এই পর্যন্ত বলে মিনিটখানেক থামলেন। একটু নড়েচড়ে বসে সাধুবাবা আবার বললেন,
– এবার বলি তোর সৎলোকের কথা। পৃথিবীতে কোনও মানুষই সৎ হতে পারে না বাহ্যত সৎ মনে হলেও। কারণ সত্ত্ব তমো ও রজো এই তিনটে গুণ মানুষের থাকেই। সত্ত্বগুণের প্রভাবে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কিছু না কিছু সৎ কর্ম মানুষ করেই। তমো আর রজো গুণের প্রভাবে কিছু না কিছু অসৎ বা পাপকর্মও সারাজীবনে মানুষ কমবেশি করে থাকে। পাপকর্ম সব সময় যে প্রত্যক্ষ হবে, তা নাও হতে পারে। সেটা মানসিকভাবেও হতে পারে। যেমন ধর মুহুর্তের জন্য কারও ক্ষতির চিন্তা করা, পরস্ত্রীর সৌন্দর্যে আকর্ষিত হয়ে মুহুর্তের জন্য তাকে পাওয়া বা ভোগের বাসনা জাগা, এমন অসংখ্য মানসিক অপরাধ বা পাপ মানুষ করে থাকে তমো ও রজোগুণের প্রভাবে। বাহ্যত দেখা যায় না ঠিকই তবে এগুলোও পাপকর্মের অন্তর্গত। সুতরাং তোর দৃষ্টিতে কাউকে সৎ বলে মনে হলেও ভগবানের হিসাবটা অন্য। অতএব ‘অদীক্ষিত সৎলোক’ বলতে তুই যা বুঝিস সেটা ঠিক বোঝা নয়, বুঝলি?
এবার তোর প্যাঁচমারা কথার উত্তরে বলি, ‘মৃত্যুর পর পিশাচত্ব দূর হয় না অদীক্ষিতদের’। একথাটা যে নির্মম সত্য তার কারণ তোকে একটু আগেই বলেছি। কিন্তু আমি কি একথা বলেছি ‘মৃত্যুর পর দীক্ষিতদের পিশাচত্ব দূর হবে?’ তা বলিনি। বেটা, জন্মান্তরের কোনও সংস্কারে মানুষ অনেক সময় সিদ্ধ গুরুবংশে সদগুরুর আশ্রিত হয় বটে, তবে দীক্ষিত হয়েও নারীপুরুষ জন্মান্তরের উৎকট সংস্কারে, তুই যেটা বলেছিস, লম্পট প্রতারক চরিত্রহীন এমনকি নানা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পাপ কর্ম করতে পারে, অনেকে করেও থাকে। সেখানে বেটা ভগবানের রাজত্বে কারও ক্ষমা নেই। সদগুরুর কাছে দীক্ষিত হলেও শিষ্যের পাপ বা অসৎ কর্মের জন্য গুরু পৈশাচিক জীবনযাপন করাতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না।
মানুষের অপরাধের ক্ষেত্রে দীক্ষিত আর অদীক্ষিতের সাজার কোনও তফাৎ নেই ভগবানের দরবারে। তবে দীক্ষিত অপরাধীদের সাজার পরও সদ্গতি হয় কারণ গুরুর সঙ্গে ইষ্টনামের সুতোয় শিষ্য বাঁধা থাকে বলে। বেটা, আশ্রিত মানুষ অন্যায় করে সাজা পেলেও সে কখনও আশ্রয়হীন হয় না, আশ্রয় আছে বলে। আশ্রয়হীন সাজা পেলেও সে অনাশ্রিতই থাকে যেহেতু সে কারও আশ্রয়ে নেই। বেটা, ইহকাল পরকালের আশ্রয় বলতে একমাত্র গুরুকেই বোঝায়, বুঝলি?
কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই জনা দশ-বারো হিন্দিভাষী তীর্থযাত্রী এসে দাঁড়ালেন আমাদের সামনে। সকলেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন সাধুবাবাকে। বয়েসে ছোট বলে আমাকে তাঁরা নমস্কার জানালেন হাতজোড় করে। আমিও জানালাম। অদ্ভুত ব্যাপার, অতগুলো তীর্থযাত্রীর মধ্যে থেকে একজন বৃদ্ধা দুটো মাঝারি আকারের আপেল পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করলেন। সাধুবাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আমিও অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে হাসলাম। তীর্থযাত্রীরা সকলে চলে যেতে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, সকাল থেকে কিছু খেয়েছেন?
হাসিমাখা মুখে সাধুবাবা জানালেন,
– না বেটা, কিছু খাইনি। এই তো রাধারানী আজ জুটিয়ে দিলেন সারাদিনের খাবার।
সঙ্গেসঙ্গেই আবার জিজ্ঞাসা,
– বাবা, সারাদিনে দুটো ফলই আহারের জন্য প্রয়োজন। তাতেই আপনার চলে যায়! আমার জিজ্ঞাসা, দুটো ফল প্রয়োজন, এল মাত্র দুটোই। এটা কি করে সম্ভব? তিনটেও তো দিতে পারত অথবা ফলের বদলে অন্য কিছু? তা না দিয়ে শুধু ফলই দিল কেন, দয়া করে বলবেন?
প্রশ্নটা শুনে খুব হাসতে লাগলেন। হাসিতে ভুঁড়িটা বেশ নাচতে লাগল তবে নিঃশব্দ হাসি। সাধুবাবা হাসলেও আমি কিন্তু বিস্ময়ে গম্ভীর হয়ে রইলাম উত্তরের আশায়। ধীরেধীরে হাসিটা মুখ থেকে মিলিয়ে যেতেই তিনি বললেন,
– বেটা, এতে তোর আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এটা আমার কেন, তোর মতো সমস্ত গৃহীদের জীবনেও প্রতিমুহুর্তে হতে পারে। বেটা, সাধুসন্ন্যাসী হোক আর গৃহীই হোক, ভগবানের উদ্দেশ্যে কেউ যদি নিষ্ঠা নিয়ে কোনও ব্রতপালন করে অথবা গুরুপ্রদত্ত কোনও নিয়ম যদি কেউ রক্ষা বা পালন করতে দৃঢ় সংকল্প হয় তাহলে নিশ্চিত জানবি, সেই ব্রতপালন বা নিয়মকে যথাযথভাবে রক্ষা করার জন্য ভগবান তার সহায় হয়ে, সঙ্গী হয়ে যা যা প্রয়োজন ও যতটুকু প্রয়োজন, তা ঠিকঠিক ভাবে যোগান দিয়ে তাকে সাহায্য করেন। এর মধ্যে এতটুকু ফাঁক রাখেন না। তিনি দেখেন শুধু ব্রতপালনকারীর নিষ্ঠা।
তীর্থক্ষেত্রে ব্রত বা নিয়মপালনকারীদের সাহায্য করেন সেই তীর্থের স্বয়ং তীর্থদেবতা। আজকের এই আহার জুটিয়ে দিলেন রাধারানী স্বয়ং। আমি তো বেটা বসে আছি রাধারানীর কোলে। আহার জুটিয়ে দেয়ার দায়িত্ব তাঁর। না দিলে আমার কি হবে, কলঙ্ক হবে তো রাধারানীর। বাড়িতে অতিথি এলে তার মর্যাদা না দিলে বদনামটা কার হয় গৃহকর্ত্রীর, না পাড়ার লোকের?
এই পর্যন্ত বলে আবার হাসতে লাগলেন প্রাণ খুলে। হাসিতে এক অপার্থিব আনন্দের ফোয়ারা ছুটতে লাগল। নিঃশব্দ হাসির ফোয়ারার তোড়ে শ্যামকুণ্ডের জল মনে হল যেন থরথর করে কেঁপে উঠল। কি বিশ্বাস, বাপ রে! কি শরণাগতি! অবাক হলেও এই মুহুর্তে আর সময় নষ্ট করলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, আপনার কথানুসারে ধরে নিলাম রাধারানীই এই ফলদুটো দিয়েছেন। আমরা দেখলাম এক বৃদ্ধা আপনাকে দান করলেন। এই দানে বা যে কোনও দানে মানুষ কিছু না কিছু ফললাভ করে থাকেন বলে সকলে বলে থাকেন, শাস্ত্রে নাকি সে কথাই আছে। আমার জিজ্ঞাসা, দানে কি ফল লাভ করে থাকেন দানকারী?
প্রশ্ন শেষ হতে সাধুবাবা বললেন,
– বেটা, তোর দেখছি কথার আর শেষ নেই। একটা শেষ হতে না হতে চেপে বসছে আর একটা। পারিসও বটে!
বলে একটু হাসলেন। হাসিতে সাধুবাবারা দেখেছি কেউ ‘কমতি’ যান না। আমি আর কিছু না বলে অপেক্ষায় রইলাম। সাধুবাবাও মিনিটখানেক চুপ করে রইলেন। ভাবলেন কিছু, ভাব দেখেই বুঝলাম। পরে বললেন,
– বেটা, কোনও কিছু পাওয়ার আশা না করে নির্বিচার দানের ফল অসামান্য। তবে সাধুসন্ন্যাসীদের জীবনপথে প্রয়োজনের অতিরিক্ত এতটুকু কোনও দান গ্রহণ করতে নেই, শুধুমাত্র শরীর রক্ষার জন্যে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু ছাড়া। সাধুসন্ন্যাসী বা গৃহী যে কেউই দান গ্রহণ করলে প্রথমেই মনের স্বাধীনতা নষ্ট হয় দানগ্রহীতার। যিনি দান করেন তার ভিতরের যা কিছু ধর্মপথে অগ্রসরতার ক্ষেত্রে শুভবিরদ্ধভাব তা অবশ্যই দানগ্রহীতার মধ্যে প্রবেশ করে অতি সূক্ষ্মভাবে। চোখে দেখা যায় না, কালে ক্রিয়া করে।
দানগ্রহণে গ্রহীতার বিষয়ে আকর্ষণ বাড়ে, দেহের শান্তি নষ্ট হয়, মনেরও। দাতার এসব কমে। দান করলে দাতার দেহের প্রতি ভালবাসা নষ্ট হয় অর্থাৎ দেহাত্মবোধ কেটে যায় ধীরে ধীরে, বিষয়ের প্রতি নষ্ট হয় আকর্ষণও। আর দানগ্রহণ এমনই যে, পূর্বজন্মের স্মৃতিকে নষ্ট করে দেয়। জীবনে কেউ কখনও দানগ্রহণ না করলে বা করে না থাকলে পূর্বজীবনের স্মৃতির উদয় হয় ক্ষেত্রবিশেষে। দান করলে মন নির্মল হয়, নির্মল জ্ঞানের বিকাশ হয়, মন হয় ধীরে ধীরে বাসনাবিহীন। মন বাসনাবিহীন হল মানেই তো প্রকৃত জ্ঞানের উদয় হল। তাকে লাভ করার পথ সুগম হল।
কথাটা শেষ হওয়ামাত্র জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, দাতার তো দেখছি সবদিক থেকেই লাভ হল কিন্তু ব্যাপারটা খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে, দানগ্রহীতা সবদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বিশেষ করে দেহমন ও অধ্যাত্মবাদের উন্নতিতে। সুতরাং কারও দান গ্রহণ না করাই ভাল। আর একটা কথা, আমার দান যদি আমার কল্যাণ করে অপরের অমঙ্গল করে তাহলে সে দান করে অপরের ক্ষতি করার কোনও যুক্তি আছে কি?
আবার হাসতে শুরু করলেন সাধুবাবা। একটু রহস্যেভরা হাসি। বললেন,
– বেটা, দাতার দেহ ও মনের পরিপন্থী যেসব ভাব তা দানগ্রহীতার মধ্যে সূক্ষ্মভাবে প্রবেশ করে ঠিকই তবে দানগ্রহীতাও জীবনে কোনও না কোনও সময় কিছু না কিছু দান তো করছে কাউকে না কাউকে। একটা পয়সা যদি কাউকে কেউ দান করে, তাহলে পূর্বে দান গ্রহণের ফলে যে বিরুদ্ধভাব তার ভিতরে সংক্রামিত হয়েছিল তা তৎক্ষণাৎ অন্যের ভিতরে সংক্রামিত হচ্ছে। এই ভাবেই ক্রিয়া চলতে থাকে।
দীক্ষিতদের ক্ষেত্রে দান গ্রহণমাত্রই দাতার বিরুদ্ধভাব গ্রহণ করেন গুরু। ফলে এতটুকুও ক্ষতি হয় না তার। কারণ দীক্ষার পরই গুরু আশ্রয় করেন শিষ্যের দেহকে। অদীক্ষিত যারা, তারাও দান গ্রহণের দায় মুক্ত হয় যদি সে নিজে দান না করে কোনও দেবালয়ে পুজো অথবা তাঁর উদ্দেশ্যে কিছু দেয়। কারণ দানগ্রহণের ফলে তাকে আশ্রয় করা দাতার বিরুদ্ধভাবের ফল সংক্রামিত হয় দেবতায়। সুতরাং বুঝতেই পারছিস, গড়ে দাতা আর দানগ্রহীতা কারও কোনও ক্ষতি তো হচ্ছেই না, বরং লাভ হচ্ছে দানে। দেহাত্মবোধ কাটছে, বিষয়ে আকর্ষণ নষ্ট হচ্ছে, দেহমনের শান্তি আসছে, মন নির্মল হয়ে হচ্ছে জ্ঞানের বিকাশ। মোটের উপর তাঁকে পাওয়ার পথ পরিস্কার হচ্ছে। যারজন্যই তো শাস্ত্রে দানকে সবচেয়ে পুণ্যের কাজ বলে অভিহিত করেছেন শাস্ত্রকারেরা।
সাধুবাবা থামলেন, কথাটা শুনে মনটা আমার আনন্দে ভরে গেল। আরও অনেকক্ষণ কথা হল। অনেক কথা হল। এবার উঠতে হবে। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, কোথায় থাকেন, এখানে ক’দিন থাকবেন, এখান থেকে যাবেনই বা কোথায়?
এতটুকু বিরক্ত না হয়ে বললেন,
– আমি থাকি রুদ্রপ্রয়াগে। হিমালয় ভাল লাগে তাই ওখানেই পড়ে থাকি। অনেকদিন পাহাড় থেকে সমতলে আসিনি তাই এবার একটু বৃন্দাবনে এলাম। আর মাত্র দিনকয়েক থাকব এখানে। পরে চলে যাব রুদ্রপ্রয়াগে।
– বাবা, ঈশ্বরকে কীভাবে পেতে পারি, কিভাবে পেতে পারে আর সকলে?
এ প্রশ্নটা শুনে প্রসন্ন হাসিতে ভরে উঠল বৃদ্ধ সাধুবাবার উজ্জ্বল মুখখানা। স্নেহভরা কণ্ঠে তিনি বললেন,
– বেটা, কামনা আর ঈশ্বর এ দুয়ের সম্পর্ক সাপে নেউলে। যেখানে কামনা, যার মধ্যে কামনা, সেখানে, তার মধ্যে ঈশ্বর নেই।