Mythology

কী করে আনন্দময় জীবনলাভ সম্ভব, এক কথায় জানালেন সাধুবাবা

এ জীবনের কথা তোকে বলে বোঝাতে পারব না বেটা। বড় আনন্দময় এ জীবন। কোনও কষ্ট নেই-নেই কোনও দুঃখ। আনন্দ আনন্দ আর আনন্দ, সদানন্দ।

বয়েসটা এই মুহুর্তে আন্দাজ করতে পারলাম না। বয়স্ক যে তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। মাথার চুলগুলো সোজাসোজা। নেমে এসেছে কাঁধ পর্যন্ত। দোহারা চেহারা। সুন্দর চোখ। নাকটাও সুন্দর। টিকালো। কপালে চন্দনের তিলক। সাধুবাবা বৈষ্ণব। আপনভোলা হয়ে বসেছিলেন মন্দাকিনী গঙ্গাতীরে রামঘাটে। চিত্রকূটের মন্দাকিনী খরস্রোতা নয়। বয়ে চলেছে অতি ধীরে, যেন কোনও তাড়া নেই। রামের মত ধীর স্থির অচঞ্চল। পাশের ছোট্ট ঝোলাটা তার কর্মগৃহ। একটা সাদা কাপড়ের দুটি ফালির পরনে একটুকরো। গায়েও একটুকরো জড়ানো বেশ ময়লা। বসনটা গেরুয়া বা কোনও রং করা নয়। সাদা কাপড় বহু ব্যবহারে যেমন ময়লা হয় তেমনই। বেলা প্রায় দশটা। ঘাটে স্নান করছে অনেকে।

কাছে গিয়ে প্রণাম করলাম হুট করে। একটু থতমত খেয়ে সাধুবাবা বললেন,


– ঠিক হ্যায় বেটা ঠিক হ্যায়। রামজি আনন্দে রাখুক তোকে।

জিজ্ঞাসা করলাম,


– বাবা কি চিত্রকূটেই থাকেন, না অন্য কোথাও ভজনকুটির আছে?

তাকালেন আমার মুখের দিকে। কৌতূহলী দৃষ্টি। দাঁড়িয়ে আছি। বসতে বললেন না। কোনও উত্তরও দিলেন না। ভাবে বুঝলাম, সহজে মুখ হয়ত খুলবেন না। নিজেই বললাম,

– আমি কলকাতায় থাকি। শ্রীরামের লীলাক্ষেত্র চিত্রকূট দর্শনে এসেছি। দূর থেকে দেখতে পেলাম আপনাকে তাই এলাম। আপনার ‘ভাব’-এর কি কোনও ব্যাঘাত ঘটালাম?

উত্তরে সাধুবাবা বললেন,

– না না বেটা, সেসব হয়নি কিছু। বোস বোস। আমার আবার ভাব কোথায়? এই তো বসে আছি। কোনও ‘ভাব’ এ নয়, অভাবেও নয়।

পাশে বসলাম ঘাটের সিঁড়িতে পা ঝুলিয়ে। তীর্থযাত্রীরা স্নান করছে। যে যার মতো। ঘাট তেমন কোলাহলমুখর নয়। আবার সেই একই প্রশ্ন করতে বললেন,

– চিত্রকূটে আছি প্রায় বছর ত্রিশ। স্থায়ী ভজনকুটির বা ডেরা কোথাও নেই। রামদরবার চিত্রকূটই আমার সব।

কথাটা শুনে কৌতূহল বেড়ে গেল। জানতে চাইলাম,

– শীত গ্রীষ্ম বর্ষাতে কি করেন, কোথায় থাকেন? তখন আশ্রয় তো একটা কোথাও আছে?

হাসতে হাসতে সাধুবাবা বললেন,

– রামজিই আমার আশ্রয়। অসুবিধে হয় না। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরি ফিরি। সন্ধ্যের পর কখনও কোনও গাছতলায়, কখনও ধর্মশালায়, নইলে কোনও মন্দিরের বারান্দায় রাতটা কাটিয়ে দিই বেশ আরামে। রাতটুকু তো, কোনও না কোনওভাবে কেটে যায়।

মনে মনে ভাবলাম, থাকাটা ব্যাপারটা কোনও ব্যাপারই না সাধুবাবার কাছে। সমস্যা তো নয়ই। জানতে চাইলাম,

– এত বছর ধরে রয়েছেন এখানে, মাথাটুকু গোঁজার জন্য অন্তত ডেরা তো একটা করতে পারতেন?

হালকা হাসিতে ভরা প্রসন্ন মুখ সাধুবাবার। বললেন,

– এখানে যদি ঘরই বানাবো তাহলে রামজি আমাকে ঘর থাকতে এমন ঘরছাড়া করলেন কেন?

জানতে চাইলাম,

– আপনি ঘর ছাড়লেন কেন বাবা?

চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। কাছাকাছি নেই কেউ। শুধু দেশোয়ালি তীর্থযাত্রীরা চলেছে দলে দলে তুলসীদাস আশ্রমে। চেয়ে রইলাম মুখের দিকে। লক্ষ্য করলাম কোনও চঞ্চলতা নেই সাধুবাবার। দৃষ্টি ফেরালেন মন্দাকিনীর বয়ে যাওয়া স্রোতে। এবার তাকালেন আমার মুখের দিকে। মুহুর্তে উদাসীনতায় ভোরে গেল মুখখানা। পরে খুব শান্ত কণ্ঠে বললেন,

– বেটা, বিত্ত আর স্ত্রী, এর কোনওটা থাকলে সাধারণত সংসারত্যাগ হয় না। আমি ঘর ছেড়েছি মনের গ্লানিতে।

এ কথায় কৌতূহল বেড়ে গেল। জানতে চাইলাম,

– কি এমন গ্লানির সৃষ্টি হয়েছিল যে আপনাকে সংসারত্যাগ করতে হল! আপনি কি বাবা বিয়ে করেছিলেন?

উত্তর দিলেন নিঃসঙ্কোচে,

– হাঁ বেটা সংসার করেছিলাম, টিকলো না। আসলে রামজির ইচ্ছা নেই। বউটা মারা গেল অসুখে। রেখে গেল দু’বছরের একটা বাচ্চা। তারপর মনের গ্লানিতেই একদিন বেরিয়ে পড়লাম ঘর ছেড়ে।

বাচ্চার কথাটা শুনে মনটা ছ্যাঁত করে উঠল। জিজ্ঞাসা করলাম,

– কার কাছে রেখে এলেন বাচ্চাটাকে? আসার সময় ওর ওপরে কি এতটুকু মায়া হল না আপনার?

নির্বিকার উত্তর দিলেন মলিনমুখে,

– সংসারটা মায়ার বন্ধনেই আবদ্ধ। ওটা কাটাতে না পারলে মুক্তি কোথায়? আবার ঘুরে আসতে হবে যে! আর ছেলেটার ওপর মায়া তো আমার ছিল কিন্তু সংসার থেকে যে মনটা একেবারে উঠে গেল। সন্তানের মায়া আমাকে আটকাতে পারল না। বেরিয়ে পড়লাম। বাচ্চাটাকে ভগবান কোনও না কোনওভাবে তো রক্ষা করবেনই।

খুব সাধারণভাবে কথাটা বললেন সাধুবাবা কিন্তু আমার ভালো লাগল না। এটা কি কোনও কথা! জিজ্ঞাসা করলাম,

– গৃহত্যাগের পর বাড়িতে গেছেন কখনও, ছেলেটাকে দেখার জন্য মনটা ছটফট করেনি আপনার?

কথাটা শুনে ভুরুটা সামান্য কুঁচকে উঠল। পরমুহুর্তেই তা মিলিয়ে গেল। মুছে গেল মলিনতার ছাপটুকু। সহজভাবে উত্তর দিলেন,

– না বেটা, আর কখনও বাড়িতে যাইনি, তবে ঘর ছাড়ার পর প্রথম প্রথম একটু চিন্তা হত ছেলেটার জন্য। এখন আর কিছু হয় না।

মনে মনে বললাম, অপদার্থ। একটা ছোট্ট শিশুকে ফেলে রেখে এল অথচ মনে কিছু হয় না। একটু ক্ষুব্ধ হয়েই বললাম,

– একটা শিশুর জীবন, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু ভাবলেন না। এটা কি সত্যিই মানুষের মতো কাজ করেছেন? শিশু তো কোনও অপরাধ করেনি তাহলে কেন তাকে পৃথিবীতে এনে এইভাবে পরিত্যাগ করলেন? আপনি যেমন শিশুরূপী নারায়ণকে পরিত্যাগ করেছেন, আপনার উপাস্য রামজিও তো আপনাকে পরিত্যাগ করতে পারেন?

এ কথা সাধুবাবার মনে বিন্দুমাত্র রেখাপাত করল বলে মনে হল না। নির্লিপ্তভাবে বললেন,

– বেটা এই সংসারে কেউ কাউকে গ্রহণ করে না, করে না পরিত্যাগও। অনেক সুন্দর সংসার তো ভেঙে যায়, কেন বলতে পারিস? অথচ ভাঙার তো কথা নয়, তবুও ভাঙে। আমি কি চেয়েছিলাম বউটা মরুক, ছেলেটা ফেলে আসি, সাধু হই? কিন্তু এ সবই তো হল। তুই সংসারী। আমার মতো অবস্থা না হলে, আমার জায়গায় না এলে তুই বুঝবি না। তোর জীবনভাবনা একরকম, আমার আর এক। একটা কথা জানবি, ভগবান কাউকে পরিত্যাগ করেন না। সৃষ্টির উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এ সব তিনি করান। এর রহস্য ভেদ তুইও করতে পারবি না, আমিও না। অনেক চেষ্টা করেও তো মানুষ অনেক বিষয়ে ব্যর্থ হয় কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে তো তা হওয়া উচিত ছিল না, অথচ হয়। এর প্রকৃত উত্তর কি কেউ দিতে পারবে? আবার অনেকের অনেক কিছুই তো হয় যা সে ভাবা তো দূরের কথা, কল্পনাও করেনি। কেন এমন হয়, এর উত্তর তোর বা কার জানা আছে? উত্তরটা পেলে তুই আমাকে যে প্রশ্ন করেছিস, তার উত্তরটাও তুই পেয়ে যাবি সহজে।

এ কথার কি উত্তর দেব এই মুহুর্তে কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। চুপ করে রইলাম মিনিটদশেক। ভাবলাম অনেক কথা। কোনওটাই যথাযথ মনে হল না। শেষে অনেক ভেবে মনে হল, এর উত্তর আমার জানা নেই। প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম,

– বাড়ি কোথায় ছিল আপনার? কোন সম্প্রদায়ের সাধু আপনি?

এবার একটা বিড়ি ধরলাম। দিতে গেলাম সাধুবাবাকে। মাথা নাড়িয়ে জানালেন, চলে না। নিজেও টানলাম না। ফেলে দিলাম। উত্তরে বললেন,

– বাড়ি ছিল এলাহাবাদে। ‘শ্রী সম্প্রদায়’-এর সাধু আমি।

– গৃহত্যাগ করেছেন কত বছর বয়সে?

এ কথায় সাধুবাবা যেন একটু বিরক্ত হলেন বলে মনে হল। বললেন,

– কি হবে তোর এ সব কথা জেনে?

চুপ করে রইলাম। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মন্দাকিনীর দিকে। কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়। পরে নিজের থেকেই বললেন,

– প্রায় বছর ত্রিশেক হল সংসার ছেড়েছি।

উত্তর যখন পেয়ে গেলাম তখন প্রশ্ন,

– বাবার বয়স কত হল এখন?

একটু ভেবে নিয়ে বললেন,

– ৬০/৬৫ হবে।

বয়েস ধরেই প্রশ্ন করলাম,

– ধরে নিলাম আপনার বয়েস ষাট। এদিকে ত্রিশ বছরের সাধুজীবন আর ওদিকে সংসারজীবন ত্রিশ বছরের, দুটো জীবনের স্বাদই আস্বাদন করেছেন। এখন কি বলতে পারেন কোন জীবনটা আপনার কাছে ভালো বলে মনে হচ্ছে?

সাধুবাবার মুখমণ্ডলটা বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠল এ কথায়। ভাবাবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন,

– এ জীবনের কথা তোকে বলে বোঝাতে পারব না বেটা। বড় আনন্দময় এ জীবন। কোনও কষ্ট নেই-নেই কোনও দুঃখ। আনন্দ আনন্দ আর আনন্দ, সদানন্দ। কোনও বিষয়ের কোনও চিন্তা নেই। পেলে খাই, না পেলে খাই না। থাকার রাতটুকু কোনও না কোনওভাবে কেটে যায়। পরার চিন্তাও নেই। দরকার তো শুধু এক টুকরো কাপড়ের, তাও জুটে যায়। না জুটলেও কোনও ক্ষতি নেই। তুই সংসারে আছিস, আমিও ছিলাম। দেখছিস না কত সুখে আছিস?

এক নিঃশ্বাসেই শেষ করলেন কথাগুলো। বললাম,

– এ তো বললেন বাহ্যিক বিষয়ে পাওয়ার কথা। এ সব জানতে চাইছি না। জানতে চাই অন্তরের কথা। ওখানে পাওয়ার কোনও বাসনা কি এতটুকুও নেই?

তীর্থযাত্রীদের আনাগোনা দেখে নিলেন একবার। তাকালেন আমার মুখের দিকে। একটু ভাবলেন। বললেন বেশ গম্ভীরভাবে,

– বেটা, সংসার আছে বলেই তো বাসনা আছে সংসারীদের। আমার সংসার নেই, বাসনাও নেই। সাধুদের যে বাসনা একেবারেই নেই তা নয়। ভগবানকে পাওয়ার বাসনা তো অন্তরে একটা আছেই। আগে ওসব ছিল না। এ জীবনে আসার পর ওটা এসেছে।

কথাটা শেষ হতে না হতেই বললাম,

– তিনি যে আছেন, তাঁকে যে পাবেন এমন কোনও নিশ্চয়তা আছে? বছরের পর বছর ধরে কল্পনার পিছনে ছুটছেন এমনও তো হতে পারে!

এবার শান্ত কণ্ঠে ফুটে উঠল দৃঢ়তার সুর। বললেন,

– বেটা, জগতের সমস্ত সন্তানই অন্ধ। পিতৃপরিচয় বিশ্বাসের উপরে। অথচ দেখ, জন্মদাতা পিতা সত্য হয়েও তার ঔরসজাত সন্তানের কাছে বিশ্বাসের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। দুটো চোখ নষ্ট হলেই অন্ধ হয় না। মানুষ অন্ধ-বিশ্বাসে। বিশ্বাসটাই অন্ধ। অন্ধত্বের নামান্তরই বিশ্বাস যার ওপরে বিশ্বসংসার প্রতিষ্ঠিত। এটাই যখন অনন্তকালের সত্য তখন এ পথ, এ জীবনে আমার আর সংশয় রইল কোথায়?

নির্বিকারভাবে উত্তর দিচ্ছেন সাধুবাবা। খুশি মনে করে যাচ্ছি আমার প্রশ্ন। বললাম,

– বাবা, অধিকাংশ মানুষই সাধুদের বিশ্বাস করে না। দেখেছি শ্রদ্ধারও বড় অভাব। ভণ্ড বলে মনে করে। তাদের দেখলে বা আলোচনা প্রসঙ্গে অনেকে কটূক্তিও করে। চলার পথে এটা লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়। আমার ধারণা, আপনিও এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন কোনও না কোনও সময়ে। এতে আপনার মনে কোনও ক্ষোভ বা ক্রোধের সঞ্চার হয়নি, হয় না?

হেসে ফেললেন সাধুবাবা। বললেন,

– বেশ সুন্দর কথা বলেছিস বেটা। ভণ্ড কথাটা তো শুনতে হয় হামেশাই তবে এতে কোনও ক্ষোভ হয় না মনে। ক্রোধের রেখাপাতও করে না। কেন জানিস? এ সব থাকলে কি সাধু হওয়া যায়? গাছ আর পৃথিবী এদের ধর্মই তো সহ্য করা। ডাল কাটলেও নির্বিকার। প্রতিবাদ নেই। সাধু মানে গাছ হতে হবে। সাধু ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ কখনও কু-বাক্য সহ্য করে না। যে গৃহী গাছের মতো, সাধু না হয়েও সে সাধুর মতো আনন্দময় জীবনলাভ করতে পারে সংসারে থেকে। বেটা, এ আমার উপলব্ধির কথা।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button