মথুরা থেকে টাঙ্গা চলল গোকুলের পথে মথুরা-সাদাবাদ রাস্তা ধরে। এক বন্ধু রয়েছে সঙ্গে। যমুনার ওপারে গোকুল। নৌকায় গেলে তাড়াতাড়ি যাওয়া হয়। টাঙ্গায় গেলে একটু দেরি হয় বটে, পথও কিছুটা বেশি তবে পথ চেনা আর দেখার সুখটা অনেক বেশি। মনেরও আরাম হয়। এই নিয়ে গোকুল যাওয়া হবে পাঁচবার। একবার আগ্রা থেকে বৃন্দাবন মথুরা হয়ে সরাসরি বাসে গেছিলাম গোকুলে। দু-বার নৌকায় যমুনা পার হয়ে। এবার নিয়ে দু-বার টাঙ্গায়।
টাঙ্গা খুব দ্রুত গতিতে চলছে, তা নয়। একেবারে ঢিমেতালে চলছে এমনও নয়। টাঙ্গার গতি মোটামুটি। দু-জনে চলেছি গল্প করতে করতে। চোখ চলেছে আমার পথের দু-পাশে। যমুনা পুলটা পার হতে দেখলাম লাঠি হাতে এক বৃদ্ধ সাধুবাবা চলেছেন আমরা যেদিকে যাচ্ছি সেদিকে। দেখামাত্রই দাঁড়াতে বললাম টাঙ্গাওয়ালাকে। টাঙ্গা দাঁড়াতে দাঁড়াতেই এগিয়ে গেছে প্রায় হাতত্রিশেক আগে। থামা মাত্র টুক করে লাফ দিয়ে নেমে নিচে দাঁড়ালাম। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন সাধুবাবা। এ পথে গাড়ি আর লোক চলাচলের বিরাম নেই।
বৃদ্ধের পরনে একটু ময়লা গেরুয়াবসন। বাঁ কাঁধে ঝুলছে ঝুলি। তার উপরে পাটকরা কম্বল। বাঁ হাতে ছোট্ট একটা পিতলের বালতি। ডান হাতে সরু লম্বা একটা লাঠি। মাথায় জটা নেই। সকালে স্নান করে ওঠায় লম্বা এলোচুল কাঁধ ও পিঠে ছড়িয়ে। মুখের আকৃতি পানের মতো। প্রশস্ত কপাল। সামান্য ফরসা গায়ের রং। নাক চোখ মুখ সুন্দর। অন্য সব সাধুদের মতোই এই সাধুবাবার সাজপোশাক। রূপের পরিবর্তনটুকু ছাড়া আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ল না। বয়েস আমার ধারণায় ৭০/৭৫ এর কাছাকাছি।
একেবারে কাছে আসতে আমি কয়েক পা এগিয়ে সামনে দাড়াতেই সাধুবাবা দাঁড়িয়ে গেলেন। নিচু হয়ে প্রণাম করে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম।মুখে কিছু বললেন না। একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে। আমি জোড়হাত করে অনুরোধের সুরে বিনীতভাবে বললাম হিন্দিতে,
– বাবা, আমরা গোকুলে যাচ্ছি। আপনি একই পথে পায়ে হেঁটে চলেছেন দেখে দাঁড়ালাম। যদি দয়া করে টাঙ্গায় ওঠেন তাহলে আপনার কষ্টটা কম হবে আর আমিও বলতে পারব দু-চারটে কথা। আপনি কি আমাদের সঙ্গে যাবেন? এ দিকে কোথায় যাচ্ছেন?
কোনোরকম দ্বিধা না করেই বললেন,
– আমি গোকুল যাব না। তার একটু আগেই যাব একটা দরকারে। তুই যখন বললি, চল তোর সঙ্গে যাই। আমার হেঁটে যেতেও অসুবিধে নেই, টাঙ্গাতে গেলেও কোনও অসুবিধে নেই।
কথাটা বলে উঠে বসলেন দাঁড়িয়ে থাকা টাঙ্গায় ঝুলিটা কোলে নিয়ে। আমি বসলাম সাধুবাবার বাঁ পাশে। আমার পাশে বসলো সঙ্গী। টাঙ্গাওয়ালা মুখে একটা অদ্ভুত আওয়াজ করতেই চলতে শুরু করল ঘোড়া। কথা শুরু করলাম আমি,
– বাবা, আপনি কি মথুরা বৃন্দাবনের কোথাও থাকেন, না অন্য কোথাও?
সাধারণভাবেই বললেন,
– আমি থাকি অমরকণ্টকে নর্মদামাঈ-র কাছে। ওখানে ছোটখাটো একটা ঝুপড়ি আছে আমার। হরিদ্বারে গেছিলাম। ভাবলাম একবার মথুরা বৃন্দাবন হয়ে যাই। এত কাছে এসে না দেখে ফিরে যাব! আগেও বহুবার এসেছি এখানে। এখান থেকে আর যাব না কোথাও। সোজা ফিরে যাব ডেরায়।
কথা শেষ হতে জানতে চাইলাম,
– এর মধ্যে চলে যাবেন, না থাকবেন আরও কিছুদিন?
মোটামুটি গতিতে চলেছে আমাদের টাঙ্গা। গতি ঠিক রাখার জন্যে মুখ থেকে মাঝে মাঝে একটা অদ্ভুত শব্দ করছে টাঙ্গাওয়ালা। এ পথে অধিকাংশই মালবাহী লরি। সাধুবাবা বললেন,
– হ্যাঁ বেটা, এখানে আর দিন দশপনেরো থাকব, তারপর চলে যাব।
হাতে সময় কম। টাঙ্গায় চলার পথটুকুতেই জেনে নিতে হবে অনেক কথা। সময় নষ্ট করলে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না ভেবে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে দয়া করে বললেন এই সাধুজীবনে এলেন কি ভাবে?
প্রশ্নটা শুনে একটু অস্বস্তিতে ভরে উঠল সাধুবাবার মুখখানা। এমন প্রশ্ন যাঁদের করেছি, তাঁদেরই দেখেছি ওই একইভাব। এখানেও ব্যতিক্রম নেই। উত্তরটা সঙ্গেসঙ্গে দিলেন না। মিনিটখানেক চুপ করে থেকে পরে বললেন,
– বেটা, সাধুদের এসব কথা বলা নিষিদ্ধ। তবুও বলছি শোন। মধ্যপ্রদেশের রাজনন্দগাঁওতে আমার জন্ম। ওখানেই একসময় বাড়ি ছিল আমাদের। এখন আছে কিনা বা কে আছে কিছু জানি না।
কথাটা বলে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললেন। তাকালেন আমার মুখের দিকে। বললেন,
– ছোটবেলায় পড়াশোনা কিছু করিনি। আমাদের চাষ আবাদের কিছু জমি ছিল। তখন বয়েস বছরদশেক হবে। প্রতিদিন বাবার সঙ্গে যেতাম মাঠে। ওসব আমার মোটেই ভাল লাগত না। ওই বয়েসে প্রতিদিন বাবা আমাকে জমিতে লাঙল দেয়া শেখাতেন। আমি কিন্তু কিছুই পারতাম না। তুই বল, ওই বয়েসে আমার মতো বাচ্চার পক্ষে এ কাজ করা কি সম্ভব? একদিন সকালে জেদ ধরলাম মাঠে যাব না বলে। বাবা তখন রাগে ফেটে পড়লেন। একটা লাঠি দিয়ে এমন মার মারলেন, সে মারের ব্যথা আজও অনুভব করতে পারি।
মার খেয়ে পড়ে রইলাম বাড়িতে। মায়ের প্রতিবাদে বাবা এতটুকুও কর্ণপাত করেননি। ভাবলাম, আমি যদি মাঠে যেতে না চাই, মার জুটবে কপালে। মনেমনে ঠিক করলাম, বাড়ি থেকে পালাব। তাহলে আর মাঠে যেতে হবে না, মারও খেতে হবে না। মারের প্রথম ধকল সামলে নিয়ে পালালাম ঘর ছেড়ে। এলাম সোজা স্টেশনে। একটা ট্রেন আসতে উঠে পড়লাম। আমি কোথায় যাব আর ট্রেন কোথায় যাবে কিছু জানি না। ঠোক্কর খেতে খেতে এখান ওখান করতে করতে একদিন পৌঁছে গেলাম অমরকণ্টকে। ওখানে এক বৃদ্ধ সাধুবাবার আশ্রয় পেলাম। একসময় দীক্ষাটাও হয়ে গেল। আমার প্রথম আশ্রয়দাতাই পরে হলেন চিরকালের, পরকালের আশ্রয়দাতা। অমরকণ্টকেই রয়ে গেলাম। ওখান থেকে যখন যেখানে মন চেয়েছে চলে গেছি। তবে থাকার জন্য অন্য কোথাও মন বসেনি।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবার বয়েস কত হল এখন?
প্রসন্নভাবেই বললেন,
– সেই ছোটবেলায় ঘর ছেড়েছি, এখন কি আর অতসব খেয়াল আছে বেটা! বয়েস আন্দাজ সত্তর পঁচাত্তর আশি হবে!
কথার ভাবটা দেখে মনে হল, কোনও কিছু না ভেবেই বললেন কথাটা। আর ভাববারই বা কি আছে? বিয়ের প্রয়োজনে কুমারী মেয়েরা আর চাকরির জন্য বয়েস নিয়ে ভাববে ছেলেরা, সাধুসন্ন্যাসীরা ভাববে কোন দুঃখে? তাঁদের জীবন ভাবনাটা তো বয়েস নিয়ে নয়, মন নিয়ে! যাইহোক টাঙ্গা এগিয়ে চলেছে গোকুলের দিকে। ক্রমশ কমে আসছে পথের দূরত্ব। তবুও হাতে এখনও সময় আছে একটু। আমি দেখেছি, তাড়াহুড়ো করে সাধুদের সঙ্গে কথা বললে চট্ করে কোনও প্রশ্ন আসে না মানে। এখন ভিতরে প্রচণ্ডভাবে একটা অস্থিরতা কাজ করছে।
কথায় কথায় কথা বাড়ে কথা হলে। আগ্রহ করে সাধুবাবাকে টাঙ্গায় তুলেছি কিন্তু ভিতর থেকে কোনও কথা আসছে না। সাধুসঙ্গের সময় মাথায় কোনও প্রশ্ন না এলে একটা কৌশল করে থাকি। তাতে ফলও হয় দারুণ। তখন কথাও চলতে থাকে সমানে। সাধুদের উপর ছেড়ে দিয়ে এইভাবে বলি এবং বললাম,
– বাবা, এমন সুন্দর একটা কথা বলুন, যে কথাটা সারাজীবন যেন মনে রাখার মতো হয়।
একথা শুনে সাধুবাবা একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন, ভাবটা দেখে মনে হল। ডানহাতটা কপালে একটু বুলিয়ে নিয়ে বললেন,
– বেটা, সব সময় গুরুকে ধরে রাখবি। সংসারে গুরু ছাড়া আপন বলতে আর কেউই নেই। আমার গুরুজি বলতেন, মানুষের শরীর হল রথ, মন হল সারথি আর ইন্দ্রিয়গুলি হল লাগাম ছাড়া বেগবান ঘোড়া। সংসারে ত্যাগী যারা, তারা এই শরীররথে চড়ে, সংসারে থেকে গুরুকে ধরে সংসারপথ অতি সহজে অতিক্রম করে পৌঁছে যায় তাঁরই কোলে। আবার এই একই রথে চড়ে, গুরুকে আশ্রয় না করে ভোগীরা দুঃসহ যন্ত্রণাময় নরকপ্রাঙ্গণে সর্বদা ভ্রমণ করে।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, ত্যাগী বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন? সংসারে থেকে সংসারীদের পক্ষে সবকিছু ত্যাগ করা কি সম্ভব?
সুন্দর প্রসন্নভাবেই সাধুবাবা বললেন,
– বেটা, গুরুর শরণাগত হলে মানুষের সব ত্যাগ হয়, ত্যাগী হয় আপনা থেকে। মানুষ শরণাগত না হলে যে যে বিষয়গুলি থেকে সে নিবৃত্ত হয় বা ত্যাগ করে, শুধু সেই সেই বিষয়গুলি বন্ধন থেকেই সে মুক্তিলাভ করে, বুঝলি?
সাধুবাবা থামলেন। টাঙ্গার গতি একটু বেড়েছে। বিরক্ত হলাম। এতে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব। অনেক কথা জানা যাবে না। বিরক্ত হলেও কিছু বললাম না টাঙ্গাওয়ালাকে। বললাম সাধুবাবাকে,
– বাবা, থামলেন কেন, আরও কিছু বলুন?
সাধুবাবা ডানহাতে ঝুলিটা চেপে ধরে বাঁ হাতটা আমার পিঠের উপর রেখে বললেন,
– বেটা, সংসারে হোক আর সাধুসন্ন্যাসীদের সংসারহীন জীবনেই হোক, যা কিছু সুখের উৎপত্তি তা হয় বিষয় থেকে। বিষয়ের আলোচনায় জন্মে বিষয়ে আসক্তি। এই আসক্তি থেকে কামনার উদয় হয় মনে। কামনা থেকেই উৎপত্তি হয় কলহের, অসহনীয় ক্রোধের জন্ম হয় কলহ থেকে, ক্রোধ প্রকৃষ্ট জ্ঞান নষ্ট করে মানুষকে করে তোলে বিবেকহীন, বিবেকহীনতাই সারাজীবনব্যাপী চলতে থাকে সঙ্গেসঙ্গে। যারা বিবেকহীন, তারা ঘুরে বেড়ায় অস্তিত্বহীন হয়ে। ফলে সাধুসন্ন্যাসী বা গৃহী যাই হোক কেন, মুক্তিলাভের পথ থেকে তারা ভ্রষ্ট হয়। এক কথায় এরা জীবিত থেকেও জীবনযাপন করে মৃতের মতো।
প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, অমরকণ্টকে নর্মদামাঈর কোলে বসে আছেন বছরের পর বছর ধরে। মায়ের করুণা কি কিছু উপলব্ধি হল? উচ্চমার্গের মহাত্মারা কি এখনও আছেন ওখানে?
সাধুবাবা কপালে হাতদুটো ঠেকিয়ে নমস্কার জানিয়ে বললেন,
– বেটা, গৃহত্যাগের পর সেই ছোটবেলা থেকে অমরকণ্টক ছেড়ে যাইনি কোথাও। আজ তো ‘বুঢঢা’ হয়ে গেছি। নর্মদামাঈ করুণা না করলে জীবনের এতগুলো বছর কাটালাম কি করে! নর্মদামাঈর কৃপার কথা, করুণার কথা শুনলে তুই অবাক হয়ে যাবি। পাহাড়ে তীর্থযাত্রী গেলে দুটো খাওয়ার অভাব হয় না। বহু বছর আগের কথা। তখন আমার গুরুজি আর দেহে নেই। সেবার একটানা ছয় সাতদিন প্রবল ঝড় বৃষ্টি হয়েছিল। ঝুপড়ি থেকে বেরোয় কার সাধ্যি! পাহাড়ে একটা লোক আসার মতো পরিস্থিতি নেই, আসেওনি কেউ। একটা পাখির পর্যন্ত দেখা পাওয়া যায়নি। সাধুদের তো সঞ্চয় থাকে না। লোকের দেওয়া বাড়তি যেটুকু থাকে সেটুকুই খাওয়া হয় পরে। আমার কাছে যা ছিল প্রথম দু-দিনেই শেষ। তৃতীয় দিনে একটা দানাও নেই। ডেরা থেকে বেরব তার কোনও উপায় নেই। আর বেরিয়ে কারও কাছে যে কিছু চাইব, এমন একটা মানুষও নেই। কি করব, আহারের সন্ধানে কোথায় যাব, কিছু ভেবে পেলাম না।
উপায়হীন হয়ে ভজনকুটিরের দাওয়ায় বসে শুধু নর্মদামাঈকেই স্মরণ করতে লাগলাম। এমন সময় ঘটে গেল এক আশ্চর্য ঘটনা। দেখলাম, অতি বৃদ্ধা সুন্দরী এক রমণী ভিজতে ভিজতে এসে উপস্থিত হলেন আমার কুটিরের উঠোনে। সঙ্গে তাঁর মাঝারি আকারের একটা ঝুড়ি। পাহাড়ি গাছের বড় বড় পাতা দিয়ে ঢাকা। ঝুড়িটা দাওয়ায় রাখতেই জিজ্ঞাসা করলাম,
– মাঈ, কোথায় থাকো তুমি? এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে এখানে এলেই বা কেমন করে?
অদ্ভুত সুন্দরী শ্যামবর্ণা অতিবৃদ্ধা হাসি হাসি মুখ করে বললেন,
– বেটা, আমি থাকি কাছেই ভীলদের পাড়ায়। তুমি এখানে অনেকদিন ধরে আছো তা জানি। এই দুর্যোগে কোথাও বেরতে পারবে না দেখেই চলে এলাম, নইলে যে তুমি অভুক্ত থাকবে। আমার বাচ্চা না খেয়ে থাকবে, মা হয়ে তা কি কখনও দেখা যায়! তাই তো ছুটে এলাম বেটা।
কথাটুকু শেষ হতে এবার আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– বেটা, আমি ভাবলাম মাঈকে একটু বসতে দিই। ভেবে কুটিরে ঢুকে একটা আসন আনতে যেটুকু সময়, ব্যস, বাইরে এসে দেখলাম ফল আটা ঘি সবজির ঝুড়িটা ছাড়া আর কেউ নেই। একফোঁটা জলে ভেজেনি ঝুড়িটা। মনটা আমার খারাপ হয়ে গেল। মাঈকে হাতে পেয়েও হারালাম। এইভাবে নর্মদামাঈ আমাকে করুণা করে জুটিয়ে দিয়েছেন আহার। তাঁর দয়াতেই তো বেটা চলছি, বেঁচেও আছি।
আর সাধু মহাত্মাদের কথা বলছিস, তাঁদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়, তবে লোকালয়ে আসেন না। তাঁরা তপস্যা করেন নর্মদার তীরে তীরে গভীর অরণ্যে। এই জীবনে অনেক মহাত্মার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, তাঁদের কৃপালাভও করেছি।
টাঙ্গাওয়ালা ঘোড়া ছুটিয়েছে বেশ গতিতে। এখন আমার আর কোনও দিকে মন নেই, নজরও নেই। চোখদুটো সাধুবাবার মুখের দিকে। মথুরা থেকে কতটা পথ এলাম, এখান থেকে গোকুল আর কতটা বাকি, সাধুবাবা কোথায় নামবেন, কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারলাম না। শুধু সাধুবাবার উপরে নর্মদামাঈ-এর কৃপার কথা ভাবছি আর ভাবছি। এ যুগে এসব কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে? কারও মুখে অবিশ্বাস্য কথা শুনে, সেই কথায় শ্রোতার প্রগাঢ় বিশ্বাস জন্মাবে, এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না। একেবারে যে কেউ নেই, একথায় আমার বিশ্বাস নেই। বিশ্বাসটা মানুষের জন্মান্তরের সংস্কারের উপরে সম্পূর্ণ নির্ভর করে। সাধুদের কথায় আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা সারাটা জীবনই তো কাটালেন ভগবান ভগবান করে। তাঁকে লাভ করার পথের অন্তরায়টা কি, তা কি জানা আছে আপনার?
দেখেছি সব সাধুবাবারই যেন ‘রেডিমেড সাপ্লায়ার’। প্রশ্ন করা মাত্রই উত্তর প্রস্তুত। সাধননিষ্ঠ বৈরাগ্যময় জীবন সাধুবাবার। মুখখানা দেখে মনে হয়, আবিলতার এতটুকু স্পর্শ নেই মনে। উত্তরে জানালেন,
– বেটা, ভগবানকে লাভ করার, তাঁর করুণা কৃপালাভের অন্তরায় মাত্র দুটো বলেই আমার মনে হয়। এক আসক্তি, দুই অভিমান। এই দুটো যার মধ্যে আছে, তার তাঁকে লাভ করা তো দূরের কথা, তাঁর করুণা থেকেও মানুষ বঞ্চিত হয় সারাটা জীবন। বেটা, যেকোনও বিষয় বা বস্তুতে মানুষের আসক্তি নষ্ট করে দেয় ধর্মভাবকে। অভিমান নষ্ট করে দেয় সমস্ত গুণকে। তার মধ্যে বিশেষ করে নষ্ট করে সত্ত্বগুণকে। সুতরাং বেটা, আসক্তিতে ধর্মভাব আর অভিমানে যার সমস্ত গুণ নষ্ট হয়ে গেল, তার তাঁকে পাওয়ার পুঁজি রইল কোথায়?
ঠিক এই রকমই মানুষের ক্রোধ নষ্ট করে অর্থ ও বিষয় সম্পত্তি, রূপ সৌন্দর্যকে নষ্ট করে রোগব্যাধি, সমস্ত আশা নষ্ট করে দেয় ধৈর্যকে, অসৎসঙ্গ নষ্ট করে স্বভাবকে, আর কাম মানুষকে নির্লজ্জ করে তোলে লজ্জাকে নষ্ট করে। আসক্তি আর অভিমান এ দুটো ত্যাগ করতে না পারলে তাঁর করুণাটুকুও মানুষ লাভ করতে পারে না। বেটা, ভ্রমের বশে মানুষ যাঁকে খুঁজে বেড়ায় অথচ যিনি রয়েছেন তোর আমার সকলের ভিতরে, তিনিই তো ঈশ্বর। তবে তিনি আছেন অপ্রকট অবস্থায়। যে আসক্তি আর অভিমান ত্যাগ করতে পারে, তাঁর কাছেই তিনি প্রকটিত হন। যাঁরা পেরেছেন তাঁদের কাছে তিনি প্রকটিতও হয়েছেন। যারা তা ত্যাগ করতে পারবে না, তাদের কাছে তিনি প্রকটিত হবেন না।
কথাটুকু শেষ হতে ঘাড় ঘুড়িয়ে সাধুবাবা পথের ধারে বড় একটা গাছ দেখিয়ে বললেন,
– বেটা, এবার আমি নামব। ওই গাছটার সামনে নামিয়ে দিলেই হবে।
দেখতে দেখতে টাঙ্গা এসে গেল গাছের কাছে। থামতে বললাম। গাছ ছাড়িয়ে আরও হাত কুড়ি এগিয়ে টাঙ্গা থামল। সাধুবাবা নামলেন। আমিও নামলাম। সঙ্গী বন্ধুও নেমে এল। আমরা দুজনেই প্রণাম করলাম। হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে মাথায় হাত দিলেন। তারপর বাঁ পাশের একটা মেঠো পথ ধরে চললেন নির্মলহৃদয় আসক্তিহীন ও নিরভিমান বৃদ্ধ সাধুবাবা। আমরা উঠে বসলাম টাঙ্গায়। টাঙ্গাওয়ালা স্বভাবসিদ্ধ মুখে সেই অদ্ভুত আওয়াজটা করতেই ঘোড়া চলতে শুরু করল। কথাগুলো রয়ে গেল। চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেলেন সাধুবাবা।