বয়েসকে ধরে রাখার গোপন কৌশল জানালেন ৮০ বছরেও টানটান সাধুবাবা
গুরুজিকে কখনও হয়রানিতে পড়তে হয়নি আমাকে নিয়ে। তাঁর কাছে শুনেছি প্রায়ই এসে মা আমাকে বুকের দুধ খাইয়ে যেতেন। আরে বেটা, ও যে মা!
আনন্দভবন থেকে বেরিয়ে এলাম বিপরীত ফুটপাতে। এগোতে লাগগাম ঋষি ভরদ্বাজ আশ্রমের দিকে। আশ্রমে যাওয়ার রাস্তার মুখে এসে দাঁড়ালাম। বাঁ পাশে বই আর ফটোর দোকান। রাস্তাটা পিচের তবে খুব বেশি চওড়া নয়। দোকানের কর্নারে ফুটপাতে হকার বসে আছে মণিহারী জিনিস নিয়ে। এদের সকলকে বাঁয়ে রেখে সোজা এলাম আশ্রমে। পরপর কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে চত্বরে উঠেই দেখলাম মন্দিরের প্রবেশদ্বারের পাশে বসে আছেন এক সাধুবাবা। একনজরে মনে হল ৫৫/৬০-এর মধ্যে বয়েস। মাথায় জটা নেই। এলোমেলো চুলগুলো ছড়িয়ে আছে কপাল আর কাঁধে। লম্বায় এক হাতের বেশি হবে না। কালচে খয়েরি মিশিয়ে একরাশ চুল। নাকচোখ মুখ একেবারেই সাধারণ। তেমন আকর্ষণ কিছু চোখে পড়ল না। একখানা বেশ ময়লা সাদা ধুতি পরা দুভাঁজ করে। গায়ে একটা ছেঁড়া ফতুয়ার মতো, তবে ফতুয়া যেমন হয় তেমন নয়। একটু তামাটে গায়ের রং। পাশে দেখছি অজস্র তাপ্পিমারা একটা ঝোলা, বাঁদিকে। কমণ্ডলু লোটা বা জলপাত্র কিছু দেখলাম না। চেহারায় শক্তসমর্থ ভাবটা বেশ চোখে পড়ল। একাই বসে আছেন বাবু হয়ে। ইতস্তত কিছু যাত্রীর ঘোরাঘুরি ছাড়া আর তেমন কিছু নজরে পড়ল না।
মন্দিরপ্রাঙ্গণে উঠে সাধুবাবাকে দেখে সটান এসে বসলাম তাঁর মুখোমুখি হয়ে। বাঁধানো মেঝেতে ধুলোর উপরে। বসেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। কোনও আপত্তি করলেন না, বাধাও দিলেন না প্রণামে। দুহাত জোড় করে মুখে শুধু বললেন,
– জয় গুরু মহারাজজি কি জয়।
হুট করে সাধুবাবাকে পেয়ে যাব ভাবিনি। বসেও তো পড়লাম। এখন কথা শুরু করব কিভাবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে কথার যখন শেষ নেই তখন অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। শুরু করলাম এইভাবে,
– বাবা, আপনার কোনও অসুবিধার কারণ হলাম না তো?
হাতদুটো তুলে অভয় দিয়ে বললেন,
– নেহি বেটা নেহি, আমার কোনও অসুবিধা কিছু হয়নি।
মুখে হাসি নেই প্রসন্নতা আছে। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবার ডেরা কি এখানে না অন্য কোথাও?
উত্তরে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন,
– ডেরা বলতে যা তা আমার নেই। আজ এখানে কাল সেখানে, এই করেই দিন কাটে।
বুঝতে পারলাম কথা বলতে বেশি বেগ পেতে হবে না। জানতে চাইলাম,
– কোন সম্প্রদায়ের সাধু আপনি?
এবার সাধুবাবার ঠোঁটে ফুটে উঠল সামান্য হাসি, ঠিক আধফোটা ফুলের কুঁড়ির মতো। বললেন,
– বেটা আমার কোনও সম্প্রদায় নেই। কোনও জাতও নেই। গুরুজি ছিলেন কবীরপন্থী সাধু। গুরুধারা ধরলে আমি কবীরপন্থী। কবীর মহারাজজির কোনও জাত ছিল না, সম্প্রদায়ও ছিল না। তাই আমি মনে করি আমার কিছু নেই।
কথা বলে উত্তর পাচ্ছি তাই বেশ আনন্দ হল মনে। তবে আমার অজস্র দোষের মধ্যে একটা বড়ই প্রকট। সেটা সব ব্যাপারে এক্ষুনি হলে ভালো হয়। এখনই পেতে চাই। শুধু তাই নয় সবকিছু ‘তাড়াতাড়ি চাই’ ব্যাপারটা আমার বুদ্ধির বিকাশের পর থেকেই আছে। এখন সাধুসঙ্গ করতে বসে স্বভাবের দোষটা চাড়া দিল মাথায়। জানতে চাইলাম,
– বাবা আপনি ঘর ছাড়লেন কেন?
ব্যস, হয়ে গেল। সাধুবাবা যেন একটু বিগড়ে গেলেন। বেশ বিরক্তির সুরে বললেন,
– আমি ঘর ছাড়লাম কেন, তা দিয়ে তোর দরকার কি?
কথায় ও সুরে বুঝে গেলাম ঠিক জায়গায় পা পড়েনি। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে একটু কাদায় পা পড়ে গেছে স্বভাব দোষে। তবে বেঠিক জায়গায় পা পড়লেও আমার পা ধরার অভ্যেসটা তো আছে যেটা এখন অনেকেরই নেই। একেবারে পা দুটো ধরে বললাম,
– বাবা, সাধুদের জীবনপ্রসঙ্গ জানার কৌতূহল অদম্য। আপনি যদি দয়া করে বলেন তবে মনের আশাটা মেটে। বলুন না বাবা কেন ঘর ছাড়লেন আপনি?
সাধুবাবা পা থেকে হাতদুটো সরিয়ে দিতে দিতে বললেন,
– না বেটা, ওসব কথা জিজ্ঞাসা না, আমি কিছু বলব না। বেশ ছিলাম, তুই ভাগতো এখান থেকে। যা একটা কথাও বলব না।
বুঝতে পারলাম যা ভেবেছিলাম তা নয়। সব শিয়ালের এক রা। আমিও ছাড়ার পাত্র নই। জানতেই হবে, তবে এখন জোরাজুরি করে কোনও লাভ হবে না। অপেক্ষা করতে হবে সময়ের জন্য। প্রসঙ্গ ঘুড়িয়ে বললাম,
– বাবার কি সব তীর্থদর্শন হয়েছে, না বাকি আছে কিছু?
মুহুর্তে একগুঁয়ে ভাবটা কেটে গেল। আগের ভাবে ফিরে এসে বললেন,
– টুকটাক দু-একটা বাকি থাকলেও প্রায় সমস্ত তীর্থদর্শন হয়েছে। বৃন্দাবন আর নর্মদা পরিক্রমাও করেছি। এত জায়গা ঘুরলাম কিন্তু নারায়ণ সরোবরটা যাওয়া হয়নি। ইচ্ছে আছে ওখানে একবার যাব।
সাধুবাবা এখন অনেক সহজ হয়ে এসেছেন। আমারও বেশ ভালো লাগছে। জানতে চাইলাম,
– বাবার বয়েস কত এখন?
এবার সাধুবাবা খিলখিল করে হেসে উঠলেন। এ হাসির সুরে বুঝলাম একটা রহস্য জড়িয়ে আছে। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
– হাসলেন কেন বাবা?
হাসতে হাসতে বললেন,
– বয়েসের কথা জিজ্ঞাসা করলি বলেই তো হাসলাম।
বিস্মিত হয়ে বললাম,
– কেন?
সাধুবাবার হাসি থামল। বেশ গম্ভীরসুরে বললেন,
– আমার বয়েসটা শুনলে তোর বিশ্বাস হবে না বলে হাসলাম। শুনবি আমার বয়েস? এখন বয়েস আশি চলছে।
শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। বলে কি সাধুবাবা! আমার আন্দাজের বাঁধ ভেঙে চুরমার করে দিল যে! ভেবেছিলাম ৫৫/৬০ হবে। এ তো দেখছি একেবারে উল্টো। মিনিটপাঁচেক কথা সরলো মুখ থেকে। বিশ্বাসও হল না। ভাবছি তো ভাবছিই। এভাবে কাটার পর বললাম,
– বাবা, এত বয়েস আপনার অথচ দেখলে বোঝা যায় না। আমার ভাবনাটা ছিল অন্যরকম। মনে হয় না এত বয়েস হয়েছে! এটা কি করে সম্ভব?
হাসতে হাসতে বললেন,
– কেন বেটা, অসম্ভবের কি আছে? এটা সকলের পক্ষেই সম্ভব। নিরামিষ আহার ও ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন যদি কেউ করে তবে একশো বছরের বৃদ্ধকেও মনে হবে ৬০/৬৫। নিরামিষ আয়ু বৃদ্ধি করে, যোগ আর ব্রহ্মচর্য ব্রত দেহকে করে অটুট, রোগমুক্ত। তবে নিরামিষ আহার অনেকে করে কিন্তু ব্রহ্মচর্য রক্ষা করা খুবই কঠিন। তাই আয়ু বৃদ্ধি হলেও দেহকে রোগমুক্ত করে ঠিকভাবে যৌবনকে ধরে রাখা প্রায় কারও পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অকালে সব ‘বুড্ডা বনে’ যাচ্ছে।
সাধুবাবা থামলেন তবে হাসিটা কিন্তু মিলিয়ে গেল না। জানতে চাইলাম,
– এখানে আছেন কতদিন?
উত্তরে জানালেন,
– আজ ত্রিবেণীসঙ্গমে স্নানের জন্য এসেছি, আজই চলে যাব।
– কোথায় যাবেন?
হাসি হাসি ভাব করে বললেন,
– কোথায় যাব তার কি ঠিক আছে বেটা? মন যেখানে নিয়ে ফেলবে সেখানেই কেটে যাবে রাত দিন, যেমন এখানে কেটে গেল আজকের দিনটা।
মনে মনে ভাবলাম, সাধুবাবার অনেক বয়েস হয়েছে সুতরাং জীবনে দেখা এবং অভিজ্ঞতা হয়েছে যথেষ্ট। তাই নিজের কিছু জিজ্ঞাসার উত্তর যতটা পারি জেনে নিই। এমন সুযোগ তো আর চট করে পাব না। বলা কথাটা ধরেই প্রশ্ন করলাম,
– বাবা আপনি বললেন, মন যেখানে নিয়ে ফেলবে যেখানেই কেটে যাবে রাত দিন। আমার জিজ্ঞাসা, আপনি মনের বশীভূত হয়ে কাজ করেন, না আপনার বশীভূত হয়ে মন কাজ করে, কোনটা? কথায় তো পরিস্কার মনে হল মনের বশীভূত হয়ে কাজ করেন, নইলে একথা বললেন কেন, ‘মন যেখানে নিয়ে ফেলবে’। এই বয়েসে, এতদিন এপথে থেকেও যদি মন বশে এসে না থাকে তাহলে তো আপনার সাধুজীবনটাই বৃথা গেল। কোন দিন হয়তো বেশ্যাগমন করে আত্মতৃপ্তিলাভ করবেন এই ভেবে, মন নিয়ে এসেছে তাই এসেছি, আমার কি দোষ।
কথাটা মন দিয়ে শুনলেন। দেখে মনে হল এতটুকুও বিচলিত হলেন না। মুখের ভাবেরও পরিবর্তন হল না বিন্দুমাত্র। এতক্ষণ বসেছিলেন বাবু হয়ে। এবার পায়ের উপরে পা তুলে দিয়ে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর কায়দায় শিরদাঁড়াটা সোজা করে বসলেন। সোজাসুজি তাকালেন আমার মুখের দিকে। নড়াচড়া বসার ভাবটা দেখে বুঝলাম আসরটা এখন জমবে। সাধুবাবা আঙুলের ফাঁকে আঙুল দিয়ে হাতটা বেঁধে হাঁটুর মাথায় রেখে শুরু করলেন,
– বেটা, তোর মতো পড়াশুনো আমার নেই। তাই কথায় তোর মতো প্যাঁচও নেই। আমি সাদাসিধে মানুষ, কথাও বলব সাদাসিধে। তুই যে কথাটা বললি সেটা যুক্তিগত দিক থেকে অকাট্য। এতটুকুও ভুল বলিসনি। কিন্তু একথাটা সংসারীদের ক্ষেত্রে সত্য, সব সাধুদের ক্ষেত্রে নয়। মনকে বশীভূত করাই প্রকৃত সাধুদের একমাত্র সাধনা। এ সাধনা প্রায় সকলেরই চলে সারাজীবন। কেউ পেরে যায়, কেউ হেরে যায়।
একটু থামলেন। ডাইনে বাঁয়ে আমার পিছনে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন,
– বেটা, সংসার বিষয়ে, জাগতিক যে কোনও প্রাপ্তি বিষয়ে সব ব্যাপারটা ল্যাজেগোবরে জড়িয়ে নিয়ে চলাই মনের প্রথম ও প্রধান ধর্ম। এর থেকে মনকে যে সরাতে পারল তারই বশে এল, তাঁকে পেল। যে সরাতে পারল না, সে চলল মনের বশে। এবার এরাই শুভবিরুদ্ধ কাজ করলে ভগবানের দোহাই দেয়, ‘তিনিই করিয়েছেন।’ মনের স্রোতধারায় সংসারের শোক লোভ দুঃখবেদনার উপলখণ্ডে ঘা খেতে খেতে এগিয়ে চলে সারাজীবন ধরে।
একটু থামলেন। আশি বছরের এই বৃদ্ধকে বিড়ির কথা বলতে নিজেরই কেমন যেন বেশ লজ্জা বোধ হল। তাই আর বিড়ি খাওয়ার কথা বললাম না। সাধুবাবা বললেন,
– আমি তোকে বলেছিলাম ‘মন যেখানে নিয়ে ফেলবে সেখানেই কেটে যাবে দিন রাত’। হাঁ বেটা, ঠিকই বলেছি আমি। আমার মনটা এখন আর গৃহীমন নয়, তাই এ মন এখন আর বেশ্যাবাড়ি নিয়ে ফেলবে না। এমন জায়গায় নিয়ে ফেলবে যেখানে আমার মনের শান্তি কিছুতেই ক্ষুণ্ণ হবে না, বুঝলি? মনটা এখন আর বহুকে নিয়ে চলার ধর্মটা হারিয়ে ফেলেছ। আমি আর তোর মতো মনের বশীভূত নই।
আবার থামলেন সাধুবাবা। আগেও এসেছি প্রয়াগে তবে এ যাত্রায় একা এসেছি বলে কোনও তাড়া নেই। হাতে অনেক সময়ও আছে। এবার কি বলেন সেই অপেক্ষায় চেয়ে রইলাম মুখের দিকে। হঠাৎ খেয়াল করলাম মুখখানা কেমন যেন মলিন হয়ে এল। বেশ করুণকণ্ঠে বললেন,
– বেটা, তুই বেশ্যাবাড়ি বললি, অমন ঘৃণার ভাব নিয়ে আর কখনও ও কথাটা বলিসনে। কথাটা মনে বড় লেগেছে। সংসারে ওরা ঘৃণিত নয়।
কথাটুকু শেষ হতে না হতেই দেখলাম দুচোখ বেয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ল কয়েক ফোঁটা জল। মুহুর্তে মনটা আমার একটা অস্বস্তিতে ভরে উঠল। বুঝতে পারলাম ‘বেশ্যা’ কথাটার মধ্যে কোনও একটা রহস্য নিশ্চয় লুকিয়ে আছে। এমন কথা তো হামেশাই বলে থাকি। তবুও কথাটায় মনে আঘাত পাওয়ার কথাটা শুনে দুটো পা ধরে বললাম,
– বাবা, আমার অজান্তে কথায় আপনাকে আঘাত করে থাকলে নিজগুণে এ সন্তানের অপরাধটা ক্ষমা করে দিন।
দুহাত দিয়ে চোখদুটো মুছে ডানহাতটাকে অভয়সূচক করে বললেন,
– না না বেটা, অপরাধ তোর কিছু হয়নি। আসলে আমার গর্ভধারিণী মা তো বেশ্যা, সেইজন্য কথাটা শুনে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেছিল। তাই তো ও কথা বললাম।
কথাটা শুনে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। হাঁ করে চেয়ে রইলাম মুখের দিকে। তিনিও আমার মুখের দিকে একইভাবে। বুঝতে পারলাম দুঃখ আর ও কথায় রহস্যটা কি? তবে খোলাখুলি কিছু জানতে না পারলে বিষয়টা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। এই মুহুর্তে কিছু বললাম না। অপেক্ষায় রইলাম। সাধুবাবার বলার অপেক্ষায়। মিনিটখানেক পর বললেন,
– বেটা, আমার গৃহত্যাগের কারণ তুই জানতে চাওয়ায় আমি কিছুতেই বলতে চাইনি। ফিরেও যেতে চাইনি অতীতে। কিন্তু এমন একটা জায়গায় আঘাত করেছিস, যেখানে, তোকে এখন না বলতে পারলে শান্তি নেই।
এখন আমি কোনও কথা বলছি না। দেখি না সাধুবাবা কি বলেন। এবার বললেন,
– বেটা, আজ থেকে প্রায় আশিবছর আগের কথা। তবে একথা আমার কথা নয়। একথা শোনা আমার গুরুজির মুখে। বয়েস তখন সবে মাত্র একমাস। সে সময় মা বেনারসে এক প্রমোদপল্লীতে দুটো অন্নের জন্য দেহের বিনিময়ে দিন গুজরান করছেন। আমার বাবা ছিলেন এক জাঁদরেল জমিদার। একের পর এক বিয়ে করতেন আর ভোগ করে তাড়িয়ে দিতেন কয়েক বছর পর। মাকে বিয়ে করার বছরখানেক পর জমিদারের সব বউয়ের মতো মায়ের কপালে নেমে এল দুর্ভাগ্য। গরিবের মেয়ে, রাজসুখ সইল না কপালে। দাদুও আর্থিক দুরবস্থার জন্য মাকে ঠাঁই দিলেন না তার বাড়িতে। বেটা, দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে!
সাধুবাবা থামলেন। দেখলাম চোখদুটো জলে ভরে উঠেছে। একবার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথাটা নিচু করে বললেন,
– তারপর মাকে একসময় নেমে আসতে হল পথে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে শারীরিক ক্লান্তি সহ্য করে মা দুটো পেটের ভাত জোগাড় করতে লাগলেন। বেটা, ভগবানের যে কি ‘চক্কর’ তা কারও বোঝার উপায় নেই। আবার দুর্ভোগ নেমে এল মায়ের কপালে। আমি জানি না, অজানা অজ্ঞাত কোনও এক পুরুষের ঔরসে আমি এসেছিলাম মায়ের গর্ভে। এখনকার মতো তো আর তখনকার দিন ছিল না, তাহলে হয়তো কোনও ব্যবস্থা হত। তা আর সম্ভব হয়নি বলেই ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে লাগলাম। দিন তো আর বসে থাকে না। যথাসময়ে ভূমিষ্ঠ হলাম।
এই পর্যন্ত বলার পর আবেগে দুঃখে সাধুবাবার কণ্ঠস্বর যেন রুদ্ধ হয়ে এল। কালবৈশাখীর আকাশের মতো হয়ে গেল মুখখানা। করুণকণ্ঠে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন ‘জয় গুরুজি’। কোনও কথা বললাম না। এদিক ওদিক একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন,
– বেটা, আমার যখন একমাস বয়েস তখন একদিন এক সাধুবাবা গেছিলেন মায়ের কাছে ভিক্ষা করতে। গৃহস্থের বাড়ি ভেবেই ঢুকেছিলেন সেখানে। মা তখন তার দুঃসহ জীবন কথা বসে বসে শোনালেন। দুটো পায়ে ধরে কাতরভাবে প্রার্থনা করে সাধুবাবাকে জানালেন, ‘হে মহাত্মা, আমি মুক্তি চাই না, চাই না আমার এ জীবনযন্ত্রণা শেষ হোক। কি অপরাধ করেছিলাম বাবা বিশ্বনাথের চরণে জানি না। আরও যত কষ্ট দিতে হয় তিনি দিন, মাথা পেতে সহ্য করব। এ জীবনটা তো আমার বরবাদ হয়ে গেল, তা যাক। কিন্তু এ শিশুপুত্রকে আপনি গ্রহণ করে রক্ষা করুন, আমাকে মুক্তি দিন’। বলে সাধুবাবার চরণদুটো ধরে প্রাণ উজাড় করে কাঁদতে লাগলেন। এরকম একটা অভাবনীয় পরিস্থিতিতে পড়ে সাধুবাবা তো হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। বেশ খানিকটা সময় কি চিন্তা করে মায়ের স্নেহভরা কোল থেকে তুলে নিলেন আপনকোলে। একমুঠো চাল ভিক্ষা করতে গিয়ে সেদিন ভিক্ষায় পেলেন আমাকে। সেই দয়ার্দ্রহৃদয় কবীরপন্থী সাধুবাবাই আমার গুরুজি। গুরুর জাত নেই, জাত নেই আমারও। যেটা তোকে আগেই বলেছিলাম। বেটা, জীবনপ্রবাহ তো আর থেমে থাকে না, তাই সেই প্রবাহে আমিও ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে লাগলাম গুরুজির মাতৃস্নেহ প্রেম আর আদর ভালবাসার মধ্যে দিয়ে। আমার তরঙ্গময় জীবনস্রোতের গতি হল ভিন্ন। সেই একমাস বয়স থেকে এই আশি পর্যন্ত উত্তরবাহিনী গঙ্গার মতো আমার জীবননদী একমুখী হয়ে বয়ে চলেছে। এখন যা কিছু শুনলি তা আমার গুরুজির মুখেই শোনা।
সাধুবাবা থামলেন। দেখলাম মুখখানায় আর আগের মতো গুমোট ভাবটা নেই। অনেক পরিস্কার হয়ে গেছে। জানতে চাইলাম,
– বাবা, আপনার মায়ের কাছ থেকে আপনাকে নিয়ে গুরুজি বেনারস থেকে কোথায় নিয়ে গেছিলেন?
এতক্ষণ পায়ের উপর পা দিয়ে বসেছিলেন। এবার বাবু হয়ে বসলেন। বললেন,
– আমাকে গ্রহণ করার পর প্রথমদিকে গুরুজি বেনারস ছেড়ে কোথাও যাননি হয়রানির ভয়ে। বেনারসেই থাকতেন। তবে বৃদ্ধের কাছে একমাসের শিশুপুত্রের আগমনটা মানুষের কাছে কৌতূহল ও সন্দেহের সৃষ্টি করেছিল। ধীরে ধীরে সমস্ত সত্যি ঘটনাটা জানার পর দুয়েরই নিরসন হল। গুরুজিকে কখনও হয়রানিতে পড়তে হয়নি আমাকে নিয়ে। তাঁর কাছে শুনেছি প্রায়ই এসে মা আমাকে বুকের দুধ খাইয়ে যেতেন। আরে বেটা, ও যে মা! মা ছাড়া জগতে আর কে এমনটা করতে পারে সন্তানের জন্য।
কথাটুকু বলতে বলতে সাধুবাবা হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন। আমি একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। একটা কথাও সরল না মুখ থেকে। কি বলব আর কি বলে যে নির্লিপ্ত এই মহাত্মাকে সান্ত্বনা দেব ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে গৃহত্যাগের কারণটা জানতে পেরে মনে মনে বেশ খুশিই হলাম। খানিক পরে কপাল বেয়ে গড়িয়ে আসা চোখের জল মুছে বললেন,
– বেটা, আমার বয়েস যখন দুবছর তখন মা মারা গেলেন কি একটা রোগে, জানি না। জ্ঞান হওয়ার পর এসব কথা শুনেছি গুরুজির মুখে।
একটু অনুরোধের সুরে বললেন,
– বেটা, অমন করে ও কথাটা আর কাউকে বলিসনে কখনও। আমার মা তো ওপথে ছিলেন তাই কথাটা আমার কানে বড্ড বেজেছে।
ভাবছি কি অদ্ভুত ঘটনাপ্রবাহ মানুষের জীবনপ্রবাহকে কোনদিকে কিভাবে নিয়ে যায়! ভাবতে গেলে অবাক হয়ে যেতে হয়। প্রকৃত রহস্যের সন্ধান পাওয়া যায়না। আরও একটা লক্ষ্যের বিষয়, ভারতের যেকোনও প্রান্তে যখন যেকোনও সাধুমহাত্মাদের সঙ্গে কথা হয়েছে তখন মায়ের প্রসঙ্গ উঠতেই দেখেছি, প্রত্যেকের চোখদুটো জলে ভরে উঠেছে। কাউকে দেখেছি হাপুস নয়নে কাঁদতে। বাবার কোনও কথা তোলেননি কোনও সাধুবাবা। কি যাদু যে মায়ের অন্তরে আছে তা একমাত্র মা-ই জানে!