সাধুরা কি সত্যিই সংসার ত্যাগ করে, মনকে ছুঁয়ে যাওয়ার মত জবাব দিলেন সাধুবাবাই
এই সব ছেলে বুড়োদের দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম প্রভাসঘাটের সোজা লম্বাচত্বর ধরে। অনেক দূর থেকে দেখতে পেয়েছি এক সাধুবাবাকে।
এগিয়ে চললাম প্রভাসতীর্থের ঘাট ধরে। একদিকে থইথই করছে জল। বেশিরভাগ ঘাটই ভাঙাচোরা, অপরিস্কারও বটে। প্রভাসে শ্রীকৃষ্ণের দেহরক্ষার পর থেকে আর বোধহয় কেউ সময় পায়নি ঘাট পরিস্কার করার। অনেকে স্নান করছে, কেউবা করছে পারলৌকিক ক্রিয়াদি পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে। ‘জানানা’ বা ‘মরদানা’ বলে কিছু নেই। নারীপুরুষ সমান সমান। একই ঘাটে স্নান করছে সকলে।
এই ঘাটগুলির কাছে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু লোক যারা স্নান করছে না, পারলৌকিক ক্রিয়াদিও নয়। এদের মধ্যে যুবক তো আছেই, আছে আধাবয়সী, বেশ বয়স্কও। ওদের কাজ শুধু দেখা। মেয়েদের স্নানের সময় অসতর্ক মুহুর্তটাই এদের কাছে একমাত্র আকর্ষণ। আরও বেশি সতর্ক হলে, কিছু দেখা না গেলেও সিক্তবসন লেপ্টানো দেহের আকর্ষণই বা কম কি? এটা দেখার জন্যেই এদের হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা। চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায় এখন সংসারের আর কোনও ভাবনাই এদের নেই।
এমন পুরুষের সংখ্যা কম নয় সারা ভারতের সমস্ত তীর্থের স্নানঘাটে। এরা দেখে, এদেরও যে কেউ দেখে, এরা তা দেখে না। হরিদ্বারের হর কি পেয়ারী, কাশীর দশাশ্বমেধ, অমরনাথের অমরগঙ্গা, কলকাতার কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর, মধ্যপ্রদেশের নর্মদা কুণ্ড থেকে শুরু করে এমন কোনও ঘাট নেই, যেখানে দণ্ডায়মান এই কামাতুর পুরুষগুলো নেই। এদের চোখগুলো যেন গিলে খাচ্ছে স্নানরতাদের। পলক পড়ে না। একেবারে বকচক্ষু। কোনও বিশেষ তিথিউৎসবে যেকোনও তীর্থের স্নানঘাটে মেয়ে স্নানার্থীর সংখ্যা বাড়ে, এদের সংখ্যাও বাড়ে। এমনও দেখেছি, নিজ পরিবারের কেউ স্নানে নামলে তাদের জামাকাপড় নিয়ে বসে থাকে ঘাটে। ভাবটা এমন, চুরি যেতে পারে তাই কোলে নিয়ে বসে আছি। আর চোখদুটো খুঁজে বেড়াচ্ছে গা থেকে কাপড় সরে যাওয়া মেয়েদের। এরা একবারও ভাবে না, এদের নিয়েও কেউ ভাবে।
এই সব ছেলে বুড়োদের দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম প্রভাসঘাটের সোজা লম্বাচত্বর ধরে। অনেক দূর থেকে দেখতে পেয়েছি এক সাধুবাবাকে। এসে গেলাম একেবারে সামনে যেখানে বসে আছেন তিনি। এখানে সাধু মহাত্মাদের অসংখ্য বাঁধানো সমাধিবেদী। এরই নিচে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন কোনও সাধুসন্ন্যাসী। পাশে একটা শিবমন্দির। এখান থেকে একটু দূরে থইথই করছে নিস্তরঙ্গ জলরাশি।
সাধুবাবা বসে আছেন একটা কম্বল বিছিয়ে। মুখোমুখি বসে আছে দুজন অল্পবয়স্ক ছেলে। এদের দেখে স্থানীয় বলেই মনে হল। পরনে ময়লা নোংরা পোশাক। দীর্ঘদিনের অভাব ফুটে উঠেছে পোশাকে, দেহে। দেখলাম সাধুবাবারও ওই একই দশা। ছেঁড়া ন্যাতার মতো একটা কাপড় পরা, ময়লা। একেবারেই ময়লা। ময়লারও আর তিল ধারণের জায়গা নেই। এলোমেলো চুলে মাথাভরা। একটু খয়েরি রঙের। তেলজলের বালাই নেই তাই এমন হয়েছে হয়তো! মাথার পিছন দিকটায় একটা মাত্র জটা হাতখানেক লম্বা। জটা একটা, এমনটা খুব কম দেখা যায়। গালদুটো একেবারেই তোবড়ানো। বহু ব্যবহারে তোবড়ানো খালি নারকেলতেলের কৌটোর পেটটা যেমন হয় তেমন। প্রায় সব দাড়িই পাকা। একনজরে সুন্দর চোখ। ইহলোকের সম্পত্তি ছোট্ট ঝুলিটা রয়েছে পাশে। মুখখানা দেখলে বেশ বোঝা যায় সংসারের কোনও আবিলতাই স্পর্শ করেনি সাধুবাবাকে। পৌষ মাস। এই শীতেও গায়ে তেমন শীতবস্ত্র কিছু নেই পাতলা কাপড়ের একটা টুকরো ছাড়া। সারা কপালে মাখানো বাটা চন্দন। ময়লা রঙের উপর ফুটে উঠেছে সাদা চন্দন, দারুণ লাগছে দেখতে। বয়েস আন্দাজ ৭০/৭৫-এর মধ্যে হবে। দেখে মনে হয় এককালে চেহারাটা বেশ বলিষ্ঠ ছিল। ভাঙতে ভাঙতে এই বয়েসে যেমন হয় এখন তেমন। মোটের উপর ঝুলি আর জটা এ দুটো না থাকলে ভিখারিই বলতো লোকে।
সাধুবাবার পাশে গিয়ে বসতেই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল ছেলেদুটো। নিজেরা জড়ানো হিন্দিতে কিছু একটা বলল। বুঝলাম না। ওদের বিরক্তির কোনও কারণ হলাম কিনা জানতে চাইলে ওরা দুজনেই একবাক্যে হিন্দিতে বলল, না, তেমন কিছু নয়। তবে জানতে চাইল হঠাৎ আমি কেন এসে বসলাম। সাধুসঙ্গই আমার উদ্দেশ্য, এ কথা জানাতে খুব খুশি হল ওরা। আর কোনও কথা বললাম না ওদের সঙ্গে, ওরাও না। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম সাধুবাবাকে। মুখে কিছু বললেন না। হাতজোড় করে শুধু কপালে ঠেকালেন।
সাধুবাবা নিজের থেকে কিছু বলেন কিনা, এই অপেক্ষায় বসে রইলাম চুপ করে। কেটে গেল প্রায় মিনিট পাঁচ-সাত। কোনও কথাই বললেন না। আগে কথা হচ্ছিল ওদের সঙ্গে। আমার উপস্থিতিতে সকলেই চুপ। এবার উঠে গেল ছেলে দুটো। ওরা উঠতেই খুশি হলাম মনেমনে। এটাই তো চাইছিলাম। এখন মুখ খুললেন সাধুবাবা,
– কোথা থেকে আসছিস?
মুখে হাসিহাসি ভাব আনলাম একটা। সংসারে একে অন্যকে খুশি করতে স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে, শাশুড়ি বউমাকে, বউমা শাশুড়িকে, অফিসে ছোটবাবু বড়বাবুকে, যেকোনও পরিবারে, যেকোনও পরিবেশে, যেকোনওভাবে নিজের স্বার্থসিদ্ধি কিংবা ভালোমানুষি ভাব দেখানোর জন্যে আর সকলে যেমন মিথ্যা হাসি একটা ফুটিয়ে তোলে মুখে তেমন করে বললাম,
– বাবা, বাড়ি আমার কলকাতায়। দূর থেকে দেখতে পেলাম আপনাকে। ভাল লাগল। তাই এসে বসলাম আপনার কাছে। কথাটা শুনে কিছু একটা চিন্তা করলেন মনে হল মুখের ভাবটা দেখে। কিন্তু কোনও কথা বললেন না। তীর্থযাত্রীদের আনাগোনা লক্ষ্য করতে লাগলেন। আবার মাঝেমাঝে তাকাচ্ছেন আমার মুখের দিকে। এইভাবে কাটল আরও কিছুটা সময়। আমিই এবার জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, আপনার ডেরা কোথায়, এখানে?
একটু অনিচ্ছার সুরে বললেন,
– ‘নেহি বেটা’, নীরোগ মানুষের যেমন কোনও ওষুধের প্রয়োজন হয় না তেমনই কোনও ডেরার প্রয়োজন হয় না সাধুদের। যখন কোনও সাধুর ডেরা আছে দেখবি, তখন নিশ্চিত জানবি সেই সাধুকে গৃহীদের মতো কোনও কামনারোগে ধরেছে, চিকিৎসার প্রয়োজন।
এরকম কাঠখোট্টা কথা বলবেন ভাবিনি। বললাম,
– এটা কি ঠিক বললেন বাবা? সাধুদের একটা ডেরা থাকলে শীত গ্রীষ্ম বর্ষার হাত থেকে যেমন বাঁচা যায় তেমন সাধনভজনেরও তো অনেক সুবিধা হয় বলে আমার মনে হয়, আপনার কি মত?
চুপ করে রইলেন কথাটা শুনে। মনে হল, কোনও প্রয়োজন মনে করছেন না উত্তর দেয়ার। কাটল বেশ কিছুটা সময়। আমিই বললাম একটু অনুনয়ের সুরে,
– বাবা, আপনাকে প্রশ্ন করায় মানসিক দিক থেকে কি অপ্রসন্ন হয়েছেন আপনি? যদি তেমন কিছু হয়ে থাকেন তাহলে উঠে যাচ্ছি আমি। আপনার কোনও অসুবিধা হোক এমন উদ্দেশ্য আমার নয়।
কথাটা বলে একটা অভিমানের ভাব নিয়ে যেই উঠতে যাব, ওমনি সাধুবাবা বললেন,
– বোস বোস বেটা, বোস। অপ্রসন্ন হইনি আমি। তোকে দেখার পর থেকে ভাবছি হাজার প্রশ্ন করবি, এই ভাবনাই ভাবিয়ে তুলেছে আমাকে, আর কিছু নয়।
কথাটা শুনে মনে হল বেশ কাজ হয়েছে। অভিমানের ভাব দেখানোটা বেশ কাজে লেগেছে। তাই আগের কথার রেশ টেনে বললাম,
– বাবা, আগে যে কথাটা বললাম, সেটা কি ভুল বলেছি?
এবার কণ্ঠে ফুটে উঠল প্রতিবাদের সুর। বললেন,
– তোর কথার সঙ্গে আমি একমত নই। কেন জানিস? জপ করবে মন। তাঁকে ডাকবে মন। মন মনেতেই করবে যাগযজ্ঞ হোম-পূজাদি। এরজন্যে ডেরার কি প্রয়োজন বলতো শুনি? এই ঘাটে বসেই তো নিরবচ্ছিন্ন জপ করা যায়। আকুলভাবে ডাকা যায় তাঁকে। প্রাণ খুলে কাঁদা যায় তাঁর জন্যে। এরজন্যে কি কোনও ডেরা বা প্রাসাদের প্রয়োজন আছে? আর ডেরাই যদি সাধুরা করবে তাহলে বাড়িঘর ছেড়ে পথে বেরনো কেন? নিজের বাড়ির চেয়ে ভাল ডেরা কি কারও পথে ঘাটে অন্যের জমিতে হতে পারে?
কথাটা শেষ হতে না হতেই বললাম,
– তাই যদি হয় বাবা, জপের কাজটা তো ঘরে বসেও করা যেত অনায়াসে। আপনি কেন তাহলে ঘর ছেড়ে পথে বেরোলেন? তাঁকে ডাকার কাজটা যখন মনেরই, তখন মনটা তো ঘরেও একাজ করতে পারত, তারজন্যে গৃহত্যাগের প্রয়োজনটা কোথায়, কেন ঘর ছাড়লেন আপনি?
এমন পাল্টা প্রশ্নে একটু দমে গেলেন মনে হল। তবে মুহুর্তে সে ভাবটা কাটিয়ে উঠলেন, মুখ দেখে তাও মনে হল। হালকা একটা হাসির ভাব ফুটে উঠল চোখে মুখে। বললেন,
– ‘হাঁ বেটা, তু সহি বাত বোলা।’ তাঁকে ডাকবে মন, তা ঘরে বসেও ডাকা যায়। তবে আমার কথা বলি, ঘর ছেড়েছি আমি ভগবানের প্রেরণাতে। ভিতর থেকে একদিন মনে হল সব ছেড়ে দে। মনে হওয়ামাত্র বেরিয়ে পড়লাম। আর ফিরেও তাকালাম না পিছন দিকে। একটা কথা আছে বেটা, আমরা কিন্তু কেউই সংসার ছাড়িনি, না তুই না আমি। আমরা সকলেই আছি পরমাত্মার সংসারে। এখানে এসেছি বেড়াতে। সময় হলে চলে যাব, তুইও।
অনেক অনেক প্রনাম নেবেন গুরুজী ,
ফেসবুকে , আপনার লেখা সাধুবাবাদের কথা পড়বার জন্য
মনটা ছটফট করে , কিন্তু এখন পাই না ,দয়া করে দিলে
খুব ভালো হয় ।