প্রথম যে বার মথুরায় গেছিলাম সে বারের কথা। তখন বেলা প্রায় আটটা হবে। যমুনাদেবীর মন্দির থেকে বেরিয়ে সোজা এলাম বিশ্রামঘাটে। জমজমাট ঘাট। কেউ পুজো, কেউ তর্পণ, কেউ বা স্নান করছেন যমুনায়। আমার মতো এই সাতসকালে যারা স্নানে আগ্রহী নয় তাদের অনেকেই দাঁড়িয়ে দেখছেন যমুনার সৌন্দর্য, লোকজন। আজ বিশ্রামঘাটে যেসব যাত্রীদের দেখছি, তাদের মধ্যে চেহারায় প্রায় সকলেই হিন্দি ভাষাভাষীর তীর্থযাত্রী, স্নানার্থী। এর বাইরে যে কেউ নেই তা নয়। তবে আমার চোখে পড়ল না। কোলাহল আর কৃষ্ণনাম এ দুয়ে মিলে এক হয়ে বিশ্রামঘাটকে করে তুলেছে আনন্দমুখর। এখন ঘাটের পরিবেশ অনেকটা কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটের মতো।
মাথায় একটু যমুনার জল দেব এই ভাবনা রয়েছে মনে। একদিন আমার মা বলেছিলেন, যেকোনও তীর্থে গিয়ে স্নান করতে না পারলে নদী বা কুণ্ডের জল স্পর্শ করে মাথায় দিলে তাতেই তীর্থস্নানের ফল হয়। সেইজন্য বিশ্রামঘাটের কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে নামতে চোখ পড়ল অতি বৃদ্ধ এক সাধুবাবা স্নান সেরে উঠে আসছেন উপরে। বয়েসের ভারে অনেকটা নুয়ে পড়েছেন। পরনের গামছাটা বেশ ছোট। হাঁটুর মালাইচাকির একটু উপরে উঠে আছে। দেহটা পরিপুষ্ট নয়। কালচে তামাটে গায়ের রং। মাথায় জটা নেই। কাঁধের একটু নিচে নেমে এসেছে ভিজে চুলগুলো।
কারও দিকে তাঁর নজর নেই। এক ধাপ এক ধাপ করে সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসছেন উপরে। দেখামাত্রই আমার ভাল লাগল। সাধুবাবার গতি খেয়াল রেখে একে ওকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত নেমে এলাম শেষ ধাপে। ঝটপট একটু জল মাথায় ছিটিয়ে আবার আগের গতিতেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলাম সাধুবাবার পিছনে, তখনও তাঁর উপরের সিঁড়ি শেষ হতে খানকয়েক বাকি। ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালেন শেষ ধাপে। দেখলাম ময়লা একটা সাদা কাপড়, একটা ঝুলি আর খয়েরি রঙের একটা কম্বল রয়েছে এক জায়গায় জড়ো করা অবস্থায়।
কাপড়টা পরে নিলেন গামছার উপর বেড় দিয়ে। তারপর ছাড়লেন গামছাটা। ঝুলি থেকে বের করলেন ফতুয়ার মতো একটা। গায়ে দিলেন। কাঁধে ঝুলিটা নিয়ে তার উপর ভাঁজ করা কম্বলটা রাখতেই আমি সামনে এসে দাঁড়ালাম। দু-পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললাম,
– বাবা চলুন, একটু চা জলখাবার খাই।
একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন মুখের দিকে। হিন্দিতে বললেন,
– বেটা, তীর্থে এসেছি। তীর্থদেবতাকে দর্শন না করে কোনও কিছু গ্রহণ করলে ইষ্ট অভুক্ত থাকেন। আর যে খাদ্য গ্রহণ করি না কেন, তা বিষ্ঠার সমান হয়। তাই একটু দাঁড়া, আগে যমুনামাঈকে একটু দর্শন করে আসি।
কথা কটা বলে চলতে শুরু করলেন, সঙ্গে আমিও। যমুনাদেবীকে দর্শন ও প্রণাম করলেন সাধুবাবা। মন্দির থেকে বেরিয়ে সোজা এলাম একটা কচুরি মিষ্টির দোকানে। দুজনে প্রায় ভরপেট খেয়ে নিলাম। পরে বললাম,
– বাবা, চলুন একটু ফাঁকায় গিয়ে বসি।
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন। বিশ্রামঘাট ছেড়ে কিছুটা গিয়ে দুজনে বসলাম যমুনাতীরে একটু উঁচু বাঁধানো জায়গায়। লোক চলাচল আছে, তবে বিশ্রামঘাটের তুলনায় কিছুটা কম। আমি বসেছি মুখোমুখি হয়ে কথার সুবিধার জন্যে। এবার সাধুবাবার মুখের দিকে তাকাতে জিজ্ঞাসা করলেন,
– কি জন্যে আমাকে নিয়ে এলি এখানে, তুই কি কিছু বলবি?
কথাটা বলে কাঁধ থেকে প্রথমে কম্বল পরে ঝুলিটা পাশে নামিয়ে রাখলেন। আমি ভাবলাম, দুম করে কিছু জানতে চাইলে সাধুবাবা উত্তর না-ও দিতে পারেন। ধীরে ধীরে ঢুকতে হবে ভিতরে। তাই প্রথমে কথা শুরু করলাম এইভাবে,
– বাবা, প্রায় সব সাধুসন্ন্যাসী যাঁদের সঙ্গে ভাগ্যক্রমে আমার পরিচয় হয়েছে, তাঁদের দেখেছি প্রত্যেকে খুব ভোরে উঠে স্নান করেন। আপনাকে দেখলাম অনেক বেলায় স্নান করলেন। স্নানের কি বাঁধাধরা কোনও নিয়ম আছে, নাকি সারাদিনে যখন খুশি স্নান করলেই হল?
কথাটা শুনে সাধুবাবা হেসে ফেললেন। বললেন,
– খুব ভোরে উঠে স্নান করাটাই শাস্ত্রীয় নিয়ম। আমি নিজেও শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সব ঋতুতে স্নান করি খুব ভোরে আবছা অন্ধকার থাকতে। আজই এখানে এলাম। বিশ্রামঘাটে স্নান করব ভেবেছিলাম। আসতে দেরি হয়ে গেল তাই আর ভোরে স্নান করা হল না।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা আপনি বললেন শাস্ত্রে নিয়ম আছে, নিয়ম যখন আছে তখন তার ফলও তো কিছু আছে। দয়া করে বলবেন কি ফল হয়?
প্রশ্ন শুনে একটু ভাবলেন। পরে একটা হিন্দিতে শ্লোক বলে তার মানে করে বললেন,
– বেটা, কোনও নারী বা পুরুষ প্রতিদিন খুব ভোরে উঠে যদি স্নান করে, তাহলে শাস্ত্রে বলেছে সে দশটা গুণের অধিকারী হবে। প্রথমে আসবে তার দেহের পবিত্রতা। তারপর আসে দেহের কোমলতা, লাবণ্য। প্রতিদিন স্নানে দেহে বল বাড়ে। রূপ খোলে। কণ্ঠস্বর সুন্দর হয়। সৌরভ বাড়ে, কথার উচ্চারণ সুন্দর ও নির্দোষ হয়। নীরোগ হয় দেহ। মানসিক প্রফুল্লতা বাড়ে। যার জন্যই তো সাধুসন্ন্যাসীদের রোগভোগটা খুব কম হয়।
সংসারজীবনে নিজের কাজ হাসিল করতে অনেক শয়তানমার্কা লোক যেমন অকারণ কথায় কথায় ‘কিছু মনে করবেন না, একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি’ এমন ধরনের কথা বলে শ্রোতার কাছে কৃত্রিম বিনয়ীভাব প্রকাশ করে, এখন সেই সব শয়তানদের ভাবটা মনে পড়ে গেল সাধুবাবার কাছে বসে। আমিও বলে ফেললাম,
– কিছু যদি মনে না করেন, তাহলে বাবা একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
সাধুবাবা অভয় দিয়ে বললেন,
– বল না, কি জানতে চাস?
জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবার বয়েস কত হল এখন?
ভাবের কোনও পরিবর্তন হল না। সাধারণভাবেই উত্তর দিলেন,
– বেটা, বয়েস দিয়ে আর কি হবে? এখন বয়েস ধর আশি থেকে পঁচাশি হবে। তার কম হবে না।
এবার সরাসরি মনের কথাটা বললাম,
– বাবা, আপনাকে এখানে এনেছি আপনার সাধুজীবনের কিছু কথা জানার জন্যে। আপনি যদি দয়া করে বলেন তো জিজ্ঞাসা করি।
কথাটা শুনে একটা বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠল চোখেমুখে। কয়েক মুহুর্ত ভেবে বললেন,
– কি জিজ্ঞাসা আছে তোর?
আমরা যেখানে বসেছি সেখানে কেউ আসছে না। সামান্য দূর থেকে চলছে মানুষের যাতায়াত। তবে অনেকেই আমাদের দেখতে দেখতে যাচ্ছে এটা লক্ষ্য করলাম। জানতে চাইলাম,
– বাবা, সংসারের ভোগবাসনা ফেলে দিয়ে কেন এলেন এমন এক কষ্টকর অনিশ্চিত জীবনে?
প্রশ্নটা শোনামাত্র উত্তর দিলেন না। মিনিটখানেক চুপ করে থেকে কি যেন ভাবলেন। পরে বললেন,
– বেটা, সংসারে কিছু ভোগসুখ আছে ঠিকই তবে সংসারীদের জীবনটা কি সত্যিই নিশ্চিত? যেমন ধর তুই এসেছিস বৃন্দাবন মথুরায় বেড়াতে। এখান থেকে তুই ঘরে ফিরে যেতে পারবি এমন নিশ্চয়তা কি আছে, এমন নিশ্চয় করে কি তুই বলতে পারবি, তোর প্রাণপ্রিয় বড় আপনজন মা তোর বেঁচে আছে? একটা কথাও তুই নিশ্চয় করে বলতে পারবি না। পৃথিবীর কোনও মানুষই বলতে পারবে না একঘণ্টা পরে কি হবে। আসলে কি জানিস, মানুষের মনটা ভগবান এমন করে তৈরি করে দিয়েছেন, মনের ধর্ম অনুসারে মানুষ সবকিছু ভেবে নিচ্ছে নিশ্চিত বলে। যেমন তুই নিশ্চিত ভেবে নিয়েছিস, এখান থেকে বাড়ি যাবি। মাকে দেখবি। এখানে যা যা দেখেছিস সেসব কথা গিয়ে বেশ গল্প করে সবাইকে বলবি। এমনতর অনেক কথা। একটু ভেবে বলত, কোনওটাই কি নিশ্চিত? তা নয়, সুতরাং মানুষের জীবনটা যখন অনিশ্চিত তখন সংসারে থাকা না থাকা দুটোই সমান।
সঙ্গেসঙ্গেই বললাম,
– তাহলে তো বাবা আপনি যে এপথে আছেন ভগবানকে লাভ করার উদ্দেশ্যে, তাঁকে যে লাভ করবেন এমন নিশ্চয়তা কোথায়?
মুহুর্ত দেরি না করে বললেন,
– হাঁ বেটা, তোর কথাটা আপাত সঠিক। এই জীবনে তাঁকে লাভ করব এমন কোনও নিশ্চয়তা এতটুকুও নেই। তবে এপথে ‘নিশ্চয়তা’-র কোনও ভূমিকা নেই। তাঁকে লাভ করার ব্যাপারটা নিশ্চয়তার উপর নির্ভর করছে না, সেটা দাঁড়িয়ে আছে মানুষের একান্ত গভীর বিশ্বাসের উপর। নিশ্চিত এটুকুই ‘তিনি আছেন’। তাঁকে পাওয়ার ব্যাপারে কাজ করবে একমাত্র বিশ্বাস।
কথাটুকু বলে থামলেন। মনে হল সাধুবাবার সঙ্গে কথা বলে মনের মজা হবে। জানা যাবে অনেক কথা। আমার মূল প্রশ্ন থেকে সরে গেছেন। তাই সরাসরি জানতে চাইলাম,
– বাবা, ঘর ছাড়লেন কেন?
এ প্রশ্নে মিনিটখানেক চুপ করে রইলেন। ফিরে গেলেন সুদূর অতীতে একসময় যেখানে তিনি ছিলেন। শান্তকণ্ঠে বললেন নির্বিকার চিত্তে,
– বেটা, যখন আমার বিয়ে হয় তখন বয়েস আঠারো কুড়ি। বিয়ের পর দুটো বাচ্চা হয়। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে আমি। বাড়ি ছিল নাসিকে। ছেলের বয়েস যখন নয়, তখন মেয়ের বয়েস সাত।
এই পর্যন্ত বলে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
– বেটা, দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে। ওই বয়েসে একই সময়ে আমার ছেলে মেয়ে দুজনের বসন্ত হল। তখনকার দিনে এখনকার মতো অত ওষুধপত্র ছিল না। গাঁয়ের ওঝাবদ্যি করলাম। কিছু হল না। দিনপাঁচেকের মাথায় একদিনে মাত্র কয়েক ঘণ্টার তফাতে ছেলেমেয়ে আমার দুজনেই চলে গেল ‘ভোগ সুখের’ পৃথিবী ছেড়ে। শোক সম্বরণ করতে পারলাম না। কয়েকদিন পর একদিন আমিও ছাড়লাম সংসার। গড়ে ধর সংসার করেছি বোধ হয় বছরদশেক।
সাধুবাবা থামলেন। দেখলাম দেহটা একেবারে স্থির হয়ে গেছে। মুখখানা হয়ে গেছে বিবর্ণ ফ্যাকাসে। মুখের দিকে তাকাতে পারলাম না। মাথাটা নামিয়ে নিলাম। বসে রইলাম চুপ করে। অতীতের এই মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতি এ মুহুর্তে আঘাত করল সাধুবাবার অন্তরকে, পীড়িত করল আমার মনকেও। কি বলব কিছু ভেবে পেলাম না। চুপ করে বসে রইলাম। নির্বিকারভাবে বললেন,
– বেটা, দুঃখ করার কিছু নেই। সুখ-দুঃখ এটাই তো সংসারের নিয়ম। এমন ছেলেমেয়ে তো মরে অনেকেরই। তারা কি সবাই সংসার ছাড়ে? ছাড়ে না। আমি ছাড়লাম কেন?
আমার প্রশ্নটাই সাধুবাবা করলেন। উত্তরের আশায় চেয়ে রইলাম মুখের দিকে। এক মিনিট দু-মিনিট করে কেটে গেল প্রায় মিনিট আটেক। তবুও কোনও কথা বললেন না। বৃদ্ধের প্রসন্ন উজ্জ্বল মুখখানা একেবারে গম্ভীর হয়ে উঠল। আমি অপেক্ষায় রইলাম। আরও মিনিটখানেক পর সাধুবাবা মুখ খুললেন,
– বেটা, সংসারে আছিস ভাল কথা। তবে কোনওদিন কারও উপর মানসিক দিক থেকে নির্ভর করবি না। যা কিছু অশান্তি দুঃখ কলহ হিংসা থেকে শুরু করে সংসারীদের সমস্ত অশান্তির মূল কারণই হল মানসিক নির্ভরতা। যে অন্যের উপর মানসিকভাবে নির্ভর করে না তাকে কোনও দুঃখই স্পর্শ করতে পারে না। যে যত বেশি অন্যের উপর নির্ভরশীল তার দুঃখ অশান্তির পরিমাণও তত বেশি। নির্ভরতায় দুঃখ ছাড়া আর কিছুই নেই। সন্তানদের উপর মানসিক দিক থেকে নির্ভর করেছিলাম বলে শোকের তীব্রতা ছিল এত বেশি যে, আমাকে সংসার থেকে টেনে এনেছে পথে। ওদের মৃত্যুতে আমার মনের নির্ভরতা গেল, শান্তি এল।
আবার থামলেন। মিনিটখানেক পর বললেন,
– আসলে বেটা আমাদের মানসিক নির্ভরতা যেটা, সেটা একান্তই মনের একটা মামুলি সাধারণ ভাবনা। যেটার কোনও প্রয়োজনই নেই চলার পথে। অথচ ওটা না করেও যে সংসারীদের চলার উপায় নেই। আর সেইজন্য তো সারাজীবন মানুষের দুঃখেরও কোনও অন্ত নেই।
এবার বেশ উদ্দীপ্ত ও বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন,
– বেটা, যদি পরমানন্দময় জীবন কেউ চায়, আত্মবিশ্বাস যদি কেউ চায়, সংসারের সমস্ত বন্ধন থেকে কেউ যদি মুক্ত হতে চায় তাহলে প্রথমেই তাকে নিঃস্ব হতে হবে, নিঃসঙ্গ হতে হবে, তবে সেটা সংসারের সকলকে পরিত্যাগ করে নয়, মনের দিক থেকে। বেটা, সংসারে মানসিক নির্ভরতা মানুষের মধ্যে কিছু পাওয়ার বাসনা সৃষ্টি করে। চাহিদা যেমন নির্ভরতার কারণ তেমনই অন্তরে দৈন্যের একটা কারণ বটে।