আকবর দুর্গ থেকে কিছুটা এগোলে কেল্লাঘাট। বহু নৌকা বাঁধা আছে ঘাটে। এখান থেকে যেতে হয় ত্রিবেণীসঙ্গমে। আমার সহযাত্রীরা সকলে চলে গেছেন। আমি যাইনি। এর আগে চারবার এসেছি তাই অত গা করলাম না। প্রয়াগে দেখার যা কিছু তা দেখেছি। হাতে এখন অনেক সময়। সঙ্গীদের সঙ্গমে যাওয়া আসা নিয়ে প্রায় ঘণ্টাতিনেক লাগবে। ওদের অনেকে স্নানও করবে।
কোনও কাজ নেই। ঘাটে বসে আছি। দেখছি কোনও নৌকা যাত্রী বোঝাই করে চলেছে সঙ্গমে, আবার কোনও নৌকা বোঝাই যাত্রী নিয়ে এসে উগরে দিচ্ছে ঘাটে। এইসব আনাগোনাই দেখছি ঘাটে বসে। আর দেখছি নীল যমুনার যৌবন। এখানে, এই প্রয়াগে যেন উথলে পড়েছে। যৌবনের দাপট দেখার মতো। জলের রং বিদেশিনী নারীর চোখের মতো। দিল্লি আগ্রায় যমুনাকে দেখলে বড় কষ্ট হয়। একমাত্র সন্তানহারা মায়ের মতো। যেন ভেঙে পড়েছে দেহমনে।
যমুনাপাড়ে এখানে বাঁধানো ঘাট বলে কিছু নেই। নৌকা এসে ভিড়লে যাত্রীরা লাফিয়ে লাফিয়ে নামেন। পর পর দুটো নৌকা এসে ঘাটে ভিড়ল। প্রথম নৌকা থেকে একনৌকা দেশোয়ালি নেমে এল টুকটুক করে। পরনে অধিকাংশের ময়লা পোশাক। বাচ্চা বুড়ো মাঝবয়সী সব বয়েসের নারীপুরুষ আছে তবে বুড়োবুড়িদের সংখ্যাই বেশি। এসব লক্ষ্য করছি ঘাটে বসে। দ্বিতীয় নৌকা লেগেছে প্রথম নৌকার গায়ে গায়ে। এতেও দেশোয়ালির সংখ্যা কম নয়। পোশাকে অবস্থাপন্ন ঘরেরও আছে বেশ কিছু। একে একে সকলে নামার পর দেখলাম নৌকার ছই-এর ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন এক বৃদ্ধ সাধুবাবা। বেশ বৃদ্ধ। কাঁধে ছোট্ট একটা ঝুলি। পরনের বসনটা গেরুয়া। একটু ফ্যাকাসে। লম্বা একটা লাঠিতে ভর দিয়ে অতি সাবধানে পা ফেলেফেলে এগিয়ে এলেন নৌকার এ মাথায়। চট করে নামলেন না। নৌকাটা দুলছে। মাঝি নৌকার দড়িটা পাড়ে দাঁড়িয়ে একটু টানতেই দুলুনিটা অনেক কমে গেল। এবার মাথাভর্তি পাকা চুলদাড়ি নিয়ে সাধুবাবা নেমে এলেন। পাতলা ছিপছিপে চেহারা। ভাঙা গাল। চোখদুটো বসে গেছে বলে নাকটা অনেক উঠে এসেছে। বয়েসের ভারে বৃদ্ধ সামান্য ঝুঁকে পড়লেও চোখমুখের উজ্জ্বলতায় ভাটা পড়েনি একটুও। পাড়ে নেমে একটু দাঁড়ালেন। তারপর আর কোনও দিকে না তাকিয়ে খুব ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে চললেন আকবর দুর্গের রাস্তা ধরে। পথ ওই একটাই।
সাধুবাবা কিছুটা এগিয়ে গেলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। এবার আমি উঠলাম। লম্বা লম্বা পায়ে পিছু নিলাম। ঠিক দুর্গের প্রবেশদ্বারের কাছে (যেখানে অক্ষয়বট আছে) আসতেই আমি পা চালিয়ে একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালাম। সাধুবাবা দাঁড়িয়ে গেলেন। প্রণাম করলাম। হাতজোড় করে নমস্কার জানালেন। মুখে কিছু বললেন না। আমিই বললাম বাঁধানো জায়গাটা দেখিয়ে,
– বাবা, দয়া করে ওখানে একটু বসবেন, দু-চারটে কথা বলব।
কথাটা শুনলেন। মুখে কিছু বললেন না। আঙুল দিয়ে দেখানো জায়গার দিকে এগোতে লাগলেন, আমিও। একটু উঁচু বাঁধানো জায়গায় ধুলোর মধ্যে আমি বসে সাধুবাবাকে বললাম বসতে। প্রথমে ঝুলিটা, পরে পাশে লাঠিটা রেখে উবু হয়ে বসলেন। ওইভাবে বসা দেখে হিন্দিতে বললাম,
– বাবা, থোড়া আরামসে বয়ঠিয়ে।
এ কথায় সাধুবাবা বসলেন বাবু হয়ে। দুজনে বসেছি ধুলোর মধ্যে মুখোমুখি হয়ে। আমার মুখটা পথমুখো। সাধুবাবাকে দেখছি আবার ঘাটে যাচ্ছে যারা, তাদেরও দেখতে পাচ্ছি। অসংখ্য তীর্থযাত্রী চলেছেন ঘাটের দিকে। যাবেন হয়ত ত্রিবেণীসঙ্গমে। সাধুবাবা এক কথাতেই কথা বলতে রাজি হওয়ায় মনে বেশ আনন্দ হচ্ছে। এখনও চুপচাপ আছেন। শুরু করতে হল আমাকে। বললাম,
– বাবা, আপনি কোন সম্প্রদায়ের সাধু?
উত্তরে একবাক্যে বললেন,
– উদাসী সম্প্রদায়।
পোশাকের রং গেরুয়া দেখে জানতে চাইলাম,
– বাবা, উদাসী সম্প্রদায়ের সাধুদের দেখেছি কালোরঙের আলখাল্লা পরতে অথচ আপনাকে দেখছি গেরুয়া বসনে, কেন?
বৃদ্ধ লাঠিটা কোলের উপর শুইয়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,
– যার যেমন ইচ্ছা সে তেমন পরে। আমার গেরুয়া ভালো লাগে তাই গেরুয়াই পরেছি।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– আপনার ডেরা কোথায়?
সাধারণভাবে বললেন,
– ডেরা বলতে যা, তা আমার নেই। আমার ভক্ত নেই, শিষ্যও নেই তাই ডেরা কোথাও করিনি। বিভিন্ন তীর্থে তীর্থে বেড়াই, যখন কোথাও মন চায় না তখন হরিদ্বারে পড়ে থাকি।
জানতে চাইলাম,
– বাবা, দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক বয়েস হয়েছে আপনার। এখন আন্দাজ কত হবে?
এ প্রশ্নে ভুরুটা একটু কোঁচকালেন। পরে ওই একইভাবে বললেন,
– এখন বয়েস বেটা প্রায় আশির কাছাকাছি হবে।
যতটুকু প্রশ্ন করছি ঠিক ততটুকুই উত্তর দিচ্ছেন সাধুবাবা। আমি দেখেছি, যাঁরা প্রকৃত সাধুসন্ন্যাসী তাঁরা প্রত্যেকেই কথায় বড় সংযমী। একটা বাজে কথা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনও কথা, অবাঞ্ছিত কথা, তড়িঘড়ি করে কথা, এমন কি হেঁয়ালি করেও কথা বলেন না, বলতেও শুনিনি। এও একই গোত্রের। একটা কথাও নিজের থেকে বলেননি। এবার আমার উদ্দেশ্যের কথা বললাম,
– বাবা, আপনি তো বহু বছর ধরে আছেন এ পথে। তাই আমার বিশ্বাস আপনি নিশ্চয়ই কিছু জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে পারবেন। যদি বিরক্ত না হয়ে উত্তর দেন তো জিজ্ঞাসা করি।
এমন কথা শুনে সাধুবাবা কেমন যেন একটু অবাক হয়ে গেলেন। চোখমুখের ভাবটা দেখে বুঝলাম কথার সঙ্গেসঙ্গেই উত্তর দিলেন না। একটু ভেবে নিয়ে বললেন,
– আমি মূর্খ মানুষ। জ্ঞান বিশেষ কিছু আছে বলে নিজেরই মনে হয়না। উত্তর সাধ্যের মধ্যে থাকলে নিশ্চয়ই দেব। বল কি জানতে চাস?
সাধুবাবা রাজি হওয়ায় মনটা আমার আরও খুশিতে ভরে উঠল। প্রথমে জানতে চাইলাম,
– বাবা, তিনটে গুণের মধ্যে যতক্ষণ না মন সত্ত্বগুণে সদাসর্বদা মাখামাখি হয়ে থাকছে ততক্ষণ পর্যন্ত ভগবানের কৃপালাভ করা যায় না। এটাই ভগবানের কাছে পৌঁছনোর নিয়ম। জপ সাধনভজন না করেও কিভাবে সত্ত্বগুণ বাড়ানো যাবে, দয়া করে বলবেন?
খুব শান্ত মধুর কণ্ঠে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– বেটা মানুষ যখন, তখন দোষ গুণ তো থাকবেই। মানুষ রিপুর অধীন, ফলে কামনা বাসনা লোভ হিংসা সবই রয়েছে প্রতিটা মানুষের মধ্যে। তুই যাদের সঙ্গে ওঠাবসা কথাবার্তা বলিস তাদের যেসব দোষ দেখবি, সেসব কথা একবারও ভাববি না। তাদেরও বহুগুণ আছে। তুই শুধু গুণগুলোর কথা ভাববি। তাদের প্রকটিত গুণগুলোকে চেষ্টা করবি নিজের কথায় ও কাজে লাগাতে। এটা অভ্যাস যোগ। একদিনে হবে না। প্রতি পদক্ষেপে এই চেষ্টা চালিয়ে গেলে কিছুদিনের মধ্যে দেখতে পাবি, মন তোর সত্ত্বগুণে ভরে উঠেছে। যেমন ধর, কেউ অসৎ উপায়ে অর্থোপার্জন করে আবার দানও করে। ওর দোষটা না ধরে দানের গুণটাকে গ্রহণ কর। দশ পয়সা দানের ক্ষমতা না থাকলে এক পয়সা কর। সে ক্ষমতা না থাকলে অন্য কোনও উপায়ে দানের সমতুল্য কোনও কাজ কর। এইভাবে কিছুদিন করলে ওই গুণটা তোর মনে গেঁথে যাবে। এ রকম দশটা মানুষের দশটা গুণ যদি ধরতে পারিস তাহলে তমো রজোগুণের ক্রিয়া তোর ভিতরে আর কাজ করতে পারবে না। মন ধীরে ধীরে সত্ত্বগুণের আশ্রয়ে আশ্রিত হবে, বুঝলি? এটুকুর জন্যে জপতপ, ভগবানকে আলাদা করে ডাকার প্রয়োজন হবে না। তিনি আপসেই আসবেন, কারণ মন অন্তরে সত্ত্বগুণের আসন পেতে না দিলে ভগবান বল আর ইষ্টই বল, তিনি এসে বসবেন কোথায়? অন্তরে নির্মল সত্ত্বগুণের আসনই তাঁর বসার আসন। সত্ত্বগুণ এমনই এক ঈশ্বরীয় শক্তি যাতে সমস্ত ইন্দ্রিয় দমন হয়ে মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত লক্ষ্যে অলক্ষ্যে তাঁরই সঙ্গসুখ অনুভব করে।
সাধুবাবা থামলেন। এমন সময় একদল মহিলা পুরুষ দেশোয়ালি সুরে গান গাইতে গাইতে চলেছেন প্রয়াগঘাটের দিকে। আমি তাকালাম। সাধুবাবাও তাকালেন ঘাড় ঘুরিয়ে। আবার আমার মুখের দিকে। বাঁধাধরা কোনও প্রশ্ন থাকে না সাধুসঙ্গের সময়। কথা বলতে বলতে মনে যে প্রশ্ন আসে সেটাই করি। চট করে কোনও প্রশ্ন না এলে বলি কোনও উপদেশ দিতে। এইভাবে চলতে থাকে কথা। বললাম,
– বাবা, গৃহত্যাগ করেছেন কত বছর বয়েসে?
কোনও রকম দ্বিধা না করে সরাসরি উত্তর দিলেন,
– আমি যখন গৃহত্যাগ করি তখন বয়েস বছরদশেক হবে।
প্রশ্ন করলাম,
– গৃহত্যাগ করলেন কেন?
নির্বিকার ভাবে সাধুবাবা বললেন,
– বেটা, আমার গৃহত্যাগের কথা শুনলে তোর বিশ্বাস হবে না। তখন অত বুঝিনি তবে এখন বুঝি। জন্ম জন্মান্তরের সংস্কার ও কর্মানুসারে মানুষ যেমন সুখদুঃখ ভোগ করে, তেমনভাবে সাধুসন্ন্যাসীও হয়। এ পথে ভগবানের ইচ্ছা না থাকলে জোর করে কেউ আসতে পারে না, আমিও আসিনি। সবই পূর্বনির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে। বছর দশেক বয়েস তখন, কি বুদ্ধিশুদ্ধি আর হবে! একেবারেই ছেলেমানুষ আমি। একদিন ভোর রাতে, তখনও আকাশ পরিস্কার হয়নি, আবছা অন্ধকার। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি, এক জ্যোতির্ময় মহাত্মা আমাকে বলছেন, ‘কি রে বেটা, ওঠ, এখনও ঘুমিয়ে থাকবি? আমি যে তোর জন্যে অপেক্ষা করছি। ওঠ, চলে আয়।’ বলে স্বপ্নে আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটা বড় পিপুলগাছ দেখিয়ে বললেন, ‘আমি ওই গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছি, চলে আয়।’ কথাটুকু শেষ করে সেই জটাধারী মহাত্মা স্বপ্নেই মিলিয়ে গেলেন। ঘুমও ভেঙে গেল। দেখলাম তখনও কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। মাটির ঘরের দরজা খুলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে পড়লাম। কারও কথা মনে পড়ল না। দ্রুত পা চালিয়ে এলাম সেই পিপুলগাছের তলায়। দেখলাম স্বপ্নে দেখা সত্যিই সেই মহাত্মা দাঁড়িয়ে আছেন গাছে হেলান দিয়ে। মুখে প্রশান্তি। অবাক হয়ে কাঁপতে লাগলাম থরথর করে। মহাত্মা আমাকে কাঁপতে দেখে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। অভয় দিলেন যেন ভয় না পাই। গাছতলায় কাটল সামান্য সময়। পরে হাতটা ধরলেন। চলতে লাগলেন দ্রুতপদে। কিছুটা হাঁটার পর একটা জঙ্গলের ধারে এলাম গ্রাম ছেড়ে। তখনকার দিনে তো এখনকার মতো এত বাড়িঘর ছিল না। পথে কোনও সুবিধা হয়নি। এইবার মহাত্মা চোখে একটা কাপড় বেঁধে দিলেন। তারপর বাঁ হাতটা চেপে ধরতেই শরীরটা কেমন যেন হালকা হয়ে এল। পরে আমার আর কোনও জ্ঞান ছিল না। যখন মহাত্মা চোখ খুলে দিলেন তখন দেখলাম একটা পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে লতাপাতা দিয়ে তৈরি একটা কুটির। মহাত্মা বললেন,
– আমরা হরিদ্বারে এসেছি। এই পাহাড়ের নাম চণ্ডীপাহাড়।
এই পর্যন্ত বলে থামলেন। আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম সাধুবাবার মুখের দিকে। তিনিও একনজর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– কি রে বেটা, আমার কথায় বিশ্বাস হল না বুঝি?
কথা বললাম না। মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম মুখখানা বেশ খুশিতে ভরে উঠেছে। কোনও কথা বললেন না। মাথাটা একটু চুলকালেন। আমিই বললাম,
– চণ্ডীপাহাড়ে আসার পর কি করলেন?
উত্তরে বললেন,
– তখনকার দিনে তো অত লোকজন ছিল না। বেশ নির্জনে আমি আর মহাত্মা ওই পাহাড়ে রয়ে গেলাম। ওখানেই একদিন দীক্ষা হল। সাধনভজনের নানা শিক্ষা দিলেন। সেই মহাত্মাই জীবনপথের ইহকাল পরকালের সঙ্গী হলেন। গুরুজি ছিলেন যোগী। এযুগে এমন শক্তি খুব কমই আছে। খুব সুকৃতি ছিল তাই আমার এমন গুরু মিলেছে।
কথা শেষ হতেই বললাম,
– বাবা, যোগীগুরুর শিষ্য যখন, তখন নিশ্চয়ই আপনি উড়ে যাওয়া, ফটাফট কিছু অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ দেখানো ইত্যাদি গুরুজির কাছ থেকে শিখেছেন।
কথাটা শুনে একগাল হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতেই বললেন,
– বেটা, অতই সস্তা! গুরুজি বলেছিলেন, আমার এ দেহটা যোগের উপযুক্ত নয় তাই আমাকে তিনি সাধনভজনে যোগের যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুই দিয়েছেন। উপযাচক হয়ে কিছু চাইনি। দয়া করে আশ্রয় দিয়েছেন এটাই আমার কাছে অনেক।
সাধুবাবা গুরুজির উদ্দেশ্যে দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। জিজ্ঞাসা করলাম,
– চণ্ডীপাহাড়ে কত বছর ছিলেন?
একটু ভেবে নিয়ে বললেন,
– তা বেটা প্রায় বছরচল্লিশেক ছিলাম। লোকালয়ে খুব কমই আসতাম। গুরুজি বলতেন, তৈরি না হয়ে সকলের সঙ্গে মিশলে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। মানুষের কামনাবাসনার ঢেউ এত শক্তিসম্পন্ন যে, তাদের সংস্পর্শ ‘আচ্ছা আচ্ছা’ সাধুকেও টলিয়ে দিতে পারে। তাই যতদিন পাহাড়ে ছিলাম, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া আমরা খুব একটা লোকালয়ে আসতাম না।
জানতে চাইলাম,
– বাবা এখানে একটা প্রশ্ন আছে, লোকালয়ে না এলেও রিপুর প্রভাব তো একটা ছিলই। সেই রিপু দমন বলুন আর জয় বলুন, তা করলেন কেমন করে?
কথাটা শেষ হতে বললেন,
– বেটা, ভোগের জিনিস দেখলেই ভোগ করার ইচ্ছা মানুষের সব সময় আসে না যদি ভোগের কৌশলটা জানা না থাকে। গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাটা তোর কখনওই হবে না যদি না তুই চালাতে জানিস। মানুষের যা কিছু ভোগবাসনা কামনা তা সব অন্যের ভোগ করাকে দেখে শেখা। আমার সাধনজীবনে অন্যের ভোগ করার ব্যাপারটা দেখা হয়নি। তাই ভোগের বাসনাটা কোনও কালেই আসেনি। ফলে রিপুর তাড়নাটা ছিল না বলতে পারিস। কামনা বাসনার উদ্রেক তো করায় রিপু। সেই রিপুর ক্রিয়া করার মতো কোনও কিছুর সংস্পর্শে ছিলাম না বলে দেহমনে পার্থিব প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভাবনা কখনও আসেনি। যেমন ধর লজ্জা নিবারণের টুকরো ন্যাকড়া আর পেটের জন্য একবেলা একমুঠো অন্ন নইলে কন্দমূল, এছাড়া কোনও চাহিদা বা কামনা ছিল না। অবশ্য এগুলো জোগাড় করতেন গুরুজি। আমাকে কিছু ভাবতে হত না।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, যৌবনে কামরিপুর প্রভাব তো একটা ছিলই। সেটা জয় করলেন কি ভাবে?
নির্লিপ্তভাবেই বললেন,
– বেটা, কোনও জিনিসের প্রয়োগ পদ্ধতি জানা না থাকলে তা যত মূল্যবান হোক না কেন, সে জিনিস অবহেলাতেই গড়াগড়ি খায়। শিশুর কাছে একটুকরো সোনা ফেলে রাখলে যেমনটি হয়। গুরুসঙ্গে সাধনভজন ছাড়া জগতের আর কোনও বিষয়, কোনও কিছু নিয়েই ভাবার অবকাশ ছিল না। সারা দিনরাত আমার কেমন করে কাটতো তা শুনলে তুই অবাক হয়ে যাবি।
সাধুবাবা থামলেন। কোনও কথা বললাম না। শান্ত মধুর কণ্ঠে বললেন,
– বেটা, শীত গ্রীষ্ম বর্ষাতে উঠতাম রাত তিনটের সময়। তখনই গঙ্গায় স্নান করে এসে বসতাম জপধ্যানে। তারপর শুরু করতাম হোম। এসব চলত একাসনে বসে সারাদিন ধরে। সন্ধ্যার একটু আগে গুরুজির প্রসাদ গ্রহণ করতাম। তিনিই আহারের জোগাড় করতেন যাতে আমার ভজনে বিঘ্ন না হয়। আহার গ্রহণ করতাম একবারই। রাতে শাস্ত্রের কথা শুনতাম গুরুজির মুখে। ঘুমাতাম রাত বারোটা নাগাদ। ঘণ্টাতিনেকের বেশি গুরুজি আমাকে ঘুমাতে দেননি। এইভাবেই বছরের পর বছর কেটেছে কৈশোর থেকে যৌবন। আমার জীবন মন ধন্য। বহু বছর ধরে গুরুসঙ্গ পেয়েছি। এমনটা সকলের ভাগ্যে জোটে না। এরপর গুরুজি একদিন বললেন, ‘বেটা আমার কাজ শেষ হয়েছে। এবার যেতে হবে।’ বলে তিনি হিমালয়ের আরও গভীরে কোথায় গেলেন, কিছু বলে গেলেন না। যাওয়ার সময় শুধু বলে গেলেন, ‘প্রয়োজন মনে করলে আসব।’
এ কথার সূত্র ধরে বললাম,
– বাবা, আপনার গুরুজি চলে যাওয়ার পর আর কখনও এসে স্থূলদেহে দেখা দিয়েছেন?
হাসি হাসি মুখ করে বললেন,
– হাঁ বেটা, দিয়েছেন। তাঁর কত দয়া শুনলে তুই বুঝতে পারবি। একবার কাশীতে অন্নকূটের সময় গেছিলাম। ভাবলাম, গঙ্গায় স্নান করে মা অন্নপূর্ণার প্রসাদ পাব। এই ভেবে দশাশ্বমেধঘাটে স্নানে নেমেছি। কেমন করে যে কি হল তা বুঝতেই পারলাম না। সাঁতার জানা ছিল না। ক্রমশ তলিয়ে যেতে লাগলাম। ভাবলাম আর বাঁচব না। গুরুজির নাম স্মরণ করতে লাগলাম। তারপর আমার কোনও জ্ঞান নেই। যখন জ্ঞান হল, দেখলাম গঙ্গার ওপর পাড়ে একটু নির্জনে গুরুজির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। উঠে বসে প্রণাম করলাম। গুরুজি হাসলেন। মাথায় হাত দিয়ে আশির্বাদ করে বললেন, ‘বেটা, গুরু তাঁর সন্তানকে কখনও পরিত্যাগ করেন না। তিনি সদাসর্বদা রয়েছেন তাঁর সন্তানের সঙ্গে। সুখে দুঃখে বিপদে আপদে তিনি সন্তানের সঙ্গেই থাকেন। মানুষ মিথ্যা মায়া, কামনা বাসনায় ডুবে থাকে বলে কোনও অনুভবই করতে পারে না। দেখলাম অনেকদিন হল তোর সঙ্গে এইভাবে বসে কথা হয় না। ভাবলাম একবার দেখা করি। তাই ছল করে তোকে জলে ডুবিয়ে আবার টেনে তুললাম আমি। হুট করে এলে তুই মজা পেতিস না। তাই এলাম এইভাবে।’ বলে বৃদ্ধ গুরুজি আমার শিশুর মতো খিলখিল করে হাসলেন। আমিও তাঁর অপার করুণার কথা ভেবে চোখে জল ধরে রাখতে পারলাম না। আনন্দে কেঁদে ফেললাম। গুরুজি আমাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। তারপর কিছুক্ষণ কথা হল নানা বিষয়ে। আবার চলে গেলেন তিনি।