Mythology

মৃত ব্যক্তির ছবি রাখা নিয়ে গুরুতর বিষয় জানালেন সাধুবাবা

প্রসঙ্গ পাল্টালাম, কারণ হু-হু করে কেটে যাচ্ছে সময়। হাতে সময় অল্প অথচ জানতে হবে অনেক কথা। জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, সাধুজীবনে যখন আছেন তখন নিশ্চয় জানেন আপনার মতো পথ চলতি সাধু যারা, তাদের কোনও আশ্রয় নেই — নেই কোনও ঠিকানা। আজ এখানে কাল সেখানে, এইভাবেই কেটে যায় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আমার জিজ্ঞাসা, শেষ দিনটাকে নিয়ে। দেহত্যাগের পর কে বা কারা তাদের দেহটাকে দাহ করে বা সমাধি দেয়?


প্রশ্নটা শুনে একটা অদ্ভুত প্রসন্নতার ভাব ফুটে উঠল সাধুবাবার মুখখানায়। একটু ভেবে নিয়ে বললেন,

– বেটা, যেসব সাধুসন্ন্যাসীরা মঠ মন্দির আশ্রমে আশ্রয় নিয়ে আছেন, তাদের দেহত্যাগের পর মৃতদেহ দাহ করে বা বিশেষ নির্দেশ থাকলে সমাধি দিয়ে দেয় তার ভক্তশিষ্যরা। সমাজে এটা হয়তো দেখে থাকবি। আর আমার মতো ‘রমতা’ সাধু যারা, তারা বেওয়ারিশই বলতে পারিস। কিন্তু এদের এমনই ভাগ্য, তাঁর নামে পড়ে থাকায় তাঁর এমনই কৃপা এদের উপরে, একটু খোঁজ নিলে দেখতে পাবি এরা সচরাচর হাসপাতালে মারা যায় না। দেহটাও পচেগলে পড়ে থাকে না মর্গে, পথেঘাটে। ‘গণদাহ’-র মতো পুড়িয়েও দেয়া হয় না এদের মরদেহ। দৈবাৎ কখনও এক-আধটা হলেও হতে পারে তবে হয় না বললেই চলে। আমি অন্তত এই বয়েস পর্যন্ত দেখিনি কোথাও।


এদিক ওদিক তাকিয়ে নিলেন একটু। কথায় কথা টেনে এনে ছেদ টানলাম না কথায়। শুরু করলেন,

– পথচলতি সাধুদের দেখবি সবসময় কোনও না কোনও তীর্থে অবস্থান করে তারা। বেটা, মন থেকে সব সাধুরা সব কিছু ছাড়তে পারে কিনা জানি না, তবে সব ছাড়তে পারুক বা না পারুক, ভগবানের নামে পড়ে থাকার ফল একটা আছেই আছে। সারাজীবনে অনেকটা পথই তো চললাম। এই চলার পথে দেখেছি, প্রায় সব ‘রমতা’ সাধুদের মৃত্যু হয় অতি সামান্যরোগে ভুগে। ‘রমতা’ সাধু দীর্ঘকাল ভুগে ভুগে মারা গেছে এমন তুই পাবি না। আমি নিজেও দেখিনি। ভগবানের কত দয়া! দেখেছি মৃত্যুর সময় কোনও ভাল মানুষকে তিনি পাঠিয়ে দেন মৃত্যুপথযাত্রী সাধুর কাছে। পাঠিয়ে দেন শেষ সেবাটুকু আর শেষকৃত্যাদি সম্পন্ন করার জন্যে। আর্থিকসম্পন্ন হলে সে নিজেই বহন করে সমস্ত খরচা। নইলে স্থানীয় আর সকলে মিলে সাহায্য তুলে শেষ করে শেষ কাজটা। কখনও কোথাও কোনও সাধুর শেষকৃত্যাদি সম্পন্ন করতে অসুবিধে হয়েছে এমনটা দেখিনি। তবে খুব আর্থিক অসুবিধে হলে পথচলতি সাধুর দেহটা নদী কিংবা গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয় সাধারণ মানুষ। সারাজীবনে এমন ভাসিয়ে দিতে দেখেছি এক-আধবার।

একটু থেমে কি যেন একটু ভাবলেন! বললেন,

– তবে গিরি সম্প্রদায়ের সাধুদের অনেকের দেহকে দেখেছি সলিলসমাধি দিতে। দেহরক্ষার পর মৃতদেহে পরিয়ে দেয়া হয় নতুন বসন। তারপর সুন্দরভাবে সাজিয়ে দেয়া হয় ফুলের মালা দিয়ে। এবার ভারীভারী পাথর বেঁধে দেয়া হয় মরদেহে। এসব কাজ শেষ হলে দেহটা নৌকায় করে নিয়ে যাওয়া হয় মাঝগঙ্গায়। যেখানে গঙ্গা নেই সেখানে কোনও নদীতে। নৌকার মধ্যে আসন অবস্থায় বসিয়ে পরে ছেড়ে দেয়া হয় জলে। দেখতে দেখতে তলিয়ে যায় দেহটা। এইভাবে দেয়া হয় সলিলসমাধি।

কথাটা শেষ হতে জানতে চাইলাম,

– বাবা, এইভাবে জলসমাধি দেয়া হয় কেন? এর পিছনে নিশ্চয় কোনও কারণ আছে, আপনি কি জানেন বা শুনেছেন কিছু?

গাম্ভীর্যভরা মুখে বললেন,

– হিন্দুদের দেহ পুড়িয়ে ফেলা, খ্রিস্টান মুসলমানদের কবর দেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। জলসমাধি দেয়াটা গিরি সম্প্রদায়ের একটা রীতিই বলতে পারিস। অবশ্য এর পিছনে কোনও কারণ থাকলেও থাকতে পারে। ঠিক বলতে পারব না। আমার ধারণা, জলসমাধি আর কিছু কিছু হিন্দুসাধুর মরদেহ সমাধি দেয়ার পিছনে একটা কারণ, সাধনভজনে দেহটা নামময় হয়ে যায় বলে। তবে বেটা হিন্দুদের দেহটা পুড়িয়ে ফেলার একটা বড় কারণ আছে। সেটা কি জানিস? মৃত্যুর পর আত্মা দেহ ছেড়ে চলে গেলেও জাগতিক বিষয় ও দেহের উপর আকর্ষণ একটা থেকে যায় প্রথম অবস্থায়, যদি উন্নত ও মুক্ত আত্মা না হয়। সমাধি দিলে আত্মা ওই দেহের উপর আকর্ষণ অনুভব করে যতদিন না দেহটা মাটিতে মিশে যাচ্ছে, যতদিন না মুক্তি পাচ্ছে বা পুনর্জন্ম হচ্ছে সেই আত্মার। এতে আত্মার কষ্ট বাড়ে। পুড়িয়ে ফেললে প্রথম আকর্ষণ দেহটার উপর মায়া কেটে যায় অতিদ্রুত। আত্মার পরিতৃপ্তির জন্যেই মৃত্যুর পর দেহ পুড়িয়ে ফেলার রীতি। বেটা, মৃতব্যক্তির ফটোও ঘরে রাখা উচিত নয়, প্রকৃতই মানুষ যদি তার স্বজনের আত্মিক কল্যাণ চায়। মৃতের ছবিও আত্মার মায়া ও কষ্ট বৃদ্ধির কারণ জানবি।

এবার সেই আগের প্রশ্নে ফিরে জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, এমন এক অনিশ্চিত জীবন কেন আপনি বেছে নিলেন? আগে বলেছেন, ভগবানের প্রেরণাতেই ঘর ছেড়েছেন। প্রেরণাটা এল কেমন করে?

এ প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে গেলেন সাধুবাবা। তারপরই সে ভাবটা কাটিয়ে নিয়ে বললেন,

– কোন জীবনটা নিশ্চিত বলতে পারিস বেটা? তবুও এ পথে তাঁকে পাওয়ার একটা আশা থাকে সাধুসন্ন্যাসীদের। সংসারজীবনে তাঁকে লাভ করা যে কত কঠিন তা একমাত্র সংসারীরাই বলতে পারে। সবকিছুর মধ্যে থেকে কজন সংসারী তাঁকে লাভ করেছে? এ পথটাও যে তাঁকে লাভ করার জন্যে অতি সরল, তা যে নয় সেটা তো আমি খুব ভালভাবেই বুঝতে পারছি। আর এ পথে আসার প্রেরণাটা কেমন করে এল বলি শোন। একেবারে ছোটবেলাতেই মারা গেল বাবা মা। তখন ছোট শিশু আমি। বয়েস বছরপাঁচেক হবে। রইলাম আমি আর দিদি। ওর তখন বিয়ে হয়ে গেছিল, অল্প বয়েসে। আমি বাবা মায়ের একটু বেশি বয়েসের সন্তান। মায়ের মতো স্নেহ ভালোবাসা যেটুকু পেয়েছি দিদির কাছ থেকে। তারপর দিদি হঠাৎ একদিন চলে গেল সামান্য রোগে। তখন বয়েস আমার আন্দাজ বারোই হবে। মানসিক দিক থেকে কেউ আর সহায় সম্বল রইল না। অধীর হয়ে পড়লাম শোকে।

কথাগুলো বলার সময় বিবর্ণ ফ্যাকাসে হয়ে গেল সাধুবাবার মুখখানা। অন্তরের দুঃখের একটা ছাপ ফুটে উঠল সারা চোখেমুখে। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

– নিজের বলতে আমার কেউ রইল না সংসারে। এমন একটা অবস্থায় ভিতর থেকে কে যেন বলে দিল বেরিয়ে পড়, বেরিয়ে পড়। রোগ শোক দুঃখ বেদনা আর জ্বালার নামই সংসার। সংসারে থাকলে তোকে ঘর করতে হবে ওদেরই সঙ্গে। যদি শান্তি চাস, এখনই বেরিয়ে পড়। একদিন নয়, প্রতিদিন একই সুর, একই কথা কে যেন বলতে লাগল অন্তরে। এতে একেবারে অস্থির হয়ে পড়লাম আমি। একদিন একছুটে বেরিয়ে পড়লাম ঘর ছেড়ে। তারপর স্থির হয়ে গেলাম ধীরে ধীরে। ভগবানকে লাভ করার বাসনা আমার কিছুই ছিল না। এইভাবেই একদিন বেরিয়ে পড়েছিলাম পথে, নিঃশব্দে। কেউ টের পায়নি এ পথে আসার সময়, টের পাবে না কেউ চলে গেলে। বেটা, এ পথে আসার কারণ একটাই। এটাকেই আমি মনে করি ভগবানের প্রেরণা।

এমন বিমর্ষতা কাটাতে একটু রসিকতার সুরে বললাম,

– তাহলে বাবা সংসারের ভয়েতেই বলুন আপনি গৃহত্যাগ করেছেন?

মুখের তাৎক্ষণিক মলিন ভাবটা কাটিয়ে আবার সাধারণভাবে ফিরে এসে বললেন,

– বেটা, বারোবছর বয়েসে সংসার ভয়? তখন সংসারের বুঝিটা কি? যদি মনে করিস ভয়েতে এসেছি এ পথে তাতে ভালই হয়েছে আমার। ভাল আছি বেটা, বেশ ভাল আছি। পরম শান্তিতে আছি। আমার মত কটা লোক আছে এমন শান্তিতে, এমন আনন্দে!

অনেক দিনের জমে থাকা একটা প্রশ্ন হঠাৎ মনে পড়ে গেল। বলে ফেললাম,

– বাবা, ভারতের প্রায় সব সাধকের জীবনীই আমি পড়েছি। তাতে একটা বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি, প্রায় প্রতিটা সাধকই বলেছেন ‘সংসারে থেকেও তাঁকে লাভ করা যায়।’ এ কথা যারা বলেছে, তাদের মধ্যে প্রায় কেউই কিন্তু সংসার করেননি! এমন অসংখ্য উদাহরণ আমি দিতে পারি। যারা করেছেন, তারাও কিছুদিনের জন্যে। তারপর বেরিয়ে পরেছেন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে। মোটের উপর ওই কথার বক্তা সাধক বা সাধুসন্ন্যাসীরা শেষ পর্যন্ত কেউই ছিলেন না সংসারে। আপনি বাংলার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের নাম শুনেছেন কিনা জানি না। তিনিও বলেছেন ওই একই ধরনের কথা। অথচ নিজে গতরে খেটে রোজগার করে, সংসারে আর পাঁচজনকে খাইয়ে, নিজে খেয়ে কখনও সংসার করেননি। তাঁকেও একটা আলাদা জীবনে থাকতে হয়েছে গ্রাম ছেড়ে এসে। সাধকেরা নিজেরা সংসার করলেন না অথচ জ্ঞান দিলেন সংসারীদের, ‘সংসারেই তাঁকে মিলবে’, সাধুদের এ কোন ধরনের উপদেশ? এ ব্যাপারে আপনার কি মত?

কথাটা শুনে হেসে ফেললেন সাধুবাবা। বললেন,

– বেটা সাধুজীবন আর সংসারজীবন, সবক্ষেত্রেই লাভ করা যায় তাঁকে। ঘর ছেড়ে বেরনো সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। সৃষ্টির নিয়মে চেষ্টা করেও সম্ভব হয় না। সংসারে সার্বিক ভোগের ভিতর দিয়ে তাঁকে ডাকা এক জীবন, সাধুদের ভোগবিহীন সংযম ও কঠোরতা এক জীবনসাধন, এই দুই জীবনের পার্থক্য অনেক। আমার ধারণা ও বিশ্বাস, সংসারত্যাগী মহাপুরুষ বা সাধকেরা ওকথা বলেছেন এই কারণে গৃহীরা যেন এমন না ভাবে, সংসারে থেকে তাঁকে লাভ করা যায় না। তবে বেটা, সংসারীদের কাঁধে বোঝা নিয়ে চলা, আর সাধুদের ঝাড়া হাত-পা, তফাৎ এই। এবার সংসারীদের মধ্যে ভোগ বাসনার বোঝার ভার যত বেশি, তার চলার গতি তত কম । সাধু-গৃহী, কেউ দুদিন আগে পৌঁছবে, কেউ দুদিন পরে, এই আর কি। তবে ছোট্ট একটা কথা বলে রাখি বেটা, সংসারীরা সাধনবলে সাধনমার্গে অনেক উচ্চাবস্থাপ্রাপ্ত হতে পারে কিন্তু তাদের কখনও বিভূতিলাভ হয় না, এ কথা নিশ্চিত সত্য বলে জানবি।

প্রশ্ন করলাম,

– তাহলে গৃহত্যাগী সাধুসন্ন্যাসীরা কি সকলেই বিভূতিলাভের অধিকারী হতে পারেন? আপনার কি সে লাভ হয়েছে?

হাত আর মাথা নাড়িয়ে বললেন,

– না না বেটা, আমার ওসব লাভটাভ হয়নি। কঠোরতম যোগ সাধনার মাধ্যমেই বিভূতিলাভ হয় যোগীদের। আর লাভ হয় কঠোরভাবে ব্রহ্মচর্য পালনকারী সাধুসন্ন্যাসীদের, তবে সুকঠিন ও কঠোর তপস্যা তাদের থাকতেই হবে, নইলে ওই শক্তি লাভ হওয়ার নয়। তবুও বলব লাখে একটা সাধুর হয় কিনা সন্দেহ!

অনেকটা সময় কেটে গেল এখানে। এবার শেষ প্রশ্নের উত্তরের আশায় কথা পাড়লাম,

– বাবা একটু আগে আপনি বলেছেন, গৃহত্যাগের সময় কোনও বাসনা ছিল না আপনার। বাসনাই যখন ছিলনা তখন কি নিয়ে, কেমন ভাবে পাড়ি দিলেন জীবনের এতগুলো বছর?

এ প্রশ্নে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বললেন,

– এ পথে যখন নেমে পড়লাম তখন সম্বল তো একটা কিছু চাই-ই, যাকে ধরে পথ চলা যায়। তবে আমাকে ধরতে হল না বেটা, তিনিই আমাকে ধরলেন। তাঁর করুণাতে গুরুলাভ হল আমার। তারপর ভগবানের নামস্বরূপকে সম্বল করেই পথ চললাম। তিনিই কেমন করে যেন কাটিয়ে দিলেন জীবনের এতগুলো বছর।

এ কথার উপরেই প্রশ্ন করলাম,

– বাবা, সকলেই বলেন ভগবানকে ডাকার একটা ফল আছে। সে ফল কি আপনি পেয়েছেন? সে ফলটাই বা কি?

উদাসীনকণ্ঠে নির্লিপ্ত সাধুবাবা প্রভাসতীর্থের সাগরপাড়ে বসে উত্তর দিলেন শেষ প্রশ্নের,

– পেয়েছি মানে। প্রতিটা মুহুর্তেই পাই। বেটা, গুরু আমার বীজ বপন করে দিয়েছেন। তারপর সযত্ন লালনে সে বীজ ফুটে গাছ হয়েছে, বড়ও হয়েছে ধীরে ধীরে। একসময় দেখলাম ফলও হয়েছে গাছে। সে ফলটা কি জানিস, পরমানন্দ। আত্মার গাছ আমার ভরে গেছে পরমানন্দ ফলে।

কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই টস্ টস্ করে কয়েক ফোঁটা জল নেমে এল দুচোখ বেয়ে। আর প্রশ্ন করার মতো কিছু রইল না আমার। মনে মনে ভাবলাম, সার্থক জন্ম তোমার সাধুবাবা। পৃথিবীতে এসে সহসা মানুষ যা পায় না, তা পেয়েছেন নিঃস্ব নির্বিকার এই বৃদ্ধ। এমন পাওয়া মানুষটাকে কাছে পেয়ে আমারই বা কি কম পাওয়া হল! প্রণাম করলাম। মুখে কিছু বললেন না। হাতটা শুধু একবার স্পর্শ করলেন মাথায়। ধীরে ধীরে পা বাড়ালাম আমার পথে।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button