একটু থামলেন। একনজরে এদিক ওদিক একটু দেখে নিলেন। দাড়িতে একবার হাত বুলিয়ে বললেন,
– বেটা, ভগবানকে ডাকতে হলে প্রথমে দীক্ষিত হতে হবে। ইষ্টমন্ত্র ইষ্টের সঙ্গে, পরমাত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। বলতে পারিস ইষ্টমন্ত্র জপকারীর সঙ্গে ইষ্টের সেতু হল ইষ্টমন্ত্র। অদীক্ষিত নারীপুরুষের ভগবানের উদ্দেশ্যে দৈহিক শ্রম, দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত পুজো, বিভিন্ন ব্রতাদি ও নিয়ম পালন, কঠোর সংযমের মাধ্যমে তপস্যা ইত্যাদিতে কোনও ফল হয় না। কারণ, শাস্ত্র বলেছে ভগবানকে লাভ করার উদ্দেশ্যে এমন ডাকাটা পাথরে বীজ রোপণের মতো অকারণ চেষ্টা।
জানতে চাইলাম,
– বাবা, অদীক্ষিত যারা তারা তো তাঁকে ডাকছে। দেখেছি তাদের অনেকেরই গতি অব্যাহত। অনেক অ-নে-ক উন্নতি করেছে। দুর্লভ বিষয়ে নানাভাবে সিদ্ধিলাভ করেছে। যশ কীর্তির শিখরে উঠেছে। ধনেজনে লক্ষ্মীলাভ করেছে। এদের অনেকেই অদীক্ষিত ঈশ্বরবিশ্বাসী, আবার অনেকে নাও হতে পারে। অদীক্ষিত ঈশ্বরবিশ্বাসীদের অনেকের মুখে শুনেছি, ভগবানের দয়াতেই তার সব হয়েছে। এ ব্যাপারের রহস্যটা একটু বলবেন?
একমুহুর্ত দেরি না করেই বললেন,
– কেন বেটা, এ তো সহজ হিসাবের কথা, এটা বুঝলি না? একজন অদীক্ষিত মানুষ ধনদৌলত বিষয় সম্পত্তি খ্যাতি প্রতিপত্তি, জীবনে তার চাওয়ার বাইরে আরও অনেক বেশি কিছু পেতে পারে, পায়, পাবেও। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোটি কোটি মানুষ পেয়েছেও, তাতে কি এসে গেছে! ওটা পাচ্ছে তার জন্মান্তরের সুকৃতি বা পুণ্যফলে। যারা পাচ্ছে তারা ভাবছে ভগবানকে ডাকছে, তিনি দয়া করে দিচ্ছেন। আসলে তা নয়, ভগবানের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক হয়নি তার। জন্মান্তরের পুণ্যফলে ওগুলো পাচ্ছে, সুখভোগের মাধ্যমে পুণ্যের ক্ষয় হচ্ছে। এখানে তাঁকে ডাকা না ডাকার, বিশ্বাস অবিশ্বাসের কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁকে লাভ করতে হলে বেটা নিয়মে আসতেই হবে।
এই পর্যন্ত বলে সাধুবাবা বললেন,
– কি যেন কথাটা হচ্ছিল?
বলে মাথাটা চুলকাতে লাগলেন। আমি পূর্বকথার খেই ধরিয়ে দিতে তিনি বললেন,
– বেটা, গুরুপ্রদত্ত মন্ত্র জপ করার সময় আঙুলের গায়ে আঙুল লেগে থাকবে, যেন ফাঁক না থাকে। ফাঁক থাকলে জপের পরিপূর্ণ ফললাভ হয় না। করজপে বা মালা জপের সময় সংখ্যা রেখে জপ করতে হয়, নইলে সে জপে কোনও ফল হয় না। মানস জপে সংখ্যা রাখার দরকার নেই। বেটা, জপ করার সময় খেয়াল রাখতে হয় যেন আঙুলের ডগায় কিংবা আঙুলপর্বের সংযোগস্থলে জপ না হয়। জপটা যেন আঙুলপর্বের পেটে হয় নইলে সে জপও নিষ্ফল হয়। মালায় জপ করলে নিজের মালা যেন অন্যে স্পর্শ না করে, তাতে ইষ্ট রুষ্ট হন। প্রতিদিন জপ করা মালা কোনও কারণে জপ না করে ফেলে রাখলে মালা বা ইষ্ট উপবাসী থাকে। তাতে সাধক বা জপকারীর অকল্যাণ হয়। মালায় জপ করলে মালায় করবি, না করলে না করবি কিন্তু কিছুদিন করে ছেড়ে দেওয়া ভালো নয়। মেয়েদের রজঃস্বলা অবস্থায় মালা জপ করতে নেই, স্পর্শও নয়। একই মালায় গুরুপ্রদত্ত আপন ইষ্ট ভিন্ন অন্য কোনও দেবদেবীর মন্ত্র জপ করতে নেই। তাতে জপকারীর অমঙ্গল হয়। জপের ফলও নিষ্ফল হয়।
একমনে শুনে যাচ্ছি ভগবানকে ডাকার নিয়মের কথা। একটু থেমেছেন। কথা বললাম না, তাহলে খেই হারিয়ে যাবে কথায়। তাকিয়ে রয়েছি মুখের দিকে। লক্ষ্য করলাম তিনিও একটু ভুরু কুঁচকে বেশ ভালো করে দেখলেন আমার মুখখানা। ভাবলাম বলি ‘কি দেখছেন অমন করে’ কিন্তু বললাম না। কথা চলে যাবে অন্যপ্রসঙ্গে। এখন শুনি, যা জিজ্ঞাসা করার পরে করব। এইসব ভাবছি, এমন সময় সাধুবাবা বললেন,
– বেটা মালা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যখন জপ করবি তখন যেন কোনওভাবে শব্দ না হয়। জপের সময় মালাতে শব্দ হলে দেহে রোগ আসে, আরোগ্য হতেও বড় সময় নেয়। কর বা মালাতে দ্রুত জপ করবি না, তাতে মালা বা কর-ছুট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে একশোভাগ। কর বা মালা জপ ছুট হলে, জপের সময় হাত থেকে মালা পড়ে গেলে কিংবা জপের সময় মালা ছিঁড়ে গেলে ইষ্টমন্ত্র জপকারীর খুবই অমঙ্গল হয়। বিশেষ করে শারীরিক মানসিক, পারিবারিক দিক থেকে বড় কোনও বিপদ বা ঝামেলা সৃষ্টি, অর্থক্ষতি নইলে চরম অপমানিত হওয়া, এক কথায় কোনও না কোনও অনিষ্ট তার কিছু হবে।
সাধুবাবা হঠাৎ মাথাটা নিছু করে আমার চোখের সামনে এনে আঙুল দিয়ে চুলে বিলি দিতে দিতে বললেন,
– দেখ তো, এখানে একটা ফাটা দাগ দেখতে পাচ্ছিস?
বেশ ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম প্রায় ইঞ্চি তিনেক ফাটা একটা দাগ লম্বালম্বিভাবে মাথার বাঁদিকে ব্রহ্মতালুর পাশে। আমি ‘হ্যাঁ’ বলতেই মাথাটা সরিয়ে নিয়ে বললেন,
– বেটা, আজ থেকে বহুবছর আগের কথা। তাও বছর পঞ্চাশ হয়ে গেছে। তখন কিছুদিন জ্বালামুখী ছিলাম। একদিন ভোরে স্নান করে মন্দিরচত্বরে বসে জপ করছি, হঠাৎ মালাটা গেল ছিঁড়ে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। তোকে শাস্ত্রের যেসব কথা এখন বলছি তা গুরুজির মুখ থেকে শোনা। মালাটা ছেঁড়ামাত্র বুকটা আমার কেঁপে উঠল। মনে মনে ভাবছি, কিছুদিনের মধ্যে একটা অমঙ্গল কিছু ঘটবে। বেটা কিছুদিন কিরে, ভাবনাটা শেষ হয়েছে কি হয়নি, হঠাৎ এত বড় একটা পাথরের টুকরো এসে পড়ল মাথায়। চিৎকারে করে পড়ে গেলাম মাটিতে। বাহ্যজ্ঞান প্রায় লোপ হওয়ার অবস্থা। স্থানীয়রা ধরাধরি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। বহুদিন ভুগে ছিলাম মাথাটা নিয়ে। আজও আমি খুঁজে পাইনি পাথরটা কোথা থেকে, কেমন করে এল আর মারলই বা কে? কারও সঙ্গে শত্রুতা তো ছিল না যে লুকিয়ে মারবে। শাস্ত্রবাক্য গুরুবাক্য যে কি অমোঘ তার ফল পেলাম হাতে নাতে।
কথটা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। অবাক হওয়ারই কথা। সাধুবাবা একটু থেমে বললেন,
– বেটা, কর বা মালার জপ ছুট হলে আবার প্রথম থেকে জপ শুরু করলে কোনও দোষ হবে না। মালা ছিঁড়ে গেলে ফের নতুন করে গেঁথে নিয়ে একশো আটবার জপ করাই বিধি। আর শুচি অশুচির কোনও বালাই নেই, যেকোনও অবস্থাতে মানস জপে শুধুমাত্র ইষ্টমন্ত্র স্মরণ করলে দোষ হবে না। মানস জপ না হলে এই অবস্থায়, যেমন মাথায় কাপড় মুড়ি দিয়ে, বিছানায় শুয়ে, আসন ছাড়া, উলঙ্গ অবস্থায়, খাওয়ার সময়, দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে, রাগতভাবে, কারও সঙ্গে কথা বলতে বলতে, পেটে খিদে থাকলে, অপবিত্র অবস্থায়, পথ চলাকালীন কোনও জপ করতে নেই। তাতে অকল্যাণ ও জপের ফলও নষ্ট হয়। কয়েকটি সংঘটিত শব্দের বারংবার মনের দ্বারা মন বুদ্ধি ও চিত্তের মলিনতা দূর করে পার্থিববন্ধন হতে মুক্ত হওয়ার নামই ইষ্টমন্ত্র বা জপ বলে, বুঝলি? তবে বেটা একটা কথা আছে। স্থান বিশেষে ফলের কম বেশি তারতম্য ঘটে। যেমন ধর, কেউ যদি দেহিগুরুর সামনে বসে মানস জপ করে তবে তার ফল হয় অনন্ত। ওই জপ নিজের ঘরে বসে করলে তার ফল হয় মাত্র একগুণ। একই ইষ্টমন্ত্র কোনও শিবমন্দিরে বসে জপ করলে ফল হয় একশো কোটি গুণ। নিরালায় বনের মধ্যে করলে একশোগুণ, নদীর তীরে বসে করলে এক লক্ষগুণ ফললাভ করে জপকারী। পাহাড় পর্বতে বসে জপ করলে ফল হয় এক কোটি গুণ। স্থান বিশেষে জপের তারতম্যের কথা বলা হয়েছে শাস্ত্রে। তবে অতসব শাস্ত্র-টাস্ত্র আমি পড়িনি। গুরুমুখ থেকে যা শুনেছি, যেটুকু মনে আছে তাইই বললাম তোকে।
সাধুবাবা থামলেন। ‘তাঁকে ডাকতে হলে নিয়মে ডাকতে হবে’-এই নিয়মের কথাই বলে চলছেন সাধুবাবা। কথায় একটু বিশ্রাম দিয়ে বললেন,
– বেটা, জপ করলে ফল হবে তবে গুরুবাক্যে বিশ্বাস ভক্তি ও শ্রদ্ধা থাকতে হবে। তবেই জপের ফল দ্রুত ক্রিয়াশীল হবে গুরুবাক্যশক্তিতে, কারণ মন্ত্র তো তাঁরই মুখনিঃসৃত। মন্ত্র মানেই আপ্তবাক্য, ঋষিবাক্য। যা অভ্রান্ত তাইই আপ্তবাক্য। অশ্রদ্ধায়, অবহেলায়, কোনওরকম দায়সারাভাবে জপ করলে কোনও ফল হবে না। তাঁর কাছে পৌঁছনো যাবেনা কোনওদিন। ‘গুরুই সব, তিনিই আমার পরম পথের কাণ্ডারি’-এই বিশ্বাস থেকে আসে শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা থেকে তাঁকে পাওয়ার ছেদহীন যে অদম্য উৎসাহ ও প্রবৃত্তির সৃষ্টি হয় তাকে শাস্ত্রে বলে বীর্য। নারীপুরুষ যার মধ্যে এই বীর্যের সৃষ্টি হয়েছে, জানবি সে ঠিক ঠিক রাস্তায় চলতে শুরু করেছে। কারণ বীর্যই সৃষ্টি করে স্মৃতি। স্মৃতির একমাত্র কাজ হল ধরে রাখা। যে যে পথে আছে তার সেই বিষয়কে সদা জাগরূক করে রাখাই স্মৃতির কাজ। সাধনজীবনে ভগবান বা ইষ্টকে অন্তরে সর্বদা স্মরণে রাখা স্মৃতির সাধনা। স্মৃতিতে যতক্ষণ না ভগবান প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ততক্ষণ কিছু হবে না। এর পর আরও নানান অবস্থার মধ্যে দিয়ে মানুষ তাঁর সান্নিধ্যলাভ করে।
সাধুবাবা থামতে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, সারাদিন রাতের মধ্যে কোন সময় জপ করলে ভালো হয়? আপনি আপনার সাধনজীবনে কখন জপ করতেন?
উত্তরে বললেন,
– বেটা, সাধুসন্ন্যাসীরা যে নিয়মে চলে সেই নিয়মে কি আর গৃহীরা চলতে পারে? গুরু যে নিয়ম বলে দেন সেই নিয়মেই গৃহীদের চলা উচিত বলে আমার মনে হয়।
একথায় বুঝতে পারলাম বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইছেন। মনে মনে ভাবলাম, ধারণা নেই এ বান্দার কাছ থেকে পার পেয়ে যাওয়া মুশকিল। কথাটুকু ভেবে সাধুবাবার মুখের দিকে তাকাতেই দেখলাম তিনি হাসছেন। হাসিতে ভরা মুখখানায় আন্তরিকতার একটা অনাবিল স্পর্শ। বুঝলাম ভাবনাটা ধরা পড়ে গেছে। আমাকে আর কোনও অনুরোধ বা জিজ্ঞাসা করতে হল না। বললেন,
– বেটা, জপের সবচেয়ে ভাল সময় ভোররাতটা। বিশেষ করে রাত সাড়ে তিনটে থেকে চারটের মধ্যে উঠে শুদ্ধভাবে বিষয়চিন্তা মাথায় না রেখে জপ করলে মন দ্রুত স্থির হয়। ওই সময় থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত জপের পক্ষে সর্বোৎকৃষ্ট সময়। শেষ রাতে জপে বসলে দেবদেবী, এমনকি অনেকসময় পরলোকগত সাধক মহাত্মাদের কৃপালাভও হয়ে যায় ভাগ্য ভালো থাকলে। সেটা হয় জপকারীর অলক্ষ্যে। কারণ ওই সময় দেবদেবী এবং পরলোকগত সিদ্ধমহাত্মাদের অনেকে মর্তে বিচরণ করেন। কোনওভাবে তাঁদের কৃপাদৃষ্টি লাভ করলে প্রাথমিক কল্যাণ হয়। অনেক জাগতিক দুর্ভোগের হাত থেকেও পরিত্রাণ পাওয়া যায়। দিনের বেলায়, সন্ধ্যে বা রাতে নিয়ম করে জপ করতে হয়। তবে দিনে জপে তেমন মন বসে না। ভোররাতে মানুষ শুধু নয়, জীবজগতের কামভাব কামচিন্তা এবং পার্থিব বিষয়বাসনা খুব কম হয়। দেহমন থাকে প্রায়ই শান্ত শীতল। যার জন্য প্রাণিজগৎ সচরাচর ভোররাতে বা সকালে দৈহিক মিলনে প্রবৃত্ত হয় না। বেলা বৃদ্ধির সঙ্গে দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে দেহমনের উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। ফলে মনের অস্থিরতা বেড়ে যায়, জপে তেমন মন বসে না। প্রকৃতি যত শান্ত শীতল হয়, জীবজগৎও হয় ঠিক একইভাবে। সন্ধের পর বা শেষ রাতটা জপের পক্ষে অনুকূল। অন্তত আমার গুরুজি সেই কথাই বলতেন। তবে সাধুসন্ন্যাসীদের দিবারাত্র জপের মধ্যে ডুবে থাকাটাই একমাত্র কাজ এবং সেটা নির্দিষ্ট নিয়মের অধীন।
কথাটা শেষ হতে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, আপনি বললেন ভোররাতে দেবদেবী এবং পরলোকগত সিদ্ধমহাত্মারা মর্তে বিচরণ করে অনেকের উপর কৃপা করেন। একথা আপনার শোনা, না নিজে অভিজ্ঞতায় দেখা, দয়া করে বলবেন?
এ প্রশ্নটা শোনামাত্রই একটু চমকে উঠলেন বলে মনে হল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে। এইভাবে তাকানোয় আমি চোখ রাখতে পারলাম না সাধুবাবার চোখে। মাথাটা নিচু করে রইলাম। কেটে গেল কয়েক মিনিট। কোনও কথা বলছেন না দেখে মুখটা তুলে তাকাতেই দেখলাম তিনি একইভাবে চেয়ে আছেন আমার মুখের দিকে। নামিয়ে নিলাম মাথাটা। এতক্ষণ অতটা খেয়াল করিনি। এখন দেখলাম এমন তীব্র উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকাটা আমার পক্ষে কিছুতে সম্ভব হচ্ছে না, তাই মাথাটা আপসেই নেমে এল। এইভাবে কেটে গেল আরও কিছুটা সময়। সাধুবাবার কোনও রা নেই। মাথাটা নিচু করে অনুরোধের সুরে বললাম,
– বাবা, আমার কথায় যদি কোনও অপরাধ হয়ে থাকে তবে ক্ষমা করে দিয়ে বলুন না, সত্যি কি অমনটা হয়? সংসারে আছি, ওসব কথা তো স্বপ্নেও ভাবতে পারিনে।
কথাটুকু শেষ করে দুহাত দিয়ে একবার প্রণাম করে হাতদুটো মাথায় বুলিয়ে নিলাম। তাকালাম সাধুবাবার মুখের দিকে। দেখলাম এক অবর্ণনীয় পারমার্থিক প্রসন্নতায় মুখখানা ভরে উঠেছে। বৃদ্ধ দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন,
– আমার কথা বিশ্বাস করলে কর, না করলে করিস না। আমি দেখেছি কিনা তা জানার দরকার নেই। এসব কথা জেনে তোর কোনও লাভও হবে না। অনেক কথা হয়েছে এবার তুই যা তো।
যা বললেই গেলাম আর কি! বুঝলাম, এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়েছে তাই মুখ খুলতে চাইছেন না। আমার তো একটা কৌশল জানাই আছে। কে দেখছে না দেখছে ওসব কিছু না দেখে খপ্ করে পা দুটো ধরে কাতর কণ্ঠে বললাম,
– বলুন না বাবা, দয়া করে বলুন না, বললে ক্ষতি তো কিছু হবে না। বলতেই হবে নইলে আমি কিছুতেই ছাড়ব না।
সাধুবাবা আমার হাতদুটোকে সরিয়ে দিতে দিতে বললেন,
– বেটা উচ্চকোটির সাধক আর সাধুমহাত্মা যোগীদের এ দেশে কোনওটাই অবিশ্বাসের নয়। সবই সত্য। তখন আমার বয়েস কম। গুরুজির মুখে শাস্ত্রের নানা কথা শোনার সময় ওসব কোথাও শুনেছি। তবে মনে প্রাণে বিশ্বাস করিনি। বলতে পারিস ভাবিনিও অতটা। কালের নিয়মে একদিন গুরুজির ‘দেহান্ত’ হল। তীর্থভ্রমণ করতে করতে তখন গিয়েছিলাম দেওঘরের তপোবনে। ওখানে ছিলাম প্রায় বছরখানেক। প্রতিদিন রাত তিনটে নাগাদ উঠে যোগ তপ সেরে নিই। বেলায় পায়ে হেঁটে এসে বাবা বৈদ্যনাথের মাথায় জল বেলপাতা চড়াই। এইভাবে কাটছিল দিনগুলো। একদিন যথা নিয়মে উঠেছি শেষরাতে। বসেছি যোগে। হঠাৎ দেখি এক দীর্ঘকায়, জটাজুটধারী মহাপুরুষ কোথা থেকে এসে হাজির হয়েছেন আমার সাধনআসনের সামনে। প্রশান্ত মুখমণ্ডল। জ্যোতির্ময় দেহ। আজানুলম্বিত বাহু। পরনে গাছের একটা বাকলমাত্র। হাসিমাখা মুখে বললেন,
– বেটা, তুই যে যোগসাধনা করছিস তা ঠিক আছে। তবে যোগের কয়েকটা প্রক্রিয়ায় তোর কিছু ‘গড়বড়’ হচ্ছে। এভাবে করলে ঠিক হবে না, করতে হবে এইভাবে। এখান থেকে যাচ্ছিলাম, দেখলাম তোর ক্রিয়াতে কিছু ভুল হচ্ছে তাই এলাম।
কয়েক মুহুর্তে যোগের ক্রিয়াটুকু বুঝিয়ে দিয়ে চোখের সামনে অতবড় দেহটা হাওয়ার মিলিয়ে গেল চকিতে। হতবাক হয়ে গেলাম। কোথা থেকে তিনি এলেন, তাঁর পরিচয়ই বা কি, কিছু জানার সুযোগ হল না। পলকে এলেন, গেলেনও পলকে। আসনে বসে থাকলেও সেই সময় জপতপ কিছু হল না। আমার গুরুজির বাক্য আর মহাপুরুষের অপার করুণার কথা ভাবতে ভাবতে সকাল হয়ে গেল। সেদিনটা কেটেছিল পরমানন্দে। একটা কথা মনে রাখিস, গুরুজি দেহে থাকলে সাধুসন্ন্যাসী বা দীক্ষিত গৃহীদের জীবনে অলৌকিক দর্শন ও ঘটনা খুব কম ঘটে। বিশেষ ভাগ্যবান না হলে ঘটেই না। গুরুদেহে থাকাকালীন কারও মুখে ঈশ্বর সম্পর্কিত বিশেষ কোনও দর্শনের কথা শুনলে বুঝবি সেটা তার কল্পনাপ্রসূত কোনও রূপের দর্শন বা স্পর্শলাভ হয়েছে। গুরু দেহরক্ষার পর যার ভাগ্যে থাকে তার জীবনে ওসব অলৌকিক বিষয়গুলো প্রত্যক্ষভাবে প্রকট হয় বেশি করে এবং তা হয় গুরুরই কৃপায়, বুঝলি।
কথা শেষ হতে সাধুবাবা বাঁহাতে ঝুলিটা ধরে ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন। এতটুকু বুঝতে পারিনি এখানে কথা শেষ হয়ে যাবে। আরও কিছু জানার ছিল কিন্তু জানা হল না। প্রণাম করলাম। মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
– মঙ্গল হোক বেটা, গুরুকৃপা লাভ হোক, পরমানন্দে থাক, এই প্রার্থনা করি গুরুজির কাছে।
মন্দিরচত্বর ছেড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন শান্ত পদক্ষেপে। আমিও চলতে লাগলাম সঙ্গেসঙ্গে। ভরদ্বাজ আশ্রমের পথটুকু চলতে চলতে বললাম,
– বাবা, এমন একটা কথা কিছু বলুন যাতে ভগবানের দর্শন না হয় না হোক, অন্তত নিজের মনের যেন কিছুটা উন্নতি হয়। এত নিচ হীন মন নিয়ে মানুষের সঙ্গে বাইরে ভালো ব্যবহার করে বেড়াই অথচ যখন ভাবি তখন নিজেরই খুব খারাপ লাগে। বাইরে এক আর ভিতরটা আর এক। দেখলে কেউ বুঝবে না। আমি চাই বাইরে ভিতরটা সব এক হোক, এই আমার একমাত্র প্রার্থনা।
কথা বলতে বলতে এসে গেছি আশ্রমের রাস্তা ছেড়ে বড় রাস্তায়, যেখানে দাঁড়ালে আনন্দভবনটা দেখা যায়। সাধুবাবা দাঁড়ালেন, আমিও। দাঁড়িয়ে আছি বাঁপাশে। মাথাটা সামান্য ঘুরিয়ে তাকালেন মুখের দিকে। আমি তো একদৃষ্টিতে তাকিয়েই আছি। বাঁ হাতটা আমার কাঁধে রেখে বললেন,
– বেটা, প্রত্যেকটা মানুষের সবচেয়ে বড় দোষ হল অন্যের দোষ দেখা। এতে চিত্ত কলুষিত হয়। যে যা দোষ করে করুক, নির্বিকারভাবে থাকবি। দেখবি মনের নিচভাবনাটা কেটে যাবে। আনন্দের বন্যা বয়ে যাবে মনে। এটা যদি পারিস তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যে বাইরে আর ভিতরটা একাকার হয়ে যাবে। অন্যের দোষটা উড়িয়ে দেয়ার একমাত্র পথ হল, দোষগুণ যা কিছু তা মানুষের অন্তর থেকে। সব ভগবানের, গুরুজিরই খেলা। সুতরাং আমার দেখার দরকার নেই। এইভাবে থাকতে ও দেখতে চেষ্টা করবি, ব্যস তাহলে আসল রাস্তায় উঠতে বেশি সময় লাগবে না। এবার চলি আমি।
কথাটুকু বলে আমার পিঠে স্নেহভরে হাত বুলিয়ে দিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরে সোজা হাঁটতে লাগলেন, আমি একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। সাধুবাবা একবারও পিছন ফিরে তাকালেন না। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলেন পথের বাঁকে। আমি কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চলতে লাগলাম উদ্দেশ্যহীনভাবে।
These Anecdotes from various unknown Spiritual Gurus have immense effect on human minds. One believes or not, the style of story telling mesmerizing.