দ্বারকাধীশ মন্দিরে ঢোকার আগে বাঁপাশে পড়ে শঙ্করাচার্যের মন্দিরের প্রবেশদ্বার। তার একটু এপাশে যাত্রীদের জুতো রাখার জায়গা। এ দুয়ের মাঝে একফালি জায়গা পড়ে আছে অকেজো হয়ে। কোনও প্রয়োজনে, কারও প্রয়োজনেই এখনও লাগেনি জায়গাটুকু। পড়ে রয়েছে হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে। এমনভাবে পড়ে থাকে সবসময়। এর সামনে দিয়ে যাতায়াতে বিরাম নেই যাত্রীদের। এখন এই জায়গায় বসে আছেন এক সাধুবাবা। তিনি উঠে গেলে আবার ফাঁকা পড়ে থাকবে।
গেরুয়াবসন পরা সাধুবাবা বসে আছেন দেয়ালে বা চেয়ারে, ঠিক তেমন ভাবেই বসে আছেন। হাঁটুদুটো মুড়ে, বাবু হয়ে নয়। আধকাঁচা আধপাকা দাঁড়িতে গালভর্তি। মাথাভর্তি লম্বাচুল কিছু নেমে এসেছে কাঁধ বেয়ে সামনে কিছু পিছনে। গায়ের রঙ ফরসা। পরিপুষ্ট চেহারা তবে মোটা নয়। বসা অবস্থায় আন্দাজ করলাম লম্বা নয়। আবার বেঁটে বলা যাবে না। মাঝারি উচ্চতা। মুখখানা খুব সুন্দর। বেশ টান আছে একটা। পাশে রাখা ছোট্ট একটা ঝোলা। বসে আছেন খালি মাটিতে। আমি দেখলাম, তিনি দেখছেন যারা মন্দিরে আসছে যাচ্ছে।
সরাসরি গিয়ে বসলাম সাধুবাবার সামনে মুখোমুখি হয়ে। প্রণাম করলাম। হাঁটুভেঙ্গে বসে ছিলেন। আমি বসতেই তিনি বসলেন সোজা হয়ে, বাবু হয়ে। তাকালেন মুখের দিকে। জানতে চাইলাম,
– বাবা কি দ্বারকাতেই থাকতেন, না অন্য কোথাও ডেরা আছে?
কোনও দ্বিধা সঙ্কোচ না করে জবাব দিলেন ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে,
– না বেটা, আমার কোথাও ডেরা নেই। দ্বারকাতে এসেছি। এখানে থাকব এখন মাসখানেক। আগেও অনেকবার এসেছি। কেন জানি না, দ্বারকাটা আমার বেশ ভাল লাগে।
কথা শেষ হতে না হতেই উত্তর পাব ভাবিনি। চোখমুখের ভাব দেখে মনে মনে ভাবলাম, কথা বলে উত্তর পেতে বেশি বেগ পেতে হবে না। জিজ্ঞাসা করলাম,
– এখানে আসার আগে কোন তীর্থে ছিলেন?
সহজভাবে উত্তর দিলেন,
– এর আগে মাসদুয়েক ছিলাম বৃন্দাবনে। তারপর মনটা চলে এল দ্বারকায়, মনের সঙ্গে এলাম আমিও।
কথাটা শুনে বললাম,
– মন যা চায়, মন যা করে আপনি কি তাই-ই করেন?
হাসিমুখে বললেন,
– হাঁ বেটা, তাই–ই করি। আগে মন কাজ করে তারপর মনের আজ্ঞায় কাজ করে দেহ।
আসর জমবে। জানতে চাইলাম,
– বাবা, মন যা চায় তাই-ই যদি আপনি করেন তাহলে তো দেখা যাচ্ছে মন ইন্দ্রিয়ের বশীভূত হয়েই আছে, আপনার বশে নেই। যদি কখনও কোনও কু-ভাব মনে আসে তাহলে তো আপনি ইন্দ্রিয়বশীভূত মনের দ্বারা চালিত হয়ে সেই কাজই করবেন, ঠিক কি না?
এমন বেয়াড়া ধরনের প্রশ্নে সাধুবাবার মুখের সহজ ভাবটা কেমন যেন হঠাৎ মিলিয়ে গেল। একটু চুপ করে রইলেন। পরে বললেন,
– না বেটা, এমন কোনও চিন্তা ভগবান মনে কখনও দেন না যাতে আমার মাধ্যমে অন্যের কোনও ক্ষতি হয়।
দেরি না করে বললাম,
– অন্যের না হোক, নিজের চিন্তায় নিজের দেহমন কিংবা অধ্যাত্মজীবনে উন্নতির পক্ষে ক্ষতিকারক বা প্রতিবন্ধক চিন্তাও তো আপনার ক্ষতি করতে পারে?
কথাটা শুনে মাথাটা দুলিয়ে বললেন,
– হাঁ বেটা, তা হতে পারে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। এমন অজস্র চিন্তাভাবনা আছে যা শুধু নিজের দেহমনকে নয়, অন্যের ক্ষতি করতে পারে স্বয়ং উপস্থিত হয়ে কাজ না করলেও, তবে আমার মনে তাও আসে না।
জানতে চাইলাম,
– আপনার কথার সূত্রেই প্রশ্ন করি, স্বয়ং উপস্থিত না হয়েও একজনের চিন্তা অন্যের ক্ষতি করে কেমন করে?
বিনীত সাধুবাবা বললেন,
– বেটা, আত্মীয় বন্ধু থেকে যেকোনও মানুষের সঙ্গে পরিচয়, হৃদ্যতা কিংবা শত্রুতার সৃষ্টি হোক না কেন, নিশ্চিত জানবি পূর্বজন্মের কোনও একটা সম্পর্ক ছিলই। ফলে যে যেখানেই থাকুক না কেন, এক মন থেকে আর এক মনের মাঝে অলক্ষ্যে সৃষ্টি হয় এক বন্ধনসূত্র। যারজন্যেই তো একে অপরের দুঃখে দুঃখিত, শোকে অভিভূত, আনন্দে আনন্দিত হয়। এগুলো হয় ওই বন্ধনসূত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ থাকায়। একেবারে বেটা ওয়্যারলেসের মতো। তার দেখা যায় না অথচ কথা চলে যায়।
কারও সম্পর্কে কোনও খারাপ বা পাপচিন্তা যেমন অন্যের মনকে অলক্ষ্যে কলুষিত করে, তেমনই ওই চিন্তা উদয় হওয়ামাত্র তোর মনও কলুষিত হবে। তাই মনে কখনও পাপ বা কুচিন্তা আনতে নেই। অনেক সময় দেখবি মনটা তোর খুব খারাপ লাগছে। কোনও কিছুই ভাল লাগছে না। আবার দেখবি, কোনও কারণ নেই অথচ মনটা ভরে আছে এক অদ্ভুত আনন্দে। এমনটা হওয়ার পিছনে জানবি তোর সম্পর্কে কারও না কারও ভাল বা খারাপ চিন্তা কাজ করছে। যারজন্যে মনের ভাবেরও পরিবর্তন হচ্ছে। সুচিন্তায় যেমন অন্যের তেমন নিজের আনন্দ হয় আত্মার কল্যাণও হয়।
পৃথিবীতে সবচেয়ে অতি তীব্র গতিসম্পন্ন হল একমাত্র মন। পরিচিতজনের কারও সম্পর্কে ক্রমাগত তীব্র কু-চিন্তা তাকে চরমভাবে বিপদগ্রস্ত, এমনকি মৃত্যুমুখে ফেলতে পারে, শুভচিন্তা পারে নতুনভাবে প্রেরণা দিতে, পারে আনন্দময় জীবনপথের সন্ধান দিতে। সেইজন্যে তো বেটা রাজা অত্যাচারী হলে দেশের মানুষের ক্ষোভ ও বিতাড়নের চিন্তা তাকে পদচ্যুত কিংবা তার মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনে, সংসারে কারও অনাচার অত্যাচারেও পতন ঘটে অন্য সকলের তীব্র বিরুদ্ধচিন্তার ফলে তার উপরে। অত্যাচারীর অত্যাচার দীর্ঘকাল একভাবে চলতে পারে না এই কারণে। বেটা সম্মিলিত প্রার্থনায় মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে পারে। মৃত্যু পথযাত্রীও ফিরে পায় প্রাণ মনের যে কি তীব্র শক্তি তা কেউ কল্পনা করতে পারবে না। সুতরাং সব সময় সৎচিন্তা করবি। তাতে নিজের মতো আর পাঁচজনেরও মঙ্গল হবে। শান্তি পাবি।
তীর্থযাত্রীদের অনেকে দোকানে জুতো খুলে রাখছে, এক একবার তাকাচ্ছেও আমাদের দিকে। সাধুবাবা এতক্ষণ বসেছিলেন সোজা হয়ে। এবার দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসলেন। তাকালেন মুখের দিকে। একবার হাতটা বুলিয়ে নিলেন দাড়িতে। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, সারাদিন তো আপনার কোনও কাজকর্ম নেই। বসে থাকাটাই একমাত্র কাজ। এইভাবে বসে থেকে কি চিন্তা করেন?
কথাটা শুনে একটু হাল্কা হাসি ফুটে উঠল মুখে। বললেন,
– বেটা, সারাদিন ধরে গুরু যে মন্ত্র দিয়েছেন সেই মন্ত্র জপ ছাড়া আর কিছু করি না। কেউ এসে কথা বললে তার কথা শুনি, বলি। কেউ না এলে বসে শুধু জপই করি। এছাড়া আর কোনও কাজ নেই।
জানতে চাইলাম,
– নিরবচ্ছিন্নভাবে জপ কি সম্ভব? নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, জপ করতে থাকলে অল্প কিছু জপের পর জপ সরে গিয়ে অন্য চিন্তা মাথাজুড়ে বসে, মন যে কোথায় চলে যায়!
হাসিমুখে বললেন,
– হাঁ বেটা, এটাই নিয়ম তবে অভ্যাস হয়ে গেলে এটা আর হয় না। কখনও কখনও বাড়ির কথা জপের সময় মাথায় ঢোকে। আবার চলে যায়।
সাধুবাবার মুখে ‘বাড়ির চিন্তা’ শুনে মনে কেমন যেন একটা খটকা লাগল। সঙ্গে সঙ্গে বললাম,
– সে কি বাবা, আপনি গৃহত্যাগ করে এসেছেন সাধুজীবনে। এই জীবনে এসেও বাড়ির চিন্তা, বলেন কি!
গৈরিক বসনে আবৃত দেহ চমকে দিয়ে বললেন,
– না বেটা, একেবারে গৃহত্যাগ আমার হয়নি। সেইজন্যে তো মাঝে মধ্যে বাড়ির জন্যে একটু চিন্তা হয় তবে তাও খুব সামান্য সময়ের জন্যে।
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
– একেবারে গৃহত্যাগ হয়নি মানে?
হাসিমাখা মুখে সাধুবাবা অকপটে খুলে দিলেন তাঁর জীবনকথার দরজা। একটু নড়ে চড়ে বসে বললেন,
– বেটা, বিয়ে হয়েছে বছর পঁচিশ বয়সে। এখন বয়েস ৫০/৫২ হবে। বিয়ের বছরখানেক পর মনটা আমার কেমন যেন হয়ে যায়। বেরিয়ে পড়ি ঘর ছেড়ে। কিছু দিন নানা তীর্থে ঘুরে আবার ফিরে যাই বাড়িতে। থাকি মাস ছয়েক ফের বেরিয়ে পড়ি। বাইরে বাইরে কাটে ছমাস একবছর, কখনও বা দেড় দুবছর, আবার ফিরে যাই ঘরে। এইভাবেই কাটছে বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত।
কথাটা শুনে বিস্ময়ে চমকে উঠলাম। বলে কি সাধুবাবা! গেরুয়াবসন চুল দাড়ি ঝোলাঝুলি থেকে শুরু করে বাহ্যত সাধুদের যা যা থাকা দরকার তা সবই আছে এই সাধুতে। অথচ বিয়ের পর থেকে গত ২৫/২৬ বছর ধরে চলছেন এইভাবে। এটা কেমন জীবন? কৌতূহল বেড়ে হাজার প্রশ্ন এসে গেল মাথায়। সাধুবাবার অন্তরের অন্দরমহলে ঢুকতে হবে ধীরে ধীরে। জিজ্ঞাসা করলাম,
– আপনার বাড়ি ছিল কোথায়?
সহাস্যে উত্তর দিলেন,
– কেরল-এ।
– সংসারে কে কে আছেন আপনার?
– বাবা নেই। ছোটবেলায় মারা গেছেন। বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, ভাই, বোন আর পাঁচটা সংসারের মতো আমার সংসারেও এরা আছে।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– আপনার সন্তান কটি? আপনি তো বাইরে বাইরেই পড়ে থাকেন। সংসার চলে কি ভাবে?
প্রসন্ন মনে বললেন,
– আমার কোনও সন্তান নেই। দেশে মুদিখানার দোকান আছে একটা। সেখান থেকে যা আয় হয় তাতে চলে যায় সংসারটা। বোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে। ভাইরা সব টুকটাক চাকরি বাকরি করে। বউটাই আমার দোকানটা দেখাশুনা করে আমি না থাকলে।
সন্তান নেই শুনে মাথায় ঢুকলো আর একটা ফ্যাঁকড়া। সাধুবাবার কি তাহলে শারীরিক কোনও ত্রুটি আছে, যার জন্যে সন্তান হয় না। সেইজন্যে স্ত্রীর প্রতি অনীহা, কোনও আকর্ষণ নেই! নইলে বিয়ে করে ঘর ছেড়ে বাইরে পড়ে থাকে। আবার ঘরে যাওয়া, এইভাবে কেটে গেল জীবনের অর্ধেকটা বয়েস। মাথায় যখন ঢুকেছে তখন আর ছাড়াছাড়ি নেই। বললাম,
– বাবা, কোনও সন্তান নেই বললেন। তাহলে আপনার শারীরিক কোনও অক্ষমতার জন্যে সন্তান হয়নি আর সেইজন্যেই কি ঘর ছেড়েছেন?
কথাটা শুনে সাধুবাবা খিলখিল করে হেসে উঠলেন। হাসির রেশটা মিলাতে না মিলাতেই বললেন,
– না না বেটা, শরীরে কোনও রোগ নেই আমার, স্ত্রীরও না। ভগবানের ইচ্ছাতেই সন্তান হয়নি আমাদের। কোনও রোগ নেই দেহে অথচ সন্তান হয় না, এমন অনেকেই তো আছে সংসারে। ‘বড়া বড়া’ ডাক্তারও এর কোনও সদুত্তর দিতে পারে না। অনেক সময় মানুষ শারীরিক দিক দিয়ে কষ্ট পায়। ডাক্তারকে বলে। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিন্তু রোগ আর রোগের কারণ খুঁজে পায় না অথচ রুগী কষ্ট পায়। এর কোনও সঠিক উত্তর আধুনিক বিজ্ঞান আর চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী ‘আচ্ছা আচ্ছা’ ডাক্তারও দিতে পারে না। তাদের জানাও নেই। অনেক সময় যার মারা যাওয়ার কথা সে বেঁচে ওঠে এদের হাতে। আবার যার বেঁচে ওঠার কথা সে মরে যায় অকালে। এমনটা কেন হয়, এরও কোনও উত্তর দিতে পারে না বিজ্ঞানমনস্ক ডাক্তারেরা। এর উত্তর একমাত্র দিতে পারেন তিনিই, যিনি এই সংসার রচনা করেছেন।