Mythology

সমস্ত কার্যসিদ্ধি, এমনকি ভগবানকেও লাভ করবেন এই জিনিসটি ত্যাগ করলে, পথ দিলেন সাধুবাবা

সাধুবাবার জীবনে তাঁর গুরুকৃপার কাহিনি শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কথাটা শেষ হতেই দু-চোখ বেয়ে নেমে এসেছে জলের ধারা। এ ধারায় তাদেরই বুক বেয়ে যায় যাদের জীবনে তাঁর কৃপালাভ হয়েছে। দেখলাম এই মুহুর্তে সাধুবাবার মুখখানা আরও উজ্জ্বল, আরও আনন্দময় হয়ে উঠেছে। ভাব নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে এখন কোনও প্রশ্ন করলাম না। তিনিও চুপ করে রইলেন। মিনিটপাঁচেক পর বললাম,

– বাবা, আপনি তো ভক্ত মানুষ। ভক্তিলাভ হয়েছে আপনার। ভক্তিলাভের উপায়টা দয়া করে বলবেন?


প্রশান্ত চিত্তে হাসিভরা মুখে বিনয়ী বৃদ্ধ বললেন,

– বেটা, আমার আর ভক্তিলাভ হল কোথায়। যদি সত্যি কিছু হয়ে থাকে তাহলে তা গুরুজিই করে দিয়েছেন দয়া করে। আসলে কি জানিস বেটা, আমরা যে চাই না, তাই তো আমাদের হয় না। কারণ, ভক্তি মুখাপেক্ষী হয়ে আছে ভক্তের কিন্তু ভক্তের এমনই কপাল, সে ভক্তির মুখাপেক্ষী নয়। তাই তো ভক্তের ভক্তিলাভ হয় না।


একটু থেমে আবার বললেন,

– বেটা, স্বামী ছাড়া রমণীরা সুন্দরী হলেও যেমন সকলের মাঝে শোভা পায় না, তেমনই ভক্তি ছাড়া নারীপুরুষ সাধনভজন করলেও ধর্মজগতে শোভা পায় না, পায় না প্রকৃত পথের সন্ধান। বেটা, পৃথিবীর কোনও স্বামীই তার স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে পারে না সব দিয়েও, অথচ দেখ ভগবান কত করুণাময়, সামান্য একটু ভক্তিতেই তিনি সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর ভক্তকে দুহাতে ঢেলে দেন তাঁর করুণাবারি, যা নিয়ে ভক্ত রাখার জায়গা পায় না।

নাথ সম্প্রদায়ের এই বৃদ্ধ সাধুবাবা কথাগুলো বলে মুখের দিকে তাকালেন স্নেহের দৃষ্টিতে। তাঁর চোখে চোখ রাখতেই আনন্দের একটা শিহরণ খেলে গেল আমার সারাটা দেহমনে। মুখ থেকে একটা কথাও সরল না। প্রসন্ন হাসিভরা মুখে বললেন,

– বেটা, লজ্জা যেমন নারীর ভূষণ, ক্ষমা যেমন পুরুষের অলংকার, তেমনই ভক্তের অন্তরে তাঁর নামগানই ভগবানের অলংকার। বেটা, যখন যেখানে যে অবস্থায় থাকিস না কেন, তাঁর নাম ছাড়বি না। সংসারীরা বাধা ছাড়া যেমন বিষয় সুখ উপভোগ করতে পারে না, তেমন তিনি নাম ছাড়া অন্য কোনও কিছুতেই আনন্দ পান না, ফলে নাম-সাধনহীন মানুষের উপর তাঁর করুণাধারা, কৃপাধারাও বর্ষিত হতে পারে না।

হঠাৎ কানে এল খোল করতালের আওয়াজ। দুজনেই তাকালাম পথের দিকে। দেখলাম একদল কীর্তনকারী নারীপুরুষ চলেছেন মন্দিরের দিকে। মনে হল এরা সকলে বোধ হয় ব্রজপরিক্রমাকারী। আবার তা না-ও হতে পারে। একনজর দেখে ফিরে এলাম আমাদের কথায়। সাধুবাবা বললেন,

– বেটা, কোনও ব্যাপারে কখনওই অসহিষ্ণু হবি না। মানুষের কার্যসিদ্ধি, এমনকিই ভগবানকে লাভ করার ক্ষেত্রেও সবচেয়ে বড় বাধা হল অসহিষ্ণুতা। সহিষ্ণু ব্যক্তির মনের বেগ তীব্র গতিসম্পন্ন পাহাড়ি স্রোতস্বিনীর মতো। পাহাড়ি নদীবেগ যেমন বড়বড় পাথর বৃক্ষকে ভেঙেচুরে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়, তেমনই সহিষ্ণুমনের তীব্রশক্তি সমস্ত কার্যসিদ্ধি, তাঁকে লাভ করতে সহায়তা করে।

একটু থামলেন। নিজের একটা সমস্যার কথা মাথায় এল। রেহাই পেতে অকপট স্বীকারোক্তি করলাম এইভাবে,

– বাবা, এখন আমার বয়েস তেইশ শেষ করে চব্বিশে পড়েছি। পুজোপাটে তেমন মন না থাকলেও কিছু করি। সাধক মহাপুরুষদের জীবনী পড়ি। যখন পুজোপাট করি বা মহামানবদের জীবনী পড়ি তখন মনের ভাবটা একেবারে অন্যরকম হয়ে যায়। মনে হয়, কি হবে আর সংসার দিয়ে, কিছুই নেই সংসারে। যত রকম জ্ঞানের কথা সবই ঢোকে মাথার মধ্যে। অর্ধেক ভগবান হয়ে যাই। আরও মনে হয়, যদি তৈলঙ্গস্বামী কাঠিয়াবাবা কিংবা শ্রীজীব গোস্বামী প্রমুখ মহাপুরুষদের কারও মতো হতে পারতাম তাহলে কি পরমানন্দময় জীবনটাই না হত। খাওয়ার চিন্তা থাকত না, পরার চিন্তা থাকত না। সকলে সম্মান করত, ভাল মন্দ খেতে পেতাম, সব ব্যাপারটাই বিরাট বিরাট হত। এই ভাবনাটা আসে পুজোপাট আর মহাপুরুষদের জীবনী পড়ার সময়। গড়ে ধরুন তখন ভাবে প্রায় ভগবানই হয়ে যাই তাঁর সম্পর্কে কোনও ধারনা না থাকলেও। তারপর সকলের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা শুরু করি। সাধক সাধক ভাব। এবার মাকে হয়ত খাবার দিতে বললাম। হাতের কাজটা সেরে খাবারটা দিতে পাঁচ-সাত মিনিট দেরি করেছে তখন এমন দাঁত খিঁচিয়ে উঠলাম যে, বাঁদরও অনেক বেশি ভদ্র। সাধক ‘আউট’। ধরুন রাস্তায় বেরলাম। একটা সুন্দরী মেয়ে চোখে পড়ে গেল। ব্যস, তখন পুজোপাট, সাধক মহাপুরুষ হওয়ার ভাবনা, ভগবান, কোথায় যে হাওয়া হয়ে গেল তা ভগবানই জানেন। তখন মনে হতে থাকে, ‘মাকালী, এ রকম একটা সুন্দরী মেয়েকে যদি বিয়ে করতে পারতাম, আহ্’। বেশ কিছুক্ষণের জন্যে মেয়েটির চেহারা ঘুরপাক খেতে থাকে মাথার মধ্যে। সাধক ভগবান কেউই আর ওই ভাবনাটা সরায় না মাথা থেকে। অথচ এঁদের নাম করে এসেছি খানিক আগে। এ নিয়মেই চলছে আমার মন। এর থেকে মুক্তির উপায় কি?

কথাটা শুনে সাধুবাবা হো হো করে হেসে উঠলেন উচ্চস্বরে। আমিও সলজ্জ হাসি হাসলাম। হাসতে হাসতেই তিনি বললেন,

– বেটা, তোর এটা বয়েসের ধর্ম, মনেরও ধর্ম। এসব বয়েসের ছেলেমেয়েদের কমবেশি হয়ে থাকে। এমন ভাবনাটা কোনও অপরাধ নয়। এটা প্রকৃতির খেলা। কাম থেকে এই ভাবনার সৃষ্টি করে থাকেন প্রকৃতি, সেখানে কুৎসিত পুরুষ বা রূপসী নারী, এমনকি জাতধর্মের কোনও প্রভেদ রাখেন না তিনি। এই ভাবনার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনও উপায় নেই। প্রকৃতির নিয়মে আসে আবার তাঁর নিয়মে তা কালে কালে সরে যায় মন থেকে।

এমন একটা মামুলি উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। তবে তা মুখে ও ভাবে প্রকাশ করলাম না। হাসিমুখে প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম,

– বাবা স্থায়ীভাবে কোথাও বাস করেন?

উত্তরে বললেন,

– স্থায়ীভাবে ডেরা কোথাও নেই। যখন যেখানে ভাল লাগে তখন সেখানে থাকি কিছুদিন। আবার মনটা যেখানে যেতে চায় সেখানে চলে যাই। এইভাবেই তো কেটে যাচ্ছে, জীবনের শেষের দিনগুলো।

হঠাৎ সাধুবাবা বললেন,

– বেটা এবার আমি উঠবো। আজ এক জায়গায় পঙ্গত আছে সেখানে যেতে হবে। এখান থেকে অনেকটা পথ। এখন না উঠলে সময় মতো সেই আশ্রমে পৌঁছতে পারব না।

অনুরোধের সুরে বললাম,

– আর একটু বসুন বাবা। এটাই প্রথম আর এটাই আপনার সঙ্গে শেষ দেখা, আর একটু বসুন।

কথাটুকু শেষ করে জানতে চাইলাম,

– বাবা, পঙ্গতে যাবেন বললেন। পঙ্গতটা কি?

সাধুবাবা বললেন,

– বহু সাধু মিলে এক জায়গায় ভোজন করাকে বলে পঙ্গত। বেটা, পঙ্গতে যোগদান করলে সাধুদের অনেক লাভ হয়।

বলে থামলেন। আমি মনে মনে ভাবলাম, লাভ তো হয়ই কারণ পঙ্গতে খাওয়া হয় বিনা পয়সায় আর ক্ষেত্রবিশেষে দান দক্ষিণালাভ তো আছেই। মুহুর্তের এই ভাবনাটুকুকে ভিত্তি করে সাধুবাবা বললেন,

– বেটা সাধুদের কখনও খাওয়ার অভাব হয় না। তাঁর কৃপাতে রোজ কিছু না কিছু জুটবেই। পঙ্গতে কোনও সাধুই খাওয়ার ভাবনা বা দক্ষিণালাভের আশা নিয়ে যায় না। পঙ্গতে সাধুরা যায় নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে, সাধনতাপে নিজেকে তাপিত করতে, বুঝলি?

কথাটা বুঝলাম না। হাঁ করে চেয়ে রইলাম মুখের দিকে। বললেন,

– পঙ্গতে বহু সাধুর সমাগম হয়। অনেক সময় অনেক মহাত্মারও আগমন ঘটে পঙ্গতে। তখন অনেক বিষয় নিয়ে অনেক কথা আলোচনা হয় একের সঙ্গে অপরের। সাধনজীবনের সুবিধা অসুবিধা, দ্বিধা দ্বন্দ্ব, মানসিক কোনও অস্বস্তির সৃষ্টি হলে সাধুপঙ্গতে আলোচনার মাধ্যমে সাধনপথে যেসব সমস্যা আছে তা প্রায় সময়েই সমাধান হয়ে যায়। সবসময় তো আর একসঙ্গে তুই অনেক সাধুকে এক জায়গায় পাবি না। পঙ্গতে আসা সাধুদের নানা কথা, নানা আলোচনার মাধ্যমে যেমন সাধনজীবনের সমস্যা কাটে, তেমন জ্ঞানও বাড়ে। আর একটা লাভ আছে বেটা, পঙ্গতে সাধুরা আসনে বসে পাশাপাশি সারি দিয়ে। এতে একের সাধন তাপ অপরের দেহমনের ওপর আনন্দময় ক্রিয়া করে, সাধনশক্তি সঞ্চারিত করে। ফলে সাধনজীবনের অনেক কল্যাণ হয় যা পঙ্গত বা জমাৎ ছাড়া অন্য কোনও সময়ে সেটা সম্ভব হয় না। অনেক সময় কোনও মহাত্মার কৃপালাভও হয়ে যায় কোনও কোনও সাধুর ভাগ্যে। তাই ছোট হোক আর বড় হোক সাধুরা পঙ্গতে এই কারণে অংশগ্রহণ করে, দুটো খাওয়া আর দক্ষিণা হিসাবে একটা লোটাকম্বলের জন্য নয়, বুঝলি!

সাধুবাবার কথার বিষয়টা আমার বোধে এল। জানতে চাইলাম,

– বাবা, জমাৎ কথাটা বললেন, জমাৎ মানে কি?

উত্তরে বললেন,

– একসঙ্গে বহু সাধুসন্ন্যাসীদের দলবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন স্থানে অবস্থানকেই বেটা জমাৎ বলে। অনেক সময় সুসংঘবদ্ধ এই দল তীর্থ ভ্রমণও করে থাকে।

কথাটুকু শেষ করে সাধুবাবা অনুরোধের সুরে বললেন,

– কিছু মনে করিস না বেটা, আমাকে আর আটকাস না। হেঁটে অনেকটা পথই আমাকে যেতে হবে। এবার আমি উঠি।

এমন সুরে কথাটা বললেন, আমার আর কিছু বলার রইল না। সাধুবাবা উঠে দাঁড়ালেন। তিনি যে এতক্ষণ সঙ্গ দিলেন তার ঋণ আমি শোধ করতে পারব না। আজ থেকে কত বছর আগের কথা অথচ তিনি আজও মুছে যাননি আমার মন থেকে। স্মৃতিভ্রষ্ট না হলে মুছেও যাবেন না কখনও। প্রণাম করলাম। মাথাটা পায়ে ঠেকিয়েই প্রণাম করলাম। মাথায় হাত দিয়ে বললেন,

– বেটা, তোর ব্যবহারে আমি প্রীত হয়েছি। অন্তর থেকে আশীর্বাদ করি, আমাকে ভিখারি না ভেবে সাধুর সম্মান দিয়েছিস, ভবিষ্যতে তুই সম্মানী ও যশস্বী হবি। সকালে পেট ভরে খাবার খাইয়েছিস। এখন তুই সত্যিই অভাবে আছিস, দুঃখ কষ্টে আছিস। এসব কেটে যাবে, অর্থ অন্ন ও বস্ত্রকষ্ট তুই আর পাবিনা কখনও। ঈশ্বরে, গুরুতে তোর শরণাগতি লাভ হবে।

এমন আশীর্বাদের কথা শুনে সারাটা দেহ আমার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। কাঁপতে লাগলাম। আনন্দে আবেগে দুচোখ বেয়ে ঝরঝর করে নেমে এল জলের ধারা। হাতদুটো জোড় করে কেমন যেন বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আর কোনও কথা না বলে ডান হাতটা অভয়সূচক করে মন্দিরের পথেই মিলিয়ে গেলেন ভিড়ের মধ্যে। সাধুবাবা মিলিয়ে গেলেও হারিয়ে যায়নি সেই সময় আমার দৈন্যময় জীবনে তাঁর বলা কথাগুলো, আজও।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button