Mythology

সাধুবাবার দেওয়া শর্ত মেনে বন্ধ্যা মায়ের গর্ভে যমজ সন্তান

সাধুবাবার চোখের মণিদুটো কালো নয়। একেবারে নীল। মনে হয় যেন কোনও বিদেশিনী নারীর চোখদুটো তুলে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে সাধুবাবার চোখে।

পুষ্করতীর্থের সরোবর বেশ বড়। প্রতিটা বাঁধানো ঘাট। এখন শীতকাল। লোভ মানুষের শীতগ্রীষ্ম বর্ষা কোনও ঋতুরই অপেক্ষা করে না। সময়েরও না। শারীরিক ক্লেশ তো নয়ই। এই কনকনে শীতেও লোভীর সংখ্যা কম নয়। এরা পুণ্যলোভী তীর্থযাত্রী। স্নান করছেন সরোবরে। কেউ কেউ ডুব দিয়ে উঠলেন, কাঁপছেন ঠকঠক করে। ডুব দিয়ে ওঠা মানেই সব পাপ গেল ধুয়েমুছে। শুরু হয় পুণ্যরূপী ঠকঠকানি। স্নানে স্থানীয় লোকের সংখ্যা কম। চেহারা দেখে এটা মনে হল।

সরোবরের এই ঘাটটি ব্রহ্মাঘাট নামে প্রসিদ্ধ। জল টলটল করছে একেবারে কাঁচের মতো। ঘাটের একপাশে বসে আছেন এক সাধুবাবা। সিঁড়ির চওড়া ধাপের ওপরে। পাশে কম্বল দিয়ে জড়ানো ছোট্ট একটা বোঁচকা। কমণ্ডলুও আছে একটা। গায়ে জড়ানো ফ্যাকাসে মোটা কম্বল। গলার ওপর থেকে মাথা পর্যন্ত বকসাদা চুলদাড়ি। জড়ানো কম্বলের জন্যে অর্ধেক চুলদাড়ি দেখা যাচ্ছে না। কানকে বেড় দিয়ে মাথায় ফেটি বাঁধা আছে একটা। তবে পাগড়ি নয়। তাই ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে চুলগুলো। গেরুয়াবসন যে পরা আছে তা দেখা যাচ্ছে ফাঁকফোকর থেকে কম্বল ঢাকা দেওয়া সত্ত্বেও। কাচাকাচির অভাব আছে বলেই মনে হল।


এমন অনেক সুন্দরী আছে যাদের চেহারা দেখলে বোঝার উপায় নেই, বারো মাসে তেরো পার্বণ তাদের লেগেই আছে। এই সাধুবাবার চেহারা সুন্দর, শক্তসমর্থ। দেখলে বোঝা যায় নিরোগ। তেরো পার্বণের বালাই নেই। ফরসা, সাধুবাবা বেশ ফরসা। চোখদুটো ফালাফালা টানা। জীবনে এই প্রথম দেখলাম সাধুবাবার চোখের মণিদুটো কালো নয়। একেবারে নীল। ময়ূরের কণ্ঠের‌ মতোই নীল। মনে হয় যেন কোনও বিদেশিনী নারীর চোখদুটো তুলে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে সাধুবাবার চোখে। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল, জটা নেই।

সাধুবাবার সামনে জ্বলছে কয়েক টুকরো কাঠ, ধুনী নয়। আগুন তাপছেন, জব্বর ঠান্ডা পড়েছে, তাই। আমি সোজা গিয়ে বললাম একেবারে মুখোমুখি হয়ে। ভাবটা এমন করলাম যেন বেশ ঠান্ডা পড়েছে। আগুন তাপতে বসেছি। হাত তাপতে তাপতে ঝট করে প্রণাম করলাম সাধুবাবাকে। হঠাৎ এমনটা করায় কিছু বলারই সুযোগ পেলেন না। হাতদুটো জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে মুখে বললেন,


– রামজি তোকে বৈরাগ্য দিক, আনন্দে রাখুক।

ঠান্ডার মধ্যে বিড়িতে টান দিলে আলাদা আমেজ আসে একটা। তাই কিছু জিজ্ঞাসা না করে বিড়ি বের করলাম পকেট থেকে। এগিয়ে দিলাম সাধুবাবার দিকে। আপত্তি না করেই নিলেন। সামনে জ্বলতে থাকা আগুনে ধরালেন। টানতে টানতে জিজ্ঞাসা করলেন,

– বেটা, কোথায় থাকিস?

ধোঁয়া লাগছে চোখে। একটু জ্বালা জ্বালাও করছে। চোখের জল মুছতে মুছতে বললাম,

– থাকি কলকাতায়। এখানে এসেছি বেড়াতে। বেশ ঠান্ডা পড়েছে আজ। আপনাকে আগুন তাপতে দেখে চলে এলাম।

সাধুবাবা জানতে চাইলেন,

– তোর চুলদাড়ি দেখে মনে হয় তুই ব্রহ্মচারী। তুই কি সংসারে আছিস না সংসার ত্যাগ করেছিস?

হেসে ফেললাম। কথাটা শুনে বললাম,

– না বাবা, বিয়ে-থা করিনি এখনও। বয়েসও তো হয়নি বিয়ের। আপনাদের মতো অল্প বয়সে বিয়ে হয় না আমাদের। সংসারেই আছি।

কথাটা শুনে মাথাটা দোলাতে লাগলেন। সাধুবাবার চোখেও ধোঁয়া লাগছে। মাঝেমাঝে চোখ রগড়াচ্ছেন দুহাত দিয়ে আবার আগুন তাপছেন। এবার সুযোগ পেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, এই তীর্থে আছেন কতদিন?

ধোঁয়া এড়াতে মাথাটা এপাশ ওপাশ করে বললেন,

– এখানে আমি মাসখানেক। আর কয়েকদিন পর চলে যাব বৃন্দাবনে।

জানতে চাইলাম,

– বৃন্দাবনে কি ডেরা আছে আপনার?

ঘাড় নাড়লেন প্রথমে পরে মুখে বললেন আকাশ দেখিয়ে,

– না বেটা, আমার কোথাও ডেরা নেই। আকাশের নিচে ভগবানের এতবড় ডেরা থাকতে আর কোথায় ডেরা করব বলতে পারিস? বিষয়বুদ্ধির আগমন ঘটলে তবেই সাধুদের ডেরা করার ইচ্ছা জাগে। আমার ওসবে ইচ্ছা হয়নি কখনও, হয়ও না। এই ভাল আছি। খোলা আকাশ, উন্মুক্ত বাতাস, বেটা এর আনন্দই আলাদা, অসীম। ডেরা করা মানেই বদ্ধ হলাম। চার দেয়ালের মায়া কেটে বেরিয়ে আসা মুশকিল।

এবার সংসারীদের উদ্দেশ্য করে বললেন,

– মানুষের যখন চারটে দেওয়াল হল তখনই সাংসারিক দুঃখভোগের আয়োজনও বেশ ভালোভাবে গুছিয়ে নিয়ে বসল। পাকাপাকিভাবে। তারপর যে কি হয় তা তো তুই ভালভাবেই দেখতে পাচ্ছিস। কোনও সাধুর ডেরা মানে বিয়ের পর গৃহীদের মতো অশান্তিময় জীবনের শুরু হল। একটা সাধু একটা ডেরা করল মানে একগাদা প্রসব করল। এবার রোগ ভোগ শোকদুঃখ বেদনা তো তাকে পীড়িত করবেই। তাই ওসব করায় মন যায়নি আমার।

সাধুবাবার কথায় সুযোগ এসে গেল কথার। বললাম,

– ওসবে মন যায়নি ভাল কথা। তবে বাবা এ পথে মনটা এল কেমন করে, ঘরই বা ছাড়লেন কেন?

সাধুবাবা যে বৈষ্ণব প্রণাম করার সময় মুখে ‘রামজি’ উচ্চারণ করায় মনে হয়েছিল। কোনও বিরক্তির চিহ্ন নেই মুখখানায়। উত্তর দিলেন সহজভাবে,

– কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে বা সাংসারিক কোনও কারণে গৃহত্যাগ করিনি আমি। বেটা, মানুষের জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে প্রতিটা নারীপুরুষের মনে রামজি কোনও না কোনও সময় ‘কিঞ্চিৎ’ বৈরাগ্যের উদয় ঘটান। প্রতিটা মানুষ, সে যত সুখভোগে বা দুঃখেই থাকুক, কোনও না কোনও সময় ইচ্ছা অনিচ্ছায় বলে, ‘ধুর, সংসার আর ভাল লাগছে না।’ এটা বলবেই, আসলে সে বলে না। রামজি ওই কিঞ্চিৎ বৈরাগ্যের সৃষ্টি করে অন্তরে তার অজান্তে। সে নিজেও বোঝে না, ভাবেও না একবার। বেটা, মনে ওই বৈরাগ্য উদয় হওয়া মাত্রই বুদ্ধি তখন নিশ্চয় অনিশ্চয় স্থির করে। বুদ্ধি অনিশ্চয়তায় মানুষকে সংসারী করে। অনিত্য বস্তুজীবনের দিকে টেনে নিয়ে আবদ্ধ করে সংসারে। বুদ্ধি বৈরাগ্যকে নিশ্চয় করলে মানুষ সংসার ছাড়ে সন্ন্যাসী হয়। নিশ্চয় হচ্ছে পরমপ্রাপ্তির পথ। বেরিয়ে পড়ে তাকে লাভ করার উদ্দেশ্যে। সংসারের কোনও বন্ধনই তাকে বাঁধতে পারে না। এগিয়ে চলে নির্লিপ্ত মহাজীবনের পথে। আমার বুদ্ধিকে রামজি নিশ্চয় করেই এনেছেন এ পথে।

একটু থামলেন। বারকয়েক ফুকফুক করে টান দিলেন বিড়িতে। তারপর ফেলে দিয়ে আগুনের জ্বলন্ত কাঠটা একবার নাড়িয়ে বললেন,

– তবে বেটা এখানে কথা আছে একটা। রামজির কৃপা হলে বুদ্ধি অনিশ্চয় সংসারজীবনেও মানুষের মধ্যে অনুরাগ সৃষ্টি করে। সেই অনুরাগে মানুষ সংসারে থেকেও বৈরাগ্যময় জীবনযাপন করতে পারে।

এখানে বসামাত্রই সাধুবাবা যে এমনভাবে কথা বলবেন, ভাবতে পারিনি। মনের আনন্দে আবার প্রণাম করলাম। বেশ খুশি হলেন। মুখ দেখে বুঝলাম প্রসন্নতায় ভরে উঠেছে মুখখানা। উদাহরণ দিয়ে বললেন,

– বেটা জলে উৎপন্ন হয় পদ্ম। ওই একই জলে সৃষ্টি হচ্ছে জোঁক অথচ দেখ, মানুষের মনে সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটায় পদ্ম। আপন সৌন্দর্যে ভরিয়ে তোলে মানুষের মনকে। সুগন্ধে আকর্ষণ করে ভ্রমর মৌমাছিকে। অথচ ওই জলে উৎপন্ন জোঁক রক্ত চুষে খায় মানুষের। বেটা ঠিক সেইরকম, একই বুদ্ধি কারও মনে বৈরাগ্যের সৃষ্টি করে নিয়ে যায় সৃষ্টির রহস্যসন্ধানে অজানা অজ্ঞাতজীবনের উদ্দেশ্যে। আবার ওই একই বুদ্ধিতে উৎপন্ন হয় অনিশ্চয় সংসারজীবনের। উৎপন্ন করে ভোগী গৃহস্থের।

কাঠের আগুন থেকে ধোঁয়া উঠছে। বেশি লাগছে সাধুবাবার চোখে। মাথাটা একবার বাঁ-পাশে আর একবার ডানপাশে করছেন ধোঁয়া এড়াতে। এবার বাঁ-হাতটা চোখে ঘষে প্রশ্ন করলেন,

– বেটা সংসারে আছিস ‘লিখাপড়া’ তো কিছু করেছিস নিশ্চয়ই।

মাথাটা নাড়ালাম, তবুও বললাম,

– হ্যাঁ, বাবা সামান্য কিছু করেছি।

একথা শুনে প্রসন্নমনে বললেন,

– যে বিদ্যায় সত্যকে জানা যায় তাকেই প্রকৃত বিদ্যালাভ বলে। যে বিদ্যায় জগতের সত্যকে জানা যায় না, সেটা বিদ্যা নয়, তেমন লেখাপড়া করে কিছু লাভ হয় না পারমার্থিক জীবনে। তবে সংসারজীবনে তো কিছু লাভ হয়ই। এবার বল বেটা লেখাপড়া তো করেছিস, বিদ্যালাভ হয়েছে?

একটু অস্বস্তিবোধ করলাম কথাটা শুনে। বললাম,

– না বাবা, সত্যকে জানার মতো বিদ্যালাভ আমার হয়নি। কি করলে, কেমন করে সত্যকে জানা যায় দয়া করে বলবেন বাবা?

আগুনে হাত তাপতে তাপতে বললেন,

– বেটা, সংসার ও সাধুজীবনে একমাত্র ত্যাগ ছাড়া সত্যকে জানার আর কোনও পথ আছে বলে আমার জানা নেই।

জানতে চাইলাম,

– সংসারে থেকে সংসারীদের মানসিক দিক থেকে ত্যাগ করা তো সুকঠিন ব্যাপার।

উত্তরে সাধুবাবা বললেন,

– হাঁ বেটা, ঠিকই বলেছিস। গৃহত্যাগী হয়েও তো অনেক সাধুই তা পারেনি, সংসারীদের পক্ষে এতো বড় কঠিন কাজ। যে পারে, সে সত্যকে জানতে পারে। যে পারে না, সে পারে না।

হঠাৎ বলে বসলেন,

– একটু চা খাবি বেটা, বানাবো? এক ভক্ত একটু দুধ দিয়েছে আমাকে। যদি খাস তো বানাই।

সাধুবাবার সঙ্গে আরও মজে, আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে জানার আশায় ‌সম্মতি জানালায় ঘাড় নেড়ে। পাশে একটা পাত্রে দুধ ছিল খানিকটা। উঠে পড়লেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে নিয়ে এলেন চা, চিনি কাছেরই একটা দোকান থেকে। দুটো ইট এনে তার উপরে পাত্রটা বসিয়ে কোনওরকমে বানিয়ে ফেললেন চা। আমাকে দিলেন একটা ভাঙা এ্যাল‌ুমনিয়ামের বাটিতে। দুজনেই পান করলাম। কনকনে ঠান্ডায় এই সকালে বেশ ভালই লাগল। জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, সাধুসন্ন্যাসীরা সংসারের বাইরে হলেও তাঁদেরও তো একটা কর্তব্য আছে মানুষের জন্য কিছু করা। আপনি কি মনে করেন সাধুদের কোনও কর্তব্যই নেই। ভিক্ষে করে কোনওরকমে পেট ভরালেন আর ভগবানকে ডাকলেন, এটাই কি সব বলে মনে করেন?

একথা শুনে মুহুর্তমাত্র দেরি করলেন না সাধুবাবা। হাত নাড়িয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে মুখে বললেন,

– না না বেটা, তা কখনও মনে করি না। নিশ্চয়ই আছে, সাধুদের কর্তব্য আছে বইকি। সেটা কি জানিস? যত সংসারী মানুষ দেখবি প্রতিটা মানুষই ‘ভিতু’-র এক একটা প্রতিমূর্তি। যা কিছু ভয় তা একমাত্র সংসারীকেই। যেমন ধর, রোগশোকের ভয়, সম্মানযশ ধনসম্পত্তিহানি বা নষ্টের ভয় থেকে শুরু করে একেবারে শেষ ভয় মৃত্যু পর্যন্ত। এককথায় সমস্ত কিছুর ভয়ই আচ্ছন্ন করে রেখেছে সংসারীদের। গৃহীদের এই ভয় থেকে নির্ভয় করাই প্রতিটা সাধুসন্ন্যাসীর একমাত্র পরম কর্তব্য।

জানতে চাইলাম,

– এই কর্তব্যটুকু কি সমস্ত সাধুসন্ন্যাসীরা পালন করে থাকেন? সকলেই কি এই কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন বলে মনে হয় আপনার। এ পথে আপনি তো আছেন বহু বছর ধরে। নিজে সাধু হয়েও দেখেছেন অসংখ্য সাধু। করেছেন সাধুসঙ্গও।

এবার একটু উদাসীনতার সুর ভেসে উঠল কণ্ঠে,

– সাধুদের কর্তব্য সম্পর্কে সকলেই সচেতন কিনা তা বলতে পারব না। এপথে যারা আসেন তাদের অন্তত এটা জানা উচিত। না জানলে বলব এ পথে তার উচিত হয়নি আসা। আর এই কর্তব্য সাধুরা পালন করে কি করে না তা বলতে পারব না আমি।

প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, বহু সাধুসন্ন্যাসীদের সঙ্গে কথা হয়েছে। যেমন হচ্ছে আপনার সঙ্গে। তাতে দেখেছি যেটুকু তার প্রেক্ষিতে ধারণা হয়েছে সাধুসন্ন্যাসীদের দেহ ও মনোগত যেসব ব্যাপার, যেমন কাম ক্রোধ লোভ ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে তেমন কোনও পার্থক্য দেখি না গৃহীদের সঙ্গে। একজন শুধু সংসারে আর একজন বাইরে। পার্থক্য তো শুধু এই-ই দেখি। ভগবানকে তো ভাবছে দুজনে। এ ব্যাপারে আপনার কি মত?

কথাটা শুনে একগাল হেসে ফেললেন। কাঠের আগুনে খুব ধোঁয়া উঠছে দেখে কমণ্ডলুর জল একটু ছিটিয়ে দিলেন। ধোঁয়া কমল কিছুটা। এবার হাসিমাখা মুখে বললেন,

– হাঁ বেটা, কথাটা তুই ঠিকই বলেছিস তবে এটা অংশত ঠিক। দেহগত ব্যাপার যেটা, যেমন ধর কামের কথা। এ বিষয়ে সাধুসন্ন্যাসী ও সংসারীদের মধ্যে পার্থক্য নেই এতটুকু। কারণ ইন্দ্রিয়ের কাজ ইন্দ্রিয়ই করে। তার প্রভাব নারীপুরুষ সকলের ক্ষেত্রেই সমান। তবে সাধুসন্ন্যাসীদের সংযমী জীবনের জন্যে উগ্রতাটা গৃহীদের মতো নয়। যার যেমন তপ তার সেই অনুসারে। আমি নিজে যেটা বুঝি, গৃহীদের মতো কিছু কিছু চিন্তাভাবনা যে সাধুদের মাথায় খেলা করে না, এমন নয়। কখনও কখনও করে বইকি। তবে গৃহীদের মতো অত প্রকট নয়। গড়বিচারে যদি একটা হিসাবে আসিস তাহলে দেখবি, গৃহী ও সাধুসন্ন্যাসীতে পার্থক্য নেই কিছু। একজন ঘরের বাইরে, একজন ভিতরে। পার্থক্য শুধু যে বাসনাবিহীন, ইন্দ্রিয় সংযমী, অর্থ ও নারীকে যার আকর্ষণ নেই সেই-ই সাধু। সে সংসারে থাকুক, বা না থাকুক।

এবার সংস্কৃতে একটা শ্লোক আউড়ে হিন্দিতে তার মানে করে সাধুবাবা বললেন,

– বেটা, সুন্দরী স্ত্রী আর রতিশক্তি একইসঙ্গে এ দুটো যেমন খুব কম পুরুষের আছে, তেমন বাসনাবিহীন সাধুসন্ন্যাসী খুব কমই আছে বলতে পারিস।

অতীত জীবনের কথা জানতে জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, কত বছর বয়েসে আপনি গৃহত্যাগ করেছেন, আর এখন বয়েসই বা কত হল?

আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে পরে তাকালেন জ্বলন্ত কাঠের দিকে। বললেন,

– বয়স যখন বছর সাতেক তখন আমি ঘর ছেড়েছি। এখন আমার ৮০/৮১ হবে বোধ হয়।

বিস্মিত হয়ে বললাম,

– বলেন কি বাবা। এত অল্প বয়সে গৃহত্যাগ। কেন করলেন, কিসের তাড়নায় দয়া করে বলবেন?

ঘাটে একের পর এক তীর্থযাত্রী আসছে স্নান করতে। কেউ কেউ ফিরে যাচ্ছে স্নান সেরে।‌ আমরা দুজনে এমন একটা জায়গায় বসে আছি যেখানে সকলেরই চোখ পড়বে। তাই প্রত্যেকটা স্নানযাত্রী একবার করে দেখতে দেখতে চলে যাচ্ছে। উত্তর দিলেন প্রসন্ন মনে,

– বেটা, মানুষ কি তার নিজের ইচ্ছায় চলতে পারে, না কিছু করতে পারে। বিধাতার নিয়মে যা বাঁধা ছিল, তাই-ই হয়েছে। আমার এপথে আসার পিছনে রয়েছে পূর্বনির্দিষ্ট লিখন। বলি শোন, তখন আমার জন্ম হয়নি। পরে শুনেছি মা আর গুরুজির মুখে। মায়ের বিয়ের পর কেটে গেল দশ-দশটা বছর। কোনও সন্তান হল না। শান্তি নেই মায়ের মনে। মেয়েদের সন্তান না হলে মনের যে দশা হয়, মায়েরও হল ওই একই দশা। পাড়া প্রতিবেশী এমনকি বাড়ির লোকেরা পর্যন্ত মায়ের মুখ দেখত না সকালে উঠে। যেতে পারত না কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে। সকলে বলত বন্ধ্যামেয়ে। মানসিক কষ্টের আর শেষ ছিল না মায়ের। বাবাও চিন্তা করতে লাগল আবার বিয়ের কথা। সেকালে দুপাঁচটা বিয়ে তো কোনও ব্যাপারই ছিল না। এখনকার মতো তো আর তখন নয়।

এবার ছোট্ট পাতলা একটা কাঠের টুকরো দিলেন আগুনে। খুব আলতোভাবে দিলেন যেন সাজানো আগুন ভেঙে না পড়ে। একবার তাকালেন মুখের দিকে। বললেন,

– মায়ের মনের অবস্থা যখন চূড়ান্ত খারাপ তখন হঠাৎ একদিন এক ‘মহাত্মা’ এলেন বাড়িতে। এসেছিলেন ভিক্ষে করতে। মা কিছু চাল আর সবজি নিয়ে এসে দাঁড়ালেন মহাত্মার সামনে। মাকে দেখামাত্র তিনি বললেন, বেটি, তোর মনে বড় দুঃখ, সন্তান হয় না। তাই না? কথাটা শুনে মা আমার কান্নায় ভেঙে পড়লেন মহাত্মার পায়ে। মহাত্মা বললেন, ‘বেটি তোকে দুটো সন্তান আমি দিতে পারি একটা শর্তে, যদি কথা দিস একটা আমাকে দান করবি তবেই দেব’।

কথাটা শুনে মা তো অবাক। সন্তান হবে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পা-দুটো জড়িয়ে ধরলেন মহাত্মার। কাঁদতে লাগলেন অঝোরে। রাজি হলেন যে কোনও শর্তে সন্তান চাই-ই। মহাত্মা প্রতিজ্ঞা করালেন মাকে, কথার যেন নড়চড় না হয়। এবার ঝোলা থেকে কিছু জড়িবুটি বের করে দিলেন মায়ের হাতে। খেতে বললেন নিয়ম করে। বৃদ্ধ মহাত্মা চলে গেলেন বাড়ি থেকে। যাবার সময়ে বলে গেলেন যথাসময়ে আসবেন তিনি।

একটু থামলেন। বিড়ি চাইলেন একটা। কাঠের আগুনে ধরিয়ে দিলাম সাধুবাবার হাতে। টানতে টানতে বললেন,

– জানিস বেটা, অদ্ভুত ব্যাপার। একটা মাসও গেল না। সন্তান এল বিয়ের দশ বছর পর। আনন্দের বন্যা বয়ে গেল বাড়িতে। ঠিকঠিক সময়ে যমজ সন্তান হল মায়ের। আমি আর দাদা। অল্প কিছু সময়ের ছোট বড়। বেড়ে উঠলাম দুজনে। বয়েস যখন আমার সাত তখন হঠাৎ একদিন বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালেন সেই মহাত্মা। মায়ের চিনতে কোনও অসুবিধে হল না, ভুলতেও পারেননি তাঁর দয়ার কথা। আর প্রতিজ্ঞার কথা তো মায়ের মনেই ছিল। দাদাকে রেখে বাবা মা আমাকে স্বেচ্ছায় তুলে দিলেন মহাত্মার হাতে। দাদা হলেন সংসারী আর আমি হলাম সাধু। ভগবানের কি খেলা তাই না বেটা!

একটু থেমে বললেন বিড়িতে টান দিয়ে,

– সেই মহাত্মা আমাকে সোজা নিয়ে গেলেন হরিদ্বারে। পরে দীক্ষা দিয়ে তিনিই হলেন ইহকাল পরকালের ত্রাণকর্তা গুরুজি। এবার বলত দেখি বেটা, মানুষ কি সত্যিই তার নিজের ইচ্ছামতো জীবনপথে চলতে পারে, না কিছু করতে পারে? আমি কি ভেবেছিলাম এ পথে আসব?

জানতে চাইলাম,

– যখন মহাত্মা আপনাকে নিয়ে যান মায়ের কাছ থেকে যাবার মুহুর্তে তো মা কেঁদেছিলেন এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে কথা আমি জানতে চাইছি না। জানতে চাই, মায়ের স্নেহ ভালোবাসা ছেড়ে, খেলার সঙ্গী দাদা, বাবাকে ছেড়ে যাওয়ার ওই সময় আপনার মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল, তা কি এখনও স্মরণে আছে আপনার?

এ প্রশ্নে ভুরু কুঁচকে একটু ভাবলেন। ফিরে গেলেন সুদূর অতীতে। কিছুক্ষণ। আবারও ফিরে এলেন। বললেন,

– বেটা তখন আমি কিছুই বুঝি না। মনের অবস্থা আমার কি হয়েছিল তা বলতে পারব না এখন। তখন তো আমি একেবারেই ছেলেমানুষ। এটুকু মনে আছে খুব কেঁদেছিলাম। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছিল। কিন্তু কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কিভাবে চলবে, কি হবে আমার, আর কখনও বাড়ির মুখ দেখতে পাব না, মায়ের কাছে আর ফিরব না, এসব কোনও ভাবনাই আমার মনে আসেনি, এটা এখনও বেশ মনে আছে। আর এটাও বেশ খেয়াল আছে, বিবশভাবেই বেরিয়ে পড়েছিলাম সেই মহাত্মা গুরুজির সঙ্গে।

আবার জানতে চাইলাম,

– ঘর ছেড়ে বেরনোর পর মায়ের জন্যে মনটা খারাপ হত না? আর কখনও বাড়িতে গেছিলেন? বাড়ি কোথায় ছিল আপনার?

উত্তরে নির্বিকার সাধুবাবা বললেন,

– প্রথম প্রথম মায়ের জন্যে মনটায় খুব কষ্ট হত। লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম। গুরুজি সান্ত্বনা দিতেন। নানা কথায় ঘুরিয়ে দিতেন মনটাকে। একইসঙ্গে দিতেন মায়ের মতো স্নেহ আদর ও ভালোবাসা। আর নিয়ে বেড়াতেন এ তীর্থে সে তীর্থে। ধীরে ধীরে মনটা আমার বসে গেল। ভুলে গেলাম সকলের কথা। বাড়ির সমস্ত স্মৃতি লোপ পেয়ে গেল অদ্ভুতভাবে, বছর খানেকের মধ্যে। উত্তরপ্রদেশের কোনও এক গ্রামে আমার জন্ম। কোথায় কোন গ্রামে কিছু চিনতে পারব না, বলতেও পারব না। ঘর ছাড়ার পর ঘরও আমাকে ছেড়ে গেছে তাই আর ঘরে যাইনি।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন‌। জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, বছরখানেকের মধ্যে মা বাবা দাদা বাড়ির সকলের কথা আপনার স্মৃতি থেকে লোপ পেয়ে গেল। এটা কি করে সম্ভব?

একটু উদাসীনতার সুরে বললেন,

– বেটা, তখন তো আমি কিছু বুঝিনি, ভাবিনিও। এখন বুঝি তখন গুরুজি আমাকে ‘হজম’ করে নিয়েছিলেন বলে সম্ভব হয়েছিল। বেটা, শিষ্যকে যদি গুরু আত্মসাৎ করে না নেন তাহলে শিষ্যের কল্যাণ তো কিছু হয়ই না, মুক্ত হয় না মন, মুক্তিও নয়।

Show Full Article

One Comment

  1. ওঁ ত্রম্বকং য্জামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্
    উর্বারূপমিব বন্ধনান মৃতৌমোক্ষীয় মামৃতাত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button