Mythology

বাড়ি ফিরে স্ত্রীর সাথে মিলন, আশ্চর্য সাধুবাবার অকপট স্বীকারোক্তি

১৯৭০ সাল থেকেই লেখক ও পরিব্রাজক শিবশংকর ভারতীর ভ্রমণ ও সাধুসঙ্গের জীবন শুরু, যা আজও জারি আছে। আসমুদ্র হিমাচলের প্রায় সব জায়গায় ঘুরেছেন। প্রায় পাঁচ হাজার পথচলতি (রমতা সাধু) বিভিন্ন বয়স ও সম্প্রদায়ের সাধুসন্ন্যাসীদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে।

সাধুসন্ন্যাসীরা কেন ঘর ছেড়েছেন, কিসের আশায়, কিভাবে চলছে তাঁদের, কেমন করে কাটে জীবন, এমন অসংখ্য কৌতূহলী প্রশ্নই লেখককে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে ভারতের অসংখ্য তীর্থে, পথে প্রান্তরে। এসব প্রশ্নের উত্তরই আছে এ লেখায়। একইসঙ্গে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের দেখা ‘ঈশ্বর’ সম্পর্কে অনুভূত ও উপলব্ধ মতামত।


তাঁদের জ্ঞানের পরিধির বিশালতা উপলব্ধি করে বারবার মুগ্ধ হয়েছেন লেখক। ‌যাঁকে প্রথমে নিতান্তই ভিখারি ভেবেছেন, পরে কথা বলে পেয়েছেন অগাধ জ্ঞানের পরিচয়। অশিক্ষিত অক্ষরজ্ঞানহীন সাধুদের এমন সব তত্ত্ব ও তথ্যপূর্ণ কথা, যা অনেক পণ্ডিতমনাদের ধারণায় আসবে না। তাঁদের কাছে পর্যায়ক্রমে কথোপকথন, বিভিন্ন তত্ত্বের বিশ্লেষণ, যা অধ্যাত্ম্যজীবন, ভারতীয় দর্শন ও জীবনধারার পরিবাহক।

এ লেখায় কোনও মঠ, মন্দির, আশ্রমের সাধুসন্ন্যাসীদের কথা লেখা হয়নি। কারণ অধিকাংশই তাঁরা গৃহীজীবনের সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে জড়িত। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের উপর নির্ভরশীল। এখানে সেইসব পথচলতি সাধুদের কথা আছে, ‌যাঁদের জীবন জীবিকা চিন্তাভাবনা ইত্যাদি সাধারণ মানুষের কাছে সম্পূর্ণই অজ্ঞাত। ‌যাঁরা সংসারের গণ্ডী ভেঙে বেরিয়েছেন এক অজানা অনিশ্চিত জীবনের উদ্দেশ্যে। ‌যাঁদের কৌতূহলী অন্বেষণ নেই। চাওয়া পাওয়ার বাসনায় ‌যাঁরা নির্বিকার অথচ আত্মতৃপ্ত। এ লেখায় তাঁদের কথাই লিখেছেন পরিব্রাজক শিবশংকর ভারতী।


কি প্রশ্নের উত্তর কোথায় গিয়ে শেষ করলেন। বললাম,

– সন্তান হয়নি বলে আপনার স্ত্রীর মনে দুঃখ হয় না?

হাসিমুখে বললেন,

– না বেটা, আমার ওসব দুঃখ-টুঃখ হয় না, তবে স্ত্রীর মনে দুঃখ তো একটু আছেই কারণ ও তো মেয়ে মানুষ। কিন্তু ওই বা কি করবে আর আমিই বা কি করব? এখন স্ত্রীর মনে এ ব্যাপারে আর কোনও দুঃখ নেই বলতে পারিস। যে কোনও কষ্ট সেটা যে ধরণেরই হোক না কেন, দীর্ঘদিন চললে অথবা সে দুঃখ মোচনের সমস্ত রাস্তা বন্ধ থাকলে তা গা সওয়া হয়ে যায়। তখন মনে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয় যখন সেটা আর দুঃখ বলে মনে হয় না। অভাবে অভাববোধটাও আর থাকে না। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। এখন ওই অবস্থাতেই আছে আমার স্ত্রী।

জিজ্ঞাসা করলাম,

– আপনি তো আপনার স্ত্রীকে বাড়িতে ফেলে রেখে এসেছেন। এখন তো তার কোনও সঙ্গী নেই। মনের কথা, সুখ দুঃখের কথা বলতে পারে না কাউকে। আপনি কি তার অন্তরের এই ব্যথার কথা উপলব্ধি করেন কখনও? আপনার উপরে তার ক্ষোভ বা রাগ হয় না এইভাবে ফেলে বেরিয়ে আসায়?

Dwarkadhish Temple
দ্বারকাধীশ মন্দির

কথাটা শুনে মুখভাবের কোনও পরিবর্তন হল না, স্বাভাবিকভাবে হাসিমুখে বললেন,

– প্রথম প্রথম বেরিয়ে ন-মাস বা একবছর পর যখন দেশে ফিরতাম তখন অনেক অভিযোগ দুঃখ করতো। আমার উপর তার অভিমানও হত। ধীরে ধীরে সেটা গা সওয়া হয়ে গেছে। এখন আর কিছু মনে করে না। আমি কখনও না বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসিনা। ঘরে যখন মন টেকে না তখন সবাইকে বলে বেরিয়ে পড়ি। কবে ফিরব কিছু বলি না তবে ফিরব যে একথা বলে আসি।

সাধুবাবার অবাক করা কথা শুনে নিজেরই কেমন যেন লাগছে। জীবনে পথচলতি সাধুসঙ্গ তো কম হল না। তবে অর্ধেক সংসারে অর্ধেক সাধুজীবনে এমন মানুষ পেলাম এই প্রথম। দুটো আলাদা জীবনের অভিজ্ঞতাই হয়েছে। যতটা পারি জেনেনি। এমন সুযোগ হয়তো আর কখনও পাব না। এখন সকাল দশটা। সাধুবাবা হয়তো কিছু খাননি। কিছু খাবার খাইয়ে কথা বললে সাধুবাবার ওঠার দরকার হবে না। তাই বললাম,

– বাবা আপনি সকালে কি কিছু খেয়েছেন?

ঘাড় নেড়ে বললেন, না। আমি বললাম,

– আপনি একটু বসুন, আমি আসছি।

বলে একদৌড়ে চলে গেলাম খাবারের দোকানে। কিছু পুরি সবজি আর মিষ্টি নিয়ে ছুটে এলাম একদৌড়ে। হাতে দিয়ে বললাম,

– সামান্য খাবার আছে বাবা, খেয়ে নিন।

কোনও সঙ্কোচ না করে নিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন,

– বেটা, তুই খাবি না?

হেসে বললাম,

– না বাবা, আমি খাব না। সকালে খেয়ে বেরিয়েছি।

সাধুবাবা খাওয়া শুরু করলেন। অল্প সময়েই শেষ হল খাওয়া। সামান্য একটু বিশ্রামের পর শুরু করলাম,

– বাবা, একটু আগে বললেন ঘরে যখন মন টেকে না তখনই বেরিয়ে পড়েন। কি মনে হয় তখন?

দাড়িতে দুবার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত হাত বুলিয়ে বললেন,

– আমার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অস্থির অস্থির ভাব হয়। কিছুই ভাল লাগে না। নেশাড়ির নেশাদ্রব্যের অভাব হলে সে যেমন অস্থির হয়ে ওঠে তেমন হয় আমার। কে যেন আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় ঘর থকে। বেড়িয়ে পড়লেই মনটা শান্ত হয়, আনন্দে ভরে ওঠে। আবার ধর, এই যে পথে বেরিয়েছি এখন বাড়ির উপর কোনও টান বা আকর্ষণ নেই। যখন তখন মনেও পড়ে না। ন-মাস ছ-মাস এক বা দেড়বছর পর হঠাৎ করে শুরু হয়ে যায় মনের অস্থিরতা। তখন আবার ঘরে ফিরতে না পারলে মনের শান্তি নষ্ট হয়ে যায়। তাই ফিরে যাই ঘরে। শান্ত হয় মনটা।

জানতে চাইলাম,

– ঘরে ফেরার পর কি করে কাটে দিনগুলো? তখন কি এই গেরুয়াবসন পরেই থাকেন, না পরিবর্তন করে অন্য পোশাক পরেন?

উত্তরে প্রসন্ন মনে জানালেন,

– বেটা, যখন ঘরে ফিরে যাই তখন সংসারের নিয়মেই চলি। গেরুয়াধারণ করি না। ব্রহ্মচর্যব্রত পালন না করে এই বস্ত্র পরিধান করাটা অপরাধ। এমন মাহাত্ম্যপূর্ণ বস্ত্রকে অপমান করা হয়। বাইরে থাকলে ব্রহ্মচর্যটা বজায় থাকে, গেরুয়া বসনের সম্মানও ক্ষুণ্ণ হয় না। তাই বাড়িতে এই বস্ত্র পরি না। সংসারের কাজকর্ম করি। দোকানটায় বসি। বেচা কেনা করি তবে মনেমনে গুরুপ্রদত্ত মন্ত্র জপও করি। গুরুজির কৃপায় ওটাতে আমার ভুল হয় না।

কথার এবার একটা ধাপ এগিয়ে গেলাম। কৌতূহলের সীমা ছাড়িয়ে গেল। জিজ্ঞাসার উত্তরটা দিয়েছেন। তবুও সরাসরি মুখ থেকে শোনার জন্যে বললাম,

– বাবা, বাড়িতে ফেরার পর আর পাঁচটা কাজের মধ্যে তো স্ত্রীর দেহ মনোরঞ্জনের কাজও তো একটা আছে। আমি জানতে চাইছি স্বামী-স্ত্রীর মিলনের ব্যাপারটা, সেটাতে কি রত হন?

কথাটা শুনে মনে এতটুকু প্রতিক্রিয়া হল বলে আমার মনে হল না। নির্বিকারভাবে বললেন,

– হাঁ বেটা, সংসারে ফিরলে তখন আর ব্রহ্মচর্য রক্ষা করতে পারিনা। স্বামী-স্ত্রী মিলনটা আমাদের হয়ই। যদি বলি হয় না তাহলে গেরুয়াবসন আর কৃষ্ণের কোলে বসে তাঁর খেয়ে তাঁকেই অস্বীকার করা হয়। অত বড় মিথ্যে কথাটা আমি বলতে পারব না।

মাথায় একটা কুটিল প্রশ্ন ঢুকল। করেই ফেললাম,

– বাবা এ পথে যখন আছেন তখন শাস্ত্রের কথা, শাস্ত্রকারের কথায় নিশ্চয় আপনার বিশ্বাস আছে?

মুখোমুখি বসে কথা হচ্ছে আমাদের। এবার মাথাটা নেড়েও সাধুবাবা মুখে বললেন,

– হাঁ বেটা, শাস্ত্রে আমার বিশ্বাস আছে। শাস্ত্রে অবিশ্বাস করলে ভগবানের মাহাত্ম্যকথা, এমনকি ভগবানকেও তাহলে অবিশ্বাস করতে হয়।

মুহুর্ত দেরি না করে বললাম,

– এতটাই যখন বিশ্বাস তাহলে একটা কথা জানতে চাই আপনার কাছে। শাস্ত্রকারেরা বলেছেন, কোনও পুরুষ স্ত্রীকে ঘরে ফেলে দীর্ঘকাল প্রবাসে থাকলে সেই স্ত্রীর চরিত্র নষ্ট এবং ব্যভিচার দোষে দুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এইভাবে মাসের পর মাস বাইরে থাকার কারণে শাস্ত্রকারের কথা আপনার স্ত্রীর উপরেও তো বর্তায়।

সাধুবাবা কথাটা শুনে একটু হাসলেন। শোনামাত্রই উত্তর দিলেন না। তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে। কেটে গেল মিনিট খানেক। পরে স্বাভাবিক শান্ত কণ্ঠে বললেন,

– হাঁ বেটা, সব নারীপুরুষেরই দেহমনের চাহিদা একটা আছে। কারও কম কারও বেশি। শাস্ত্রকথা অস্বীকার না করে বলি, সংসারে সব নারীপুরুষই কি সমান? তা তো নয়। স্ত্রীকে ছেড়ে পুরুষ দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকলে স্ত্রীর চরিত্র নষ্ট বা পরপুরুষে আকৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা যে একটা থেকে যায় এর মধ্যে কোনও ভুল নেই। বিপরীতভাবে এমনটা তো পুরুষেরও হতে পারে। তবে বেটা ঘরে বল আর বাইরে বল, বিশ্বাসটাই বড় কথা। আর বিশ্বাসটা আছে বলেই তো সংসারটা টিকে আছে। প্রবাসে না থেকেও তো অনেক পুরুষ চরিত্রহীন, অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে রয়েছে। বিপরীতভাবে অনেক নারীর সদাশিবের মতো স্বামী থাকা সত্ত্বেও তো অন্য পুরুষের সঙ্গে সহবাস করছে। বিশ্বাসের বশে থাকলে শান্তিটা থাকে। কেউ যদি মনে করে সত্যিই খারাপ হবে সে নারী বা পুরুষ যেই হোক না কেন, তাকে চোখেচোখে রাখলেও ঠেকানো যায় না।

এবার উদাহরণ দিয়ে বললেন,

– যেমন ধর তোর বাবার কথা। মনে কর প্রবাসে আছে। তুই তোর মাকে নিয়ে আছিস দেশে। তোর মা অন্য কোনও পুরুষে মিলিত হল গোপনে। তুই কিন্তু তা একবারও ভাববি না। মিলিত না হলেও ভাববি না। তোর বিশ্বাস, তোর মা সুন্দর নিষ্পাপ। এমন বিশ্বাস সব সন্তানই তার মাকে করে, স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে। যার জন্যে তো সংসারের গতি রুদ্ধ না হয়ে বয়ে চলেছে অবিচল গতিতে। এ ধারা কখনও রুদ্ধ হবে না বেটা। যেখানে বিশ্বাসের অভাব সেখানেই রুদ্ধ হয়েছে অবাধগতির সংসার। ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। স্রোতবতী নদী বাধা পেলে যেমন তার গতি ভিন্নমুখী হয়, তেমন অবাধ বিশ্বাসের ধারা বাধা পেলে সংসারস্রোতও নারীপুরুষকে করে তোলে অন্যমুখী। বুঝলি বেটা!

Dwarkadhish Temple
দ্বারকাধীশ মন্দির

ভরা সত্য কথাটা বলে সাধুবাবা একটু থামলেন। জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, এইভাবে দু-নৌকায় পা দিয়ে চলে কি লাভ? সংসার করলে সংসারই করুন নইলে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ুন চিরদিনের মতো।

বিরক্ত না হয়ে বললেন,

– বেটা, তোর অনেক আগেই এটা আমি ভেবেছি। মাঝে মাঝে ভাবি, বেড়িয়ে পড়েছি যখন আর ফিরে যাব না। কি হবে সংসার দিয়ে! কিন্তু বেরিয়ে আসার পর আবার কে যেন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নিয়ে যায় সংসারে। ঘরে যখন থাকি মনে হয় আর বেরবো না। কিন্তু কিছুদিন পরই মন আমার হাঁপিয়ে ওঠে। তখন মনে হয় কে যেন খোঁচাচ্ছে বেড়িয়ে পড়ার জন্য। না বেরনো পর্যন্ত শান্তি হয় না। তাই এখন ভেবেছি ভগবানের যা ইচ্ছা তাই করুক। মনের যদি কখনও পরিবর্তন আনে তবে হবে, না আনলে হবে না। আমাকে নিয়ে তাঁর যা ইচ্ছা হয় করুক। কি আর কতটুকুই বা ক্ষমতা আছে মানুষের।

তীর্থযাত্রীরা মন্দিরে যাচ্ছে। অনেকেই দেখছে। আমরা চালিয়ে যাচ্ছি আমাদের কথা। সাধুবাবা প্রতিটা কথার উত্তর দিচ্ছেন অকপটে, নির্বিকারভাবে। জিজ্ঞাসা করলাম,

– পথের খরচা আর আহার সংগ্রহ করেন কি উপায়ে?

নির্লিপ্ত গেরুয়াধারী বললেন,

– বেটা, বিনামূল্যে সাধুভোজনের ব্যবস্থা আছে এখানে। এমনটা আছে প্রায় সব তীর্থে, তাই আহার জুটে যায়। তারপর এমনভাবে বসে থাকি পথের ধারে। কেউ কিছু দিলে নিয়েনি। না দিলে চাই না কারও কাছে। যদি কখনও দূরের তীর্থে যাওয়ার মন হয় তখন হাতে পয়সা থাকলে খরচ করি। না থাকলে দেশে চিঠি লিখি। বউ টাকা পাঠিয়ে দেয়। এই তো গত বছরের কথা। গেছিলাম কেদারবদরি চারধাম দর্শন করতে। হাতে একটাও পয়সা ছিল না। বাড়িতে চিঠি লিখলাম, টাকা পাঠিয়ে দিল। চলে গেলাম। এইভাবেই পথ চলি।

এ এক অদ্ভুত চরিত্রের সাধুবাবা। অবাক করা কথা। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন দ্বিধাহীন চিত্তে। এতে আনন্দ আর প্রশ্ন করার উৎসাহও বেড়ে যাচ্ছে। ভাবছি কি অদ্ভুত জীবনযাপন! এমনটা যে হয় ভাবনাতে ছিল না। জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, গৃহী ও সাধু এই দু-জীবনের মধ্যে তফাৎ কিছু বুঝলেন? একটা বাইরে আর একটা বদ্ধজীবনে নির্দিষ্ট গণ্ডীর মধ্যে থাকার যে মন, এই দুই মনের গতি চিন্তাভাবনা ও বিকার, এর কতটা পরিবর্তন, কি রকম পরিবর্তন হয়, আপনি কি এসব ভেবে কখনও দেখেছেন?

কথাটা শুনে চুপ করে রইলেন সাধুবাবা। চোখমুখের ভাবটা দেখে মনে হল বেশ গভীরভাবেই ভাবছেন কথাটা। উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। কেটে গেল প্রায় মিনিট সাতআট। বললেন,

– বেটা, সে রকম কোনও দিন কিছু ভাবিনি আমি। ঘরে থাকলে অনেক সময় ভেবেছি কবে একটু দ্বারকায় যাব, কবে যাব মথুরা বৃন্দাবনে। মন আমার অস্থির হয়ে উঠেছে বেরিয়ে আসার জন্যে। আবার বেরিয়ে এসে বিভিন্ন তীর্থভ্রমণের সময় মাঝেমাঝে মনে হয়েছে কবে বাড়ি ফিরব, ওরা সকলে কেমন আছে? মন আমার উতলা হয়েছে, ফিরে গেছি বাড়িতে। মন শান্ত হয়েছে সকলকে দেখে। মনের যে কি ভাবগতি তা আমার মনও এখনও জানতে পারেনি। তবে পার্থক্য একটা বুঝেছি দুই জীবনের। সংসারে খাওয়া পরাটা বাদ দিলে বাকিটা অনিশ্চিত ভয়ের জীবন। সংসারে আর পাঁচজনের চিন্তাই মনকে চিন্তিত, ভীত করে রাখে যেটা সংসার গণ্ডীর বাইরে নেই। ‘যা হয় হবে’ এমন একটা জীবনই সাধুজীবন। কালকের কথা কালকে ভাববার জীবনই সাধুজীবন। কিন্তু সংসারে তা হওয়ার উপায় নেই। কাল পরশুর ভাবনাটা আজকেই পেয়ে বসে, নষ্ট করে মনের আনন্দ। এটা বেশ ভালই বুঝেছি। অনাগত ভবিষ্যৎ চিন্তা সংসার শান্তির অন্তরায়। এ জীবনে না আছে অতীত, না আছে ভবিষ্যৎ, তাই মনে আনন্দ একটা থাকেই। তবে জপতপটা বাইরেই ভাল হয়। সংসারের কালকের চিন্তা আজকে থাকে না বলে মনটা জপে বসে বেশি। এটা বললাম আমার কথা। এটুকুই আমার উপলব্ধি হয়েছে। এ ব্যাপারে আর কিছু বলতে পারব না আমি।

জিজ্ঞাসা করলাম,

– সংসার থেকে বেরিয়ে আসার পর ফেলে আসা দিনগুলোর কথা, স্ত্রীর কথা কি মনে পড়ে? বিব্রত করে কি এই নিঃসঙ্গ জীবনে?

হাসতে হাসতে বললেন,

– বেটা, কোনও দিনটাই মানুষ কোনও দিনই ফেলে আসে না অতীতে। সারাটা জীবন বয়ে নিয়ে বেড়ায় সঙ্গে করে। কেমন করে বলতে পারিস? অতীতের দিনগুলো আর স্মৃতিই তো বয়ে নিয়ে বেড়ায় মন। দেহ কি অতীত নিয়ে চলে? নারীপুরুষের মিলনের যে তৃপ্তি, আনন্দ তা কি দেহের? ও তো মনের। কোনও সুখ বা দুঃখ তা কি দেহ ভোগ করে? ভোগ করে তো মন। অতীত তো চলে মনের সঙ্গে, যেখানেই তুই যাস না কেন। এটা বললাম সাধারণ নিয়মের কথা। এগুলো মন থেকে মুছে ফেলার জন্যে যে জীবন, সেটাই তো আসল জীবন, সাধুজীবন। সাধনার জীবন। সেটা ঘরে থেকেই করিস আর বাইরে থেকে। করতে হবে। তবে সাধুজীবনে এসেই বা তা কটা সাধু পারছে? যারা পারছে তারা ভগবানের সান্নিধ্য পাচ্ছে। যারা আজ পারছে না তারা একদিন না একদিন পারবে, এবিশ্বাস আমার আছে, কারণ তাকে তো তিনি টেনে এনেছেন এ পথে তাঁর কাছে টেনে নেয়ার জন্যে। সেটা আজ না হলে দুদিন পর হবে। ‘লেকিন’ হবেই।

একটু থামলেন। কি যেন একটা ভাবলেন। বললেন,

– বেটা, তুই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা বলছিস, শোন তাহলে। একবার শীতকালে গেছিলাম হরিদ্বারে। ভোরবেলায় স্নান করা অভ্যাস তাই ঘাটে ঝুলি কাপড় কম্বল রেখে নেমেছি গঙ্গাস্নানে। স্নান সেরে উঠে দেখি কেউ কম্বলটা নিয়ে গেছে। ঘটনাটা ঘটে ছিল আজ থেকে প্রায় বছর কুড়ি আগে। কিন্তু সে কথা যখন আজও ভুলিনি তখন বাড়ির সকলের কথা ভুলবো কেমন করে! ও কথা কি ভোলা যায়? তবে সবসময় কি আর মনে পড়ে? কখনও সখনও মনে পড়ে বই কি!

এবার লাজলজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, বাড়িতে গেলে স্ত্রী তো কাছে থাকে। মনে কাম ভাব জাগরিত হলে তখন না হয় স্ত্রীকে দিয়ে দেহমনের কামপিপাসা নিবৃত্ত করেন। যখন পথে থাকেন তখন তো কামরিপু নিশ্চয় মাঝেমধ্যে দেহমনের উপর ক্রিয়া করে। সেই সময় আপনি কি করেন?

কোনও সংকোচ না করে উত্তর দিলেন,

– হাঁ বেটা, দেহমনে মাঝেমধ্যে তো কামরিপুর প্রভাব অনুভব করি এই পথচলতি জীবনে। তবে বাড়িতে স্ত্রী কাছে থাকলে যতটা হয় তার সিকিভাগও হয় না যখন পথে বেরিয়ে পড়ি, কিন্তু হয়। সেটা নিয়ে গভীরভাবে আমি কিছু ভাবি না। জপটা করতে থাকি। দেহমনে ক্ষণিকের জন্যে উত্তেজনা এসে আবার তা দেহমনেই মিলিয়ে যায়।

জানতে চাইলাম,

– পথে চলার সময় যেসব সুন্দরী মেয়েদের দেখেন, তাদের দেখে কখনও মনে ভোগের বাসনা জাগে না?

সাধুবাবা হাসিমাখা মুখেই বললেন,

– না বেটা, আমার ওসব মনে হয় না। কেন হবে বলতো? দোকানে সাজানো মিষ্টি আছে। ও মিষ্টিটা তোর খাওয়া আছে আগে। চলার পথে দেখলি তোর আগে খাওয়া মিষ্টিগুলোই দোকানে সাজানো আছে থরেথরে। তোর কি তখন লোভ হবে, আবার খাই? তা হবে না, কারণ তোর আগে জানা আছে তুই খেয়েছিস, স্বাদটা কেমন?

আমিও হাসতে হাসতে বললাম,

– আপনার কথা মেনে নিয়েও বলি, তাহলে তো মানুষ শুধু রসগোল্লাতেই তৃপ্ত থাকতে পারতো! তা তো পারে না। নানা স্বাদের মিষ্টিতে মানুষের মন আকৃষ্ট হয় কেন?

এতক্ষণ বসেছিলেন একভাবে। এবার একটু নড়ে বসে বললেন,

– বেটা, মন বলেই তো মনের এই আসক্তি। এটাই তো মনের ধর্ম। নইলে মন বলে কথাটাই থাকত না। একই মিষ্টি কারিগর তৈরি করে বিভিন্নরূপে আর স্বাদের। সেইরকম নারী সহবাসের স্বাদ একই। সুন্দরী বা কুৎসিত রূপ যাই হোক না কেন। দেহমনের অস্বস্তি মিটলেই শেষ। আর রূপের জন্যে মনের আলাদা তৃপ্তি যেটা, সেটা একান্তই মনের ধর্ম। বেটা তুই বিশ্বাস করবি কিনা জানি না, আমার অন্য মেয়েমানুষের উপর কোনও লোভ বা ভোগ করার ইচ্ছা কখনও জাগেনি। গুরুজির কাছে প্রার্থনা করি ওসব যেন না জাগে।

কথাটা বলে কপালে হাতজোড় করে নমস্কার করলেন গুরুজির উদ্দেশ্যে। একটু গম্ভীর হয়ে বললেন,

– বেটা, যার রূপ আছে সে নারী বা পুরুষ যাইহোক না কেন, একেবারে সত্য জানবি, ওটাই তার নিজের এবং অন্যের দেহমনের প্রথম ব্যভিচারের অস্ত্র। আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায়। সুতরাং বেটা, কখনও রূপের আকর্ষণে নিজেকে জড়িয়ে ফেলবি না, তাহলে আর সাধনপথে এগোতে পারবি না। ভগবান মানুষের রূপ দিয়েছেন মানুষকে ভুলিয়ে রাখার জন্যে। এটা তাঁর সৃষ্টির একটা বড় কৌশল।

অনেকক্ষণ কথা হল। আরও অনেক কথা হল। এবার উঠতে হবে আমাকে। তাই জানতে চাইলাম,

– বাবা, আপনার সঙ্গে কথা না বললে বা আপনি নিজে অকপটে কিছু না বললে তো এমন এক অদ্ভুত জীবনকথা কিছুই পারতাম না। তবুও একটা কৌতূহল আমার রয়ে গেল যেটা আপনার ব্যক্তিগত ঈশ্বরভাবনা সম্পর্কে। দয়া করে বলবেন, তাঁর সম্পর্কে আপনার উপলব্ধি কি হল?

শেষ কথাটাও বললেন অকপটে,

– বেটা, সংসার বিষয়ে মমতা ত্যাগ না হলে ঈশ্বরে মমতা আসে না। আমার তো তা আসেনি তাই আজও তাঁর দর্শনলাভ হয়নি আমার ভাগ্যে। তবে ঘরে যখন থাকি তখন যেমন, বাইরে থাকি যখন, তখনও তিনি এমন এক আনন্দময় অবস্থায় রেখেছেন যে সদা অন্তরে অনুভব করি আছেন, আমার সঙ্গেই নইলে এমন আনন্দে আছি কেমন করে?

এই পর্যন্ত কথা হল সাধুবাবার সঙ্গে। প্রণাম করলাম। হাতদুটো স্পর্শ করলেন মাথায়। উঠে দাঁড়ালাম। বললাম,

– চলি বাবা।

হাসিমুখে হাতজোড় করে নমস্কারের ভঙ্গিতে বললেন,

– ঠিক হ্যায় বেটা, সদা খুশ রহো।

ধীর পায়ে এগিয়ে চললাম মন্দিরের দিকে। ভাবতে লাগলাম সাধুবাবার সংসার আর পথচলতি আলাদা জগৎ ও জীবনের কথা।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button