প্রণাম করলে আদৌ কী কোনও ফল হয়, ব্যাখ্যা দিলেন সাধুবাবা
আমরা সংসারী, কমবেশি ভগবানকে ডেকে থাকি কিন্তু কিছুই তো বুঝতে পারি না সাধনভজনে উন্নতি হচ্ছে কিনা? কিভাবে বুঝতে পারব নিজের বা অন্য কারও সাধনজীবনে উন্নতি হয়েছে?
কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম,
– বাবা, আপনার গুরুজি কি ফট্ করে অদৃশ্য হয়ে গেলেন?
হেসে ফেলে সাধুবাবা বললেন,
– না বেটা, তিনি গঙ্গার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে একসময় বহুদূরে মিলিয়ে গেলেন।
এবার উদাত্তকণ্ঠে ‘জয় গুরু মহারাজ কি জয়’ বলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– বেটা, গুরুজি পারেন না এমন কোনও কাজ নেই সংসারে। তিনি তাঁর সন্তানকে প্রয়োজনে কষ্ট দেন আবার তিনিই সমস্ত কষ্টের অবসান ঘটিয়ে দেন পরমানন্দ। দুঃখ কষ্ট যা কিছু, তাঁর শরণাগতের প্রয়োজনে তিনি করান। ভালমন্দ বোঝার ক্ষমতা ক্ষুদ্রবুদ্ধি সন্তানের নেই বলেই তো সন্তানের মান অভিমান আর কষ্ট। তাঁকে সব সময় স্মরণে রাখবি, দেখবি তোকে সংসারের কোনও আবিলতা, দুঃখ কষ্ট ব্যথা বেদনা স্পর্শ করতে পারবে না।
সাধুবাবা থামলেন। আমি একবার এদিক ওদিক দেখে নিয়ে বললাম,
– বাবা, আপনার নিরস কঠিন সাধনজীবনের কথা তো শুনলাম। এছাড়াও আমি অত্যন্ত কঠোর কঠিন তপস্যা করা কয়েকজন সাধুবাবাকে দেখেছি চলার পথে, যা চোখে না দেখলে কারও বিশ্বাস হবে না এযুগে। সাধুদের মুখে শুনেছি, জপ করলে তাঁকে পাওয়া যায়, তাঁর করুণালাভ হয়। তাহলে এই কঠিন তপস্যার কি প্রয়োজন? যেমন ধরুন, তিনমাসে একবার আহারগ্রহণ, শুধু গঙ্গাজল আর বেলপাতা খেয়ে থাকা, বছরের পর বছর উর্দ্ধবাহু হয়ে থাকা, একপায়ে বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে থাকা, সারাদিন রাতে দুটো ফল খেয়ে থাকা, শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় গলা জলে দাঁড়িয়ে তপস্যা, এমন কত কঠিন সাধনা নিজের চোখে দেখেছি ভ্রমণকালে। আপনার দীর্ঘকালের সাধনজীবনও তো এঁদের চাইতে কোনও অংশে কম নয়। আমার জিজ্ঞাসা, সত্যিই কি এমন কঠোরতার প্রয়োজন আছে? সংসারীদের পক্ষে এসব তো কোনওকালেই সম্ভব নয়!
প্রশ্নটা শুনে সাধুবাবার মুখখানা হাসিতে ভরে উঠল। এবার চোখদুটো বুজে হাঁটুর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,
– হাঁ বেটা, এসব সাধনা বড় কঠিন সাধনা। সব সাধুসন্ন্যাসীদের দ্বারা সম্ভব নয়। তবে কিছু সাধুসন্ন্যাসী এমন কঠোর ব্রত গ্রহণ করে। মূল উদ্দেশ্য দেহ থেকে কামনাবাসনা রিপুর তাড়না একেবারে নিংড়ে ফেলা। কাম ক্রোধ লোভ মোহ অহংকারই তো আশ্রয় করে আছে মনকে। এই তপস্যায় সমস্ত রিপুর ক্রিয়া শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। দেহটাকে যদি কষ্ট দেয়া যায় তাহলে মনটা আর কাজ করতে পারে না। কারণ মন দেহকে আশ্রয় করে রিপুর ক্রিয়া চালায়। একটা কথা জানবি বেটা, কঠোরতার পথ ধরে এগোলেও তাঁকে পাওয়া যায়, আবার একান্ত ভক্তিবিশ্বাসে তাঁর উপর নির্ভর করেও পাওয়া যায় তাঁকে। এ যুগে এমন কঠিন ব্রত পালন করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে সাধনা ভিন্ন তাঁকে পাওয়ার কোনও উপায় নেই। সাধনা ব্যাপারটা কি জানিস? কোনও বিশেষ কিছু পাওয়ার জন্য একান্ত প্রবল ইচ্ছা হলে তাকে না পাওয়া পর্যন্ত মনের গতিকে একমুখী করে সেই বিষয়ে উতরানো বা গতি করাকে সাধনা বলে। সংসারীরা মনকে একমুখী করে সংসারে দেয় বলে তো সংসার বজায় রাখতে প্রয়োজনের যা কিছু তা সবই পাচ্ছে সংসারসাধনায়। সেই জন্যেই যে তাঁকে পায় না। ঠিক এই রকম ভগবানে করলে সে ভগবানকেই লাভ করত। অতএব সাধনা করতেই হবে। শিশুর অক্ষর পরিচয়ও সাধনা ব্যতিরেকে হয় না।
সাধুবাবা থামলেন। তাকালেন আমার মুখের দিকে। প্রশান্তভাব ফুটে রয়েছে চোখেমুখে। বললেন,
– বেটা, মনটা এমনই যে, যাতে একবার লেগে যাবে তাতেই ভেবে ভেবে সারা হয়ে যাবে। যদি কারও একবার এপথে লেগে যায়, একবার যদি তাঁর প্রতি অনুরাগ আসে, তাহলে নিশ্চিত জানবি তাঁকে প্রাপ্তি তার হবেই হবে। তখন আপসেই তার চলতে থাকে। তিনি টেনে নেন, আপন করে নেন চিরকালের মতো।
কথা শেষ হতে না হতেই তৈরি হয়ে গেছে প্রশ্ন। হাতে সময় কম তাই যতটা পারি জেনে নিই। সঙ্গীরা সঙ্গম থেকে ফিরে এলে উঠতে হবে আমাকে। জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, আমরা মুখে বলি ভগবানে, গুরুতে, শাস্ত্রবাক্যে বিশ্বাস আছে। গভীরভাবে ভেবে দেখেছি কথাটা ঠিক বলি না। কারণ গুরু হয়ত কোনও কথা বললেন, তখন মনে হল, গুরু যখন বলেছেন তখন এটা হবেই। পরে মনে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, গুরু যা বলেছেন তা হবে তো? শাস্ত্রবাক্যেও তাই। অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা পড়ে মনে হয়, দূর এসব হতে পারে না। এখন জিজ্ঞাসা, গুরুবাক্যে, সাধুসন্ন্যাসীদের এবং শাস্ত্রবাক্যে চট করে বিশ্বাস আসে না কেন, কেন মনে এত দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়? কি করলে এর থেকে মুক্তি পেয়ে স্থির ও দৃঢ়বিশ্বাস লাভ করতে পারি, দয়া করে বলবেন?
কথাটা শুনে সাধুবাবা হাঁ করে চেয়ে রইলেন মুখের দিকে। উত্তর দিলেন না। মনে মনে ভাবছি, কথাটা সাধুবাবাকে বোঝাতে পারলাম তো! কোনও কথা না বলে চুপ করে রইলাম। মিনিটখানেক পর বললেন,
– বেটা, সারা সংসারে যত মানুষ, সব কামনাবাসনা নিয়েই মানুষ। এর বাইরে কেউ নেই। এটাই জীবের ধর্ম। এই ধর্মটা রিপুর অধীন। সাধুসন্ন্যাসী গুরু ও শাস্ত্রবাক্যে বিশ্বাস আনতে গেলে একমাত্র এঁদেরই সঙ্গ করতে হবে। দু-একদিন করলে হবে না। করতে হবে বছরের পর বছর ধরে। তাঁদের সঙ্গপ্রভাব আর বাক্যের শক্তিতে মানুষ রিপুর অধীনতা মুক্ত হয়, কালে কালে বিশ্বাস স্থির ও দৃঢ় হয়। কোনও দ্বন্দ্বই মনকে টলাতে পারে না, সহসা দ্বন্দ্ব আসেও না। এ এমনই এক সঙ্গপ্রভাব। তবে সঙ্গপ্রভাব যত বেশি কাজ করে মনে, তত বেশি কাজ না করলেও সদগ্রন্থ পাঠ অনেকটা কাজ করে, বিশ্বাস উৎপাদন করে মনে। একটা শ্রেণি আছে যদিও সংখ্যায় খুব কম, তাদের বিশ্বাস বলতে পারিস আঁতুড়ঘর থেকে। এটা হয় পূর্বজন্মের সংস্কারবশত। আবার কারও সংস্কার ভালো অথচ সাংসারিক কামনাবাসনা রিপুর তাড়নাও যথেষ্ট, তাদের বেটা গুরু বা সাধুসন্ন্যাসীদের সঙ্গ করতে করতেই রিপুর প্রভাবমুক্ত হয়ে বিশ্বাস আসে, বুঝলি?
হ্যাঁ বা না কিছু বললাম না। ঘাড়টাও সামান্য নাড়ালাম না। প্রশ্ন করলাম,
– আমরা সংসারী, কমবেশি ভগবানকে ডেকে থাকি কিন্তু কিছুই তো বুঝতে পারি না সাধনভজনে উন্নতি হচ্ছে কিনা? কিভাবে বুঝতে পারব নিজের বা অন্য কারও সাধনজীবনে উন্নতি হয়েছে?
এতক্ষণ পর সাধুবাবা বললেন,
– বেটা, এ ধরনের প্রশ্ন কেউ কখনও করেনি। সত্যি করে বলত বেটা, তোর আসল উদ্দেশ্যটা কি?
বিনীত কণ্ঠে বললাম,
– বাবা, আপনি সেই ছোটবেলা থেকে রয়েছেন এ পথে। অন্তর্যামী হয়ে গেছেন বলে বিশ্বাস। আমার উদ্দেশ্য আপনার অবগত নয়, একথায় আমি অন্তত বিশ্বাস করি না। তবুও বলি, সাধুদের জীবনকথা জানতে আমার ভালো লাগে তাই আপনাকে এখানে এনেছি যদি কিছু জানতে পারি। এছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য নেই।
কথাটা শেষ হতে সাধুবাবার মুখখানায় একটা আনন্দের হালকা হাসির ভাব ফুটে উঠল। আমার আগের প্রশ্নের উত্তরে বললেন,
– বেটা, সাধনভজনে সে তত বেশি উন্নতি করেছে, যে যত বেশি নত হতে শিখেছে। যার রিপু যত বেশি অধীন সে ততবেশি নত। ক্রোধ অভিমান অভিনয় কোনও ভাবেই প্রকাশ পাবে না। সেটা শুধু বাইরে নয়, অন্তরেও। এর মূল উচ্ছেদ হয়ে মনের নম্রতা আসে। একই সঙ্গে আসে ধৈর্য। কোনও চঞ্চলতার ভাব দেখা যাবে না দুঃখসুখে। সমস্ত ব্যাপারে সব সময় একটা উপেক্ষার ভাব দেখা দেবে, সেটা মানুষকে নয়, কর্মকে নয়, সাংসারিক চাওয়া পাওয়ার বিষয়ে। কথায় ও কাজে সর্বদাই থাকবে একটা আনন্দময়ভাব। কোনও বিষয়ে অন্তরে ভয় বলে কিছু থাকবে না। সকলের প্রতি ব্যবহার হবে সমান। যখন মানুষের সাধনভজনে উন্নতি হয় তখন তার মধ্যে ইষ্টের স্থিতি আসে। ফলে সে যেমন সকলকে আপনভাবে তেমনই আর সকলে তাকে নিজের করে নেয়। এমনটা যার মধ্যে দেখবি, বুঝবি সাধনভজন তার ঠিক মতো চলছে। ধর্মীয়জীবনে সে অনেক এগিয়েছে। এটাই অধ্যাত্মজীবনে উন্নতির লক্ষণ। এর ব্যতিক্রম হলে বুঝতে হবে কিছু গলদ রয়ে গেছে। তবে বেটা এ ভাবটা সহজে আসার নয়। তাঁর শরণাগত হলে আপনিই আসে। জোর করে একটা শিশুকে কোনও বয়স্ক মেয়ে বা পুরুষ প্রণাম করতে পারে? পারে না। ভিতরটা তৈরি না হলে নত হওয়ার উপায় নেই।
প্রণামের কথা উঠতে বললাম,
– বাবা, প্রণাম করাটা আমার স্বভাবের একটা বড় দোষ বলতে পারেন। অনেক সময় সাধুসন্ন্যাসীকে স্পর্শপ্রণাম করতে গিয়ে বাধা পেয়েছি। প্রথমে পা সরিয়ে নিয়েছেন। প্রণাম নেননি, পরে অবশ্য নিয়েছেন। কেন, আমার অপরাধটা কোথায়? আপনাকে প্রণাম করার সময় আপনিও একটু পা–টা সরাতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু পারেননি। আসলে পারেননি আমার দ্রুততার জন্য। ঠিক কি না বলুন?
কথাটা শোনামাত্র সাধুবাবা খিলখিল করে হেসে উঠলেন। এমন হাসি নিষ্পাপ শিশুর মুখেই দেখা যায়। হাসতে হাসতে বললেন,
– হাঁ বেটা, তুই ঠিকই বলেছিস। পা-টা একটু সরাতে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ‘ঝট সে’ তুই প্রণাম করেছিস বলে পারিনি। বেটা, যাঁরা একটু স্বতন্ত্র জীবনযাপন করে, যেমন সাধুসন্ন্যাসী গুরু বা অত্যন্ত সাধনভজনশীল, তাঁদের অনেকেই স্পর্শপ্রণাম নিতে চান না। প্রণামকারীর কোনও অপরাধ নেই। আসলে স্পর্শপ্রণামে মন চঞ্চল হয়, শক্তি অনুসারে কারও কম হয়, কারও একটু বেশি হয়, তবে হয়ই। কারণ সংসারীদের কামনাবাসনা থাকে অতিমাত্রায়। স্পর্শে জ্বালা যন্ত্রণা সংক্রামিত হয় বলে অনেকে প্রণাম নিতে পছন্দ করে না। বেটা প্রণাম করলে প্রণামকারীর কি হয়? গুরু, সাধুসন্ন্যাসী কিংবা সাধনভজনশীল মানুষকে প্রণাম করলে প্রথমে বাড়ে মানসিক শক্তি, বাড়ে অধ্যাত্মজ্ঞান। নষ্ট হয় রিপুর তাড়না। জন্মান্তরের সঞ্চিত কোনও পাপ কর্মফল থাকলে তার তীব্রতা নষ্ট, এমনকি সাধুসন্ন্যাসীদের শক্তিভেদে কর্মফল ক্ষয় হয়ে যায়। প্রণামে সাধুসন্ন্যাসী বা গুরুশক্তি স্পর্শমাত্রই এতটা কাজ করতে পারে অলক্ষ্যে, এটা সাধারণ মানুষের ধারণাতে আসবে না।
এবার সাধুবাবা একটু রসিকতা করে বললেন,
– একটা জিনিস দেখছি বেটা, এ যুগে পায়ে হাত দিয়ে প্রণামের ব্যাপারটা প্রায় উঠেই গেছে। বেশ ভালো ভালো সাধুসন্ন্যাসী সাধনপথে যাঁরা আছেন তাঁরা বাঁচবেন।
হাসিমাখা মুখখানা একটু গম্ভীর করে বললেন,
– বেটা, এঁদের কাউকে প্রণাম করলে সংসারের অশেষ কল্যাণ হয় অলক্ষ্যে, বুঝলি? সে প্রণাম শ্রদ্ধায় করলেও ফল হবে, অশ্রদ্ধায়ও ফল হয় কারণ কাজ হয় স্পর্শে।