Mythology

নারী কি সত্যিই পুরুষের শিকলে বাঁধা আছে, মহর্ষি মনুর কথার ব্যাখ্যা দিলেন সাধুবাবা

সমাজে একশ্রেণির নারী যারা পুরুষশাসিত প্রচলিত নিয়মনীতির শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে চায়। নারী কি সত্যিই পুরুষের শিকলে বাঁধা আছে?

দুজনে কথা বলছি রামঘাটে মন্দাকিনীর পাড়ে বসে। ঠিক মহাত্মা তুলসীদাসের প্রাচীন আশ্রমের কাছাকাছি। এতক্ষণ পর সাধুবাবা জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কি কাজ করি, বাড়িতে কে কে আছেন ইত্যাদি। সবই বললাম। শুনলেন মন দিয়ে। বললেন না কিছু। এইভাবে কাটল মিনিটখানেক। জিজ্ঞাসা করলাম,

– আপনি এখন সাধু। আমার বিশ্বাস, সাধুদের একমাত্র লক্ষ্যই আত্মমুক্তি। তাই যদি হয় তাহলে তো বলতে পারি, সমাজে সাধুনামক একশ্রেণির মানুষ স্বার্থপর জীব। সংসারীদের সাহায্যে এদের জীবনধারণ অথচ এই জীবসকল তাদের কোনও উপকারেই আসে না।


কথাটা শুনে একটা অদ্ভুতভাব ফুটে উঠল সাধুবাবার চোখে মুখে। মনে হল এ প্রশ্নে বেশ খুশি হলেন। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। বাধা দিলাম। বললাম,

– বাবা, একটু অপেক্ষা করুন, এখনই আসছি।


বলে একদৌড়ে চলে গেলাম দোকানে, সকালবেলায় কিছু খাইনি। বেশ খিদে পেয়েছে। গরম গরম পুরি তরকারি কিনে আনলাম আলাদা করে। একটা ঠোঙা দিলাম সাধুবাবার হাতে। একটা নিলাম নিজে। আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করলেন। খুব খুশি হলাম আমি। খাওয়া শেষ হল। মন্দাকিনীতে হাত ধুয়ে নিলাম। সাধুবাবাও ধুলেন। এবার জিজ্ঞাসার উত্তরে বললেন,

– বেটা, তোর একটা কথাও অস্বীকার করি না আমি। আত্মমুক্তির চিন্তা সাধুদের যে আছে এটা যথার্থই বলেছিস। তবে এটাও জানবি নদী গাছ আর প্রকৃত সাধু, এ তিনের স্বভাব সমান, একই। কেমন জানিস, জল সঞ্চয় করা নদীর স্বভাব নয়, জল দানই করে। গাছ নিজের জন্যে কিছু রাখে না, দান করে ছায়া ফল ফুল আর সাধুরা বলেন সৎ কথা। দেখিয়ে দেন সত্যকে।

একটু চুপ করে রইলেন। কোনও কথা বললাম না। মিনিট কয়েক পর বললেন,

– তাই বলে তো আর সাধুরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সৎ কথা বলতে পারে না। সত্যকে কোনও দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না যে গৃহীকে ঠিকানা দিয়ে দেবে। বেটা, সাধুসঙ্গ না করলে সংসারীদের জীবনে সাধুরা সর্বদাই মূল্যহীন।

বাধা দিলাম না কথায়। নির্লিপ্তভাবে বলে চললেন,

– আসলে বেটা গৃহীরাই আপন করে নেয় না সাধুদের। ত্রিশটা বছর ধরে দেখেছি, ধনী দরিদ্র প্রায় সকলের ধারণা, সাধুদের কাছে গেলে, কথা বললে যদি কিছু সাহায্য বা টাকা চায়। এই ‘যদি কিছু চায়’ ভাবটা মনের উপর কাজ করে প্রকটভাবে। আরও দেখেছি, উপযাচক হয়ে কারও কাছে গেলেও ওই একই ভাব। তাই সাধুদের সংস্রব এড়িয়ে চলে গৃহীরা। সুতরাং সাধুরা কখনওই কোনও উপকারে আসবে না সংসারীদের। সঙ্গে সঙ্গেই বললাম,

– সমাজে কিছু ভণ্ড লম্পট…

কথাটা শেষ করতে দিলেন না সাধুবাবা। বললেন,

– লাম্পট্যদোষে দুষ্ট বা ভণ্ড কিছু সাধু যে নেই তা নয়। কিছু কিছু গৃহী যে প্রতারিত হতে পারে বা হয়, এ কথাও অস্বীকার করি না। তবে তার মানে এই নয়, সব গৃহীই সব সাধুদের কাছে প্রতারিত হয় বা হবে। তুই হয়ত বলবি, কে ভাল আর কে মন্দ বুঝব কেমন করে? কোনও ভালমন্দের বিচারে যাচ্ছি না আমি। প্রতারক, প্রতারণার প্রশ্নেও আসছি না। একটাই কথা বলি, গৃহীদের ‘কিছু দেবার ভয়’ ‘যদি কিছু চায়’ এই ভাবটা পরিত্যাগ করলে দেখবি সাধুসঙ্গ সহজ হবে। সাধুরা গৃহত্যাগী হয়েও অশেষ কল্যাণে আসবে গৃহীদের সেটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে যেকোনও ভাবেই।

চুপ করে রইলাম, সাধুবাবা থামলেন না,

– বেটা, গৃহীদের আর একটা ধারণা, সাধুদের কাছে গেলে ‘তুকতাক্’ করে যদি কোনও ক্ষতি করে, এমন একটা ভয়েও তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে। সংসার ছেলে মেয়ে বউ থাকলে না হয় কারও ক্ষতি করে নিজের স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজন হত সাধুদের। তা তো নেই, কি উদ্দেশ্যে গৃহীদের ক্ষতি করবে? প্রকৃত সাধুরা ক্ষতি করে না কারও। গাছ কখনও নিজে ফল খায় না। সাধুর শরীরও জানবি ঠিক তেমন। নিজের জন্য নয়, সাধুর শরীর, সাধুজীবন পরের উপকারের জন্য, আত্মমুক্তির চিন্তা থাকলেও। তবে যুগের পরিবর্তন হয়েছে, আরও হবে। তাই আমার এসব কথায় বিশ্বাস হবে না কারও, আস্থাও স্থাপন করতে পারবে না। তবে কিছু গৃহী আছে সাধুসঙ্গ করে আত্মিক উন্নতির জন্য নয়, আর্থিক পরশমণির খোঁজে।

একটু রূঢ়ভাবেই বললাম,

– অনেক সন্ন্যাসী সম্প্রদায় আছে যারা দুর্গতদের সেবা করে। ভালো কথা। তবে ভেক ছেড়ে গতরে খেটে উপার্জিত অর্থেও তো তা করতে পারে। তা না করে সাধুর ভেক গায়ে দিয়ে কেন?

সাধুবাবা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন,

– সেবা করছে এটাই বড় কথা। নিজের উপার্জিত না হয়ে গৃহীদের কাছ থেকে সাহায্য বা ভিক্ষে নিয়ে যদি গৃহীদের সেবা করে, ভেক ধারণ করে হোক আর না করেই হোক তাতে তোর কি যায় আসে? ভেকটা ধারণ করে বলে তো গৃহীরা কিছু দেয়, নইলে তো তাও দিত না। সেবাটা তো ধর্মোপাসনারই একটা অঙ্গ। সাধুদের এই উপাসনাতেও দোষ খুঁজছিস? যারা প্রত্যক্ষভাবে সেবায় যুক্ত নয় তাদের বলবি স্বার্থপর। যারা কিছু করছে তাদেরও সমালোচনা করবি, বেশ! নিজের কোনও মুরোদ নেই, কোনওটাতে শান্তিও নেই।

প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম,

– একসময় আপনি সংসার করেছিলেন, সাংসারিক অভিজ্ঞতা আছে যথেষ্ট। সেই সুবাদে প্রশ্নটা করি, সমাজে একশ্রেণির নারী যারা পুরুষশাসিত প্রচলিত নিয়মনীতির শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে চায়। নারী কি সত্যিই পুরুষের শিকলে বাঁধা আছে?

কথাটা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। শূন্যদৃষ্টিতে একবার এদিক ওদিক তাকালেন। চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। বললেন,

– বেটা, প্রকৃতি এই বিশ্বসংসার এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, পুরুষের সাহচর্য ছাড়া কোনও নারীর একটা পাও চলার উপায় নেই। কারণ স্বয়ং প্রকৃতিই (বিশ্বজননী) যে পুরুষে আবদ্ধ। প্রকৃতি তো নিজে পুরুষমুক্ত নয়। যেখানে প্রকৃতি নিজেই মুক্ত নয় সেখানে নারী মুক্ত হবে কি করে? তাই প্রকৃতির নিয়মে নারী নিজেই শৃঙ্খলিত। এরা পুরুষের কোনও নিয়ম শৃঙ্খলে আবদ্ধ নয়। মহর্ষি মনু বলেছেন, শিশুকাল থেকে কুমারীকাল পর্যন্ত প্রকৃতির নিয়মে নারীজাতি রক্ষিত হয় পিতার মাধ্যমে। যৌবনে রক্ষা করে তার স্বামী। বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রীজাতিকে রক্ষা করে পুত্র। প্রকৃতির নিয়মেই এটা হয়ে আসছে। এই নিয়মটাকে মেয়েরা মনে করে পুরুষের শৃঙ্খল। প্রকৃতির এটাই গতিপ্রবাহ। একে কখনও রোধ করা যায়নি, অপ্রতিরোধ্য। সুতরাং পুরুষের শিকলে বাঁধা নারী মুক্তি চায়—চায় স্বাধীনতা, ওসব কথার কথা, কোনও কথা নয়।

এখানেই থামলেন না সাধুবাবা,

– ধর, কোনও মেয়ে চাকরি করল কিংবা বড় একটা ব্যবসা ফেঁদে বসল। প্রচুর উপার্জনও করল। যা খুশি তাই কিনল। যেখানে খুশি যখন খুশি কোথাও গেল। তার স্বাধীন ইচ্ছায় ধর কেউ বাধা দিল না। তাতে কি নারী মুক্ত বা স্বাধীন হল? এতে খুব বেশি হল মানে স্বাবলম্বী হল। বিনা প্রতিরোধে ইচ্ছার নিবৃত্তি হল। কিন্তু মুক্ত হল কোথায়? মৃত্যু পর্যন্ত যেকোনও পুরুষ প্রাকৃতিক নিয়মে একা পথ চলতে, একা জীবনযাপন করতে পারে। সবক্ষেত্রে না হলেও একটা নারী পুরুষের পাশাপাশি প্রায় সমানতালেই পা ফেলে চলতে পারে। কিন্তু স্ত্রীজাতির পক্ষে প্রকৃতির নিয়মেই তা সম্ভব নয়। ওদের দেহের গঠন এমন যে দেহটাই ওদের কাছে একটা শৃঙ্খল। পুরুষ নতুন করে আর বাঁধবে কি দিয়ে? নারীর পূর্ণতা আসে পুরুষের জন্যে। নারীর পূর্ণ প্রকাশই হয় পুরুষের মাধ্যমে। তাই নারীর মুক্তি নেই, মুক্তও নয়। (একটু থেমে)

তবে একটা কথা মানতেই হবে বেটা, প্রকৃতি এমন কিছু গুণাবলী দিয়ে নারী সৃষ্টি করেছেন, যে গুণের প্রভাবে অপদার্থ পুরুষ, উচ্ছৃঙ্খল বিপথগামী পুরুষও পারে সুন্দর সুস্থ হতে। এমনটা নারীজাতির ক্ষেত্রে হয় না। সংসারে নারী উচ্ছৃঙ্খল হলে কোনও পুরুষসাহচর্যই তাকে সুস্থজীবন দিতে পারে না। ওরা পুরুষের কাছে থেকে পুরুষের পোষ মানতেই ভালোবাসে। তবে অবহেলিত হতে ভালোবাসে না। যেখানে স্ত্রীজাতি অবহেলিত সেখানেই প্রকৃতি তার পক্ষে। তার নিয়মে অবহেলায় বাধ সেধে পুরুষকে আচ্ছা করে শায়েস্তা করবেই। এই নিয়মেই চলবে। নারীদের শৃঙ্খলের কথা, মুক্তির কথা আর কিছুই নয়, সাংসারিক কোনও কষ্ট ক্ষোভ দুঃখ বা বেদনা থেকে উদ্ভূত একটি পর্যায়ে নারীর এক বিশেষ সংলাপ, বুঝলি। এমন অবস্থা সংসারে অনেক পুরুষেরও তবে তারা শৃঙ্খলিত বা পুরুষমুক্তি চাই বলে না।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button