এই শ্যাম আর রাধাকুণ্ডে এত বাঙালি যে, মনেই হয় না বাংলার বাইরে এসেছি। এখানে অনেক সাধুদর্শন হয়েছে, কথাও হয়েছে। অধিকাংশই বৈষ্ণব সাধু। সাধুদের হাট বসেছে যেন। একটা চায়ের দোকানে বিশ্রামের অবসরে বসে চা খাচ্ছি। ভাবছি সেইসব সাধুদের কথা। যাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত কথা হয়েছে। কি অদ্ভুত জীবন তাদের! খাওয়ার চিন্তা নেই, থাকার চিন্তা নেই, পরনের বস্ত্রটুকু নিয়েও চিন্তা নেই এতটুকু। এক অনন্ত শক্তির দর্শন অপেক্ষায়, তাঁর সঙ্গে চিরমিলনের অপেক্ষায় চলছে তাদের ত্যাগ তিতিক্ষাময় এক কঠোর তপস্যার জীবন। কাউকে জিজ্ঞাসা করেছি, কি পেলেন? উত্তরে মুখে কোনও কথা নেই। শুধু চোখের জলে বুক ভাসিয়েছেন আনন্দে। কেউ বলেছেন, ‘কি পাইনি বলতে পার বাবা? ভগবান আমাকে সব দিয়েছেন। আমি আর কিছুই চাই না।’
কিন্তু আমার এই চর্মচক্ষুতে দেখছি, ভগবান তাকে কাঁধে একটা কম্বল, ঝুলি, ছেঁড়া নেংটি ছাড়া আর কিছুই দেননি। অথচ কথায় পাওয়ার এত পূর্ণতা যে, আর কিছুই চাই না তার। এর পরে কিছু পেলে বোঝা বাড়বে তাই হয়ত তার এই না চাওয়া। জীবনে আর চাই না কিছু, এমন মানুষ সংসারে আমার দেখায় পাইনি কোথাও। কাউকে দেখেছি, তাঁকে পাওয়ার কি ব্যাকুল আর্তি। কেউ বা বলেছেন, ‘বেটা, একদিন না একদিন মিলবেই মিলবে।’
এক একজন সাধুমহাত্মার গৃহত্যাগের কাহিনিও বড় অদ্ভুত। কেউ স্ত্রীর সঙ্গে সামান্য কথাকাটাকাটি করে, কেউ সংসারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে, কেউ বা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন আত্মানুসন্ধানে। এমনতর নানান বৈচিত্র্যময় ঘটনার মধ্যে দিয়ে তাদের জীবনপ্রবাহের স্বাভাবিক গতির মোড় ঘুরে বয়ে গেছে অন্য পথে, অন্য খাতে।
চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম। হাতে চায়ের গ্লাসটা রয়ে গেছে। দু-এক চুমুকের বেশি পেটে যায়নি। সদ্যসদ্য সাধুসঙ্গ করে এসেছি। তাদের নেশা ধরানো কথায় একেবারে মশগুল হয়েছিলাম। নইলে চট করে আমি অন্যমনস্ক হই না। হিন্দিভাষী দোকানদারের কথায় আমার তন্ময়তা কাটল,
– বাবু, হাতের চা যে জুড়িয়ে জল হয়ে গেল।
একটু লজ্জিতভাবে বললাম,
– ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি একটু ঠাণ্ডা চা-ই খাই।
দোকানে বসে আছেন আরও কয়েকজন। এদের চেহারা দেখে মনে হল প্রত্যেকেই স্থানীয়। দোকানদার চায়ের গ্লাসে চামচ দিয়ে ঠকঠক করতে করতে বললেন,
– বাবু, আজ দু-দিন ধরে আপনাকে লক্ষ্য করছি, যে মহাত্মাকে পাচ্ছেন তার পিছনেই পাগলের মতো ঘুরছেন। কখনও হাঁটতে হাঁটতে চলেছেন কথা বলতে বলতে, কখনও দেখেছি কুণ্ডের পাড়ে বসে কথা বলতে। সাধুমহাত্মাদের সঙ্গ করতে আপনার ভাল লাগে বুঝি?
– হ্যাঁ ভাই, ওই একটা নেশাই আছে আমার।
চায়ের গ্লাস খরিদ্দারের হাতে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন,
– বাবু, এই রাধাকুণ্ড আর শ্যামকুণ্ড বৃন্দাবনের মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র ও জাগ্রত তীর্থ। ভাগ্যবান সাধু, গৃহীরা আজও রাধারানীর দর্শন পায়, শুনতে পায় নূপুরের ধ্বনি। সেইজন্যেই তো অসংখ্য সাধুমহাত্মাদের আগমন ঘটে রাধাকুণ্ডে। বারো মাস তাদের এখানে আসায় কোনও বিরাম নেই। তবে বাবু সব সাধু ‘সাচ্চা’ নয়। আমি দেখেছি, অনেক সাধু-সাধু হয়েছেন পেটের দায়ে। তাদের আচার আচরণ দেখেই আমার এই অভিজ্ঞতা। বেশিরভাগই ভিখমাঙা সাধু। প্রকৃত মহাত্মারা বাবু কারও কাছে ভিখ মাঙে না। সকলে তার কাছে গিয়ে দিয়ে আসে। কারও কাছে তার চাইতে হয় না।
এই পর্যন্ত বলে দোকানদার একজনের কাছ থেকে চায়ের দাম নিতে নিতে বললেন,
– বাবু, আপনি তো সাধু ভালবাসেন, শ্যামকুণ্ডের পাড়ে রঘুনাথদাস গোস্বামীর ভজনকুটিরের পাশে এক মহাত্মা আছেন। ওখান থেকে তিনি কোথাও যান না। আজ দিনতিনেক হল এসেছেন রাধাকুণ্ড শ্যামকুণ্ড দর্শনে। উনি ফলাহারী বাবা। শুধুমাত্র ফল খেয়েই থাকেন। এখান থেকে কবে চলে যাবেন, কোথা থেকে এসেছেন কিছুই জানি না। আপনি ইচ্ছা করলে একবার ওই মহাত্মার দর্শন করে আসতে পারেন।
কথাটা শোনামাত্র আনন্দে মনটা আমার ভরে গেল। নিজেরই অবাক লাগল, এখানে কয়েকদিন ধরে আছি অথচ এই মহাত্মার দর্শন পাইনি। কোনওভাবেই তার সংবাদটা কানে আসেনি। মনেমনে দোকানদারকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালাম। দেরি না করে উঠে দাঁড়ালাম। চায়ের দামটা দিয়ে হনহনিয়ে চললাম কুণ্ডের পাড় ধরে। কয়েক মিনিটের মধ্যে এসে গেলাম ভজনকুটিরের সামনে। দেখলাম কুটিরের বাইরে বসে আছেন এক বৃদ্ধ সাধুবাবা। সামান্য ফরসা গায়ের রং। টানাটানা চোখ। পথচলতি সাধুদের গায়ের রং ফরসা, এমনটা খুব কম দেখেছি। মাথায় মাঝারি লম্বা জটা। সামান্য ভুঁড়ি আছে। চেহারাটা এইভাবে বললে ভাল হয়, নীরোগ যুবতী মেয়ের হাতের বাহু যেমন পরিপুষ্ট গোলগোল হয় অথচ মোটা নয়, এমন বাহুযুগল সাধুবাবার। পরনে সাদাকাপড় যাতে ময়লার ছোপ পড়েছে আবছা। কাপড়টা পরা বাউলরা যেভাবে পরেন সেই ভাবে। একটা কাপড় ভাঁজ করে পরা, কাছা দেয়া নয়। ঝোলাটোলা কিছু নেই। প্রসন্ন উজ্জ্বল কমনীয় মূর্তি। সাধুবাবার সামনে বসে রয়েছেন তিনজন। বয়স্ক বাঙালি একজন, হিন্দিভাষী বয়স্ক দুজন। এটা মনে হল প্রথম দর্শনে চেহারা দেখে। সাধুবাবার মূর্তি যে হিন্দিভাষীর তা বলাই বাহুল্য।
আমি কাছে গিয়ে আর দাঁড়ালাম না। বসে পড়লাম সাধুবাবার বাঁপাশে। আমার উপস্থিতিতে আর সকলে বিরক্ত হলেন কিনা বুঝলাম না। তবে সকলেই বসলেন একটু নড়েচড়ে। আমি বসা অবস্থায় প্রণাম করলাম। সাধুবাবা হাতজোড় করে নমস্কার জানালেন। আগে কি কথা চলছিল জানি না। আমি যাওয়ার পর হিন্দিভাষী একজন হাতজোড় করে অনুরোধের সুরে সাধুবাবাকে বললেন,
– মহারাজ, আপনি কৃপা করলেই আমার বউ-এর রোগটা ভাল হয়ে যাবে। দয়া করে একটা কিছু দিন মহারাজ, নইলে আমি কিছুতেই ছাড়ব না।
ভদ্রলোক অনুরোধ করছেন আর সাধুবাবার একই কথা, ‘বেটা, আমার দেয়ার মতো কিছু নেই। রোগ হয়েছে চিকিৎসা কর। আমি কি ডাক্তার যে ওষুধ দেব।’
এইভাবে সমানে কাটল প্রায় মিনিটদশেক। এমন অস্বস্তিতে পড়ে বাঙালি ভদ্রলোক উঠে চলে গেলেন। তিনি কি জন্য এসেছিলেন জানি না। নাছোড়বান্দা হওয়া সত্ত্বেও সাধুবাবার কাছ থেকে কিছু পেলেন না। হতাশ হয়ে উঠে গেলেন হিন্দিভাষী দুজনে। এটাই মনেমনে চাইছিলাম। সকলে চলে যেতে সাধুবাবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আমার খুশির তো অন্ত রইল না। পরে জানতে পেরেছিলাম, ভদ্রলোকের স্ত্রী পঙ্গু হয়ে গেছেন বাতে। অনেক চিকিৎসা আর অঢেল টাকা খরচ করেও ভাল হয়নি। ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন, ও রোগ আর আরোগ্য হবে না। কোনও মহাত্মার কৃপায় যদি ভাল হয় এই আশায় তিনি সাধুবাবাকে প্রায় এক ঘণ্টার উপর অনুরোধ করেছেন। যখন দেখলেন কিছু পাওয়ার আশা নেই, তখন উঠে গেলেন দুঃখিত মনে। আমাকে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন,
– বেটা, আমি কি ডাক্তার যে ওষুধ দেব! আসলে ওরা কষ্ট পায় বলে সাধুসন্ন্যাসীদের কাছে আসে নানান সমস্যা নিয়ে। ভাবে অনেক ক্ষমতা আছে আমাদের। ভগবানের নাম ছাড়া আর সম্বল তো কিছু নেই। সুতরাং আমার মতো যারা, তাদের কাছে গেলে তো হতাশ হতেই হবে।
সাধুবাবা একটু থামলেন। এতক্ষণ পর আমার সুযোগ এল কথা বলার। প্রথমে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, এখন আপনার বয়েস কত হবে?
বাবু হয়ে বসেছিলেন সাধুবাবা। দু-চারজন স্থানীয় ও কিছু তীর্থযাত্রীর আনাগোনা ছাড়া তেমন ভিড় নেই শ্যামকুণ্ডের পাড়ে রঘুনাথদাসজির ভজনকুটিরের সামনে। বয়েস জানার আগ্রহ দেখে বললেন,
– কেন বেটা, হঠাৎ আমার বয়েস জানতে চাইছিস?
উত্তরে বললাম,
– তেমন কোনও উদ্দেশ্য নেই। শুধু জানার ইচ্ছাতেই জিজ্ঞাসা করা।
সাধুসন্ন্যাসীরা কেউ তাদের বয়েস নিয়ে মাথা ঘামান না এ আমি জানি। তাই বয়েস জিজ্ঞাসা করলে প্রথমেই ভুরু আর কপাল কুঁচকে যায়। স্মৃতির ভাঁড়ারে টান ধরে। এই সাধুবাবাও ব্যতিক্রম নয়। আগেকার মা বাবাদের অধিকাংশেরই সাল তারিখ রাখার বালাই ছিল না। জিজ্ঞাসা করলে উত্তর মেলে, ‘কেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তুই আমার পেটে তিন মাস।’ এছাড়াও মায়েদের বয়েস বলার আরও অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে একটা, ‘শ্যামবাবুর মেয়ে সবিতা আর তুমি সাতদিনের ছোট বড়।’ সবিতার বয়েস কত? ‘তা তো জানি না।’ আন্দাজ? মা জানালেন, ‘কত আর হবে, চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ কিংবা দু-এক বছর এদিক ওদিক হতে পারে। তার বেশি হবে বলে মনে হয় না।’ এমন মায়ের সন্ন্যাসী ছেলের কাছে বয়েস জিজ্ঞাসা করলে তো ভুরু একটু কোঁচকাবারই কথা। তিনি বললেন,
– আমার বয়েস আন্দাজ আশি থেকে পঁচাশির মধ্যে।
কথাটা শুনে বেশ অবাক হয়ে গেলাম। এমন সুন্দর চেহারায় অত বয়েসের কোনও ছাপই নেই। দেখলে মনে হবে পঞ্চান্ন থেকে ষাট। জানতে চাইলাম,
– বাবা, আপনি নাকি ফলাহারী, শুধুমাত্র ফল খেয়েই থাকেন?
ঘাড়টা নাড়িয়ে বললেন,
– হাঁ বেটা, আমি ফলাহারী। ফল আর জল ছাড়া এ দেহের জন্য অন্য কিছু গ্রহণ করি না।
শুধুমাত্র ফল আহার করে বেঁচে আছেন এমন সাধুবাবা জীবনে এই প্রথম পেলাম। এর আগে কখনও ফলাহারীর দর্শন পাইনি। দোকানদারের মুখে শোনার পর অনেক প্রশ্ন এসেছে মনে। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, কত বছর ধরে ফল খেয়ে আছেন, কটা করে খান, পেট ভরে খান তো?
কথার শেষে লাগোয়া প্রশ্ন শুনে মুখের দিকে তাকালেন। ভাবটা এমন, ‘কি হবে জেনে? এ সব জেনে কিসসু লাভ হবে না।’ তবুও বললেন,
– বেটা, আমার গৃহত্যাগ হয়েছিল বছর আঠারো বয়েসে। তার এক বছর পর দীক্ষা হল এক পাহাড়িয়া গুরুর কাছে। দীক্ষার পর প্রায় বছরদশেক ‘চাউল রোটি’ খেয়েছি। তারপর গুরুজি একদিন বললেন, ‘নিরামিষ সাত্ত্বিক আহারে দেহমনে রিপুর বেগ সংযত হয়। রিপুর প্রভাব সম্পূর্ণ বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। নিরামিষ ভোজনের চেয়ে আরও ভাল হয় যদি শুধুমাত্র ফল আহার করা যায়। তাতে আরও দ্রুত রিপুর তাড়না কমে দেহমন একেবারে শুদ্ধ ও মুক্ত হয়।’
গুরুজির এই কথার পর নিরামিষ আহার ছেড়ে দিয়ে ফল খেতে শুরু করলাম। অচিরেই ফল খাওয়ার ফলটা বুঝতে পারলাম। প্রথম প্রথম খুব অসুবিধে হত। পেট ভরেই খেতাম। ধীরে ধীরে আহারে সংযম আনলাম। এখন তো সারা দিনরাতে মাত্র দুটো ফল হলেই আমার হয়ে যায়। গড়ে ধর আজ প্রায় ৫০/৫৫ বছর ধরে শুধু ফলের উপরেই রয়েছে দেহটা।
একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম সাধুবাবার কথা শুনে। কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে তিনি বললেন,
– বেটা, সাধুসন্ন্যাসীদের জীবনে এটা একটা ব্রতপালন বা এক ধরনের তপস্যাও বলতে পারিস। এ ছাড়া কোনও কোনও সাধুসন্ন্যাসী দেহকে রক্ষা করেন শুধুমাত্র দুধপান করে। আর কোনও কিছুই দেহের জন্য গ্রহণ করেন না। তারা দুধাধারী নামে সাধুসমাজে পরিচিত। এক ধরনের সাধু আছেন, যাঁরা নিরামিষ আহার গ্রহণ করেন কিন্তু কোনও খাদ্যে লবণ দেন না। আলুনি খাবার খান। এরা অলুনা সাধু নামে প্রসিদ্ধ। তবে এমন সাধুর সংখ্যা খুবই কম।
সাধুবাবার কথা শুনছি অবাক হয়ে। এখন এখানে আর কেউ নেই। একভাবেই বসে আছেন। তীর্থযাত্রীদের অনেকে আসছেন। স্নান করছেন শ্যামকুণ্ডে। স্থির হয়ে আমিও বসে আছি সাধুবাবার মতো। এবার বললেন,
– বেটা, এ আর কি রে, আমাদের পেটে তো তবু কিছু পড়ছে। এমন তপস্বীও আছেন, যাঁরা মাসের পর মাস একটা তুলসী নইলে বেলপাতা মুখে দিয়ে একটু গঙ্গাজল পান করে বেঁচে রয়েছেন বছরের পর বছর। এই তপস্বীরা খাদ্য গ্রহণ করেন তবে কেউ তিনমাস, কেউ বা ছয়মাসে একবার। ইন্দ্রিয়গুলিকে বশে আনতে তপস্যার কি শেষ আছে বেটা।
কত ভাগ্য আমার, আজ এক নতুন ধরনের সাধুবাবার সঙ্গ করছি। আনন্দ ও আবেগে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। সঙ্গেসঙ্গে হাতজোড় করে নমস্কার জানালেন তিনি। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, আপনি থাকেন কোথায়?
সাধুবাবা জানালেন,
– আমার বেশিরভাগ সময়টা কাটে পাহাড়ে। ওখানকার পরিবেশ এখন কিছুটা কলুষিত হয়েছে ঠিকই তবে সমতলের মতো এতটা নয়। পাহাড়ে শীত কমলে ত্রিযুগীনারায়ণে (হিমালয়ে) থাকি। আহারের চিন্তা নেই। দু-বেলা দুটো ফল জুটেই যায়।
এবার সাধুবাবা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কি করি, কোথায় থাকি, বৃন্দাবনে কি জন্য এসেছি, কে কে আছে আমার, কি উদ্দেশ্য নিয়ে ভ্রমণ করি ইত্যাদি। প্রতিটা প্রশ্নেরই উত্তর দিলাম। পরে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, আপনি ঘরসংসার ছেড়ে কেন এলেন এই সাধুজীবনে?
প্রসন্ন মনে বললেন,
– বেটা, ভগবানের ইচ্ছায় মানুষের জীবনপ্রবাহের গতি বয়ে যায় একএক ভাবে। সংসারে কেউ আসে স্ত্রীসন্তানদি নিয়ে সংসার করতে, কেউ আসে অর্থোপার্জন ও সঞ্চয় করতে কিন্তু ভোগ করতে নয়, কেউ আসে সারাটা জীবন দুঃখময় আনন্দহীন জীবনযাপন করতে, কেউ আসে সুখসাগরে ভেসে বেড়াতে। ভগবান কার জীবনের গতি কোন দিকে বয়ে নিয়ে যাবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন, তা কি কারও জানা আছে? আমার জীবনকে তিনি এইভাবে, এই পথে নিয়ে যাবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন, ওর কি অন্যথা হওয়ার উপায় আছে? তবে এ পথে তো মানুষ হুট্ করে আসে না, কোনও একটা ঘটনাকে উপলক্ষ করে তিনি তাঁর নিজের ইচ্ছাই পূর্ণ করেন।
সংসারে মা বাবা ভাই বোন সকলেই ছিলেন। অভাব ছিল না কোনও কিছুর। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। আনমনে বেরিয়ে পড়লাম ঘর ছেড়ে। কেন বেরলাম, কি জন্যে বেরলাম, কি উদ্দেশ্যে, কিছুই জানা ছিল না। সাধু হব এমনটাও ভাবনাতে ছিল না কখনও। পথে বেরিয়ে পথের নেশায় পথ চলতে চলতে একদিন গুরু মিলে গেল। সাধনপথের সন্ধান পেলাম। তীর্থের পর তীর্থ পরিক্রমা চলতে থাকল। মানস সরোবর কৈলাস থেকে শুরু করে ভারতের সমস্ত তীর্থপরিক্রমা করেছি সাধনজীবনের প্রথমপর্বে। তিব্বতের লাসাতেও ছিলাম মাসছয়েক। সে আজ বহুকাল আগের কথা। গুরুজিই নিয়ে গেছিলেন আমাকে। গুরুজির সঙ্গে এক লামার পরিচয় ও হৃদ্যতা ছিল। সেই সূত্রেই ওখানে যাওয়া এবং থাকা। গুরুজির মুখে শুনেছি, ওই লামার সঙ্গে গুরুজির পরিচয় হয় বুদ্ধগয়ায়। তিনি কয়েক বছর ছিলেন গয়াতে। এসেছিলেন বুদ্ধের তপস্যাক্ষেত্র দর্শন করতে। এইভাবেই বেটা দেখতে দেখতে ‘ম্যায় সাধু বন্ গয়া’।