শুভকর্মে পয়লা বৈশাখ কি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ
ইদানিং বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটি আপামর বাঙালির একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে। কয়েকশো বছর আগেও বিষয়টি তেমন ছিল না। দিনটি তখন বিষয়ে অন্য ছিল।
বছরের পর বছর ধরে পয়লা বৈশাখকে শুভ অভিহিত করে ব্যবসা-বাণিজ্যে লক্ষ্মী-গণেশ পুজো ও নতুন খাতা লেখার একটা প্রথা প্রচলিত আছে। এটা বলা যায় বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কোনও তিথি নক্ষত্র ইত্যাদি বিচার নেই। পয়লা বৈশাখ হল মানে এই নিয়মটা পালন করতে হবে, এটাই যেন দস্তুর।
পয়লা বৈশাখ শুভদিন বা বিশেষ কোনও কারণে শুভ, শাস্ত্রে এমন কোনও কথার কোথাও উল্লেখ আছে বলে আমার জানা নেই কিন্তু অনুষ্ঠানটা বছরের পর বছর ধরে হয়ে আসছে।
বাংলা বছরে বারোটি মাস বহুকাল আগের থেকেই পালিত হত হিন্দু সৌরপঞ্জিকা অনুসারে। ইংরাজি বর্ষপঞ্জীর এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে এই পঞ্জিকার শুরু হত। যেটি সরল ভাষায় গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নির্ধারিত হত। এই ক্যালেন্ডারের ভিত্তি সূর্যের অবস্থান, অর্থাৎ এটি একটি সৌরপঞ্জিকা ভিত্তিক বর্ষপঞ্জী। একে সোলার ক্যালেন্ডার বলা হয়ে থাকে।
ইদানিং বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটি যেমন আপামর বাঙালির একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে, কয়েকশো বছর আগেও বিষয়টি তেমন ছিল না। দিনটি তখন কোনও বিশেষত্ব বহন করত না। যেহেতু বাংলা (পূর্ব ও পশ্চিম ২টি মিলিয়েই) কৃষিভিত্তিক একটি জনপদ, তাই কৃষিকার্যই মানুষের জীবনধারণের মূল আধার। আর চাষআবাদ চিরকালই এই অঞ্চলে বিভিন্ন ঋতুকে নির্ধারিত করেই করা হয়ে থাকে। কয়েকশো বছর আগে কৃষকরা আরও বেশি করে ঋতুর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন কারণ তাঁদের হাতে ঋতু পরিবর্তনের সময়কাল ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জীতেই নির্দিষ্ট ছিল। যা ছিল তাঁদের কখন কোন ফসল হবে তা নির্ধারণের একমাত্র সম্বল। ফলত বছরের প্রথম দিন বা ১লা বৈশাখ দিনটি পালিত হত গ্রীষ্ম শুরুর প্রথম দিন হিসাবে।
এদিকে কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের একটা অংশ কর বাবদ রাজকোষে জমা দিতে হত। ইংরেজরা ভারতে আসার আগে দিল্লির মসনদে ছিল মোঘলরা। মোঘল সাম্রাজ্যের বর্ষপঞ্জী নির্ধারিত হত হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী। হিজরি বর্ষপঞ্জীর ভিত্তি ছিল চাঁদের অবস্থান। অর্থাৎ এর মাসগুলি ছিল চন্দ্রমাস। এই ধরনের ক্যালেন্ডারকে বর্তমানে লুনার ক্যালেন্ডার হিসাবে জানা যায়।
এবার সমস্যা হল, ফসলের উৎপাদন হচ্ছে এক হিসাবে আর কর আদায় হচ্ছে অন্য হিসাবে। ফলে অনেক সময় কর জমা বা আদায়ের ক্ষেত্রে দুটি পৃথক ক্যালেন্ডার ব্যবহারের ফলে সৃষ্টি হত বৈরিতা। কৃষকদের কর জমা করতে বা রাজকর্মচারীদের ফসল উৎপাদনের হিসাব সঠিকভাবে রাখতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হত।
মোঘল সম্রাট আকবর কৃষকদের স্বার্থে ও একটি সুনিয়ন্ত্রিত করকাঠামো প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে ঠিক করলেন ২টি বর্ষপঞ্জীর জটিলতা দূর করার। বিষয়টিকে সরলীকরণের উদ্দেশ্যে বাংলার সেইসময়কার প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ উল্লাহ সিরাজি বাদশা আকবরের নির্দেশে কাজ শুরু করেন। তৈরি হয় একদম নতুন একটি বর্ষপঞ্জী। এটিতে সোলার ক্যালেন্ডার ও লুনার ক্যালেন্ডারকে একত্রিত করে মাস বছরের গণনা করা হয়। বছর শুরু হয় ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ১০ ব ১১ তারিখ থেকে। অনেকে বলে থাকেন এই ক্যালেন্ডারের শুরু ধরা হয়ে থাকে সম্রাট আকবরের দিল্লির মসনদে বসার দিন থেকে। দিনটি ছিল ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর, গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী।
শুরুর দিনগুলোতে আজ যা বঙ্গাব্দ বা বাংলা বছর হিসাবে পরিচিত সেই ক্যালেন্ডারের নাম বা সেই বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী গণনা করা বছরের নাম ছিল ফসলি সন। সেই সময় বছরের শেষ দিন, অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তির মধ্যে চলতি বছরের কর বাংলার অধিবাসীরা জমা দিতেন।
চৈত্রসংক্রান্তির পরদিন অর্থাৎ বৈশাখ মাসের প্রথম দিন নতুন বছরে পা দিয়ে আপামর বাঙালি উৎসব পালন করতেন মুক্ত হৃদয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উৎসব বহরে বৃদ্ধি পায়। কালক্রমে সেই ১লা বৈশাখ হয়ে উঠল বাঙালির এক সর্বজনীন উৎসব। বাদশা আকবরের আমল থেকেই সেই রীতি চলে আসছে।
সংক্ষেপে এই হল অথ পয়লা বৈশাখ কথা। এখন প্রশ্ন হল, যে কোনও মাঙ্গলিক কর্ম শুরুর জন্য পঞ্জিকাতে সারা বছরের শুভ কর্মের লম্বা একটা ফর্দ দেওয়া থাকে শুভ দিনের নির্ঘণ্টে। সেখানে ব্যবসায় উন্নতিতে পয়লা বৈশাখ-এর কোনও উল্লেখ শুভ দিন হিসাবে নেই বাদশা আকবরের আমল থেকেই। একশ্রেণির ব্যবসায়ী ‘শুভ পহেলা বৈশাখ’ লেখেন নিমন্ত্রণের কার্ডে। ব্যবসার প্রথম দিনটা শুরু করেন মানুষজন জড়ো করে। এই প্রথা চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে।
যদি কোনও শাস্ত্র বা পুরাণের কোনও বিশেষ শুভ ঘটনার সঙ্গে পয়লা বৈশাখ মহিমান্বিত হত তাহলে শুভ প্রবৃত্ত পুণ্য ইত্যাদি যোগ করলে বলার কিছু ছিল না। তবে সেরকম কিছুর উল্লেখ না পাওয়া যাওয়ায় এটা বলাই যায় একটা সাধারণ দিনের সঙ্গে পয়লা বৈশাখের এতটুকুও পার্থক্য নেই।