ ও যত্নের সঙ্গে পালনে নারীই সব। বাগানের মালী হয়ে যায়। ফলে মায়া আর আসক্তিও জন্মায় বেশি। সংসারে মেয়েরা সন্দেহমনা হয়। স্বামীর উপরে সন্দেহের ভাব একটা এদের থেকে যায় জানিস? দেহ মন সব দিয়ে স্বামীকে অবলম্বন করে বলে। তাই সংসারে এদের মানসিক কষ্ট আর অশান্তিও ভোগ করতে হয় পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি।
কথার মাঝে একজন যাত্রী এসে দাঁড়ালে সাধুবাবা তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন। একটু দাঁড়িয়ে থেকে আবার চলে গেলে শুরু করলেন,
– প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু চাইবি না। তাহলেই শান্তি আসবে। নইলে অশান্তিকে রোধ করতে পারবি না। খাওয়া পরার বিষয় নিয়ে মনে কখনও অশান্তি রাখবি না। ঈশ্বরের ইচ্ছায় ও যেকোনওভাবে জুটবেই জুটবে। তবে প্রয়োজনের যেকোনও দ্রব্য বা বিষয় পাওয়ার জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখতে নেই। তাতে ভোগ কাটে। পেলে ভাল, না পেলেও ভাল। এই ভাবটা রাখবি। অশান্তি কিছুতেই স্পর্শ করতে পারবে না তোকে।
ভাবলাম, সংসারে হাজার রকম সমস্যা। সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে নির্বিকার হওয়া এক কল্পনাতীত ব্যাপার। নির্বিকার হতে চেষ্টা করাটাই তো একটা সমস্যা। যার কালকের সংগ্রহ নেই সে আজ না ভেবে থাকবে কেমন করে! এবার জানতে চাইলাম,
– সারা জীবনটাই তো কাটিয়ে দিলেন সাধনভজনে। মন স্থির করার কায়দাটা নিশ্চয় জানেন। ঈশ্বর চিন্তার সময় সারা দুনিয়ার চিন্তা এসে ঢোকে মাথার মধ্যে। অনুগ্রহ করে বলবেন বাবা কি করলে মনটা স্থির না হোক, অন্তত অস্থিরতাটা যাতে একটু কমে।
এ প্রশ্নে বেশ চিন্তার একটা ভাব ফুটে উঠল সাধুবাবার চোখে মুখে। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন,
– বেটা, সংসার জীবনে বল আর সাধুজীবনেই বল, মন চঞ্চল থাকবেই থাকবে। সংসার থাকলে একটু বেশি। এজীবনে একটু কম, পার্থক্য এই যা। মনকে স্থির করতে কোনও কায়দা বা কৌশল নয়। অভ্যাসই প্রধান। পথ একটাই, বীর্যধারণের অভ্যাস। ওটা ধারণ করতে না পারলে মন কিছুতেই স্থির হবে না। দেহরাজ শুক্র চঞ্চল হওয়া মানে মন অস্থির হওয়া।
কথায় এবার ছেদ পড়ল। একদল তীর্থযাত্রী এসে উপস্থিত হলেন সামনে। এরা বাঙালি নয় কেউ। প্রণাম শুরু করে দিলেন ঝপাঝপ। আশীর্বাদের সময়টুকু পেয়েছিলেন কিনা সাধুবাবা বলতে পারব না। কয়েকজনের প্রণাম আমিও পেয়ে গেলাম চুলদাড়ির দৌলতে। জোর করে একজনকেও আটকাতে না পারলেন সাধুবাবা, না আমি। প্রণামীও পড়ল কিছু। শেষ হল প্রণামপর্ব। এরা বিরক্ত করলেন না কেউ। একে একে এগিয়ে গেলেন যেমন এসেছিলেন। মহিলা পুরুষ নিয়ে তাও জনাপনেরো হবে। সকলে চলে যেতে দুজনে হাসলাম মুখ চাওয়া চাইয়ি করে। পয়সাতে হাত দিলেন না। কুড়িয়ে রাখলাম এক জায়গায়। শুরু করলেন নির্বিকার সাধুবাবা,
– যেসব কুমার বা বিবাহিত পুরুষের মন বড় বেশ অস্থির, একেবারে নিশ্চিত জানবি শুক্রক্ষয় হচ্ছে তার অতিমাত্রায়। অতিরিক্ত শুক্রক্ষয় ছাড়া মন কারও অত অস্থির হতে পারে না, তবে কৈশোরের শেষ থেকেই এর শুরু।
এবার চোখ বুজে বলতে লাগলেন,
– তবে একটা কথা আছে বেটা, বীর্যধারণ করলেই যে রেহাই হয়ে গেল, মন স্থির হয়ে যাবে, তা নয়। বীর্যধারণ করলে বেড়ে যাবে কাম। অসম্ভব বেড়ে যাবে। বীর্যের বড় তেজ। কাম বাড়লেই বেড়ে যাবে ক্রোধ। ফলে মন আরও চঞ্চল আরও অস্থির হয়ে উঠবে। এসব উপসর্গ আসবে বীর্যধারণের প্রথম অবস্থাতে। কিছুদিন সংযমে থেকে বীর্যক্ষয় না করলে তা স্থির হয়ে যাবে। দেহ মনের শক্তি যাবে বেড়ে। মনের অস্থিরতা চলে যাবে। তখন মন হয়ে উঠবে আনন্দময়। সংযমের প্রথম অবস্থায় শুক্র চঞ্চল করে মনকে, পতনের জন্য। বীর্যধারণ করতে না পারলে বেটা ধর্মজগতে কেউ এগোতে পারবে না, পারেও না। ওপথে এগোতে গেলে এটা করতেই হবে।