পুজোয় ফল বা ফুল ব্যবহারের নিয়ম, কামাখ্যায় বসে জানালেন তন্ত্রসিদ্ধ সাধুবাবা
বিভিন্ন দেবদেবীর পুজোয় নিবেদিত ফল বা ফুলের কিছু বিশেষ নিয়ম রয়েছে। কোন ফুল পুজোয় দিতে নেই। কাকে অশুদ্ধ ফুল বলে।
১৯৭২ সালের ১০ মার্চের কথা। সৌভাগ্য পরবশত দেখা হয়েছিল উপদেবী মধুমতী সাধনায় সিদ্ধ এক তন্ত্রসাধকের সঙ্গে। কিভাবে এখন সেই প্রসঙ্গ।
কামাখ্যা পাহাড়ের সমস্ত কিছুই ঘুরে দেখেছি। আশ্রয় নিয়েছি এক পাণ্ডার বাড়িতে। আজ সারাদিন আর কোথাও বেরোইনি। ওখানেই ছিলাম। সন্ধ্যার খানিক আগে টুকটুক করে উঠে এলাম ভুবনেশ্বরী মন্দিরে। একাই এসে গেলাম। এখনও বেলা সামান্য। নামার সময় উতরাই। বেশি সময় লাগবে না, তাই চিন্তা নেই মনে। এসময় লোকজন বা তীর্থযাত্রী তেমন চোখে পড়ে না। বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। প্রণাম সেরে বেরিয়ে এলাম ভুবনেশ্বরী মন্দির থেকে।
মন্দিরের পাশে ভাঙা টিনের চালার একটা ঘর। অবশ্য এর দুদিকই খোলা। হঠাৎ চোখ পড়ল এক জটাজুটের প্রতি। বসে আছেন বারান্দার এককোণায়। সঙ্গে ঝোলাটোলা কিছুই দেখলাম না। ছিপছিপে চেহারা। কপালে লাল টকটকে ফোঁটা। পরনে লালচেলি একটা। একেবারে তেলচিটে মারা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। ছোট নয়, বড়বড় গুটি। দু-বাহুতেও রয়েছে। সারা গায়ে ছাইমাখা যেন ফরসা হয়ে আছে। আদতে ফরসা নয়। চোখদুটো টানা টানা নয়। বড় গোলগোল। ভয় লাগে না। তাকালে গায়ে একটা শিহরণ জাগে। কেমন যেন একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে চোখদুটোয়।
একেবারে ছোটবেলা থেকেই কোনও সাধুকে দেখে আমার ভয় করেনি কখনও। তাই কাছে গিয়ে প্রণাম করলাম। প্রণামী হিসাবে কিছু পয়সা বের করলাম পকেট থেকে। পায়ের কাছে রাখতে যেতেই ইশারায় নিষেধ করলেন সাধুবাবা। মুখে কোনও কথা বললেন না। ইশারাতে পয়সাটা রাখতে বললেন পকেটে। এতক্ষণ বসেছিলেন এবার উঠে দাঁড়ালেন।
মন্দিরে প্রণাম আর সাধুবাবার কাছে আসা, এতেই কেটে গেল প্রায় মিনিট দশেক। সন্ধ্যাও নেমে এসেছে। উঠে দাঁড়িয়ে আমার চোখের উপর রাখলেন তাঁর দৃষ্টিটা। মাত্র কয়েক মুহুর্ত। বেশ বুঝতে পারলাম সমস্ত শক্তিটাই যেন চলে গেল সাধুবাবার কাছে। কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললাম। এবার কেমন যেন ভয়েতে ঘেমে উঠলাম। ইশারায় অভয় দিলেন। ভয়ের কিছু নেই। বললেন অনুসরণ করতে। তাও ইশারায়। এই পর্যন্ত একটা কথাও বললেন না। হাঁটতে শুরু করলেন ধীরে ধীরে, বিবশভাবে অনুসরণ করলাম সাধুবাবাকে।
বেশ কিছুক্ষণ চললাম। কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পারলাম না। এলাম একটা গুহামুখে। জায়গাটা বেশ ঝোপেঝাড়ে ঘেরা। কামাখ্যায় আমার এই প্রথম আসা। পথঘাটের কিছু চিনি না। এসেছি আজ তিনদিন হল। এদিকে অন্ধকার হয়ে গেছে। আমার হুঁশ নেই কতটা সময় কাটল। দাঁড়িয়ে আছি সাধুবাবার একেবারে কাছাকাছি। অন্ধকারেও বেশ বুঝতে পারলাম, ইশারায় ঢুকতে বলে নিজে ঢুকে গেলেন গুহায়।
ভয়ে তখন আমি আর আমার ভিতরে নেই। আকর্ষণ যে কাকে বলে তা জীবনে উপলব্ধি করলাম এই প্রথম। বুঝতে পারছি সবকিছু। জ্ঞান রয়েছে ভিতরে অথচ আমার কিছু করারই নেই।
ভিতরে ঢুকে একটা লম্ফ ধরালেন। আলো হল। আমিও ঢুকলাম মাথাটা একটু নিচু করে। দেখলাম ছোট একটা ধুনী জ্বলছে। আগুন তত জোরালো নয়। এতক্ষণ পর মুখ খুললেন,
– বইঠ বেটা।
বলে বসলেন ধুনীর ওপাশে। বিপরীত দিকে আমি বসলাম মুখোমুখি হয়ে। গুহামুখটা রইল আমার পিছনে। ছোট্ট গুহা। ভ্যাপসা একটা গন্ধ। প্রথমে ঢুকতেই গন্ধটা লেগেছিল। তারপর আর বোধ হল না। সয়ে গেল। ভিতরে হাতপনেরো লম্বা। ব্যস, আর এগোনোর উপায় নেই। গুহা শেষ। সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় তবে মাথাটা ঝুঁকিয়ে। একেবারে নিস্তব্ধ পরিবেশ। ভিতরে খানকয়েক মড়ার খুলি রয়েছে ধুনীর পাশে। পিছন ফিরে দেখলাম গাঢ় অন্ধকার। ধুনী থেকে ধোঁয়া উঠছে। একভাবে তাকানো যাচ্ছে না। সামান্য জ্বালাজ্বালা করছে চোখ দুটো।
প্রথম কথাতেই বুঝেছিলাম সাধুবাবা হিন্দিভাষী। এবার বেশ গম্ভীরস্বরে বললেন,
– বেটা, তোর প্রণামী নিইনি বলে দুঃখ করিস না। আমি কখনও কারো দান গ্রহণ করি না।
চুপ করে বসে আছি। কোনও কথা নেই মুখে। ভয়েতে গলা শুকিয়ে যেন আরবি খেজুর হয়ে আছে তবে উৎকণ্ঠা কমেছে অনেকটা। সাধুবাবা বললেন,
– আমি কারও ক্ষতি করিনি, করতে শিখিনি। তোকে দেখে আমার ভাল লাগল। তাই নিয়ে এলাম এখানে। তোর ব্যবহারেও খুব খুশি হয়েছি। কারণ আজকাল তো সাধু সন্ন্যাসীদের কেউ বড় একটা সাহায্য করে না, তাই। তা বেটা, কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
কথা বললেন এইটুকু। মনের ভয় কেটে গেল অনেকটা। বললাম,
– কলকাতা থেকে এসেছি। এখন এসেছিলাম পাণ্ডার বাড়ি থেকে ভুবনেশ্বরী মাকে দর্শন করতে।
আর কোনও প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, আপনি কি তন্ত্রসাধক, মায়ের উপাসনা করেন?
এ কথার উত্তরে হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না। ভাবটা এমন, শুনেও শুনলেন না। বসে রইলেন চোখ বুজে। আমার ভিতরে এক অদ্ভুত অস্বস্তি হতে থাকল। কি করব, কোথায় যাব, কি হবে আমার, কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। একটা অসহায়ভাব দেখা দিল মনে। কেটে গেল প্রায় মিনিট দশেক। এবার চোখ খুলতে বললাম,
– আপনি কি কামাখ্যাতে থাকেন না অন্য কোথাও?
উত্তর দিলেন,
– আমার কোনও ডেরা নেই। এখানে আছি বছর খানেক হল। একটা বিশেষ সাধনের জন্য এসেছিলাম। সিদ্ধিলাভ হয়েছে। মায়ের ক্ষেত্র যে, হবে না!
বলে হাতজোড় করে একবার নমস্কার জানালেন কামাখ্যামায়ের উদ্দেশ্যে। জিজ্ঞাসা করলাম,
– এখান থেকে যাবেন কোথায়?
সাধারণভাবেই বললেন,
– যাব কোথায় কিছু জানি না। সাধুদের কি কোনও ঠিকানা আছে? যাদের ঠিকানা আছে, সাইনবোর্ড আছে তারা আবার সাধু নাকি? ওগুলো থাকা মানেই গৃহীদের মাথায় হাত বুলিয়ে খাওয়ার স্থায়ী ধান্দা।
আগের কথার সূত্র ধরে বললাম,
– বাবা, সিদ্ধিলাভের জন্য এখানে এসেছেন বললেন। ওটা তো যে কোনও জায়গাতেই হতে পারে। কারণ মন আর মন্ত্রের উপরেই তো সিদ্ধিলাভ নির্ভর করে। কথাটায় ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন সাধুবাবা। মুখেও বললেন,
– কথাটা তুই ঠিকই বলেছিস। ভগবান সর্বত্রই বিরাজ করছেন। তবে বেটা স্থানের মাহাত্ম্য তো একটা আছেই যেটা মন্ত্রসিদ্ধিতে দারুণভাবে কাজ করে। আর মনটা কাজ করে পরিবেশের উপর। ইস্কুলের পড়ার মনটা কি হাটের পরিবেশে হয়? তাহলে ফুলশয্যার রাতের জন্যে আলাদা ঘরের ব্যবস্থা কেন। ঠিক কিনা বল?
এখন ভয়টা আমার সম্পূর্ণই কেটে গেছে। মনে মনে বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠছি। সাগ্রহে বললাম,
– বাবা, মনের কথা যখন উঠল তখন মন নিয়েই একটা প্রশ্ন করি। মনের শক্তি বাড়ানো যায় কিভাবে? সাধনভজন, জপতপে মনের শক্তি বাড়ে একথা বলেন, যারা আছেন এপথে। যারা তা করতে পারে না তাদের কি উপায়ে মনের শক্তি বাড়ানো সম্ভব?
এরকম একটা প্রশ্ন করব এখন সাধুবাবা ভাবতেই পারেননি। আলো আঁধারে মুখটা দেখে তাই-ই মনে হল। এতক্ষণ পর ধুনীর কাঠটা একটু খুঁচিয়ে দিলেন। ছাইটা ঝরে পড়ল। ধুনী ছিটিয়ে দিয়ে বললেন,
– এটা তো খুব সহজ রে। কোনও ব্যাপারে কিছু ভাববি না, দেখবি মনের শক্তি আপনা থেকেই বেড়ে যাবে জপতপ না করলেও। মেপে কথা বলবি। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটাও না। তাতেও মনের শক্তি বাড়ে। তাছাড়া কোনও বিষয়ে, সেটা সুখ দুঃখ যাই হোক না কেন, শুধু একবার ভেবে নিতে হবে, যা হবার তা হবে, যা হবে দেখা যাবে, এই ভাব-এ কেউ যদি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে তো মনের শক্তি অসম্ভব বেড়ে যাবে। প্রকৃত ও যথার্থ কোনও ভাবনার বাইরে যে ভাবনা সেটাই মনের শক্তি নষ্ট করে। আর তার থেকেই তো সংসারের যা কিছু অনাসৃষ্টি, অশান্তি। মুখে যতটা সহজে বললাম কাজে করা ততটা সহজ নয়। দীর্ঘদিনের অভ্যাসে মনকে এই ভাব-এ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এতে বেড়ে যাবে মনের অদম্য শক্তি। দুশ্চিন্তা বলে আর কিছু থাকবে না।
বাঘছালের উপরে বসে আছেন সাধুবাবা, এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি হঠাৎ নজরে পড়ল। কৌতূহল সামলাতে না পেরে বললাম,
– বাবা, আপনি তো দেখছি বাঘছালের ওপর বসে আছেন। এই আসনে বসে জপ করলে কি বিশেষ কোনও ফল লাভ হয়?
কথাটা শুনে মুখের দিকে তাকালেন। একঝলক মুখে হালকা হাসির ভাব এনে বললেন,
– হাঁ বেটা, আসনের গুণ তো একটা আছেই। আর সেইজন্যেই তো অন্যের জপের আসনে বসতে নেই। নিজের আসনেও কাউকে বসতে দিতে নেই। এমনকি স্পর্শও নয়।
কারণ জানতে চাইলে বললেন,
– একই আসনে বসে প্রতিদিন জপ করতে থাকলে জপমন্ত্রের শক্তি ক্রমে গেঁথে যায় আসনে। ধীরে ধীরে আসন সিদ্ধ হয়ে ওঠে। এটা হয় অলক্ষ্যেই। মন্ত্রশক্তির প্রভাবে আসন প্রভাবিত হয়। ফলে মন যত চঞ্চল অস্থির বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হোক না কেন, আসনে বসামাত্র পূর্বজপের প্রভাব ক্রিয়া করে দেহমনের ওপরে। ফলে দ্রুত স্থির হয়ে যায় মন। যার জন্যই তো নিজের জপের আসনে কাউকে বসতে, এমনকি স্পর্শও করতে দিতে নেই।
রাত বেড়ে চলল, ভয়টা এখন একেবারেই মুছে গেছে মন থেকে। তবে একটু অস্থির হয়ে উঠলাম। পাণ্ডার বাড়িতে আমার বন্ধু আছে। সে জানে না আমি কোথায় আছি। জানি, চিন্তায় সে অধীর হয়ে উঠেছে। চারদিকে এখন গাঢ় অন্ধকার। কোনওভাবেই ফেরার উপায় নেই। এইটুকু ভাবতেই অন্তর্যামী বললেন,
– কোনও চিন্তা করিস না। তোর বন্ধু যাতে তোর জন্য চিন্তা না করে, উদ্বিগ্ন না হয় তার ব্যবস্থা আমি করেছি। ওসব কিছু ভাবিস না।
বুঝলাম আমার মনের কথা অবগত হয়েছেন সাধুবাবা। এতে মোটেই অবাক হলাম না। নিশ্চিন্ত হলাম। কারণ এই বিষয়টার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। একবার নয় বহুবার। আর ভাবলাম না। সাধুবাবারও নিশ্চিন্ত মুখটা দেখলাম। আসন প্রসঙ্গে তিনি বললেন,
– বেটা, এক এক আসনে বসে জপের ফল ভিন্ন। গৃহীদের সাধারণ জপতপ পুজোপাঠের জন্য কম্বল বা পাটবস্ত্রের আসনই ভালো। তবে ধর্মলাভ ও কাম্যবস্তুর সাধনায় কম্বলের আসন শ্রেষ্ঠ। তার রং যদি গাঢ় লাল হয় তো আরও ভালো। কৃষ্ণসার কিংবা হরিণের চামড়ার আসন জ্ঞান ও বাকসিদ্ধির ক্ষেত্রে সর্বোৎকৃষ্ট। মন্ত্রসিদ্ধির জন্য সবচেয়ে ভাল কুশের আসন।
একটু থামলেন। মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা? ‘না’ বলাতে নিশ্চিন্ত হলেন। আবার শুরু করলেন,
– পাথরের আসনে বসে জপ করতে নেই, রোগব্যধি হয়। কাঠের আসনেও নয়, সাংসারিক উন্নতিতে ব্যাঘাত ঘটে। শুধু মাটিতে বসে জপ করলে বাড়ে দুঃখ। মেয়েদের অশৌচ চলাকালীন আসনে বসতে নেই। জপ করতে হয় মাটিতে বসে। শুকনো ছোবড়া জাতীয় কিছু দিয়ে তৈরি আসনে বসে জপ করলে নষ্ট হয় সম্মান যশ। বাঘছালের আসনে বসে জপ করতে নেই গৃহীদের। সংসারের অমঙ্গল অনিবার্য। অদীক্ষিত গৃহী যারা তাদেরও কৃষ্ণসার কিংবা হরিণের চামড়ার আসনে বসে পুজোপাঠ করতে নেই। সংসারত্যাগীদের বাঘছালের আসনে বসে জপ মোক্ষলাভের সহায়ক।
এখন অন্তরে ভয়ের লেশমাত্র নেই। আন্দাজ করতে না পারলেও বুঝতে পারছি রাত অনেকটাই বেড়েছে। প্রশ্ন করলাম,
– বাবা, আসনের যেমন বাছবিচার আছে তেমন বিভিন্ন দেবদেবীর পুজোয় নিবেদিত ফল বা ফুলের কি সেরকম কিছু নিয়ম আছে?
এ প্রশ্নে সাধুবাবা খুব খুশি হলেন। এটা মুখ দেখেই মনে হল। বললেন,
– আছে বই কি। স্নান করে ওঠার পর গাছ থেকে ফুল তুলে দেবতার পুজো করতে নেই। সে ফুল দেবদেবীরা গ্রহণ করেন না। পুজোয় কোনও ফল হয় না। স্নানের আগে ফুল তুলতে হয়। ফুল ধুয়ে পুজোয় দিতে নেই। ধোয়া ফুল দেবতারা গ্রহণ করেন না। পড়ে থাকা বস্ত্রে ফুল রাখতে নেই। রাখলে তা পুজোয় দিতে নেই।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাজার থেকে কেনা বাসি ফুল, আবার অনেক সময় আজ ফুল তুলে রেখে কাল যদি সেই ফুলে পুজো করা হয়, তাতে কি কোনও অপরাধ হয়?
সাধুবাবা হাসতে হাসতে বললেন,
– অপরাধ আর কি! তবে বেটা, মলিন বা ছেঁড়া, মাটিতে পড়ে চেপ্টে যাওয়া, গন্ধশোঁকা হয়েছে এমন ফুল পুজোয় দিতে নেই। এগুলোকে অশুদ্ধ ফুল বলে। শিউলিফুল মাটিতে পড়লে তা অশুদ্ধ হয় না। তবে ধুয়ে পুজোয় দিলে সে ফুল দেবতারা গ্রহণ করেন না। শ্মশানে নানান গাছের ফুল যত সুন্দরই হোক তা পুজোয় একেবারেই নিষিদ্ধ। বিষ্ণুপুজোয় ফুলের কুঁড়ি দিতে নেই।
কোনও বিষয়ে প্রশ্ন তুলে জ্ঞানী ব্যক্তিকে একটু খুঁচিয়ে দিতে হয়। পরে আর বলতে নেই। তখন নিজেই তিনি জ্ঞানভাণ্ডারের দরজা খুলে দেন। এখন হলও তাই। বলতে লাগলেন,
– চাঁপা, পদ্ম, মালতিফুল, বেলপাতা, তুলসী আর দূর্বা কখনও বাসি হয় না। এর প্রথম তিনটে ফুল দিয়ে একবার পুজো দেওয়ার পর ওই ফুল পরদিন জল দিয়ে ধুয়ে আবার দেবতার পায়ে অর্পণ করতে পারিস। তাতে কোনও দোষ হয় না।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা কারণগুলো তো ব্যাখ্যা করছেন না। এসবের কারণ কি, কেন ভাল, কি জন্য দোষ?
হাসিমুখে সাধুবাবা বললেন,
– এই বিশ্বসংসারের সমস্ত কিছুর কারণ ও উদ্দেশ্য কি মানুষের জানা সম্ভব? যে নিয়ম চলে আসছে তা মেনে চলাই ভালো। তাতে ভালো হলে ভালো, না হলে আর যাই হোক ক্ষতি তো কিছু হয় না। প্রকৃতি বল বা ভগবানই বল, তার উদ্দেশ্য আর সমস্ত রহস্য যেদিন মানুষ জানতে পারবে সেদিন কি সে আর মানুষ রইবে বেটা।
এটুকু বলে ফিরে এলেন পূর্ব প্রসঙ্গে,
– পোকা খাওয়া কিংবা বাসি ফুল দিয়ে পুজো করতে নেই। দেবতারা অভিশাপ দেন যিনি পুজো করেন তাঁকে। উগ্রগন্ধ অথবা একেবারেই গন্ধ নেই এরকম ফুল ও জবা দিয়ে নারায়ণের পুজো করবি না। সুগন্ধি যে কোনও ফুল ও জবা দিবি শক্তিপুজোয়। ভোরবেলায়, সন্ধ্যাকালে, অমাবস্যা, পূর্ণিমা আর দ্বাদশী তিথিতে তুলসীপাতা ছিঁড়তে নেই গাছ থেকে। এটা করলে নারায়ণের অঙ্গে আঘাত করা হয়। ওই সময় ও দিনগুলিতে গাছ থেকে বেলপাতাও ছিঁড়বি না। বেলপাতার তিনটে ফলক না থাকলে অসুবিধে নেই। শিবপুজোয় দেয়া যাবে। সব সময় নিখুঁত ফল দিতে হয় পুজোয়। দিলে দ্রুত কার্যসিদ্ধি হয়।