মথুরা বাসডিপোয় এলাম। বাস ছাড়তে এখনও কিছুটা দেরি আছে। ডিপোর কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে বাসে উঠতেই দেখি পিছনের সিটে বসে আছেন এক সাধুবাবা। সামনের এবং পাশের সিটগুলো দেখলাম যাত্রীতে ভরা। পিছনের সিটে সকলে বসলেও অনেকটা বসার জায়গা তখনও ফাঁকা। একটা যাত্রীও দাঁড়িয়ে নেই। সাধুবাবা বসে আছেন এক কোণে। তার পাশে একজন ময়লা জামা কাপড়পরা দেশোয়ালি বৃদ্ধ। মাথায় একটা কাপড় জড়ানো পাগড়ির মতো করে। পায়ের কাছে একটা টিনের বাক্স। বৃদ্ধের এইপাশে পরপর বসে আছেন আরও দুজন, একজন মাঝবয়সী আর একজন বছর দশেকের ছেলে। তিনজনের বসার মতো জায়গা ফাঁকা। এরপর কয়েকজন বসে আছে জানলার ধার পর্যন্ত।
অপ্রত্যাশিতভাবে সাধুবাবাকে দেখতে পেয়ে মনটা আমার আনন্দে নেচে উঠল। তাই কোনও কিছু না ভেবে সোজা
বৃদ্ধযাত্রীর কাছে গিয়ে অনুরোধের সুরে বললাম,
– দয়া করে আপনি একটু এদিকে সরে বসবেন, ‘বাবা সে কুছ পুছনা হ্যায়।’
বৃদ্ধ তাকালেন আমার মুখের দিকে। মুখে কিছু বললেন না। পাশে বসা যাত্রীদের ইশারায় বললেন সরে বসতে। সকলে একটু একটু করে সরে বসতেই বসার জায়গা হল আমার। আমি বসলাম সাধুবাবার গা ঘেঁষে। সঙ্গী বসল দুজনের পরে।
এবার বলি সাধুবাবার চেহারার কথা। বেশ বৃদ্ধ। কাঁধে ইহকালের সম্বল সেই ঝোলা যা থাকবে মরার দিন পর্যন্ত। পরনে গেরুয়াবসনটা বেশ ময়লা। শত কাচাকাচিতেও এ ময়লা উঠবে বলে মনে হল না। গালভর্তি দাড়ি। মাথায় লম্বা লম্বা চুল তবে জটা বাঁধেনি একটাও। ভাঙা গাল লাবণ্যে ভরা। চোখদুটো অনেক বসে গেছে, তবে অসম্ভব রকমের উজ্জ্বল। মাঝারি আকারের নাক। চাপা নয় আবার একেবারে টিকালোও নয়। গায়ের রং বেশ ময়লা। একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি, আরামে বসেবসে খাওয়া সাধুরা ছাড়া পথচলতি আশ্রয়হীন একজন সাধুর চেহারাও তেল চুকচুকে নাদুসনুদুস নয়।
সাধুবাবা বসে আছেন কোণায় জানলার ধারে। মাথা নিচু করে প্রণাম করতে গেলে দুজনেরই অসুবিধে হবে। তাই দু-হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে মুখে বললাম,
– আপকা গোড় লাগে বাবা।
মুখে কিছু বললেন না। ইশারায় ডানহাতটা নাড়লেন অভয়সূচক। বাসে স্টার্ট দেয়ার আওয়াজ এল কানে। বাস ছাড়ল মথুরা বাসডিপো থেকে। সকাল তো, ফাঁকা রাস্তা। তাই শুরু থেকেই চলতে লাগল হইহই করে ডীগ জয়পুর যাওয়ার রাস্তা ধরে। বৃন্দাবন থেকে এই ডিপোয় এসেছি টাঙ্গায়। এখন অবশ্য অটো হয়েছে। যাচ্ছি গিরিরাজ গোবর্ধন। গোবর্ধন পর্বতের নাম। শ্রীকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র। সময় কম তাই কোনও ভূমিকা না করে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা আপনি কোথায় যাবেন, গিরিগোবর্ধন?
সাধুবাবা মাথাটা নেড়ে মুখেও বললেন,
– না বেটা, গিরিগোবর্ধন যাব না। যাব রাধা কুণ্ডে।
কথাটা বলে বাসের জানলা দিয়ে তাকালেন বাইরের দিকে। ইতিমধ্যে একজন উঠে খালি সিটে বসে পড়েছেন। দাঁড়িয়েও রয়েছেন কয়েকজন। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা এখন আসছেন কোথা থেকে, বৃন্দাবন?
কোনওরকম ইতস্তত না করে উত্তর দিলেন,
– বৃন্দাবনে কয়েকদিন ছিলাম। গতকাল মথুরায় এসেছি। আজ যাচ্ছি রাধাকুণ্ডে। ওখানে কয়েকদিন থাকার ইচ্ছে। তারপর গিরিগোবর্ধন হয়ে পরে যাব একটু দ্বারকায়।
বাসটা থামল। কয়েকজন হিন্দিভাষাভাষীর মহিলাপুরুষ উঠলেন একগাদা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে। বসার জায়গা নেই। সিটের কোণা ধরে বাচ্চারা দাঁড়াল। বড়রা দাঁড়ালেন উপরের হ্যান্ডেল ধরে। প্রত্যেকের পরনে ময়লা জামাকাপড়। দেখে বোঝা যায়, আর্থিক অবস্থা এদের ভাল নয়। এই বাসে একমাত্র আমি আর সঙ্গী ছাড়া প্রত্যেকেই হিন্দিভাষী। বাস ছাড়ল। ধীরে ধীরে চলতে চলতে আবার গতি বাড়ল। বললাম,
– বাবা, দয়া করে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন?
মুখে কোনও কথা বললেন না। ইশারায় জিজ্ঞাসা করলেন কি জানতে চাই। বললাম,
– বাবা, অনেক দীক্ষিতের মুখে শুনেছি এবং শুনি, দীক্ষার পর তাদের কারও গুরু প্রতারণা করেছেন, কেউ বা শিষ্যের ভক্তির সুযোগ নিয়ে প্রচুর টাকাপয়সা নিয়েছেন। ফলে শিষ্যের শ্রদ্ধা নষ্ট হয়ে গেছে গুরুর উপর। কেউ হয়ত কারও মাধ্যমে কোনও গুরুর প্রশংসা শুনে আবেগের বশে দীক্ষা নিয়ে পরে জানতে পারলেন, আসলে যা শুনেছিলেন তার সঙ্গে গুরুর চরিত্র ও কার্যকলাপের সঙ্গে মোটেই মিল নেই। ফলে শ্রদ্ধা বিশ্বাস হারালেন তার গুরুর উপরে।
কেউ হয়ত বাহ্যত দেখলেন গুরু খুবই ভাল। দীক্ষা নিলেন আনন্দের সঙ্গে। পরে জানতে পারলেন, গুরুজি তার চরিত্রহীন মদ্যপ, অবৈধ কর্মে লিপ্ত আছেন। ফলে শিষ্য বা শিষ্যার মন শুধু খারাপ নয়, শ্রদ্ধা বিশ্বাস হারালেন। দীক্ষায় লাভ করা ইষ্টমন্ত্র পর্যন্ত পরিত্যাগ করলেন। এমন অসংখ্য ঘটনার কথা শুনেছি অনেক দীক্ষিতদের মুখে। এক কথায় বাবা, তাদের ভাষায় ‘গুরু তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন’ বা এমন কিছু করেছেন যার ফলে গুরুর উপর আস্থা নেই। বিশ্বাস ভক্তি শ্রদ্ধার শেষ সম্বলটুকু মুছে গেছে অন্তর থেকে। এসব সত্ত্বেও কেউ ইষ্টমন্ত্র নামেই ধরে রেখেছেন, কেউ বা কখনও জপ করেন আবার করেন না। মোটের উপর গুরুর বিষয়ে দ্বিধা সংশয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
গুরু পরিত্যাগ করা অপরাধ। তারা এখন গুরুকে ফেলতে পারছেন না, গ্রহণও করতে পারছেন না অন্তর থেকে। আপনি তো বাবা এ পথে আছেন বহু বছর ধরে। আমার বিশ্বাস, আপনারা প্রাচীনদেরই ধারা বহনকারী। গুরুকে কেন্দ্র করে যেসব শিষ্যশিষ্যারা মানসিক দিক থেকে দিনের পর দিন কষ্ট পাচ্ছেন, তারা কিভাবে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবেন, সমস্যা সমাধানের উপায় কি, তাদের কি করা উচিত এবং কি করলে কল্যাণ হবে দয়া করে বলবেন বাবা?
যত রকমের পারলাম, আরও অনেক কথা বলে বিষয়টা বোঝালাম সাধুবাবাকে। আমার সৌভাগ্য, তিনি প্রত্যেকটা কথাই শুনলেন নিবিষ্ট মনে। বাসের ঝাঁকানি, আওয়াজ, গতির তারতম্যহেতু খুব অসুবিধে হচ্ছিল আমার কথা বলতে, সাধুবাবার শুনতে। তবুও বোঝাতে পেরেছি। কথাগুলো শোনার পর কেমন যেন একটা ব্যথার ভাব ফুটে উঠল উজ্জ্বল মুখখানায়। মিনিটখানেক চুপ করে থাকার পর সাধুবাবা বলতে শুরু করলেন,
– বেটা, এ খুব জটিল প্রশ্ন আর উত্তরও অনেক বড়। এইভাবে যেতে যেতে এসব কথা ঠিক মতো আলোচনা করা যায় না। তবুও যখন বললি তখন যতটা পারি উত্তর দিচ্ছি। এসব আলোচনার জায়গা বাসে নয়।
আমার সময় কম। যতটা পারি ততটা জেনেনি। অকারণ সময় নষ্ট হবে কথা বাড়ালে। তাই একটা কথাও বললাম না। সাধুবাবা বললেন,
– তুই যে সমস্যার কথাগুলো বললি দীক্ষিতদের সম্পর্কে, এ সমস্যা আজ বলতে পারিস সারা দেশজুড়ে। এমন ঘটনা দু-একজন শিষ্য বা শিষ্যার জীবনের নয়, লক্ষ লক্ষ অভাগাদের জীবনে ঘটে চলেছে অবিরত। যতটা পারি তোর উত্তর দিতে চেষ্টা করছি। তুই যাবি কোথায়, রাধাকুণ্ডে? থাকিস কোথায়?
কথার উত্তরে জানালাম,
– আমি বাবা কলকাতায় থাকি। বৃন্দাবন মথুরায় এসেছি কৃষ্ণের লীলাভূমি দর্শন করতে। এখন যাব গিরিরাজ গোবর্ধনে। আসার পথে দর্শন করব রাধাকুণ্ড শ্যামকুণ্ড।
কথাটা শুনে মাথাটা একটু নাড়ালেন। ভাবটা এমন ‘তেরা বাত মেরা সমঝ মে আয়া’। তিনি শুরু করলেন এইভাবে,
– বেটা, আমি শাস্ত্র পড়িনি, লেখাপড়াও কিছু শিখিনি। আমার গুরুজির মুখে শাস্ত্রকথা শুনে, তাতে যে জ্ঞানটুকু হয়েছে, তার উপর ভিত্তি করেই তোকে বলছি। একটা কথা সব সময় মনে রাখবি, গুরু কখনও লম্পট প্রতারক চরিত্রহীন বা ভণ্ড হয় না। কারণ গুরু তো মানুষ নয় যে তিনি ভণ্ড প্রতারক হবেন। গুরু ভগবান বা বলতে পারিস এমন এক বিশেষশক্তি যা মানুষের মধ্যে ক্রিয়া করে মানুষকেই দেয় মুক্তি বা পরমপথের সন্ধান। সে শুভশক্তি চোখে দেখা যায় না, অথচ প্রকাশ তাঁর ক্রিয়ায় এবং সে শক্তি নিহিত রয়েছে মন্ত্রের মধ্যে। সুতরাং গুরু বা ভগবান কিংবা পরমশক্তি যাই বলিস না কেন, অনাদিকালের অনন্ত যে সত্য, সে সত্যের কি বিকৃতি হতে পারে, না মানুষকে প্রতারণা করতে পারে, তুই একটু ভেবে বলতো দেখি?
সাধুবাবার কথা শেষ হল, বাসও থামল একটা স্টপেজে। হুড়মুড় করে কিছু লোক উঠতেই আবার চলতে শুরু করল। বাইরের দিকে আমার নজর নেই। কানটা সাধুবাবার কথা শোনায়, চোখদুটো তার মুখের দিকে। জানতে চাইলাম,
– বাবা, তাহলে এখানে একটা কথা আছে। গুরু যখন ভণ্ড লম্পট বা প্রতারক নয়, তাহলে দীক্ষিতদের অনেকে যে প্রতারিত হয়ে গুরুর উপর বিশ্বাস হারাচ্ছে, বিভ্রান্ত হয়ে লক্ষ্যচ্যুত হচ্ছে বা যিনি প্রতারণা করছেন, তাকে তো শিষ্য শিষ্যারা গুরু বলেই জানেন ও জ্ঞান করেন, তাহলে তিনি কে?
উত্তরে সাধুবাবা জানালেন,
– বেটা, যেকোনও মানুষ গুরুকরণের মাধ্যমে মন্ত্র পেতে পারে। শাস্ত্র পড়েও তার থেকে মন্ত্র সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু তা পেলেই তিনি গুরু হওয়ার বা মন্ত্রদানের অধিকারী হন না যদি তার গুরু তাকে এই পদে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষমতা দান না করেন। অনেকে স্বঘোষিত গুরু হয়ে দীক্ষা দিচ্ছেন। এমন দীক্ষাদানের অনধিকারী মানুষের মধ্যে গুরুশক্তি, যে শক্তিবলে মানুষ মুক্তিপথের অধিকারী হবে, সে শক্তির ক্রিয়া হয় না তার মধ্যে। ফলে সে রকম কেউ মন্ত্র দিয়ে প্রতারণা করলে গুরু বা পরমশক্তির অপরাধটা কোথায় ? এখন কথা হল, যাকে গুরু বলে মানুষ মেনে নিচ্ছে, তার মধ্যে সেই পরমশক্তির ক্রিয়া হচ্ছে কিনা, তা তো বাইরে থেকে দেখে তুইও বুঝবি না, আমিও নয়। কিন্তু বোঝা যাবে ও প্রকাশ পাবে তার কর্মে। কেমন করে?
বেটা, মানুষের মধ্যে অনন্ত শক্তি ও সত্যের আবির্ভাব হলে সেখানে অসত্যের প্রকাশ হবে কেমন করে? তা হবে না। যেখানে অসত্যের আশ্রয়, প্রতারণা, ভণ্ডামির প্রকাশ সেখানে গুরুশক্তি ক্রিয়া করে না। সেখানে মানুষ দীক্ষা দিয়ে, মানুষের রিপু ক্রিয়া করে মানুষকে প্রতারণা করে, সেখানে গুরু কে এবং তাঁর স্থিতি, অবস্থানই বা কোথায়? প্রকৃত গুরু যিনি, বাহ্যত মানুষের দেহ দেখছি ঠিকই তবে তিনি ভগবান। তাঁর মধ্যে বিশেষশক্তি ক্রিয়া করে মানুষকে দিচ্ছেন শান্তি ও পরমপথের মহাজীবনের সন্ধান। যখনই গুরুরূপী কারও মধ্যে সত্যের বিপরীত ভাব দেখবি, তখনই বুঝবি তিনি গুরু নয়, রক্তমাংসের মানুষ। তার মধ্যে রিপুর ক্রিয়া চলছে অবিরত। এমন মানুষের পাল্লায় পড়লে তো বাবা প্রতারিত হতে হবে অর্থে, মনে ও মন্ত্রে। মন্ত্র বলতে ভুল মন্ত্র, অসিদ্ধ মন্ত্র, মরা মন্ত্র এবং অসম্পূর্ণ মন্ত্র।
একটানা বলে সাধুবাবা থামলেন কিন্তু বাস থামল না। চলছে হইহই করে। একবার বাসের জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। সামনে দু-জনের বসা সিটের উপর হাতটা একবার রেখে আবার নামিয়ে নিলেন কোলে। পরে বললেন,
– বেটা, স্বঘোষিত বা অনধিকারী যাদের কথা বললাম, গৃহী গুরুদের মধ্যে এদের সংখ্যাটা সবচেয়ে বেশি। মঠ আশ্রম ইত্যাদিতে যে নেই তা নয় বেটা। সেখানে কোথাও কম, কোথাও বেশি, অল্পবিস্তর হচ্ছেই। তার মধ্যে বেশি প্রতারণা হচ্ছে, যেখানে মঠ মন্দির আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত সাধুসন্ন্যাসী, যাদের গৃহী শিষ্য শিষ্যাদের বাড়িতে গুরু হিসাবে কমবেশি যাতায়াতের অভ্যাস আছে।
এবার বলি তাদের কথা, যারা দীক্ষাদানের অধিকারী হয়েও শিষ্যদের নানাভাবে প্রতারণা করেছে, করছে। সেসব ক্ষেত্রেও অনধিকারী মন্ত্রদানকারী মানুষের মতো তাদের মধ্যেও গুরু বা ভগবানের শক্তি আবির্ভূত হয়নি বলেই তারা মানুষ হিসাবে রিপুর বশবর্তী হয়ে অসত্যের আশ্রয় নিয়ে প্রতারণা করছে। একটা কথা বারবার মনে রাখবি, মানুষরূপে প্রকৃত গুরু যিনি তাঁর মধ্যে কিছুতেই, কোনওভাবেই সত্যবিরুদ্ধভাবের প্রকাশ পাবে না। যেখানে এর বিপরীত কিছু দেখবি, সেখানে জানবি অপদার্থরা যা যা করে, তা সবই ওই মানুষগুলো করতে পারে মন্ত্রদান করে শিষ্যদের সঙ্গে।
তবে বেটা সংসারে গৃহীগুরু এবং সংসারের বাইরে সন্ন্যাসী গুরু কি মহৎ নেই, নির্লোভ নির্বিকার নির্লিপ্ত গুরু কি নেই, ছলচাতুরির আশ্রয় নেন না, মিথ্যা কথা বলেন না, এমন গুরুর কি অভাব আছে? না বেটা, অভাব নেই, অভাব ছিল না কোনওকালে। কালের প্রভাবে সংখ্যাটা অনেক কমে গেছে কিন্তু আছেই। যাদের কপাল ভাল তারা তাঁদের সান্নিধ্য পায়। অভাগাদের কপালে জোটে মনুষ্যরূপী ও গুরুনামধারী একশ্রেণির অপদার্থ।
সাধুবাবা থামলেন। বাসও থামল। কিছু যাত্রী উঠল আবার নামলও কিছু ! জানতে চাইলাম,
– বাবা, আমার প্রশ্ন হল, যারা এখন এই সমস্যায় পড়ে বিভ্রান্ত প্রতারিত, গুরুর উপর বিশ্বাস হারিয়েছে, হারাতে বসেছে কিংবা মনে গুরুর বিষয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় রয়েছে, তাদের তো ইহকাল পরকাল দুই-ই যাবে। তাদের সমস্যার সমাধান কি? কি করলে এই মানসিক যন্ত্রণার হাত থেকে তারা মুক্তি পাবে?
বাস চলার সময় এত আওয়াজ হচ্ছে যে খুবই অসুবিধে হচ্ছে কথা বলতে ও শুনতে। তবুও চালাতে হচ্ছে কথা। সাধুবাবা উত্তরে বললেন,
– এ সমস্যার সমাধান আছে কয়েকটা। যেমন ধর, মন্ত্রদাতা গুরুর উপর কোনও কারণে শ্রদ্ধা বিশ্বাস হারালে তাতে কিছু যায় আসে না। তার দেয়া মন্ত্র নিষ্ঠার সঙ্গে জপ করলে তাতে ফল হবে। সেখানে মন্ত্রদাতা দেহধারীর রূপ চিন্তা না করে, উপাস্য দেবতার রূপ চিন্তা করে, বিশ্বাস নিয়ে সাধনভজন করলে প্রতারিত শিষ্যরা মুক্তি পাবে, শান্তিও পাবে। এখানে মানসিকভাবে মন্ত্রদাতাকে পরিত্যাগ করলে কোনও দোষ হয় না। কারণ গুরুশক্তি তো মন্ত্রের মধ্যে নিহিত, ইষ্টের মধ্যেই তিনি, শুধু রূপের ভেদ হচ্ছে মাত্র। গড়ে ত্যাগ করা হচ্ছে না গুরুকে। সাধনে তাঁকেই লাভ করা যায়।
এখন কথা হল, প্রতারক মন্ত্রদাতার যদি মন্ত্রেও কোনও গোলমাল করে থাকে তাহলে বেটা, কিছু করার নেই। বিশ্বাস ভক্তি নিয়ে ওই মন্ত্র জপ করলে কল্যাণ কিছু হবে না। দীক্ষা নেয়া বা না নেয়া সমান। প্রতারিত হলেও মন্ত্র যদি ঠিক থাকে তাহলে বাঁচোয়া। তবে কথা হল, মন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ, না শুদ্ধ তা জানার কোনও উপায় নেই, কারণ এটা শুধুমাত্র মন্ত্রদাতা ও গ্রহীতার মধ্যেই যে সীমাবদ্ধ। এবার মন্ত্রটা অন্য কোনও গুরুর কাছে বলে শুদ্ধাশুদ্ধর বিচার করতে গেলে যদি সত্যিই শুদ্ধ মন্ত্র পেয়ে থাকে তাহলে সেখানে তা বলামাত্র নিষ্ফল হয়ে যাবে। আর অশুদ্ধ থাকলে তো তার একটা গতি হয়েই যাবে। সুতরাং এক্ষেত্রে কিছু করার নেই।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সাধুবাবা একটু থামলেন। একটু ভেবে আবার বলতে শুরু করলেন,
– বেটা, মন্ত্রদাতা গুরু যদি লম্পট ভণ্ড বা প্রতারক হয়, সে যদি সাধনা না করে, অথবা সাধনা করেও যদি তার ইষ্টপ্রাপ্তি না হয়, তাতে শিষ্যের কিছু যায় আসে না। শিষ্য মুক্ত হবে শুদ্ধ মন্ত্রের সাধনবলে, বিশ্বাসের প্রভাবে। কারণ সাধনবীজ তো রয়েছে শিষ্যের হাতে। সুতরাং হতাশার কিছু নেই। সাধনের উপরেই তো নির্ভর করে তার মুক্তি, মনের আনন্দ। বেটা, মন্ত্রই সব। কেমন জানিস, শয্যার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে যেমন নারী, তেমনই মনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে ইষ্টনাম।