একটু থামলেন। সাধুবাবার সুন্দর চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে রইলাম একদৃষ্টিতে। প্রশান্তমুখে আমার চোখে চোখ রেখে বললেন,
– বেটা, বাইরের রূপটা রূপই নয়। মানুষ দেখে বাইরেটা, গুরুজি দেখেন ভিতরের রূপটা। দাঁত, মাথার কেশরাজি আর নখ স্থানচ্যুত হলে যেমন শোভা পায় না, তেমনই সৌন্দর্যের এ সংজ্ঞার বাইরে মানুষ কখনও সুন্দর হতে পারে না।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, আপনার এখন বয়েস কত হল?
হাঁটুর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,
– ক্যা মালুম, ত্রিশ-বত্রিশ হবে। ঠিক বলতে পারব না।
আবার প্রশ্ন,
– এত অল্প বয়েসে এই কঠোরজীবনে এলেন কেন? কিসের টানে ঘর ছাড়লেন?
এ প্রশ্নে সাধুবাবা মুখের দিকে একবার অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকালেন। কথার কোনও উত্তর দিলেন না। চুপ করে রইলেন। কেটে গেল মিনিটপাঁচেক। বুঝতে অসুবিধে হল না এ জিজ্ঞাসার উত্তর সহজে পাব না। ট্রেনের সময় এগিয়ে আসছে। অকারণ সময় নষ্ট করলে অনেক কথা জানা যাবে না। তাই অনুরোধের সুরে বললাম,
– বাবা, আমি জানি সাধুদের ফেলে আসা সংসারের অতীত কথা বলতে নেই। তাতে সাধুমনে অস্থিরতা বাড়ে। তবুও দয়া করে বলুন না বাবা, কেন ঘর ছাড়লেন?
নির্বিকারভাবে তিনি বললেন,
– দেখ বেটা, ভাগ্যে যেটা হবার ছিল সেটা হয়ে গেছে। অতীতের ওসব কথা ভেবে কোনও লাভ নেই। তুই এমনি যা মন চায় কথা বল, উত্তর দিচ্ছি। তোর তো ভাগ্যটা ভালই দেখছি। এ যুগে এমন উচ্চমার্গের নির্লিপ্ত সন্ন্যাসিনীর কাছে তোর দীক্ষা পাওয়াটা সত্যিই খুব ভাগ্যের কথা। এখন বল তুই কি করছিস?
কোনও কিছু জিজ্ঞাসা না করে আমার গুরুমায়ের কথা এমন করে বলাতে খুশি তো হলাম, অভিভূতও হলাম। একথাও বুঝতে পারলাম, মূল প্রশ্নটাকে তিনি এড়িয়ে যেতে চাইলেন। সময় বুঝে আবার ওই প্রসঙ্গে যাব মনে ভেবে আমি কি করি, কোথায় থাকি ইত্যাদি সব বলে জিজ্ঞাসা করলাম,
– বাবা, অনেক শয়তানি চিন্তাভাবনা মাথায় প্রায়ই চক্কর মারে। আমার চেয়ে কম শয়তান এবং অনেক বেশি শয়তানও দেখেছি অনেক ঘরে। কি করলে অতি সহজে শয়তানিবুদ্ধি দূর করা যাবে মন থেকে, এ ব্যাপারে যদি কিছু বলেন তো অনেক উপকার হয়।
কথাটা শুনে খুশির সুরেই বললেন,
– বাঃ বেটা বাঃ, বেশ ভাল প্রশ্ন করেছিস তো! এমন করে নিজের অন্তরের অকপট কথা কাউকে বলতে শুনিনি।
এতটুকু দেরি না করে বললাম,
– বাবা, যেটা সত্য সেটাই বলেছি আপনাকে। একটু আগে যে রূপসৌন্দর্য আর কুৎসিতের সংজ্ঞা আপনি দিলেন, তাতে সৌন্দর্যের যে কথাগুলো আপনি বলেছেন, তার মধ্যে একটা কথার সঙ্গে আমার মিল নেই। কুৎসিতের যেসব কথা বলেছেন, তার সঙ্গে আমার অন্তরের প্রত্যেকটার অত্যন্ত সুন্দর মিল আছে। বলতে পারেন তার চেয়েও অনেক বেশি নীচ মন আমার। ওসব কথা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। বাইরে আমি এক, আর ভিতরে আর এক। এর হাত থেকে আমি মুক্তি পেতে চাই।
কথাটুকু বলে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। সাধুবাবা কপালে একবার হাতজোড় করে নমস্কার করলেন। এবার লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আসনের কায়দায় বসা থেকে সরে বাবু হয়ে বসে বললেন,
– বেটা, তোর এমন নির্মল সত্য কথার জন্য মনটা আমার আনন্দে ভরে গেল। এর থেকে তোর মুক্তির পথ আমি বাতলে দিচ্ছি। এ পথ ধরে যদি তুই ঠিক ঠিক চলতে পারিস তবে ধর্মপথে এগোতে তো পারবিই, পাবি মুক্তির সন্ধান, ইষ্টের সন্ধান। মন পবিত্র ও নির্মল হবে, যা হলে সহজে তাঁকে লাভ করা যায়। বেটা, তুই যাকে শয়তানিবুদ্ধি বললি, আসলে সেই বুদ্ধির একমাত্র প্রাণ হল ‘হিসাব’। মানুষের জ্ঞান বিকাশের পর থেকে একটাই মাত্র হিসাব করতে থাকে, সেটা হল সম্মান যশ অর্থ খ্যাতি প্রতিপত্তি আর প্রতিষ্ঠা কিসে বৃদ্ধি পাবে, কি ভাবে চললে তা অক্ষুণ্ণ থাকবে, ভগবানকে ভুলে ওইসব চিন্তা করাটা তোর ভাষায় শয়তানিবুদ্ধি বলে। বেটা, পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় শয়তান হল সেই ব্যক্তি যে কার্যসিদ্ধি বা নিজের প্রয়োজন বুঝে দ্ব্যর্থঘটিত কথা বলে। সোজাসুজি মিথ্যা অনেক ভালো সত্য প্রকাশের তুলনায়। কিন্তু যে মিথ্যার মধ্যে অর্ধেক সত্য, তার চেয়ে নোংরা মিথ্যা আর পৃথিবীতে কিছু নেই। দ্ব্যর্থঘটিত কথায় নিজেকে বাঁচানো যায় তবে অধ্যাত্মকামীদের অধ্যাত্মবাদে উন্নতি হয় না। পরন্তু তলিয়ে যায়, গুরুকৃপা নষ্ট হয়। বেটা, কথায় কখনও চাতুরী রাখবি না। কথার চতুরতায় মানুষের কার্যসিদ্ধি হয় অনেকক্ষেত্রে তবে তা আধ্যাত্মিক উন্নতির চরম প্রতিবন্ধক জানবি। সে রকম কথা কখনও বলবি না, যে কথার অথচ ‘হ্যাঁ’-ও হতে পারে আবার ‘না’-ও হতে পারে।
এই পর্যন্ত বলে মিনিটখানেক চুপ করে রইলেন। এদিক ওদিক একবার ঘুরিয়ে নিলেন চোখদুটোকে। বললেন,
– বেটা, যেসব চিন্তাভাবনা বা বুদ্ধি মাথায় এলে মনের শান্তি নষ্ট হয় অথচ ইন্দ্রিয় বড় আনন্দলাভ করে, তাকেই শয়তানিবুদ্ধি বলে। মনের কুটিলতা, চাতুরী আর স্বার্থপরতা দূর করতে সবসময় বিষয় এবং কূটবুদ্ধিসম্পন্ন লোকের সঙ্গ ত্যাগ করবি। সরলমনা শিশু বা বালকদের সঙ্গ করলে মন সহজ সরল হবে। মনে শয়তান বাসা বাঁধতে পারবে না। মনে যত শিশুভাব বৃদ্ধি পাবে, ইন্দ্রিয় প্রভাবিত শান্তিহারক বুদ্ধির তত নাশ হবে। মানুষের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বললে নোংরা চিন্তা ও শয়তানিবুদ্ধি কমে আসে। সম্ভব হলে প্রতিদিন ফুলের সৌন্দর্য, আকাশের চাঁদ, নদীর বহমান স্রোত, নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য (ছবিতে হলে) দেখলে, মনবিমোহন সঙ্গীত শুনলে, সাধকদের জীবনালোচনা করলে কুবুদ্ধি নষ্ট হয়ে মন পবিত্র হয়। এসব কাজগুলো নিয়মিত করলে মন ও বুদ্ধি নির্মল হবে, প্রাণের আরাম হবে, হৃদয়ে আনন্দের দরজা খুলে যাবে।
সাধুবাবা থামলেন। সময়টা জানতে চাইলেন, কটা বাজে? ঘড়ি দেখে সময়টা জানাতে তিনি মাথাটা নাড়লেন। বললাম,
– বাবা, সময় তো এগিয়ে আসছে, আরও কিছু বলুন, চেষ্টা করব যদি মেনে চলতে পারি।
উত্তরে বললেন,
– এতক্ষণ তোকে যেসব কথাগুলো বললাম তার কোনওটাই পালন করা কঠিন নয়। চেষ্টা করলে পারা যায়, একটা পয়সাও খরচা হয় না। অথচ এসব কথা পালনে কারও রুচিও হয় না। যেমন ধর কথার কথা। চেষ্টা করলে পারা সম্ভব কিন্তু কেউ তা করবে না। অতিরিক্ত কথা বলতে নেই। প্রয়োজনের তুলনায় একটা কথাও বলতে নেই। হৃদয়ের তেজ একেবারে নষ্ট হয়ে ঈশ্বরীয় চিন্তা এবং যেকোনও বিষয়ভাবের গাঢ়ত্ব কমে যায় অতিরিক্ত কথা বললে। যারা বেশি কথা বলে জানবি তার সবটা ফাঁকা। শক্তির সঞ্চয় কিছু নেই। সংযত বাক হতে গেলে তার একটাই মাত্র পথ যতটা সম্ভব একা থাকা। কিছুদিন এইভাবে থাকতে পারলে ক্রমশ কথা বলার প্রবৃত্তি আপনা থেকে কমে যাবে। অতিরিক্ত কথা বললে দেহ ও মনের শক্তি অসম্ভব নষ্ট হয়, বুঝলি? আর বেটা কারও সঙ্গে কোনওরকম কু-তর্কে যাবি না। কু-তর্কে হৃদয় শুষ্ক ও বুদ্ধি বিচলিত হয়। তর্কের বিষয় উত্থাপনকারীকে সব সময় এড়িয়ে চলবি। এরা মানুষের মনের সরলতা নষ্ট করে।
চা বিক্রেতার আওয়াজ শুনে ইশারায় ডাকতে সাধুবাবা থামলেন। দু-ভাঁড় চা নিলাম। মুখ দেখে মনে হল বেশ খুশি হলেন। এতক্ষণ পর বিড়ির কথা বলতে তিনি মাথা নাড়লেন। দুটো ধরিয়ে একটা দিলাম আর একটা নিজে টানতে লাগলাম। সাধুবাবা লম্বা একটা টান মেরে একগাল ধোঁয়া নাকমুখ দিয়ে ছাড়তে ছাড়তে বললেন,
– তোর তো দীক্ষা হয়েছে।
মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললাম। সাধুবাবা বললেন,
– বেটা, ভক্তি ছাড়া গুরুর ‘কিরপা’ লাভ করা যায় না। ভক্তি কাকে বলে জানিস? অন্তরে পরমপ্রেমভাব নিয়ে গুরুপদে যে একান্ত অনুরাগ, তারই নাম ভক্তি। তবে বেটা ভক্তিরও ভেদ আছে। দুরকম, রাগাত্মিক বা অহৈতুকি ভক্তি আর একটা হচ্ছে হৈতুকি ভক্তি।
থামলেন। বিড়িতে আবার দুটো টান দিলেন। হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টালেন দেখে আমি আর কথা বললাম না। দেখা যাক কি বলেন! তিনি আমার কপালে এবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলতে লাগলেন,
– বেটা, আপন অভিলাষিত বস্তুর জন্যে হৃদয়ে পরমানন্দের রসভরা অত্যন্ত গাঢ় যে পরম আবিষ্টটা তারই নাম রাগ। গুরু বা ইষ্টে অর্থাৎ অভিলাষিত বস্তুতে যে রাগময়ী ভক্তি, তাকে শাস্ত্রে বলা হয়েছে রাগাত্মিকা ভক্তি। বিনা চেষ্টায় পরমধনকে পাওয়ার জন্যে অন্তরে যে ব্যাকুলতা, তাই-ই রাগাত্মিক ভক্তি। ইষ্ট বা গুরু ভিন্ন পার্থিব ও অপার্থিব অন্য সমস্ত অভিলাষশূন্য ভক্তিই অহৈতুকি ভক্তি, যা রাগাত্মিকা ভক্তিরই নামান্তর, বুঝলি বেটা। ভগবানের কাছে মুক্তি প্রার্থনারও স্থান নেই এই ভক্তিতে।
মুখে কোনও কথা না বলে মাথাটা নাড়ালাম। শেষ একটা টান দিয়ে সাধুবাবা বিড়িটা ফেলে দিয়ে বললেন,
– এ ভক্তি বেটা সংসারীদের খুব কমই আসে। অনেক অনেক জন্মের সুকৃতি না থাকলে আসে না। এ ভক্তি গুরুকৃপাতেই আসে, তা আসে জন্মান্তরের সুকৃতিতে। আর একটা যে ভক্তি তা তোর আছে, আমার আছে, আছে প্রায় সমস্ত গৃহীদের। সেটা হল হৈতুকি ভক্তি যেটা কোনও কারণ বা হেতু অবলম্বন করে।
এবার উদাহরণ দিয়ে বললেন,
– যেমন ধর আমি কোনও তীর্থে যাব। কিছু অর্থের দরকার অথচ হাতে একটা কানাকড়িও নেই। মনে মনে গুরুজির কাছে প্রয়োজনের কথা জানালাম। অপ্রত্যাশিতভাবে প্রয়োজনের অর্থ এসেও গেল। পুলকিত হলাম গুরুকৃপা ভেবে। এর থেকে বা এমনতর হাজার ঘটনা থেকে যে ভক্তি উদয় হয় অন্তরে, তা হল হৈতুকি ভক্তি। কেউ হয়ত কোনও বিপদ থেকে রক্ষা পেল, তাঁর কথা স্মরণ করে ‘তিনিই বাঁচিয়েছেন, ভবিষ্যতে এমন করেই বাঁচাবেন’, যার প্রচুর সম্পদ আছে, ‘তিনিই দিয়েছেন আরও দেবেন’, ‘মেয়েটার যেন ভাল ঘরে বিয়ে হয় ছেলেটার যেন একটা চাকরি হয়’ – কালে হলেও তাই। এর ফলে মনের তরল আবেগ থেকে উত্থিত ভক্তিই হৈতুকি ভক্তি। এক কথায় বলতে পারিস, অতীতে ঘটে যাওয়া মঙ্গলজনক ঘটনার কৃতজ্ঞতামূলক অথবা পার্থিবজীবনে ভবিষ্যতের কোনও কল্যাণমূলক প্রার্থনাজনিত আশা বা কামনামূলক যে ভক্তি, তার নাম হৈতুকি ভক্তি। যেটা প্রায় সব সংসারীদের মধ্যেই আছে। তোর শুনতে খারাপ লাগবে, গৃহীদের যে সাধুসঙ্গ এবং তাদের প্রতি যে ভক্তি তাও জানবি ওটা হৈতুকি ভক্তি। তবে বেটা এই ভক্তি অত্যন্ত নিকৃষ্ট ধরনের তবুও সংসারীদের পক্ষে কল্যাণকর। গুরুকৃপা ও সাধনবলে মানুষ একসময় অহৈতুকি ভক্তিলাভ করতে পারে।