Mythology

কামরিপুর স্বরূপ জানালেন সাধুবাবা, দিলেন সংযম ও মিলনের ব্যাখ্যা

১৯৭০ সাল থেকেই লেখক ও পরিব্রাজক শিবশংকর ভারতীর ভ্রমণ ও সাধুসঙ্গের জীবন শুরু, যা আজও জারি আছে। আসমুদ্র হিমাচলের প্রায় সব জায়গায় ঘুরেছেন। প্রায় পাঁচ হাজার পথচলতি (রমতা সাধু) বিভিন্ন বয়স ও সম্প্রদায়ের সাধুসন্ন্যাসীদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে।

সাধুসন্ন্যাসীরা কেন ঘর ছেড়েছেন, কিসের আশায়, কিভাবে চলছে তাঁদের, কেমন করে কাটে জীবন, এমন অসংখ্য কৌতূহলী প্রশ্নই লেখককে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে ভারতের অসংখ্য তীর্থে, পথে প্রান্তরে। এসব প্রশ্নের উত্তরই আছে এ লেখায়। একইসঙ্গে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের দেখা ‘ঈশ্বর’ সম্পর্কে অনুভূত ও উপলব্ধ মতামত।


তাঁদের জ্ঞানের পরিধির বিশালতা উপলব্ধি করে বারবার মুগ্ধ হয়েছেন লেখক। ‌যাঁকে প্রথমে নিতান্তই ভিখারি ভেবেছেন, পরে কথা বলে পেয়েছেন অগাধ জ্ঞানের পরিচয়। অশিক্ষিত অক্ষরজ্ঞানহীন সাধুদের এমন সব তত্ত্ব ও তথ্যপূর্ণ কথা, যা অনেক পণ্ডিতমনাদের ধারণায় আসবে না। তাঁদের কাছে পর্যায়ক্রমে কথোপকথন, বিভিন্ন তত্ত্বের বিশ্লেষণ, যা অধ্যাত্ম্যজীবন, ভারতীয় দর্শন ও জীবনধারার পরিবাহক।

এ লেখায় কোনও মঠ, মন্দির, আশ্রমের সাধুসন্ন্যাসীদের কথা লেখা হয়নি। কারণ অধিকাংশই তাঁরা গৃহীজীবনের সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে জড়িত। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের উপর নির্ভরশীল। এখানে সেইসব পথচলতি সাধুদের কথা আছে, ‌যাঁদের জীবন জীবিকা চিন্তাভাবনা ইত্যাদি সাধারণ মানুষের কাছে সম্পূর্ণই অজ্ঞাত। ‌যাঁরা সংসারের গণ্ডী ভেঙে বেরিয়েছেন এক অজানা অনিশ্চিত জীবনের উদ্দেশ্যে। ‌যাঁদের কৌতূহলী অন্বেষণ নেই। চাওয়া পাওয়ার বাসনায় ‌যাঁরা নির্বিকার অথচ আত্মতৃপ্ত। এ লেখায় তাঁদের কথাই লিখেছেন পরিব্রাজক শিবশংকর ভারতী।


এইটুকু বলে একটু থেমে বললেন,

– তুই বিয়ে করেছিস?

ঘাড় নেড়ে বললাম, না। সাধুবাবা মাথাটা নাড়িয়ে বললেন,

– তাহলে তোকে বলে লাভ নেই। বিবাহিত হলে তুই বুঝতে পারতিস।

কথায় একটু চাপ দিয়ে বললাম,

– বলুন না বাবা, বুঝতে না পারি অনুভব তো করতে পারব। বিবাহিতদের দেহ, রিপুর সঙ্গে আমার তো পার্থক্য কিছু নেই।

সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বললেন,

– ধর, বিবাহিত কোনও পুরুষ তার স্ত্রীকে রেখে বাইরে গেছে। প্রবাসে কাজের উদ্দেশ্যে বা চাকরি করে। এরকমভাবে থাকতে হয় প্রায়ই। এই যোগাযোগহীন সময়ে কামের সাধারণ প্রভাবটুকু স্বামী–স্ত্রী উভয়ের মধ্যেই বর্তমান থাকে। কাম তেমন বেশি পীড়িত করে না দেহমনকে। কারণ উভয়ে জানে উভয়ের মিলন কোনওভাবে সম্ভব নয়। এই সময় দেহমনে কামের প্রকট রূপটা প্রকাশ পায় না, একে অপরকে কাছে পায় না বলে। এবার বলি ব্রহ্মচারী সাধুসন্ন্যাসীদের কথা। তারা থাকেন সংযমে। নারীদেহের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কোনও প্রশ্ন থাকে না ফলে প্রবাসে স্বামী, ঘরে স্ত্রী এদের যেমন সাধারণ কামের প্রভাবটুকু থাকে, সংযমী সাধুদেরও এর কোনও ব্যতিক্রম নেই, একথা নিশ্চিত জানবি।

সাধুবাবা লম্বা হাই তুললেন। টানটান করে পেতে দেওয়া পা-টা মুড়ে বাবু হয়ে বসলেন শিরদাঁড়াটা টানটান করে। চোখদুটো বুলিয়ে নিলেন ডাইনে বাঁয়ে সামনে। বললেন,

– এবার অনেকদিন আলাদাভাবে বা দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার পর স্বামী ফিরে এল ঘরে। ফিরে এসে একে অপরকে দেখার পর ধীরে ধীরে কামের ক্রিয়া শুরু হয়ে যায় দেহমনে। অপেক্ষা করতে থাকে উভয়ে মিলনের জন্য। ঠিক একইভাবে সংযমী কোনও সাধুসন্ন্যাসীর কোনওভাবে নারীর প্রতি দুর্বলতা এলে ও মিলনের সুযোগ থাকলে তাকে দেখে, প্রবাসী স্বামী স্ত্রীর মতো শুরু হয়ে যায় দেহমনে কামের ক্রিয়া।

এবার দিনরাত সময় অসময়ের অপেক্ষা করে না। দীর্ঘদিন আলাদাভাবে থাকা স্বামী-স্ত্রীতে, স্ত্রী-স্বামীতে প্রথম দিনের মিলনের সময় যেভাবে একে অপরকে গোগ্রাসে ভোগ করতে থাকে রুদ্ধশ্বাসে, ঠিক সেইরকম, একই অবস্থা হয় দীর্ঘদিন দেহমনের সংযমী সাধুদের, দীর্ঘ প্রবাসে থাকা স্বামীর মতো নারীভোগের সুযোগ পেলে।

এমন আলোচনায় প্রশ্ন এল একটা। জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, আপনি কি বিয়ের পর গৃহত্যাগ করেছিলেন?

ফিক করে হেসে ফেললেন। বললেন,

– না বেটা, আমি বিয়ে করিনি।

কৌতূহল বেড়ে গেল। বললাম,

– বিয়ে যদি না-ই করে থাকেন তাহলে বিবাহিত নারীপুরুষের সঙ্গকথা ও মানসিকতা জানলেন কি করে?

উলটে প্রশ্ন করলেন,

– আমি তোকে যেসব কথা বললাম, তুই কি তা বুঝতে পেরেছিস?

ঘাড় নেড়ে ও মুখে বললাম, ‘হ্যাঁ’। সাধুবাবা বললেন,

– তোর বয়েস এখন অল্প। আমি বললাম, তাতে তুই কল্পনা আর সামান্য অনুভবের উপর বিষয়টা বুঝে ফেলেছিস। অথচ দেখ তুই বিয়ে করিসনি। মানুষ এমন অনেক কাজ না করলেও, অনেক কিছু চোখে না দেখলেও, বিষয়টা দেহ ও অনুভূতি শক্তির দ্বারা বুঝতে পারে। এ ধারণা হয়েছে আমার দেহকে কেন্দ্র করে।

প্রশ্ন করলাম,

– বাবা, সাধুসন্ন্যাসীরা দেহমনকে কিভাবে সংযত বা সংযম করেন? রিপু তো সকলের ক্ষেত্রে কাজ করে থাকে সমানভাবে।

বেশ খোশমেজাজে বললেন,

– বেটা, এটার জন্যে ভ্রমণরত সাধুদের আলাদা খুব বেশি একটা কসরৎ করতে হয় না। দেহমনের সংযম আপসেই আসে এ পথে চলতে থাকলে। যেমন ধর, উত্তেজনা বাড়ে এমন খাদ্য সাধুরা প্রথমেই বর্জন করেন। বলতে পারিস খায় না। খাদ্যই প্রথম উত্তেজিত করে দেহকে। সুখাদ্য কপালে প্রায় জোটেই না। ভিক্ষালব্ধ কিছু অর্থ বা অন্নই সাধুদের সম্বল। ওই অর্থ ও অন্নে বেঁচে থাকা যায় মাত্র। আর কিছু হয় না।

এইভাবে দীর্ঘকাল, পরের পর বছর চলতে থাকলে দেহরিপুর প্রভাব এমনিতেই ক্ষীণ হয়ে পড়ে। এতে কামের মতো সংযত হয় লোভও। ভাল খাওয়া পরা না পেতে পেতে মনের এমন একটা অবস্থা আসে যখন আর কোনও কিছুতে লোভ আসে না, মনে কোনও টান থাকে না।

একটু থামলেন। পরে বললেন,

– ক্রোধ আসে এমন কোনও কাজ পথচলতি সাধুসন্ন্যাসীরা প্রায় করেই না। ক্রোধের উৎপত্তি মানুষের অনেক কারণে হতে পারে। যেমন ধর স্বার্থে আঘাত লাগলে ক্রোধের উৎপত্তি হয়। প্রত্যাশিত বস্তু না পেলে ক্রোধ আসতে পারে। মান অভিমানের খেলা যেখানে, তার মধ্যে অলক্ষ্যে ক্রোধ থাকে প্রকাশের অপেক্ষায়। আর মানুষ আত্মপ্রতিষ্ঠায় মানুষের কাছে বাধা পেলে ক্রোধ সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যেখানে সম্পর্ক সেখানেই ক্রোধ। পথচলতি সাধু যারা–তারা নিঃসঙ্গ, একক জীবন যাপন করে। ফলে ক্রোধ সংযত হয় আপসে। সংসারে থাকলে এগুলো সহজে সংযত হওয়ার উপায় নেই। আর আমরা হলাম ভিখিরি সাধু, কি আছে আমাদের যে মোহ অহঙ্কার ক্রোধ আসবে।

এবার লক্ষ্য করলাম, হঠাৎ সাধুবাবা কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। বসে রইলাম চুপ করে। কথা বলে আকর্ষণ করতে চাইলাম না নিজের দিকে। এইভাবে কাটল কিছুক্ষণ। পরে আবার ফিরে এলেন আগের ভাবে। বললাম,

– সারাজীবন ধরে তো অসংখ্য মানুষ দেখলেন। কথাও হয়েছে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে। মানুষ হয়ে মানুষ সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা কি হল?

কথাটা শুনে হাসলেন। বললেন,

– এতক্ষণ পর তুই বেশ মজার প্রশ্ন করেছিস একটা।

একটু থামলেন ভুরুও কোঁচকালেন একটু। বললেন,

– বেটা সুখ আনন্দ আর প্রতিষ্ঠা, এই তিনটে চায় না এমন মানুষ সংসারে আমি একটাও দেখিনি। এগুলো কোনও মানুষের হাতে নেই। রয়েছে ভগবানের হাতে। এর দাতাও একমাত্র তিনিই। দাতা ভগবানও বসে রয়েছেন মানুষকে দেবার জন্যে অথচ দেখ মানুষ কত বোকা! এগুলো সব চায় – চায় না শান্তিটা। ভগবান শান্তিটা ছাড়া আর সবই দিয়ে দেয়। মানুষ যদি মনের শান্তি চায় তাহলে কিন্তু ওগুলো সবই পায়, শান্তিও পায়। কামনা মনের শান্তির পরিপূরক তো ওগুলোই কিন্তু মানুষ চায় না। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা সারাজীবন তোদের মতো মানুষ দেখে।

ছোট্ট প্রশ্নের কি দারুণ উত্তর। জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, প্রতিটা মানুষের কমবেশি সুখ আছে দুঃখও আছে, সেটা আসে তারই নিয়মানুসারে। আপনি সাধু হলেও তো মানুষ। সুখ দুঃখ সবই তো আছে আপনারও। দুঃসময়ে কিভাবে কাটত? কি করতেন তখন?

কথাটা শুনে হা-হা করে হেসে উঠলেন সাধুবাবা। প্রাণখোলা হাসি। যুদ্ধজয়ী রাজার হাসি। হাসির রেশটা শেষ হতে বললেন,

– বেটা, যেদিন সংসার ছেড়েছি সেদিন থেকেই তো আমার সুসময়। দুঃসময় তো কাটে মানুষের সংসারে আর সেটা সারাজীবনই। সাধুদের আবার দুঃসময় সুসময় বলে কিছু আছে নাকি? যে তাঁকে স্মরণ করতে ভুলে যাবে, যার তাঁর নামে প্রবৃত্তি হবে না তখনি বুঝবি তার দুঃসময়। তবে এমনটা এপথে আসার পর হয়েছে বলে মনে পড়ে না।

প্রসঙ্গ পালটে বললাম,

– সংসারী আমরা। অনেক সময় অনেক কারণে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি। এমনটা অনেকেই করেন আমার মতো। অনেক সময়ে তা পূরণ হয় না। যেমন রোগভোগ বা কোনও কষ্ট থেকে মুক্তি পেতেই তাঁকে ডাকা। দেখেছি অনেক সময় তা পূরণ হয় না। আমার জিজ্ঞাসা, ভগবান কি সে ডাক শোনেন না?

উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন,

– না না বেটা, সব কথাই তিনি শোনেন। অতিক্ষুদ্র পিঁপড়ের ডাকও তিনি শুনতে পান আর মানুষের ডাক শোনেন না, তাই কখনও হতে পারে? বিশ্বাস রাখবি, ভগবান বধির নন।

মুহুর্ত দেরি না করে বললাম,

– তাই যদি হয়, তাহলে মানুষের প্রার্থনা মঞ্জুর হয় না কেন?

সাধুবাবা বেশ জোর দিয়ে প্রতিবাদের সুরে বললেন,

– কে বলল মঞ্জুর হয় না, ‘জরুর হয়’। বিশ্বাসের অভাব আছে বলেই প্রার্থনা মঞ্জুর হয় না, আর হয় না কর্মফলে। আমরা প্রত্যাশা করি, তা নিশ্চিত হওয়ার নামই বিশ্বাস। অনিশ্চিত যা – তা কখনও বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। মানুষ যা প্রার্থনা করে তা নিশ্চিত হবেই, এই বিশ্বাসের উপর প্রার্থনা ধরে রাখলে ভগবান তা মঞ্জুর করেন। কোনও প্রার্থনা করলে ভগবান তা শোনেন। প্রার্থনা থেকে ফলপ্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত সময়টা ফললাভের ক্ষেত্রে নিশ্চিত হলেও প্রার্থনাকারীর কাছে তা অনিশ্চিত, যা বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না, যতক্ষণ না প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে। ফলে প্রার্থনা মঞ্জুর করছেন না ভগবান।

প্রার্থনা থেকে প্রাপ্তি এই ফলপ্রাপ্তির নিশ্চিত সময়কাল যদি প্রার্থনাকারীর কাছে নিশ্চিত হয়, তাহলে ফল সেখানে অবধারিত। বুঝলি বেটা, কেন ফল হয় না! বিশ্বাস ধরে রাখাটাই মুশকিল। ঈশ্বর প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও একই কথা জানবি। বিশ্বাসটা আমাদের সকলেরই আছে, খাঁটি বিশ্বাসটা নেই। আর প্রার্থনা মঞ্জুর হয় চিত্তশুদ্ধির উপরে। যার চিত্ত যত শুদ্ধ হবে, তার প্রার্থনা তত বেশি মঞ্জুর হবে। প্রার্থনাকারীর কর্মফল খুব প্রতিকূলে থাকলে প্রার্থনা মঞ্জুর হয় না।

একটু থামলেন পরে বললেন,

– বেটা, সংসারজীবনে গৃহীরা যা কিছু সুখদুঃখ ভোগ করে, তার বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই করে। যেমন সারাজীবনে কোনও মানুষের নিজস্ব প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও বিশ্বাস খুব কমমাত্রায় কাজ করে। জীবনে প্রায় সবক্ষেত্রে মানুষকে চলতে হয় অন্যের কথা আর কাজের উপর বিশ্বাস করে। আধ্যাত্মিক জীবনের ক্ষেত্রেও ওই একই কথা জানবি। সেখানেও বিশ্বাস। তবে সেখানে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে চলতে হয় অতীন্দ্রিয় জ্ঞানসম্পন্ন সাধক মহাপুরুষ ঋষি কিংবা ওই পর্যায়ে যাঁরা আছেন তাঁদের কথার উপরে। তাতেই সব প্রাপ্তি।

পথে বেরলে এমনিতে আমার কোনও কাজ থাকে না, সাধু পেলে তার কাছে হাজার প্রশ্ন করা ছাড়া। সেই সময় মনে যে প্রশ্ন আসে, তাই করি। এখন জানতে চাইলাম,

– বাবা, এখনকার চেহারা দেখে মনে হয় এককালে রূপ যৌবন দুটোই বেশ ভাল ছিল আপনার। সংসারে এলেন অথচ সংসার করলেন না কেন?

কথাটা শুনে মুখখানা একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। এতক্ষণ বেশ ছিল। এ প্রশ্নে চুপ করে রইলেন তিনি। লক্ষ্য করতে লাগলেন আমার মুখের দিকে। সাধুবাবার মুখের দিকে তাকালাম না। মাথাটা নিচু করেই বললাম,

– আপনি কোনও অশান্তি করে বেরিয়েছিলেন সংসার থেকে?

কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। কাটল মিনিট পাঁচেক।

অনুরোধের সুরে বললাম,

– বাবা, আমি জানি সাধুসন্ন্যাসীদের পূর্বাশ্রমের কোনও কথা বলতে নেই। তবুও জানতে চাইছি কৌতূহলবশত। দয়া করে বলুন না বাবা, কেন ঘর ছাড়লেন?

লক্ষ্য করলাম সাধুবাবার চোখদুটো স্থির হয়ে গেল। মনে হলে চলে গেলেন ফেলে আসা সুদূর অতীতে। কিছুক্ষণ। আবার সে ভাবটা কেটে গেল, এসে গেলেন আগের ভাবে। স্নেহের সুরে বললেন,

– বেটা, সাধু হব, এপথে আসব এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। মানুষের সাধারণ চিন্তা ভাবনা, আশা আকাঙ্ক্ষা, কামনা বাসনা যা কিছু, তার বাইরেও যে কিছু হয় এবং সেটা দিবারাত্রই যে হয় তা কেউ কল্পনা করতে পারবে না। যতদূর স্মৃতিতে আছে, তখন আমার বয়স আট-দশ হবে। গাঁয়ের নামধাম কিছু জানি না, বলতেও পারব না। তবে বাড়ি যে আমার উত্তরপ্রদেশের কোথাও এটা আমি নিশ্চিত জানি। বাবা-মা দুজনে ছিলেন খুব ঈশ্বরভক্তিপরায়ণ। আমরা এক ভাই এক বোন।

আজ থেকে ধর ৬৫/৭০ বছর আগের কথা। বাবা-মা আমাকে আর ছোট বোনকে নিয়ে গেলেন বিশ্বনাথদর্শনে। সেবার প্রচুর লোক সমাগম হয়েছে কাশীতে। দলে দলে আসছে তীর্থযাত্রী। মা অন্নপূর্ণার অন্নকূটের জন্যেই এত লোক সমাগম। আমরা চলেছি বিশ্বনাথ গলিতে। এত ভিড় যে কল্পনা করতে পারবি না। ঠেলাঠেলি আর ভিড়ের চাপে মা-বাবার কাছ ছাড়া হয়ে গেলাম আমি। খুঁজেই পেলাম না বাবা-মা আর বোনকে। তারাও পেল না আমাকে।

সাধুবাবা একটু থামলেন। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

– বেটা, মা বাবাকে না পেয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। যাকে দেখছি তাকেই জিজ্ঞাসা করছি, ‘তোমরা আমার বাবা মাকে দেখেছো।’ কে কার কথা শোনে। বাড়ির ঠিকানা জানি না। কাঁদছি আর পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি। অনাহারে কেটে গেল একটা দিন। রাত কাটল একটা দোকানের সিঁড়িতে শুয়ে। এমন অবস্থায় এক সাধুবাবার সামনে পড়ে গেলাম। তিনি আমার কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। সব বললাম। সাধুবাবা বললেন, ‘বেটা, তুই ঠিকানা জানিস না। জানলে তোকে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতে পারতাম।’ অভুক্ত আছি শুনে তিনি কিছু খাবার কিনে দিলেন। তারপর আমাকে নিয়ে ঘুরতে লাগলেন কাশীর পথে পথে। খুঁজতে লাগলেন বাবা মায়ের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে। ভগবানের ইচ্ছার বাইরে যাওয়ার উপায় তো কারও নেই। অদ্ভুত ব্যাপার। ওইটুকু জায়গায় কিছুতেই খুঁজে পাওয়া গেল না তাদের। সব চেষ্টা ব্যর্থ হল সাধুবাবার।

এইভাবে কাটল তিনটে দিন। থানায় নিয়ে গেলেন সাধুবাবা। সেখানেও মা বাবা যায়নি। ওখানে পুলিশ আমাকে রাখতে চাইল। আমি কাঁদতে শুরু করলাম। বললাম, ‘সাধুবাবার সঙ্গে খুঁজে বের করব মা বাবাকে। এখানে থাকব না।’ তখন থানা থেকে পুলিশ সাধুবাবাকে বলল, ‘দেখো খুঁজে। যদি পেয়ে যাও তো ভাল নইলে ওকে এখানে দিয়ে যেও।’ সাধুবাবা সম্মতি জানিয়ে আবার খুঁজতে লাগলেন আমাকে সঙ্গে নিয়ে। একসময় অন্নকূট উৎসব শেষ হল। কাশীর পথঘাটও সব ফাঁকা হল। তবুও পাওয়া গেল না বাবা মাকে। এইভাবে কেটে গেল দিনসাতেক।

সাধুবাবার কথাগুলো শুনছি হাঁ করে। তিনিও বলে চলেছেন নির্বিকারভাবে। মুখের ভাবটা এখন বেশ প্রসন্ন। এবার কম্বলের উপর আধশোয়া হলেন। বাঁহাতটা দিয়ে গালে ঠেস দিলেন। শুরু করলেন তার জীবনকথা,

– সেই সাধুবাবা আমাকে বললেন, তোর বাবা মাকে তো আর পাওয়া গেল না। চল, তোকে পুলিশে জমা করে দিয়ে আসি। আমি তখন বললাম, না বাবা ওখানে যাব না। তুমি যেখানে যাবে আমিও তোমার সঙ্গে যাব। প্রথমে রাজি হলেন না, অনেক বোঝালেন। আমি সাধুবাবাকে ছাড়তে চাইলাম না। কি যেন অনেক ভেবে তিনি রাজি হলেন। তারপর আমার বাড়ির পরা জামা কাপড় সব ফেলে দিলেন। নিজের গায়ে জড়ানো কাপড় থেকে ছিঁড়ে একটা টুকরো পরিয়ে দিলেন আমাকে। ব্যস, সেই থেকে শুরু হল আমার সাধুজীবন। ঘুরতে লাগলাম পথেপথে, তীর্থেতীর্থে। একদিন শুভক্ষণে দীক্ষা দিলেন। ধীরে ধীরে ভুলে গেলাম বাবা মা আর ছোট্ট বোনটার কথা। দেখতে দেখতে কেটে গেল এতগুলো বছর। বেটা, বিধাতার যে কি ‘খেল’ তা কারও বোঝার উপায় নেই।

এবার দুহাত জোড় করলেন। কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার করে বললেন,

– বেটা, ওই গুরুজি সাধুবাবাই সেই থেকে আমার বাবা মা বোন, সবই। দয়া করে আমাকে না আশ্রয় দিলে এমন আনন্দময় জীবনটা আমি পেতাম না। সংসারে গেলে জীবনটাই হয়তো আমার ‘বরবাদ’ হয়ে যেত।

সাধুবাবা আবেগে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলেন,

– জয় গুরুমহারাজ কি জয়।

হঠাৎ এমন করে ওঠায় একটু চমকে উঠলাম আমি। আবেগভরা কণ্ঠে তিনি বললেন,

– বেটা, কত বড় ভাগ্য আমার। না চাইতেই গুরু পেয়েছি। সাধুজীবনে প্রথম অবস্থায় এক একদিন পেটভরে দুটো খাবারই জুটত না সারা দিনরাতে। আর এখন বেটা প্রতিদিন, প্রতিমুহুর্তে অমৃত খাচ্ছি, মুখও ধুচ্ছি অমৃত দিয়ে।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button