ছোট্ট নদী মন্দাকিনীগঙ্গা। কোনও উন্মাদনা নেই। গতি একেবারেই শান্ত, যেন মরাল চলেছে প্রেমাভিসারে। ভরা যৌবন মন্দাকিনীর অথচ উন্মাদনা নেই। এমন নদী আর নারী দেখা যায় না কখনও। মন্দাকিনীও তাই যেন লক্ষ্মী মেয়ে। যৌবন আছে উচ্ছ্বাস নেই, প্রকাশ নেই কামনার। দু’পাড়ের গাছগুলি ঢেকে রেখেছে ছায়া দিয়ে। রোদের মধ্যে মায়ের কোলে যেন ছোট্ট শিশু। আঁচল দিয়ে ঢেকে দিয়েছে মাথা। মন্দাকিনীর বুকে বয়ে চলেছে কিশোরী প্রেমের স্ফটিকধারা।
এরই পাড়ে বসে আছেন এক বৃদ্ধ সাধুবাবা। একেবারে তন্ময় হয়ে। ঠিক অত্রিমুনির প্রাচীন আশ্রমের সামনের দিকটায়। দূর থেকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম। এসে দাঁড়ালাম পাশে। দেখলাম গলা থেকে পা পর্যন্ত একটা ঢলঢলে সেমিজের মতো, পিরাইন বলে। শতচ্ছিন্ন। কালো কুচকুচে। কাঁধে পাতলা একটা কম্বল, তাতে ফুটোর সংখ্যাও কম নয়। কয়েক জায়গায় আবার ফেঁসেও গেছে। মাথায় পাগড়ি। পাশে সরু চোঙের মতো বালতি একটা পিতলের। ব্যস, আর কিচ্ছু নেই। বাথরুমে কেউ আছে কিনা জানার জন্য যেমন নকল কাশির প্রচলন, তেমনই দিলাম। আওয়াজে তন্ময়তা ভাঙল সাধুবাবার। দেখলাম টানা নাক উন্নত। চোখদুটোও বেশ টানা টানা। রোদে জলে একটু মরচে ধরেছে রংটায়। নইলে একসময় বেশ ফরসা ছিলেন বলেই মনে হল। তাকালেন, কথা বললেন না। টুকরো একটা পাথরের উপরে বসেছিলেন। আমিও বসলাম পাশের একটা পাথরে। আমার আসা ও বসাটা লক্ষ্য করলেন তবুও উপযাচক হয়ে একটা কথাও বললেন না। ভাবলাম, দেখি সাধুবাবা কথা বলেন কি না? কেটে গেল মিনিট দশেক। উশখুশ করছি। সাধুবাবা কিন্তু ফিরেও তাকালেন না।
এবার প্রণামের জন্য হাত বাড়াতেই একটু চমকে উঠলেন। হাত দিয়ে বাধা দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। প্রণাম করলাম। হাতদুটো কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার করলেন। কথা শুরু করতে হল আমাকে,
– বাবা, তীর্থদর্শনে এসেছেন বুঝি?
ঘাড় নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বললেন। মুখে কোনও কথা নয়। জিজ্ঞাসা করলাম,
– চিত্রকূট দর্শন হয়ে গেছে?
এবারও মুখ খুললেন না। ওই একই কায়দায় ‘হ্যাঁ’ বললেন। আমিও ছাড়ছি না। কথা সাধুবাবাকে বলতেই হবে। বললাম,
– কতদিন আছেন এখানে?
আড়চোখে তাকালেন মুখের দিকে। মুখ খুললেন এবার,
– আজ দুদিন হল এসেছি। পাশে পিতলের সরু বালতির ভেতরে দেখলাম কিছু নেই। একেবারেই ফাঁকা। এবার জিজ্ঞাসা করলেন আমাকে,
– কোথা থেকে আসছিস?
মুখে কৃত্রিম হাসির একটা ভাব রেখে বললাম,
– থাকি কলকাতায়। এলাহাবাদ হয়ে এসেছি চিত্রকূটে। এখন ওখান থেকে এখানে। আজই ফিরে যাব চিত্রকূটে। আপনি কি আজ থাকবেন?
মাথা দুলিয়ে বললেন,
– হ্যাঁ আজ রাতটা থাকব। কাল রওনা দেব।
– এখান থেকে যাবেন কোথায়?
– কোই ঠিক নেহি হ্যায়। গুরুজি যাঁহা লে যায়গা ওহি পর যাউঙ্গা।
জানতে চাইলাম,
– আপকা সম্প্রদায় ক্যা হ্যায় বাবা?
– উদাসী। মালুম হ্যায় তেরা, ইস্ সম্প্রদায়কা নাম তু শুনা কভি?
ঘাড় নেড়েও মুখে বললাম,
– হ্যাঁ বাবা, গুরু নানক প্রবর্তিত সম্প্রদায়ই তো উদাসী।
কথাটা শুনে খুব খুশি হলেন। বললেন,
– হ্যাঁ বেটা, তুই ঠিকই বলেছিস। ম্যায় ওহি সম্প্রদায়কা হুঁ।
সাধুবাবার মুখটা দেখে মনে হল কথা বলায় তাঁর আর আপত্তি নেই। নিজের ভিতরেও এল একটা খুশি খুশি ভাব। বললাম,
– চিত্রকূটে আসার আগে কোনও তীর্থ করে এলেন?
– মাইহারে কয়েকদিন থেকে সারদা মায়ের দর্শন করে এসেছি এখানে।
আগের প্রশ্নেই ফিরে গেলাম,
– এখান থেকে যাবেন কোথায় চিত্রকূটে?
সাধুবাবার সেই একই উত্তর,
– আগে তো বললাম বেটা ঠিক নেই। আমার গুরুজি যেখানে নিয়ে যাবেন সেখানেই যাব।
মুখের দিকে ভাল করে তাকালাম। বুঝতে চেষ্টা করলাম কথায় বিরক্ত হচ্ছেন কিনা? দেখলাম, না, তেমন কোনও ভাব ফুটে ওঠেনি মুখে। তবুও বললাম,
– আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছেন না তো বাবা?
এবার হালকা হাসির রেখা উঠল মুখখানায়। বললেন,
– মানুষের সাথে কথা বলতে যদি বিরক্তই হলাম তাহলে এই জীবনের কোনও অর্থ হয় না। সাধুজীবনে বিরক্তি হলে সাধুর পথ চলা কঠিন।
মনে সাহসটা অনেক বেড়ে গেল। কথা বলা যাবে অনেক। ধীরে ধীরে ঢুকতে হবে সাধুবাবার জীবনপ্রসঙ্গে। বললাম,
– আপনি তো বাবা এক তীর্থ থেকে চলেছেন আর এক তীর্থে। পথ চলায় পথখরচা তো কিছু লাগেই। কোথায় পান খরচা, দেয়ই বা কে? সেধে অর্থ দেয়ার মতো লোকের যথেষ্ট অভাব আছে এখন। সাধারণ গৃহীরা তীর্থে এলে দু-চার আনা বা দু-চার টাকা দিয়ে পুণ্য কেনে। ওতে কি-ই বা হয়?
কথাটা শুনে মাথাটা একটু নেড়ে বললেন,
– বেটা, কোনও নেশা নেই আমার। মদ গাঁজা ভাং কিছুই চলে না। তাই নিত্য কোনও খরচার প্রয়োজন হয় না। আর দেহধারণের জন্য যেটুকু খাদ্যের প্রয়োজন তা গুরুজিই জুটিয়ে দেন। কারও কাছে চাইতে হয় না। দেহকে রক্ষা করার মালিক তিনি—তিনিই রক্ষা করেন। তীর্থভ্রমণ ও ভ্রমণ পথে কোনও খরচা লাগে না। কারণ গাড়িতে চড়ি না কখনও। তীর্থপরিক্রমা করি আমি পায়ে হেঁটেই।
কথাটা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। বিস্মিত হয়ে বললাম,
– বলেন কি বাবা!
প্রসন্নচিত্তে দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
– হ্যাঁরে বেটা, ঠিকই বলছি। গুরুজির কাছে আশ্রয় পেলাম ১৩/১৪ বছর বয়েসে। এখন বয়েস ধর পঁচাত্তরের কাছাকাছি। এই পর্যন্ত কোনও গাড়ি ঘোরাতে চড়িনি আমি। দীক্ষার দিন গুরুজি নির্দেশ দিয়েছেন ‘পায়ে হেঁটেই তীর্থপরিক্রমা করবি’। তাঁর নির্দেশ অমান্য করিনি কখনও। তিনিই শক্তি জুগিয়ে চলেছেন। তাঁর বাক্য তিনিই আমায় দিয়ে রক্ষা করে চলেছেন। নইলে আমার সাধ্য কি? সারা ভারতের সমস্ত তীর্থদর্শন করেছি এইভাবে পায়ে হেঁটে। এতটুকু কষ্ট পাইনি পথ চলায়।
স্তম্ভিত হয়ে গেলাম কথাটা শুনে। সারাজীবন পায়ে হেঁটে সমস্ত তীর্থদর্শন, ভাবতেই পারছি না। ধন্য সাধু, ধন্য তোমার গুরুজির দয়া। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, এখানে কোন আশ্রমে উঠেছেন আপনি?
কথাটা শেষ হতে বললেন,
– না না বেটা, কোনও আশ্রম ধর্মশালা মন্দিরে আশ্রয় গ্রহণ করি না আমি। ছাদ আছে এমন কোথাও রাত্রিবাস করি না কখনও। একমাত্র বৃক্ষতলই, আমার আশ্রয়, অন্য কোথাও নয়। মন্দিরে দেবদর্শনের সময়টুকু ছাড়া ছাদ আছে, এমন জায়গায়ও বসি না। এটা আমার গুরুজিরই নির্দেশ।
এমন কথা কোনও সাধুর মুখে শুনিনি। কৌতূহল বেড়ে গেল। অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম মুখের দিকে। এমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর জীবনকথা বলবেন ভাবতে পারিনি। বললাম,
– বাবা, আপনার গুরুজি পায়ে হেঁটে তীর্থভ্রমণের কথা বলেছেন, এর পিছনে কোনও কারণ আছে নিশ্চয়ই। বলবেন দয়া করে?
বললেন সাধুবাবা,
– সাধুজীবনে সাধুর দেহ ভোগবিলাস আর আরাম পাওয়ার জন্যে নয়। কঠোরতার সংকল্প নিয়েই তো সাধুদের পথচলা, পায়ে হাঁটার সাধারণ কষ্ট তো একটা আছে তবে জপটা হয় ভাল। কারণ কোনও চিন্তা আসে না মনে। চলতে চলতে জপ করার আদেশই দিয়েছেন গুরুজি। চলার পথে প্রকৃতির রূপ আর জপ এ দুটোই এক অপূর্ব ঈশ্বরীয় আনন্দের সৃষ্টি করে অন্তরে।
কথাগুলো শুনছি আর ভাবছি কি বিচিত্র সাধু, এ এক বিস্ময়কর সাধুজীবন। জিজ্ঞাসা করলাম,
– আপনার কথা শুনে মনে হল স্থায়ী ডেরা তো কোথাও নেই-ই, ঘর তো দূরের কথা, ছাদের নিচেও বসেন না আপনি। বৃক্ষতলই একমাত্র আশ্রয়। এর পিছনেও তো নিশ্চয় কোনও কারণ আছে, বলবেন?
একেবারে অবাক করে দিয়ে সাধুবাবা বললেন,
– কারণ তো বেটা নিশ্চয়ই আছে। আর একটা কথা জেনে রাখ, কোনও গাছের নিচে একরাত্রির বেশি বাস করি না কখনও। যেমন ধর কোনও তীর্থে বাস করব তিন রাত্রি তবে একটা গাছের নিচে এক রাতের বেশি থাকব না। আজ যেটার নিচে রাত কাটাব কাল সেটার নয়।
অদ্ভুত কথাটা শুনে আর তর সইতে পারলাম না। বললাম,
– কেন বাবা, এর কারণ কি? এমন কথা তো শুনিনি কখনও!
আনন্দিত মনেই বললেন সাধুবাবা,
– জগত সংসারটা মায়ায় আবদ্ধ। কোনও কারণে গাছটার উপর যদি একবার মায়া জন্মে যায়, যেমন তার হাওয়া, তার ছায়াতে যদি মনে মায়া, আকর্ষণ কিংবা আসক্তির সৃষ্টি হয়, বন্ধনে পড়ে যাব। বেটা, মায়ার আকর্ষণ এত প্রবল, এত তীব্র যে, যেকোনও বিষয়ে, যেকোনও বস্তুতে, যেকোনও মুহুর্তে মায়া মানুষের মনকে বেঁধে ফেলতে পারে। যদি তেমন বাঁধনে বাঁধা পড়ি সেই ভয়েতেই একটা গাছের নিচে এক রাতের বেশি থাকি না।
একটু থেমে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
– মায়া মুক্ত হওয়া বড়ই কঠিন। একমাত্র উপেক্ষা ছাড়া মায়া কোনওভাবেই কাটানো যায় না। বেটা, সব বিষয়ে উপেক্ষার জীবনকেই তো বলে সাধুজীবন। উপেক্ষা নেই এমন জীবনই তো সংসারজীবন। কেমন জানিস, মায়া প্রথমে সৃষ্টি করে দেয় পরিবেশ। তার থেকে সৃষ্টি করে প্রয়োজন। তারপর তা জুগিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে মায়া বাঁধন দিতে থাকে। মায়ার ফাঁদে পা দেব না বলেই তো চলি ওইভাবে।
সাধুদের কাছে গেলে প্রথমে যখন কথা বলতে চায় না তখন খুবই অস্বস্তিবোধ করি। তারপর যখন শুরু হয়ে যায় তখন যে মনে কি আনন্দ হয় তা বলে বোঝানো যায় না। এখন আনন্দে মন আমার ভরে উঠেছে। ভারতে লক্ষ লক্ষ সাধুসন্ন্যাসীরা রয়েছেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ক’জনার কথাই বা জানতে পারি। তার মধ্যে যদি একজনার কথাও জানতে পারি সেটাই তো আমার লাভ। জানতে চাইলাম,
– বাবা, প্রচণ্ড গরমে তো না হয় একটা গাছতলায় রইলেন। কিন্তু বর্ষার সময় তো মাথা গোঁজার ঠাঁই একটা দরকার, তখন কি করেন?
নির্লিপ্তভাবে বললেন হাসিমুখে,
– ঠাঁই আমার ওই গাছতলা। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা ঝড় জল সবই আমার এই দেহের উপর দিয়ে চলে যায়। কোনও কিছুকে কখনও কিছুই মনে হয়নি, হয়ও না। মনে হলে কি এ দেহটা থাকত! বেটা, এ সংসারে সব কিছু কিছুই না, আবার সব কিছুই সব কিছু।
প্রশ্ন করলাম,
– এমন জীবনযাপনে আপনার দেহ কখনও অসুস্থ হয়নি, হয় না? বড় কোনও রোগে পড়েননি?
সামনে একটা গাছ দেখিয়ে সাধুবাবা বললেন,
– বেটা, ছোট্ট একটা বীজ থেকে ধীরেধীরে গাছটা আজ কত বড় হয়েছে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড রোদে পুড়ছে। শীতের ঠাণ্ডা আর বর্ষার ঝড় জল সবই তো বয়ে গেছে, যাচ্ছেও ওই গাছটার উপর দিয়ে। কিন্তু দেখ গাছটা মরেনি এখনও, কত সজীব! ছোট থেকে তো আজ এত বড় হয়েছে। এতদিনে তো মরে যাওয়াই উচিত ছিল, ঠিক কিনা বল? আসলে বেটা প্রকৃতি ছোট থেকে সহ্য করার ক্ষমতা দেয়াতেই গাছটার বেঁচে থাকা সম্ভব হয়েছে। আমার এ দেহটাকে তুই একটা গাছ ভেবে নে। উত্তর পেয়ে যাবি।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, ‘প্রকৃতি’ কথাটা যখন বললেন তখন ‘প্রকৃতি’ শব্দের প্রকৃত অর্থটা কি?
একমুহুর্ত ভেবে নিয়ে বললেন,
– এই বিশ্বসংসারে ঈশ্বরের বিকাশ যা তাই-ই প্রকৃতি। আমরা যা কিছু দেখছি শুনছি বলছি করছি ভাবছি, যা কিছু হয়েছে, যা কিছু হচ্ছে, যা কিছু হবে, সব-সবই ঈশ্বরের বিকাশ, প্রকৃতি।
এ কথার পর জানতে চাইলাম,
– বাবা, পড়াশুনো করেছেন কতদূর?
হাসিমুখেই বললেন,
– গুরুজি আমাকে অক্ষরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তবে অক্ষরের সঙ্গে কোনও কথা হয়নি আমার।
আবার প্রশ্ন করলাম,
– আপনি যেসব কথা বলছেন এগুলো জানলেন কি করে, বলছেনই বা কেমন করে?
আরও হাসিতে ভোরে উঠল মুখখানা। বললেন,
– কিছু বলছিনা আমি। ভেবেও বলছি না। জানি না কিছুই। তুই প্রশ্ন করলে উত্তর দিচ্ছে আমার প্রকৃতি। এটাই প্রকৃতি। এখন তোর এ প্রশ্নের উত্তর সত্য না অসত্য তা তুই জানিস না, আমিও না। সেইজন্য তো তোকে আগে বলেছি, সব কিছু-কিছুই না। আবার সব কিছুই সব কিছু।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– ঈশ্বরের অসংখ্য সার্থক সৃষ্টির মধ্যে মানুষই অন্যতম। সেই মানুষে মানুষে এতো বৈষম্য কেন?
প্রশ্ন শুনে খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলেন সাধুবাবা। পাশাপাশি দুটো গাছ দেখিয়ে বললেন,
– এটাই তো তাঁর সৃষ্টির বড় খেলা। এই দেখ, একই জল আলো বাতাস পেয়ে দুটো গাছই বড় হয়েছে। কিন্তু দেখ, একটা কত মোটা আর একটা কত সরু। একটা কত সজীব আর একটা কেমন রুগ্ন। প্রকৃতি তাঁর দেয়াতে এতটুকুও কার্পণ্য করেনি। আসলে দুটোর মধ্যে একটার অর্জন ক্ষমতা কম। ফলে আকৃতি ও প্রকৃতিগত পার্থক্যে পূর্ণ। ঈশ্বরের বিস্ময়কর বিকাশ প্রকৃতিতেই সৃষ্টি হয়ে রয়েছে বৈষম্য, মানুষ কি প্রকৃতির বাইরে। ওই একই কারণে মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টি থেকে।
তীর্থযাত্রীরা অনেকে আসছেন, চলেও যাচ্ছেন পাশ দিয়ে। কেউ আমাদের বিরক্ত করছেন না। আমরা চালিয়ে যাচ্ছি আমাদের কথা। বেলা ক্রমশ বাড়ছে। জিজ্ঞাসা করলাম,
– সাধুজীবনে অনেক বছরই তো কেটে গেল আপনার। এ জীবনে আসা থেকে আজ পর্যন্ত এমন কোনও ক্ষোভ বা দুঃখ কি কিছু সৃষ্টি হয়েছে যা আপনার মনকে কখনও কোনওভাবে পীড়িত করে?
মুহুর্তমাত্র দেরি না করেই বললেন,
– না না বেটা, কোনও ব্যাপারে মনে আমার কোনও ক্ষোভ বা দুঃখ কিছু নেই। আমি সাধু। আমার ওসব থাকবে কেন? কামনা থাকলে তো ও সব আসে। ক্ষোভ বা দুঃখের উৎপত্তি ওর থেকেই। গৃহী যার কামনা আছে তার ক্ষোভ, দুঃখ আছে। জীবনে তো চাইনি কিছু। ওটা আসবে কোথা থেকে?
জানতে চাইলাম সাধুবাবার ভবিষ্যৎ চিন্তার কথা,
– বাবা, এখন থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কি করবেন, কেমন ভাবে চলবে এসব কথা কি কিছু ভেবে দেখেছেন?
হো হো করে হেসে উঠলেন সাধুবাবা। বললেন,
– দূর বোকা, সাধুরা কি কখনও ভাবে!
জোর দিয়ে বললাম,
– তবুও কিছু ভাবনা কি আসে না?
মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,
– নেহি, কুছ নেহি, কভি-ভি নেহি।
আরও ভিতরে যাওয়ার চেষ্টায় বললাম,
– সাধুজীবনে চলার পথে কখনও কি কোনওভাবে আপনার মনের পতন ঘটেছিল?
এ প্রশ্নে সাধুবাবা ভাবলেন বেশ কয়েক মিনিট ধরে। বললেন,
– জীবনে তো কখনও কিছু ভাবলামই না। ভাবলে তবে তো মনের পতন ঘটবে! এমন কোনও কাজ করিনি, করিও না যা মনের উপর কোনও ক্রিয়া করে মানসিক পতন ঘটাতে পারে।
মনের আরও ভিতরের কথা জানতে বললাম,
– সাধনভজন জপতপের সময় ভগবানের নামই করেন। তারপর যখন কিছু না করেন, তখন কি চিন্তা, কি জাতীয় চিন্তাভাবনা করেন? মানুষের মন বলে যখন একটা কথা আছে তখন সে তো অহরহ কিছু না কিছু ভাবেই। আপনি কি সে মনের বাইরে?
এ কথাটায় চিন্তার একটা ভাব ফুটে উঠল বৃদ্ধ সাধুবাবার মুখখানায়। অ-নে-ক ভেবে বললেন,
– তোর কথাটা ঠিক। এটাই তো মন – মনের কথা। কিন্তু কি নিয়ে ভাববে বল তো? আমি তো কিছু ভেবে উঠতে পারছি না। অবসর সময়েও তো কোনও ভাবনা আসে না মনে।
ভাবলাম, মন কোন অবস্থায় পৌঁছেছে? এমন অবস্থার কথা ভাবতেই পারছি না! বললাম,
– এই যেমন ধরুন আমি আসার আগে থেকেই বসেছিলেন। তখন একা একা বসে, জপ করলে আলাদা কথা নইলে কি ভাবছিলেন আপনি?
একটু ভেবে বললেন,
– কিছু ভাবছিলাম না, চিন্তাও করছিলাম না কিছু। বসেই ছিলাম।
সাধুবাবা যত বলছেন কিছু ভাবি না, আমার ভাবনা বেড়েই চলে। এ কি করে সম্ভব! জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, মনের এমন অবস্থা আপনার হল কি করে? যোগসাধনা করেন?
উদাসী সম্প্রদায়ের সাধুবাবা বললেন উদাসীনভাবে,
– যোগ টোগ কিছু করি না। মনের অবস্থাটাই বা কি হয়েছে তাও বলতে পারব না। গুরুজি জপ করতে বলেছেন জপই করি, আর কিছু নয়।
প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম,
– আমরা সংসারে আছি। গুরু বা ইষ্টের কাছে কি প্রার্থনা করা উচিত বলতে পারেন?
এ কথায় খুশিতে ভরপুর হয়ে উঠলেন সাধুবাবা। মুখের দিকে চেয়ে রইলেন একদৃষ্টিতে মিনিটখানেক। পরে আনন্দিত চিত্তে বললেন,
– বড় সুন্দর কথা বলেছিস বেটা। এমন কথা কেউ কখনও জিজ্ঞাসা করেনি। সুন্দর, মেরা সুন্দর বেটা।
এটুকু বলে আমার মাথায় দুহাত বুলিয়ে আশির্বাদ করতে লাগলেন। সারাটা দেহ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল সাধুবাবার স্পর্শে। আমিও পা দুটো স্পর্শ করে প্রণাম করলাম। বললেন,
– বেটা, গুরু বা ইষ্টের কাছে একমাত্র প্রার্থনা হওয়া উচিত ‘হে গুরুজি, আমাকে তোমার করে নাও।’ ব্যস, এটুকুই আর একটা কথাও নয়। এই প্রার্থনাতে পার্থিব ও অপার্থিব সবকিছু লাভ হয়। কেন জানিস? শিষ্যকে যদি গ্রহণ করে নেন তাহলে তার সমস্ত দায়িত্ব বর্তে যায় গুরুর উপরে। তখন শিষ্যের সমস্ত কিছু আশা ও ইচ্ছাপূরণ করতে তিনি বাধ্য, করেনও। তাই ওইটুকু প্রার্থনাতেই সার্থক হয়ে যায় মনুষ্যজন্ম।
ছোট্ট কথা অথচ অন্তর্নিহিত সত্য ব্যাপক বিশাল যেন বটের বীজ। ভেবে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম।