Mythology

লক্ষ্যে পৌঁছতে একমাত্র পথ এটাই, নিজের জীবন অভিজ্ঞতা বললেন সাধুবাবা

বিনীতকণ্ঠে বললাম,

– বাবা, দয়া করে তো অনেক কথাই বললেন। এমন করে এসব কথা বলবেন, এত কথা বলবেন ভাবতে পারিনি। এবার অনুগ্রহ করে বলবেন, কেন সংসার ছেড়ে এপথে এলেন?


দেরি করলেন না সাধুবাবা। নির্বিকারচিত্তে বললেন,

– লোকমুখে শুনি তারা নাকি কি সব ভাবে, চিন্তা করে। তুই বিশ্বাস কর বেটা, ভাবনাটা যে কি তা আমি ভেবে পাই না। ঘর ছাড়লাম কেন, এ পথেই বা এলাম কেন, তাও তো কিছু ভেবে পাই না। তখন বয়েস আমার সাত-আট। একদিন ঘুম থেকে উঠলাম। সকালের ‘নাস্তা’টা করলাম। পড়াশুনোর কোনও বালাই ছিল না। সরস্বতী আমাদের বাড়ির মুখটুকুও দেখেনি। নাস্তা করে দু’ভাই খেলতে লাগলাম উঠোনে। হঠাৎ কি মনে হল ভাইকে বললাম, তুই দাঁড়া, আমি এখনই আসছি। ব্যস, সকলের অলক্ষ্যেই বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ি থেকে স্টেশন হাঁটাপথে প্রায় একঘণ্টা। চলে এলাম স্টেশনে। পথটা চিনতাম। ঘর ছাড়ার কিছুদিন আগে একবার বাবার সঙ্গে গেছিলাম মাসির বাড়ি রেলে চড়ে। সোজা পথ।


জিজ্ঞাসা করলাম,

– কোন স্টেশনে এলেন?

সাধুবাবা বললেন,

– জলন্ধর। কপালটা আমার এমনই ভাল, গিয়ে দেখলাম একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। যাবে কোথায় জানি না। ভাবলাম না কিছু । মা বাবা ভাই কারও কথাই না। উঠে পড়লাম। যথাসময়ে পৌঁছলাম লক্ষ্মৌ। নেমে পড়লাম। আবার ট্রেন ধরলাম ওখান থেকে। এসব করছি কেমন যেন বিবশভাবে। সোজা গেলাম হরিদ্বারে। কাউকে জিজ্ঞাসা করে ট্রেনে উঠিনি। হরিদ্বারে যাব তাও ভাবিনি। আর ওটা যে একটা তীর্থ তা জানতাম না। ও নাম শুনিনি। ওই সাত-আট বছর বয়েসেই আমার শেষ ট্রেনে চড়া। জীবনে আর কোনও গাড়িতে পা রাখিনি।

জানতে চাইলাম,

– জলন্ধর থেকে হরিদ্বার তো অনেক পথ! পথে রাতও তো কাটাতে হয়েছে ট্রেনে। কি খেয়েছিলেন পথে?

নির্লিপ্তভাবে সাধুবাবা বললেন,

– কিছু খাইনি। পথে দুদিন অনাহারেই কেটেছিল। এখানে চিনি না কিছু, জানিও না। হরিদ্বারেও পুরো একটা দিন না খাওয়া। একেবারে নুয়ে পড়লাম খিদেতে। পয়সা নেই কাছে। খাব কি? দেখলাম হর কি পিয়ারী ঘাটে বসে ভিক্ষে করছে অনেকে। যাত্রীরাও দিচ্ছে কিছু। বসে গেলাম ওদের সঙ্গে। মিলল কিছু। খেলাম। তাজা হলাম একটু। তারপর ভিক্ষে করতাম সারাদিন। ঘাটের পাশে ঘুমাতাম রাতে। এইভাবে হরিদ্বারে কাটল প্রথম তিনটে দিন।

এক নিঃশ্বাসে এই পর্যন্ত বলে থামলেন। কোনও কথা বললাম না। একটু বিশ্রাম নিয়ে বললেন,

– চতুর্থ দিন ঘাটে বসে আছি ভিক্ষে করতে। ব্রহ্মকুণ্ডে স্নান করে ফিরছেন এক সাধুবাবা। হঠাৎ নজর পড়ল আমার উপরে। ভিখারিদের মধ্যে আমাকে দেখতে পেয়ে কাছে এসে দাঁড়ালেন। মুখের দিকে তাকিয়ে মধুরকণ্ঠে বললেন,

– বেটা, আয় আমার সঙ্গে। এখানে একটা আশ্রম আছে। সেখানে থাকবি খাবি আর কাজ করবি আশ্রমের। চল ওঠ্ ওঠ্। এ পথ তোর জন্যে নয়। আয় আয় শিগগির আয় আমার সঙ্গে।

তাকিয়ে রয়েছি সাধুবাবার মুখের দিকে। কথাগুলো আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হল। মানুষের জীবনে এমন হয়! কি করে হয়? ভেবে কূলকিনারা পেলাম না। সাধুবাবা বললেন,

– তোকে কি বলব বেটা, অবাক হয়ে গেলাম কথাটা শুনে। হাতে যেন স্বর্গ পেলাম। কোনও কথা বললাম না। ভাবলামও না। উঠে দাঁড়ালাম। বিবশভাবে চললাম সাধুবাবার পিছন পিছন। এলাম একেবারে গোঘাটে। ওখানে একটা প্রাচীন গুরুদ্বার আছে। রয়ে গেলাম। আশ্রমের কাজ করি, থাকি খাই। এইভাবে কাটতে লাগল দিনগুলো। কেটে গেল মাসছয়েক। ওই সাধুবাবাই ছিলেন গুরুদ্বারের প্রধান। খুশি হলেন আশ্রমের কাজে নিষ্ঠা দেখে। তারপর একদিন এল জীবনের শুভমুহুর্ত। দীক্ষা দিলেন তিনি। শুরু হল আমার এক নতুন জীবন।

কৌতূহলী হয়ে বললাম,

– আপনার মা বাবা ভাইবোন কারও কথা মনে এল না, ভাবলেন না, মন খারাপ হলনা তাদের জন্যে?

একইভাবে বিভোর হয়ে বললেন,

– কিছু ভাবলাম না বেটা। ওদের কোনও ভাবনাই আসেনি মনে। মন খারাপও হয়নি। বাড়ির কারও মুখও আমার মনে পড়ে না। সেই থেকে জীবনের সত্তরটা বছর তো কেটে গেল এইভাবে।

কথাগুলো শুনে বিস্ময়ের অবধি রইল না। ভাবলাম, কি ধরনের মন হলে মানুষের মনের অবস্থাটা এইরকম হয়! এ কেমন গৃহত্যাগ যার কোনও কারণ বা রহস্য খুঁজে পাওয়া যায় না! কিছু ভেবে পেলাম না। তবুও ভাবছি যদি কোনও সূত্র পাই। আমার মুখের ভাবটা দেখে সাধুবাবা বললেন,

– ভেবে কিছু লাভ নেই, সময় নষ্ট। না ভেবে ভেসে চল। তাঁর কোলে মাথা রেখে কালের স্রোতে গা ভাসিয়ে দে। দেখবি, আপনিই পৌঁছে যাবি যেখানে তোর পৌঁছানোর কথা।

কথাটা বলেই একটা প্রশ্ন করলেন হুট করে,

– বিয়ে-থা করেছিস বেটা?

হেসে ফেললাম। এমন একটা প্রশ্ন করবেন ভাবতে পারিনি। বললাম,

– না বাবা, ওসব করিনি কিছু। বিয়ের বয়সই তো হয়নি এখনও।

মাথাটা নাড়লেন। কিছু বললেন না। জানতে চাইলাম,

– এত বছর ধরে কি কঠোর জীবনযাপনটাই না করলেন।! এতে লাভটা কি হল, সমাজই বা পেল কি আপনার কাছ থেকে?

সহজভাবে বললেন,

– শুধু সমাজ নয় বেটা, সংসারও কিছু পায়নি আমার কাছ থেকে। দেবার মতো তো কিছু নেই। আর এ জীবনে লাভ লোকসান কি হল তাও হিসাব করে দেখিনি। ভাবিনিও কিছু।

অনেকটা বেলা হল। উঠতে হবে এবার। জিজ্ঞাসা করলাম,

– বাবা, যাদের ঈশ্বরে বিশ্বাস বা আস্থা নেই বলে শুনি, তাদের সম্পর্কে কিছু বলবেন? আর দীর্ঘ সাধুজীবনে এই পথচলায় ঈশ্বর সম্পর্কে আপনার উপলব্ধ মতামতই বা কি?

দৃঢ়তার সুর অথচ শান্ত ধীর কণ্ঠেই বললেন,

– বেটা, কারও ঈশ্বরে বিশ্বাস বা আস্থা নেই কথাটা ঠিক নয়। প্রথমে বলি, যারা কোনও একটা শক্তির উপর নির্ভর বা বিশ্বাস করে চলেছে তাদের কথা ছেড়ে দে। যাদের বিশ্বাস নেই বা মানি না বলে, ভাবে, নিজের শক্তির বলেই সব কিছু করছে, হচ্ছে। আসলে তারা আরও বেশি ঈশ্বরে নির্ভর করছে। কেমন করে জানিস? তোকে তো আগেই বলেছি, ঈশ্বরের বিকাশ যা কিছু তাই-ই প্রকৃতি। মানুষ তাঁর শ্রেষ্ঠ বিকাশ। মানুষের ভিতর প্রকৃতিরূপ আত্মশক্তি তো ঈশ্বরেরই বিকাশ, যার ওপরে নির্ভর করে সে পথ চলছে। তাহলে নিরর্ভরটা করল না কোথায়, আস্থা বা বিশ্বাসই বা রইল না কোথায়? এখানে আত্মশক্তি প্রকৃতিই ঈশ্বর, যার উপর নির্ভর করছে।

একটা উদাহরণ দিয়ে বললেন,

– বেটা, দোকানে রঙিন জল বিক্রি হয় বোতলে। দাঁড়িয়ে থাকলে দেখবি কেউ ঢকঢক করে ঢেলে দেয় মুখে, কেউ সরু নল লাগিয়ে টানে। ব্যাপারটা কিন্তু একই। জলের সঙ্গে যোগটা দুজনেরই। একজনের সরাসরি বোতলে মুখে আর একজনের নলের উপর নির্ভর করে।

একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন সাধুবাবা। হাতদুটো কপালে ঠেকিয়ে বললেন,

– নির্ভরতা ছাড়া বাঁচতে পারে না কেউই। ঈশ্বর তিনিই, মানুষ যার উপরে নির্ভর করে।

এইটুকু বলে কেমন যেন স্থির হয়ে গেলেন। আর কোনও কথা সরল না মুখ থেকে। ধীরে ধীরে চোখ থেকে নেমে এল অশ্রুধারা। কেটে গেল অনেকক্ষণ। আমাকে ফিরতে হবে চিত্রকূটে। প্রণাম করলাম। ফিরেও তাকালেন না। সাধুবাবার শূন্যদৃষ্টি বয়ে যাওয়া মন্দাকিনীর জলে। বসে রইলেন ভাবতন্ময় হয়ে যেমন বসেছিলেন আমি যাওয়ার আগে।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button