মানসসরোবর কৈলাসে যাওয়া অনেক সাধুর সঙ্গ করেছি কিন্তু কোনও সাধুবাবা লাসায় গেছেন, সেখানে ছিলেন কিছুদিন, এমন কথা কেউ বলেননি। বিস্মিত হয়ে শুনছিলাম সাধুবাবার গৃহত্যাগের পর বৈচিত্র্যময় ভ্রমণজীবনের কথা। লাসায় থাকাকালীন কি করতেন, কেমন করে সময় কাটাতেন, কি খেতেন এবং সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অনেক কথা জেনে নিলাম কথাপ্রসঙ্গে। তবে তিব্বতের লাসা সম্পর্কে যেসব ভয়াবহ কাহিনি বইতে পড়েছি, সাধুবাবার মুখে অতটা ভয়ের কোনও লক্ষণ আমি ফুটে উঠতে দেখিনি। ফলাহারীবাবার সঙ্গে কথা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় বত্রিশবছর আগে। তখন তিনি বলেছিলেন, তখন থেকে প্রায় ষাটবছর আগে লাসায় যাওয়া তাঁর জীবনকথা। এখন থেকে মোটামুটি বিরানব্বই বছর আগের কথা। কথাপ্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন,
– বেটা, সাধারণ মানুষের লাসায় যাওয়া ও থাকাটা সত্যিই অসুবিধাজনক। বলতে পারিস একরকম অসম্ভবই। তবে লাসার লামাসমাজ ভারতীয় সাধুসন্ন্যাসী যোগীদের সম্মানের চোখেই দেখে। গুরুজির পূর্ব পরিচিত লামার আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম বলে কোনও অসুবিধে হয়নি। তিনি এদেশ থেকে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলেন। ওই লামা সামান্য হিন্দি শিখেছিলেন বলে কথা বলতে তেমন কোনও অসুবিধে হয়নি পথে, ওখানেও।
এখন লাসাপ্রসঙ্গ ছেড়ে জানতে চাইলাম,
– বাবা, আপনার বাড়ি ছিল কোথায়?
উত্তরে জানালেন,
– আমার জন্মস্থান আর বাড়ি ছিল নাগপুরের একটা গ্রামে। এখন ওখানে কি আছে, কে আছে না আছে কিছুই জানি না। কারণ গৃহত্যাগের পর আর বাড়িতে যাইনি কোনওদিন।
শ্যামকুণ্ডের ধারে রঘুনাথদাসজির ভজনকুটিরের সামনে বসে কথা হচ্ছে। এখন আর কেউ এসে বিরক্ত করছে না। আমি আর সাধুবাবা মুখোমুখি কথা হচ্ছে দুজনের। প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, আগেকার দিনের সাধুমহাত্মারা সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন। বলতে গেলে তাদের ভগবানের মতো দেখত, সম্মান ও শ্রদ্ধা করত। কিন্তু বর্তমানে খুব কম সংখ্যক ছাড়া অধিকাংশের উপরেই মানুষের আগের মতো শ্রদ্ধা বিশ্বাসটা নেই। ভগবান ভাবা তো দূরের কথা, সংঘবদ্ধ কিছু প্রতিষ্ঠানের সাধুরা ছাড়া আর সব সাধুরাই বলতে গেলে অবহেলিত। সাধুদের বিশ্বাসযোগ্যতা বা শ্রদ্ধা হারানোর মূলে সাধুরা, না সাধারণ মানুষ, কারা দায়ী বলে মনে হয় আপনার?
প্রশ্নটা শুনে সাধুবাবা একটু হাসলেন। প্রসন্ন হাসি। বললেন,
– বেটা সম্মান শ্রদ্ধা বিশ্বাস এগুলো মানুষের কাছ থেকে জোর করে আদায় করে নেওয়ার মতো কোনও বস্তু নয়। এগুলো ব্যক্তিমনের শুদ্ধ প্রতিফলন। সেখানে কোনওভাবে কেউ আঘাত পেয়ে থাকলে সে নিশ্চয়ই আহত হয়ে ওগুলো হারিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সেই সব সাধুরাই দায়ী, যারা আহত করেছে মানুষের মন আর বিশ্বাসকে। তার জন্যে গোটা সাধুসমাজটা দোষী নয়। সততা, নিঃস্বার্থ দান, অলসতা মুক্ত, সমস্ত বিষয়ে আসক্তিহীন, অটুট ধৈর্য আর নির্বিচারে ক্ষমা, এই ছ’টা গুণ আয়ত্ত করতে না পারলে কোনও মানুষের পক্ষেই ভগবানের সান্নিধ্যে যাওয়া সম্ভব নয়। এর কোনও একটা যদি কেউ ঠিকঠিক মতো আয়ত্ত করতে পারে তাহলে তার মধ্যে বাদবাকি গুণের আবির্ভাব হয় আপসে। এই গুণগুলো সাধুদের মধ্যে থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। যার মধ্যে নেই, ভগবান তার থেকে অনেক দূরে। এইসব গুণ সাধুদের সম্মান শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস বাড়ায় মানুষের কাছে। এই গুণের কপট অধিকারী সাধুরা সাময়িক সম্মানিত ও শ্রদ্ধাভাজন হলেও জীবনের কোনও না কোনও সময় তা হারিয়ে ফেলে, প্রকটিত হয় কপটতা। তবে একশ্রেণির মানুষ আছে, যারা কখনও সাধুসন্ন্যাসীদের সত্যমিথ্যা কিংবদন্তির উপর শ্রদ্ধা বিশ্বাসভক্তি করে আবার তা হারায়, এমন মানুষের সংখ্যা বেশি। সুতরাং এদের কথা, ওসব ঠুনকো শ্রদ্ধা বিশ্বাসের কথা ছেড়ে দে। যে গুণে মানুষ তাঁকে লাভ করতে পারে সেই গুণের প্রকাশ যদি কোনও সাধুসন্ন্যাসীর মধ্যে ঘটে, সে কি কখনও অবহেলিত হতে পারে? তবে এখানে একটা কথা আছে। অনেক সময় অত্যন্ত বিষয়ী বা সংসারীরা সাধুসন্ন্যাসীদের কাছে আসে বিভিন্ন সমস্যা আর কামনাবাসনা নিয়ে। তারা বাক্য আদায় করে নেয় নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। অনেকক্ষেত্রে সাধুসন্ন্যাসীরা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বাক্য দেয়। পরে হয়ত সে বাক্য ফলপ্রসূ হল না, তখন মানুষের পরোক্ষে একটা অশ্রদ্ধা বা অবিশ্বাস বাসা বেঁধে ফেলে অন্তরে। সব সাধু তো আর বাকসিদ্ধ নয়। অনেকসময় সাধুসন্ন্যাসীরা মানসিক বলবুদ্ধি বা সান্ত্বনা দিয়ে থাকেন গৃহীদের বাক্যের মাধ্যমে। সেই আশাব্যঞ্জক কথা বাস্তবে রূপায়িত না হলে তখন একটা অবিশ্বাসের ভাব সৃষ্টি হয় বক্তা সাধুসন্ন্যাসীর উপরে। এর জন্য সাধুরাই দায়ী, যেহেতু তারা আশা দিচ্ছেন। অবশ্য দুঃখী মানুষরা এসে কাতর হয়ে পড়লে সাধুদের তাৎক্ষণিক এটুকু না করে কোনও উপায়ও থাকে না।
একটানা এই পর্যন্ত বলে থামলেন। এদিক ওদিক একবার দেখে নিলেন। কয়েকজন যাত্রীও এর মধ্যে ভজনকুটিরে এসে প্রণাম করে গেছেন। সাধুবাবা লক্ষ্য না করলেও কথা শোনার ফাঁকে এ সবই লক্ষ্য করেছি আমি। মিনিটখানেক চুপ করে থাকার পর বললেন,
– বেটা, মানুষের আশা যে কি ভীষণ, এর আকৃতি যে কত বড়, কত ভয়ংকর তা তুই এতটুকুও কল্পনা করতে পারবি না। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় পর্বত হিমালয়, তার চেয়ে অনেক বড় সমুদ্র। সমুদ্রের চেয়ে অনেক অ-নে-ক বিশাল হল উন্মুক্ত আকাশ। আকাশের চেয়ে বিশালত্বে অনেক বেশি পরমব্রহ্ম। ব্রহ্মের চেয়ে জগতে বড় কিছু আর নেই। কিন্তু বেটা, এই ব্রহ্মও যেন হার মেনেছে আশার কাছে। মনুষ্যজাতির আশা আকাঙ্ক্ষা, কামনা বাসনা পরমব্রহ্মের চেয়েও অসীম অনন্ত, নাগালের বাইরে।
সাধুবাবা প্রথম থেকেই প্রসন্ন। ভাবতে পারিনি এমন সহজভাবে কথা হবে। তাই যে জিজ্ঞাসাটা মাথায় আসছে সেটাই করছি। জানতে চাইলাম,
– বাবা শাস্ত্রে আছে, যারা আপনাদের মতো তারাও বলেন, সার্বিক বিষয়ে সংযমতার কথা। এ তো খুব কঠিন কথা। সংসারে আছি। সংযম করতে বললেন, চট করে সংযম করলাম তা তো হয় না, কারও পক্ষে সম্ভবও নয়। এমন কিছু বলুন, সংসারে থেকে সেটা করলে যেন সংযমতার পথ সুগম হয়।
কথাটা শুনে সাধুবাবা তাকালেন মুখের দিকে। একটা হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠল চোখেমুখে। বললেন,
– বাহ্ বেটা বাহ্, বেশ প্রশ্ন করেছিস তো। তাহলে বলি শোন, সংসারে বিষয়ী মানুষের সংখ্যাটাই বেশি। বিষয়ী বলতে, যারা শুধু আমার আমার করছে, কিছুই হল না, কিছুই পেলাম না, কি হবে কি হবে, অভাব নেই অথচ আরও পাওয়ার বাসনা, আরও হোক এমন ভাবনা যার মনকে প্রায়ই পীড়িত করে রেখেছে, সবকিছু থাকা সত্ত্বেও অসন্তুষ্ট চিত্ত যাদের, তাদের বেটা বিষয়ী বলে। সংখ্যাটা এত বেশি যে, এদের এড়িয়ে চলাটা খুব কঠিন। বিষয়ী নারীপুরুষ সংক্রামক ব্যাধির মতো। সঙ্গ করলেই বিষয় বাসনায় আক্রান্ত হতে হবে। এদের সঙ্গ ত্যাগ করলে সংযমতার পথ অনেক সুগম হয়। বেটা, মধুহীন ফুলকে যেমন মৌমাছি, ফলহীন গাছকে যেমন পাখিরা পরিত্যাগ করে, তেমনই ঈশ্বরে ভজনহীন বিষয়ীদের সংস্পর্শ ত্যাগ করা উচিত, যারা সত্যিই সংযমী হতে চায় তাদের। সংসারী হয়ে এ রকম সংসারীদের সঙ্গ সব সময় পরিত্যাগ করা উচিত। সাধুদেরও কলুষিত করে এইসব বিষয়ীদের সঙ্গ, যদি না খুব ভজনশীল সাধু সে হয়।
একটু থামলেন। একটু চিন্তা করে আবার বললেন,
– বিষয়ী নারীপুরুষ আর বকের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। সরোবর বা জলাশয়ে দেখবি সুন্দর প্রস্ফুটিত পদ্মের সৌন্দর্য ফেলে রেখে বক যেমন ঘাড় ঘুরিয়ে, ঠোঁট বেঁকিয়ে মাছ বা খাদ্যের খোঁজ করে, তেমনই বিষয়ী মানুষ কামনার বশবর্তী হয়ে পরমানন্দময় অনন্ত জীবনের অন্বেষণ না করে প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে কদর্য ভোগ, অর্থ – তারই চিন্তা করে। সেইজন্য এদের সঙ্গ পরিত্যাগ করা ভাল।
প্রশ্ন করলাম,
– বাবা, বিষয়ীদের যদি সাধুরাও পরিত্যাগ করেন তাহলে তারা কার সঙ্গ করে বিষয়ের আসক্তি থেকে মুক্ত হবে? বিষয়ীদের পরিত্যাগ করা কি সাধুদের ধর্ম?
কথাটুকু শেষ হতে না হতেই বললেন,
– বেটা, যারা বিষয়াসক্ত তারা চট করে সাধুসঙ্গ তো করে না, মনের দিক থেকে সাধুসন্ন্যাসীদের পাত্তাও দেয় না, বরং অবজ্ঞাই করে। তবুও যারা সাময়িকভাবে সাধুদের কাছে আসে, তারা সাধুসঙ্গ করতে আসে না। আসে কোনও সমস্যায় পড়ে তার সমাধানের উদ্দেশ্যে। এক কথায় তাদের সাধুসঙ্গটা বলতে পারিস স্বার্থসিদ্ধির। মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির ভাবনাটা তাদের থাকে না। সুতরাং এমনিতে তারা নিজেরাই পরিত্যক্ত হয়ে রয়েছে, সাধুরা আর নতুন করে পরিত্যাগ করবে কেমন করে! তবে বিষয়ীদের মধ্যে কিছু নারীপুরুষ আছে, যাদের কয়েকদিনের সাধুসঙ্গ লোক দেখানো। এটা এক ধরনের বিলাসিতা বলতে পারিস। অনেক সময় সাধুদের কাছে আসে তারা সময় কাটাতে হাতে সময় থাকলে। হাজার কাজের মধ্যেও যারা সময় করে নিয়ম মতো সাধুসঙ্গ করে, সেটাকেই তো প্রকৃত সাধুসঙ্গ বলে।
একটু থামলেন। সামান্য একটু ভাবলেন। বললেন,
– বেটা, চাষের অনুপযুক্ত জমিতে চেষ্টা করলেও ভাল ফসল হয় না, কারণ ওই জমির এমনই গুণ, যা হতে দেয় না। বিষয়ীদের ক্ষেত্রে ওই একই কথা। তাদের যতই জ্ঞানের কথা বল না কেন, নিজের বিষয়-স্বার্থসিদ্ধির কথাটুকু ছাড়া আর কিছুই সে গ্রহণ করে না, কারণ তার প্রবৃত্তিটা গ্রহণ করতে দেয় না, বুঝলি?
হঠাৎ সাধুবাবা জিজ্ঞাসা করলেন,
– বেটা, তোর কি ‘দীক্সা’ হয়েছে?
ঘাড় নেড়ে জানালাম হয়েছে। হুট করে প্রসঙ্গ পাল্টে দীক্ষার কথা জিজ্ঞাসা করায় বললাম,
– বাবা, হঠাৎ দীক্ষার কথা জিজ্ঞাসা করলেন কেন?
এবার উত্তরে বললেন,
– বেটা, মানুষের সাধনভজন জপ তপস্যা সবই নির্ভর করে দীক্ষার উপরে। পাথরে বীজ বপন করলে তা যেমন ফলপ্রসূ হয় না, তেমনই অদীক্ষিতদের জপপূজাদি নিষ্ফল হয়। দীক্ষা সিদ্ধিলাভে সহায়তা করে সদ্গতিও করায়। মৃত্যুর পর পিশাচত্ব দূর হয় না অদীক্ষিতদের। সেইজন্যই জিজ্ঞাসা করলাম তোকে।
সাধুবাবার এ কথায় একের পর এক প্রশ্ন এল মনে। আমার কোনও ব্যাপারে কোনওদিনই তর সয় না। কাউকে কিছু বলতে হলে এখনই বল, কাউকে কিছু দিতে হলে এখনই দাও, কাউকে মারতে হলে বিকেলে নয়, এখনই মার। যা কিছু তা পরে নয়, এখনই হোক। কোনও ব্যাপারে ঝুলে থাকতে রাজি নই। সাধুসঙ্গের ক্ষেত্রে তো নয়ই। কথা শেষ হওয়ামাত্র জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা আপনি বললেন, যাদের দীক্ষা হয়নি তারা জপতপ পূজাদি করলে তাতে কোনও ফল হবে না বা হয় না। অর্থাৎ ভগবানের নাম করাটা ভস্মে ঘি ঢালার সমান। আরও বললেন, এদের মৃত্যুর পর পিশাচত্ব দূর হয় না। আমার দুটো প্রশ্ন, অদীক্ষিতদের জপতপ কেন ভস্মে ঘি ঢালার সমান হবে? কেন তাদের মৃত্যুর পর পিশাচত্ব দূর হবে না? অদীক্ষিত সৎলোক যারা, তাদের কি হবে, পিশাচত্ব দূর হবে না কেন, অপরাধটা কোথায়? দীক্ষিত হলেই তার পিশাচত্ব দূর হবে বললেন। দীক্ষিত অসংখ্য মানুষকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি জানি, যারা বিশেষ বিশেষ নামী সম্প্রদায় থেকে দীক্ষিত। গুরুও বরেণ্য ও সর্বজন পরিচিত। সেই সব শিষ্যদের মধ্যে আছে লম্পট, প্রতারক, নিজের স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অন্য নারীতে আসক্ত, অসৎ পথে ঠকিয়ে অর্থোপার্জন করছে স্রোতের মতো। এই সব পাপকর্মের জন্য দীক্ষিত হয়েও কি এদের পিশাচত্ব দূর হওয়া উচিত বলে মনে করেন আপনি?
প্রশ্নটা শোনামাত্র আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন একদৃষ্টিতে। মুখখানা গম্ভীর নয়, উজ্জ্বল ও প্রসন্নতার হালকা হাসিতে ভরা। সাধুবাবার চোখের দৃষ্টিতে, এরকম একটা প্রশ্ন করব ভাবতে পারেননি, এমন ভাবটাও বেশ ফুটে উঠেছে। চুপ করে রইলেন। আমিও সময় দিলাম ভেবে উত্তর দেয়ার জন্যে। যদিও জানি এর উত্তর এই বৃদ্ধের জানা আছে, আমার তো নেই। মিনিটখানেক চুপ করে থাকার পর বললেন,
– বেটা, শাস্ত্রের কথা সহজভাবে বললাম অথচ এমনভাবে প্যাঁচ মেরে প্রশ্ন করলি যার মানে দাঁড়ায় সব উল্টো। সংসারীরা যে কেন অশান্তি ভোগ করে তার প্রমাণ তোকে সামনে রেখে সকলকে দেয়া যায়। সামান্য কথাকে পেঁচিয়ে নিয়ে যে মানুষ কত জটিলতার সৃষ্টি করে, কত অশান্তি ভোগ করে, তার কোনও সীমা পরিসীমা নেই।
একটু থামলেন। চুপ করে রইলাম। এবার সাধুবাবা জিজ্ঞাসার উত্তর শুরু করলেন বেশ কোমল অথচ গম্ভীর কণ্ঠে,
– বেটা, অদীক্ষিতদের জপপূজাদি নিষ্ফল হয় বলেছি। কথাটা ঠিকই বলেছি। তুই মানে বুঝেছিস অন্য। কেউ ভগবানের নাম করলে তার কল্যাণ হবেই হবে। সেখানে কোনও মার নেই। তবে পৃথিবীতে এসে সংসারে থেকেও মানুষের একমাত্র কাম্য হওয়া উচিত ভগবানকে লাভ করা। তাঁকে লাভ করতে হলে কিছু নিয়ম আছে। সেই নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনও কাজ করলে তাতে কোনও ফল হয় না। বিভিন্ন দেবদেবীকে আকর্ষণ ও লাভ করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু মন্ত্র আছে বীজ সংযুক্ত। যেমন ধর, এক জায়গায় বহু নারীপুরুষ বসে আছে। তার মধ্যে থেকে তোর একজনকে দরকার কথা বলার জন্য। তুই যদি এখন অতগুলো লোকের মধ্যে ‘এই যে দাদা’ বা ‘এই যে দিদি’ শুনছেন বলিস, তাহলে তোর এই ডাকের উত্তর কে দেবে এবং কাকে উদ্দেশ্য করে ডাকছিস, সেটা কে বুঝবে? কিন্তু কারও সঠিক নাম যদি তোর জানা থাকে তাহলে হাজার ভিড়ের মধ্যেও ঠিক ঠিক নাম ধরে ডাকলে সে উত্তর দিয়ে কাছে এসে দাঁড়াবে কি না-বল্! দাঁড়াবেই। বেটা, দীক্ষার মন্ত্রটাও ঠিক সেই রকম। অদীক্ষিতদের তাঁর নামটা অর্থাৎ যে মন্ত্র জপে তিনি আসবেন তা জানা থাকে না। তাই শুধু শিব শিব, দুর্গা দুর্গা, কালী কালী করলে কোনও ফল হয় না। নামে কল্যাণ হয় তবে মুখ্য উদ্দেশ্য অর্থাৎ তাঁকে লাভ হয় না। জপতপ নিষ্ফল হয় আমি সেই উদ্দেশ্যেই কথাটা বলেছি। আর তপস্যা তো নির্ভর করে মানুষের দীক্ষায় লাভ করা মন্ত্রের উপর। সেই মন্ত্র যদি কারও জানা না থাকে অর্থাৎ অদীক্ষিতরা কি নিয়ে জপ বা তপস্যা করবে?
সাধুবাবা থামলেন। পরিতৃপ্তির একটা হালকা হাসি ফুটে উঠল মুখখানায়। মিনিটখানেক চুপ করে রইলেন, আমিও। জনাতিনেক যাত্রী এসে দাঁড়ালেন আমাদের সামনে। দেখে মনে হল সকলেই হিন্দিভাষী। দুহাত জোড় করে নমস্কার করলেন সাধুবাবাকে। তিনিও প্রতি নমস্কার জানালেন তাদের। পায়েপায়ে তারা চলে যেতেই শুরু করলেন,
– বেটা, দীক্ষিত লোকের মৃত্যুর পর সদ্গতি হওয়ার বিষয়ে অনেক কথা বলার আছে। সেটা সম্পূর্ণ পরলোকতত্ত্বের কথা। সে সব কথা তুই বুঝবি না আর বুঝলেও তোর মন বিশ্বাস করবে না। সে এক আলাদা জগতের বিশাল আলোচনা। আমি অত গভীরে যাব না। খুব অল্প কথায় বলি। দীক্ষিত লোকের স্বাভাবিক মৃত্যু হলে মৃত্যুর পর সূক্ষ্মদেহকে শুধুমাত্র বায়ু আশ্রয় করে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে হয় না। মৃত্যুর সঙ্গেসঙ্গে যে সম্প্রদায় থেকে দীক্ষিত সেই সম্প্রদায়ের পরম্পরা কোনও গুরু, যারা ইতিপূর্বে দেহরক্ষা করেছেন অথবা দীক্ষিত শিষ্যের গুরু যদি দেহরক্ষা করে থাকেন কিংবা পরলোকগত গুরুপরম্পরার কোনও গুরুর আদেশে মুক্ত কোনও শিষ্য এসে দীক্ষিত মৃতশিষ্যের সূক্ষ্মদেহকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় পরলোকে তার কর্মানুসারে বিভিন্ন স্তরের কোনও একটিতে। অর্থাৎ দীক্ষায় গ্রহণ করা নামের গুণে মৃত্যুর পর পরলোকে আশ্রয়হীন অবস্থায় তাকে ঘুরে বেড়াতে হয়না কখনও সঙ্গীহীন অবস্থায়, নইলে মুক্ত নয় এমন কোনও আত্মার সঙ্গী হয়ে কষ্ট ভোগ করে অর্থাৎ সদ্গতি প্রাপ্ত হয় না।