ব্যা…
আমার ভেতরে মন্ত্রশক্তি ভর করছে যেন। স্বর্গ থেকে মিষ্টি ঠান্ডা বাতাস ভেসে আসছে। চরাচর নিঃশব্দ। ভিতরটা আমার একটু অন্যরকমভাবে জেগে উঠেছে।
‘বাবা তোমাকে যেন কেমন লাগছে’
‘কেমন?’
‘ছাগলের মতো’….
আমার ছেলে, মাত্র পাঁচ বছর বয়স। আমি শুভার্থীর মুখের দিকে তাকালাম। তার মুখে হাসি টলটল করছে। এই বয়সে সে অনেক কথাই শিখেছে। মনে হয় ছাগল তার খুব পছন্দ, আর পছন্দ বলেই সে আমাকে…
যখন দাড়ি কাটতে বসি, শুভার্থী বাড়ির যেখানেই থাক আমার কাছে ছুটে আসবেই। চুপটি করে পাশে বসবে। খুব মন দিয়ে আবিষ্কারের মতো আমার দাড়ি দেখবে। আজও সে দেখছিল। যেন আমার নিভৃত ভিতরটা দেখছে।
আমার কাঁধের কাছে থুতনি রেখে শুভার্থী আদুরে গলায় বলল, ‘থুতনির দাড়িটা কেটে ফেল।বাজে লাগছে…।’ কার উপর রাগ করব? হাসি পাচ্ছে। দাড়ি রাখব না ফেলব ভাবতে লাগলাম। আজ নয়। সেই বাল্যকাল থেকে ছাগলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। ঘনিষ্ঠতা। বেশ মনে আছে, সামান্য নয় ছয় কত হয় বারবার ভুল করতাম। মাস্টারমশাই আমার লম্বকর্ণ রবারের মতো টেনে একদিন বলেছিলেন, ‘তুই একটা আস্ত ছাগল।’ স্কুলে আমার টিফিন ক্লাসের এক বন্ধুকে খাওয়াতাম প্রায়ই। একদিন ধরা পড়ে গেলাম। মনে আছে মা রাগ করে বলেছিল, ‘তুই কি ছাগল? নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়াস…।’
ভাবি সত্যি, আমি এখনও খাঁটি ছাগল হতে পারলাম না। অথবা কে জানে হয়েছি, এতকাল সেভাবে বুঝিনি। আমার নতুন করে জানা দরকার ছাগল কাকে বলে?
বকতে পারি, সেই ভয়ে ছেলে ঘর থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। সে ফাদার ডেয়ারি, সরি মাদার ডেয়ারি খায় না, খাঁটি গরুর দুধ খায়। কিন্তু আমার একমাত্র ছেলে শুভার্থী আমাকে গরু না বলে ছাগল বলল কেন? আশ্চর্য!
সদ্য কৈশোরকালের দিনগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল। স্যার বললেন, কাল গরুর রচনা লিখে আনবি…, পড়ে বললেন, ‘বাঃ, চমৎকার। তোদের গরুর রচনা লেখার এই তো সুবর্ণ সময়, বয়স।পরে লেখার সময় পাবি না।’ আমরা ছাত্ররা খুশি হয়ে বললাম, ‘কেন স্যার’? তিনি হেসে বললেন, ‘ওরে, তোরা বড় হয়ে এক এক জন ভালো জাতের গরু হবি। কেউ হবি দিশি, কেউ হবি জার্সি…’, শুনে আমাদের কি যে আনন্দ হত।
স্নান করে খেতে বসলাম। অন্যদিন চিন্তা থাকত জ্যামের যুদ্ধে জয়লাভ করে সময় মতো অফিস যেতে পারব তো? আজ আমার সময়ের নটে গাছটি একটি স্বর্গীয় ছাগল মুড়িয়ে খেয়ে যাচ্ছে…।
মুচকি হেসে বাসবী বলল, ‘কি। চুপ করে আছ যে…।’
মুখ তুলে তাকালাম, ভাত গিলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাকে কেমন লাগছে…?’
অবাক বাসবী। এই বয়েসে হঠাৎ এমন উদ্ভট কথা আশা করেনি।
একটু ট্যারাভাবে তাকিয়ে বলল, ‘কেমন আবার, তুমি যেমন, তেমনই লাগছে…।’
জোর দিয়ে বললাম, ‘কেমন?’
গভীর প্রেম বাসবীর চোখে ভেসে উঠল। বলল, আমি বলতে পারছি না…’।
ছাগলের মতো তাড়াতাড়ি খেতে খেতে বললাম, ‘একটা সত্যি কথা বলবে?’
‘তোমার মতো গুছিয়ে সুন্দর করে মিথ্যে বলতে পারি না…’
দুঃখের মধ্যেও হাসি পেল আমার। বললাম বেশিরভাগ লোকই সুন্দর করে মিথ্যে বলে। যাক গে, আমাকে কি কদাকার দেখতে হয়েছে?’
বাসবী ঝানু উকিলের মতো পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘তোমার কি ধারণা তোমাকে উত্তম কুমারের মতো দেখতে? তবে, তোমার চেহারায়, মুখে একটা আলাদা গ্ল্যামার ছিল। এখন সেটা নেই…’।
এখন আমার কত কিছু থেকেও নেই। বললাম, কি আছে তবে?’
‘তোমার নিজের কি মনে হয়?’ বাসবীর আবার পাল্টা প্রশ্ন।
ছেলের কথা মনে পড়ল। জল গিলে বললাম, ‘মাঝে মাঝে আমার মুখ চিনতে পারি না। আমার মুখ আমার মুখে নেই। মুখোশ পরে আছি। আমার আসল মুখ কোথায় গেল?’
আমার কথার উত্তর না দিয়ে মাছের বাটি এগিয়ে দিয়ে বাসবী বলল, ‘আমার মুখ কেমন লাগে তোমার?’
‘তোমার মুখ? মোনালিসা হাসির মতো একই রকম আছে।’
ঠোঁট বেঁকিয়ে বাসবী বলল, ‘খুব ফালতু কথা বললে…’।
হাসতে হাসতে বললাম, ‘কি লাভ মিথ্যে বলে? তুমি আমার কাছে সত্যি মিথ্যে ভালোমন্দ একাকার হয়ে আছ।’
মুহুর্তে বাসবীর মুখ খুশিতে উপচে উঠল। গোটা মুখ লাল হয়ে গেল। অবশ্য রাগলেও এমন হয়। তারপর আমাকে চমকে দিয়ে বলল, ‘ভালো কথা, তোমার ছেলের ডেঁপোমি কথার উত্তর আমি আর দিতে পারব না। নতুন নতুন কথা কোথা থেকে শিখছে জানি না, লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে…’
‘কি?’ বলে আমি মাটির দিকে তাকিয়ে আছি।
বাসবীর চোখে মুখে রাগের আঁচ ফুটে উঠছে। অস্থির ভঙ্গিতে বলল, ‘ছাগল। সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে। গতকাল ঠাকুরমশাই এসেছিলেন, তাঁর কোলে উঠে দাড়ি ধরে পৈতে টেনে বলল…’
জানি। তবু বললাম, ‘জানি না, কি?’
‘দাদু তুমি কি সুন্দর, ‘ছাগলের মতো লাগছে। ছি ছি…।’
বাঃ, শুনে খুব আনন্দ হল আমার। আমি শুধু একা নই, আমার মতো আরও অনেক মেহনতি জনগণ আছে। একটু হেসে আবার বললাম, ‘ধুস, ওরা অবুঝ। ওদের কথা ধরলে চলে? শিশু না? বাচ্চা…’
‘ওরা বাচ্চা? চৌবাচ্চা। শুনতে কি খারাপ লাগে না? আমাদের সম্পর্কে লোকে কি ভাবে? বলবে?’
হালকাভাবে আবার বললাম, ‘খেলার মতো। একটা কথা, শব্দ নিয়ে ক’দিন আপন মনে খেলবে, তারপর ভুলে যাবে। আবার নতুন কথা শিখবে। এটাই নিয়ম। আমি ভাবলাম কি না কি।’ বলে হাসতে লাগলাম।
‘তোমার এই ব্যাঁকা হাসি দেখলে আমার গা জ্বলে যায়’, ঝাপটার মতো বলে বাসবী যেন কি চিন্তা করে নরম গলায় বলল আবার, ‘আচ্ছা, তোমার ছেলে ভবিষ্যতে কি হবে গো? ওর চিন্তায় এখন থেকেই আমার ঘুম লাটে উঠে গেছে।’
ভবিষ্যৎ জানি না বলে নির্বিঘ্নে ঘুমোতে পারি। ঘুম পরম শান্তি, ঘুম না ভাঙলে নির্বিকল্প মুক্তি।
বাসবীকে কিছু বলতে যাব, এমন সময় আড়চোখে লক্ষ্য করলাম শুভার্থী দরজার ফাঁক দিয়ে আমাদের লুকিয়ে দেখছে। আমি তার দিকে তাকালে দরজার আড়ালে মুখ লুকচ্ছে। অফিস বলে একটা মনোরম খোঁয়াড় আছে মনেই পড়ল না। মনে পড়ল, একটি ছাগল রাঁধে-বাড়ে, একটি ছাগল খায়। আর একটি ছাগল আড়াল থেকে মজা দেখে যায়।
অফিস যাব। হাত মুখ ধুয়ে জামা প্যান্ট পরে বেরোতে গিয়ে দেখি বাসবী সদ্য প্রেমিকার মতো গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পিছন থেকে তার ফর্সা ঘর্মাক্ত পিঠে হাত রেখে বললাম, ‘সত্যি বলবে, আমাকে কি ছাগলের মতো লাগছে? আমার মুখ কি ছাগলের মতো? ছাগল কাকে বলে?’
সামনের মাঠে একটা গরু মুখ উঁচু করে ঘাস চিবোচ্ছে। তার পিঠে একটা শালিক বসে আছে। সেইদিকে বাসবী তাকিয়ে ছিল। সেভাবেই বলল, ‘আমি চাই তুমি বাঘের মতো হও…।’
একটা বাঘ খিদে না পেলে শিকার করে না। কিন্তু মানুষ খিদে না পেলেও খায়। ছাগল, যা পায়,তাই খায়। মানুষের মতো সর্বভুক।
‘বাসবী আজ থেকে আমি বাঘ, মানে দি রয়াল বেঙ্গল টাইগার হব’ বলে তার গালে সোহাগের আঙুলের টোকা মেরে সোজা অফিস…।
।।২।।
‘এই আসছি’ বলে যদি মাঠ থেকে কেটে পড়ি, আমার একমাত্র বউ এবং বউ-এর একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ কি? ভাড়া বাড়িতে থাকি; ঘটি-বাটি বেচে বিশাল দেনার চোরাবালিতে ডুবে বাড়ি করা আর নির্বিকার পরলোকের ভোগের স্রোতে ভেসে যাওয়া একই ব্যাপার। সামান্য একটু নিশ্চিন্তে মাথা গোঁজা বনাম সারা জীবনের পুঁজি এবং মহার্ঘ্য আয়ু…।
তবু বড় বেয়াড়া সাধ ছিল, নিজের একটু জমি হবে, আলো হাওয়া এমনি নেচে বেড়াবে, এমন একটা পূবদিক খোলা বাড়ি। কবে থেকে সেই স্বর্গীয় স্বপ্ন দেখে আসছি। জীবনে কিছু হবে না, সময়, বয়স ঠাট্টা করে চলে যাচ্ছে…।
আমার বোধের মধ্যে মাঝে মাঝে কি যে হয়। ঘুমের মধ্যে ভেসে ওঠে মুঘল আমলের অপরূপ শিল্প একটা বিশাল জানলা। সেই রূপময় জানলায় এক থোকা পাকা হলুদ মিষ্টি আঙুর ঝুলে আছে। আমি ছাগলের মতো লম্বা জিভ বের করে দুর্লভ স্বর্গীয় আঙুর খাওয়ার চেষ্টা করছি…
ঘুরে আসবেই। একটা ছাগলের বাচ্চা আমার মাথার মাঠে মনের শান্তিতে চরে বেড়াচ্ছে। সে আমার বুদ্ধি নাকি নির্বুদ্ধি চিবিয়ে খাচ্ছে বুঝতে পারছি না।
।।৩।।
আমাদের অফিস যেন খেলার মাঠ। লাইন দিয়ে লোক ঢুকছে, পিলপিল করে বেরিয়ে যাচ্ছে। কে যে অফিসের আর কে যে বাইরের বোঝবার উপায় নেই।
যাই হোক, কপাল ভালো আমার চেয়ারে বাইরের ফালতু কেউ বসে থাকেনি। চেয়ারে বসে ঘাম মুছতে মুছতে ভাবলাম দিনের প্রায় অর্ধেক কাটিয়ে দিলাম। বাকিটা ভালো মন্দে ভালো কাটলেই ভালো। পাশের টেবিলের হরিধনবাবু আলটপকা ছুঁড়ে দিলেন – ‘সুপ্রভাত’।
ছেলেটা টেবিলে চা দিয়ে গেল। ঘড়িতে দেখলাম বারোটা বাজতে এক মিনিট বাকি। বাঁচা গেল। এখনও আমার, দেশের বারোটা বাজেনি। চা খেতে খেতে আমিও বললাম, ‘কবে সুপ্রভাত আসবে দাদা?’
সিগারেট ধরালাম। সকালের ব্যাপারটা নতুন করে ভাবতে লাগলাম। তারপর হরিধনবাবুর সামনে গিয়ে বসলাম। ফালতু না হেজিয়ে সোজা কথায় বললাম, ‘জেঠুদা, ছাগল মানে কি? ছাগল কাকে বলে?’
হরিধনবাবু এমন অদ্ভুত কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলেন। তারপর ঢোক গিলে বিড়বিড় করে বললেন, ‘ছাগল? মানে আছে? আসলে সেভাবে…’
‘একটু ভাবুন।’
হঠাৎ কি চিন্তা করে হরিধনবাবু বললেন, ‘আপনাকে সারাদিনে একবারও চেয়ারে বসতে দেখলাম না। আপনার কি চেয়ার নেই….?’
দিব্যি হেসে বললাম, ‘আমার কি আছে না আছে জানি না। তবে যা আছে মনে হয়, তা না থাকারই মতো….।’
হরিধনবাবু যেন আকাশ থেকে পড়লেন। ‘তার মানে?’
হাসির রেশ ধরে আবার বললাম, ‘যখনই বসতে গেছি, দেখি কেউ না কেউ বসে আছে। কি করব বলুন। কারও সিট পার্মানেন্ট নয়…।’
‘সে কি, প্রতিবাদ করলেন না?’
সিগারেট টেনে বললাম, ‘না, লাভ নেই। কার বিরুদ্ধে করব বলুন? করলে নিজের বিরুদ্ধেই করতে হয় প্রথম। কেন সময় মতো সকাল দশটায় চেয়ারে বসিনি। বসা না বসা ব্যাপার নয়, কেউই সময় মতো বসে না। মোদ্দা কথা হল, প্রতিবাদ করার ক্ষমতা বিয়ের পর পরলোকগমন করেছে। দ্বিতীয়, বিপ্লব মহামান্য বিগবসের বিরুদ্ধে করতে হয়, সেটা সম্ভব? চাকরি থাকবে না দাদা। আসলে মনের সত্যি কথাটা কি জানেন, বিশাল ধনসম্পদের মতো চেয়ারেরও একটা গোপন গরম আছে। জ্বালা আছে। চেয়ারে বেশিক্ষণ বসতে পারিনা। নীলার মতো, সবার চেয়ার ক্ষমতা সহ্য হয় না …।’
শুকনো ডালের মতো চেহারা হরিবাবুর। যথেষ্ট বয়স হয়েছে। ফোকলা হেসে বললেন, ‘আমার সহ্য হয়ে গেছে। চৌত্রিশ বছর এক নাগাড়ে বসে আছি। জ্বালা টের পাই না। কড়া পড়ে গেছে।’
সিগারেট ফেলে বললাম, ‘কড়া পড়া আর ভোগে যাওয়া একই ব্যাপার। ছাগল কাকে বলে?’
হরিধনবাবু ম্লান হেসে বললেন, ‘কিছু মাইন্ড করলেন ভাই?’
‘সে কি?’
‘আগে স্ত্রীর কাছে স্বামী ছিলাম, ছেলেমেয়ের কাছে বাবা ছিলাম। এখন বুড়োহাবড়া বয়সে সন্তানের কাছে বাবা নই। স্ত্রীর কাছে…’
‘কি?’
‘ছাগল। পরিবারের সবাই ওই নামেই ডাকে। সবার সামনে…।’
আমি অবাক হব কি, হাঁ করে হরিধনবাবুর যন্ত্রণায় ঝলসে যাওয়া মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। বললাম, ‘কেন?’
চোখের জল আড়াল করার জন্য পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মোছার ছুতোয় চোখ মুছলেন হরিধনবাবু। তার পর ধরা গলায় বললেন, ‘আমার ব্যাঙ্কে টাকা নেই। প্রপার্টি করতে পারিনি। এমন কি মেয়ের এখনও বিয়েও দিতে পারলাম না। ছেলেটা বেকার। আমার পাপের, অপরাধের শেষ নেই…’
কি আর বলার থাকতে পারে, চুপ করে টেবিলের চারটে পা দেখতে লাগলাম। ভাবলাম, যারা সফল তাদের কি টেবিলের মতো চারটে পা থাকে? দুটো চোখ দেখা যায়, দুটো অদৃশ্যে থাকে?
হঠাৎ ‘অনুনয় ভঙ্গিতে হরিধনবাবু বললেন, আমার একটা কালো বোকা মেয়ে আছে। আপনার পায়ে ধরি ভাই। একটা সুপাত্র জোগাড় করে দিতে পারেন? অপঘাতে মরে যদি শান্তি পাই।’
মুখ নিচু করে অপরাধীর মতো বললাম, ‘একটা কথা আছে দাদা, তোমার প্রাপ্ত পেতে যত দেরি হবে তত বেশি সুদ সমেত আসল ফেরত পাবে।’
শিশুর মতো হেসে হরিধনবাবু বললেন, ‘আহা, বড় ভালো কথা শোনালেন ভাই। কিন্তু সেই সময় কি পাব? ভালো কথা শোনালেন মনে বল পেলাম। ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।’
আমাদের মতো ভগবানেরও সময় বড্ড খারাপ যাচ্ছে …।
।।৪।।
আমাকে দেখা মাত্রই প্রবাদ, ‘কেমন আছিস’ বলে তার ঘরে আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে গেল।
চেয়ারে বসে বললাম, ‘সেলোটেপ সাঁটা নোটের মতো কোন রকমে চলে যাচ্ছে….।’
আগাপাছতলা আমাকে দেখে প্রবাদ আবার বলল, ‘অফিসে আজকাল তোকে দেখাই যায় না। বেশ তো খোদার খাসির মতো বডি বানিয়েছিস। কোথায় থাকিস?’
কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘কোথাও থাকি না।’
‘কেন আসিস? লজ্জা করে না…’ প্রবাদের মধ্যে অদ্ভুত অস্থিরতা লক্ষ্য করলাম। পেপারওয়েট টেবিলে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ‘এ মাসে কবে মাইনে হবে ভগবানের বাবাও জানে না, তহবিল লোডশেডিং। দাদারা বিদেশে ধম্মের মতো পুঁজি খোঁজার নামে মনের আনন্দে খেয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। তখন পয়সার অভাব হয় না, আমাদের পেটে লাথি মেরে কর্মসংস্কৃতি আনবে?’
বোঝাই যাচ্ছে প্রচণ্ড খেপে আছে প্রবাদ। ওকে শান্ত করার জন্যে বললাম, ‘শুধু পেটের দায়ে নয়, প্রাণের টানেও অফিসে আসি। বাড়ির বাইরে যতক্ষণ থাকি, ওঁ শান্তি। বাড়ি থাকা মানেই অশান্তির অষ্টপ্রহর অনুষ্ঠান।’
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে প্রবাদ বলল, ‘দেখলেই মনে হয়, তুই একটা হাইব্রিড হারামি।’
‘প্রবাদ, ছাগল মানে কি? ছাগল কাকে বলে?’
খ্যাঁক খ্যাঁক করে প্রবাদ বলল, ‘ছাগলের ঘন্টা গলায় পরলি কেন? গরু পুষতে গেলে যেমন গরু হতে হয়, তেমনি ছাগলের মানে বুঝতে গেলে আগে ছাগল হতে হবে….।’
দুঃখের হাসি হেসে বললাম, ‘সেটাই প্রবলেম, আমি তো আর তোর মতো আগমার্কা ছাগল এখনও হতে পারলাম না।’
চতুষ্পদ জন্তুর মতো প্রবাদের হজম ক্ষমতা। দাঁত বের করে হেসে সে বলল, ‘পিওর জিনিস হতে গেলে সাধনা চাই, মহা সাধনায় সিদ্ধিলাভ হয়। চালিয়ে যা….।’
‘ধূর’ বলে প্রবাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। প্রবেশ এবং প্রস্থান। একে একে দুই অথবা এক-এ এক-এ শূন্য। এর বাইরে কোন অঙ্ক নেই। এই মহা অঙ্কের ভিতর আমি মহাশূন্য হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
নিজের ঘরে ঢুকতেই দরজার সামনে সমরের মুখোমুখি। সময় রাজনীতি করে। সে আমার হাত ধরে করিডরের শেষপ্রান্তে নিয়ে গেল। বলল, ‘তোকে কেমন শুকনো লাগছে, শরীর ভাল তো?’
‘ভালো না।’
‘সেকি, কেন?’
দূরে তাকিয়ে বললাম, ‘এমাসে মাইনে পেতে নাকি দেরি হবে?’
সমর হেঁড়ে গলায় হা হা করে হেসে বলল, ‘সামনে সোমবার মাইনে হবে। আজ নোটিস পড়বে। আমাদের বিরুদ্ধে প্রবাদরা অপপ্রচার চালাচ্ছে। চালাকির দ্বারা মহৎ কাজ করা যায় না।’
বললাম, ‘ঠিক বলেছিস। বাঁচালি। ভালো কথা সমর, ছাগল মানে জানিস?’
‘না। হঠাৎ?’
‘সবই হঠাৎ।’
সমর ট্যারা হেসে বলল, ‘চারদিকে এত সমস্যা থাকতে ছাগলের মতো শান্ত জীব তোর প্রবলেম হয়ে দাঁড়াল?’
‘না। বল…’
একগাল হেসে সমর আমার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, আধো অন্ধকারে আয়নায় মুখ দেখছিস?’
‘না।’
দেখবি। খুব মন দিয়ে দেখবি।’ বলে সমর পাত্তা না দিয়ে সোজা চলে গেল। সমরের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, আরে কি বলে গেল। ছাগলে কি না খায়, পাগলে কি না বলে।
সত্যি বলতে কি মাঝে মাঝে কিছুই ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে সব ছেড়েছুড়ে নাগা সন্ন্যাসীর মতো কোথাও চলে যাই। কিন্তু পা বাড়াতে গেলেই গলায় টান লাগে। আমার দড়ি সংসার, পরিবারের খুঁটিতে বাঁধা আমৃত্যু ……।
আমার বিয়ের পর আমার দু’নম্বর বাবা, মানে শ্বশুরমশাই, অলিখিত ভাবে আমি তাঁর কথায় উঠব বসব, আর আমার অরিজিনাল বাবা, বউ-এর শ্বশুরমশাই চেয়েছিলেন তিনি যা চাইবেন তাই হবে। আমি কারও গৃহপালিত হতে পারিনি, স্বাধীনভাবে নিজে চলতে গিয়ে শ্বশুরমশায়ের কাছে হলাম ছাগল। আর আমার পরম পিতার কাছে হলাম ভেড়া। আমার ইহকালের বউয়ের কাছে? না বলাই ভালো…।
ভালো লাগছে না। বাড়ি চলে যাব? গিয়েই বা কি করব। কোনও মাঠে ঘাটে বা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াব? নিজের টেবিলে এসে বসলাম। ‘সব কুশল তো?’ দেখি দরজার সামনে রজত। হ্যানো বিষয় নেই যাতে সে আলোকপাত করতে পারে না, যত জটিল সমস্যাই হোক, রজত একটা পথ বার করে সমস্যা মেটাবেই। অফিসে সে অরাজনৈতিক জনপ্রিয়।
রজত বলল, ‘অল্পে কাতর, বিস্তরে পাথর…।’
জানলা দিয়ে শুকনো চামড়ার মতো আকাশ দেখলাম। কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না। অফিস ছুটির আগেই আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। বলব না ভেবেও বলে ফেললাম। ‘আমার মাথায় একটা ছাগল ঢুকে গেছে।’ সব শুনে মুচকি হেসে রজত বলল, ‘তোকে চিবিয়ে খাচ্ছে। তবে, মাথা এমন একটা জিনিস চিবোতে দাঁতের দরকার হয় না।’
বললাম, ‘আমি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছি না। আমার সামনে কোন মডেল নেই।’
জোরে হেসে রজত বলল, ‘বলিস কি? চারদিকে এত মডেলের তেরোয়ারি বাজার। দেশজুড়ে ছাগলে কাণ্ডকারখানা। তোর ঘরেও হচ্ছে। প্রতিবাদ করিস?’
‘না, মনের জোর নেই, রক্তের জোরও নেই।’
‘তুই জানিস? রক্তের অভাবে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ অকালে মারা যাচ্ছে। ব্লাড ব্যাঙ্ক প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। দেশের শরীরে রক্ত নেই। রক্তদান উৎসব লেগেই আছে। তবে অদূর ভবিষ্যতে রক্তের অভাব হবেনা। প্রয়োজনের অনেক বেশি রক্ত পাওয়া যাবে। মানুষের নয়, জীবজন্তুর। রিসার্চ চলছে। ভবিষ্যতে যদি তোকে রক্ত দিতে হয় তবে তুই কোন জন্তু পছন্দ করবি?’
ভাবতে লাগলাম, ডাইনোসরের নাম বলব?
রজত ঝুঁকে বলল, ‘কি ভাবছিস?’
ঘুম নয়, অথচ ঘুমের মতো কি যেন আমার চোখ জুড়ে ঘনিয়ে আসছে। বললাম, ‘ছাগল।’
সজোরে তুড়ি মেরে রজত বলল, ‘চমৎকার। দুঃখ ইনকাম ট্যাক্সের মতো, সময় মতো পলিসি না করলে, প্রিমিয়াম না দিলে বাড়ে। শোন, গরু থেকে ছাগলের দুধ অনেক উপকারি। বিচিত্র সব টেনশনে মানুষের যেভাবে হার্টের সমস্যা বাড়ছে, জীবজন্তুর মধ্যে একমাত্র ছাগলের গায়ের গন্ধ হার্ট-এর রুগির অব্যর্থ ওষুধ। প্রত্যেক বাড়িতে টবে গাছ লাগালে হবে না, প্রতি বাড়িতে একটা করে ছাগল পুষতে হবে।’
চমকে উঠলাম। রজত কত জানে। তার কথাটা আমার মডেলের মতো মনে হল। আমাকে হ্যাঁচকা টানে চেয়ার থেকে তুলে বলল ‘চ’, দু’চোখ যেদিকে যায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
অপূর্ব। পড়ন্ত সন্ধ্যায় মধুর রহস্যময় ধর্মতলা। স্বয়ং ভগবানের বাচ্চাদের ধর্মতলা। কেলোর তলা।
দূরদর্শী রজত অর্ডার দিল। ওয়েটার দুটো কাঁচের গ্লাসে দু-পেগ রঙিন পানীয় প্রেমের মতো টেবিলে আলতো করে রেখে গেল।
রজত মৃদু চুমুক দিয়ে বলল, ‘এই বস্তু যে খেতে খুব রমণীয় তা নয়, তবু রিলিফ। রিল্যাক্স। ব্যাস আর কিছু না।’ দুই কচি আধবুড়ো কয়েক পেগ গিলে ঘরপোড়া গরুর মতো গুম হয়ে বসে থাকল।
প্রাণের কথা বলার মতো আস্তে করে রজত বলল, ‘ছাগল…।’
‘কি ভাই?’
‘ছাগলের মতো গলা ছেড়ে ডাক।’
আমি অলরেডি ছাগল হয়ে গেছি। ‘ব্যা…. ব্যা…. ব্যা….’
‘হল না। প্রাণ দিয়ে, মন দিয়ে ডাক।’ রজত আমাকে মৃদু ধাক্কা দিল।
‘ব্যা….।’
‘আবার’
‘ব্যা….।’
‘বাদ দে।’
‘তবে কিসের মতো ডাকব?’
রজত কমান্ডারের মতে বলল, ছাগলের সঙ্গে আমাদের বেসিক তফাৎ নেই। ফাইটও নেই। ছাগল হল গৃহপালিত কুটুম। দেশবন্ধু, সমাজবন্ধু। চারদিকে নানা জাতের জীবজন্তু, লড়াই করে বাঁচতে হবে। তবে ছাগলের মতো নয়, বাঘের মতো গলা ছেড়ে ডাক…।’
আমার গৃহপালিত স্ত্রীর দৈববাণী মনে পড়ল, ‘ছাগল হয়ে লাভ নেই, হলে বাঘ হও।’
বাঘের চোখ কি লাল হয়? জানি না। রজতের চোখ দুটো লাল মনে হল, তার মানে আমার চোখ আমি নিজে না দেখলেও বেশ বুঝতে পারছি আমার দু’চোখ বাঘের মতো লাল হয়েছে। গম্ভীরভাবে বললাম, ‘কিভাবে ডাকব?’
রজতের গলা যেন একটু টলে উঠল। বলল, ‘এমনভাবে ডাকবি যেন নাভিমূল থেকে উঠে আসে।’
‘ব্যা… অ্যাঁ…’
‘কাট কাট…’ প্রতিভাধর চিত্র পরিচালকের মতো উত্তেজিত হয়ে আমাকে আবার বলল, ‘সরি হচ্ছে না। তুই বেসিক্যালি একটা গোটা ছাগল। সব কিছু ভুলে যা। ভাব, তুই দি রয়াল বেঙ্গল টাইগার। তোর ভয়ঙ্কর ডাকে সামান্য চড়াইপাখিও ভয়ে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে।’
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, আমাদের পাশের টেবিলে বসে থাকা সুললিত এক মহিলা আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ওই মহিলা অবধারিত ভেবে নিয়েছে যে আমি একটা জ্যান্ত ছাগল।
প্রচণ্ড নেশার ভারে আমাদের চোখ ভারি হয়ে আছে। চোখ ছোট হয়ে আসছে ক্রমশ।
চোখ সরিয়ে আমি আবার দি রয়াল বেঙ্গল টাইগারের মতো ডাকতে যাব এমন সময় রজত আমাকে ঝপ করে থামিয়ে বলল, ‘ওকে। তোর হবে। তোর প্রতিভা আছে। এখানে না, বাড়িতে রোজ দরজা জানলা বন্ধ করে রিহার্সাল দিবি। এইভাবে প্রতিদিন নিজেকে ঘসতে ঘসতে দেখবি একদিন দি রয়াল বেঙ্গল টাইগার হয়ে গেছিস।’ বলে সে আমার চুলের মুঠি ভালবেসে ধরে আশীর্বাদ করল।
গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে আবার বলল, ‘বল, কেমন লাগছে?’
পরম প্রাপ্তির মতো বললাম, ‘অপূর্ব……।’
জীবন যখন একটাই, তখন আসল ভালো লাগে একবারই…। ‘আহা অনেক দিন পর ভালো কথা শুনলাম।’ হরিবাবুর কথা মনে পড়ল, রজত এ জগতে নেই, অনেকক্ষণ পর সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘বাঘকে খুব ভয়ঙ্কর ভাববি, তা কিন্তু না। বাঘও ছাগলের মতো সমাজবন্ধু। হাসছিস? চিনেরা এখনও বিশ্বাস করে বাঘের হাড়ে বাতের ব্যথা সারায়। সারে টাইফয়েড। পুরনো পোড়া ঘা সারে হাড়ের গুঁড়োয়। জানিস, এক কেজি হাড় থেকে পঞ্চাশ বোতল বিশেষ মদ তৈরি হয়। খাবি নাকি? বাঘের চামড়ার বিপুল দাম। এক একটা বাঘের থেকে আট দশ কেজি হাড় পাওয়া যায়। এখন তুই ঠিক কর তুই বাঘ না ছাগল হবি…?’
এসব জেনে আমার কি লাভ হবে জানি না। শুধু জানি, কোনওদিন পুরোপুরি না হব বাঘ, না হব ছাগল। তাই রজতকে খুশি করার জন্য বললাম, ‘জানার যখন শেষ নেই, জেনেও কোনও লাভ নেই…।’
কত রাত কে জানে। নেশার ভারে রজত সিগারেট টানতে ভুলে যাচ্ছে। কথা টলে যাচ্ছে। রজতের কপাল, নাকের ডগায় বিজবিজ করে ঘাম ফুটে উঠেছে। হঠাৎ সে গ্লাসটা জোরে চেপে ধরে বলল, ‘ঠিক বলেছিস। জানার যখন শেষ নেই, জেনেও কোনও লাভ নেই। কোন শালা সব জেনে কি করেছে? না জেনেই অনেক কিছু করা যায়। কিছু শেখা যায়…।’
মুখ ফিরিয়ে দেখি আমাদের পাশের সেই সুললিতা অদৃশ্য। শহরের আবর্জনার মতো শব্দ ক্ৰমশ নিভে যাচ্ছে। কত রাত কে জানে, বার প্রায় ফাঁকা। ছেলের মুখটা অনেকক্ষণ পর মনে পড়ল। রজতের চোখ বোজা, মনে হয় বসে বসেই সে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকেই বিল মেটাতে হবে, রজতকে ঘুমন্ত রেখে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়লাম।
বাঘে গরুতে একঘাটে জল খায় – এই পচা প্রবাদ বাক্যের মানে আজও বুজতে পারলাম না।
গরুর এক নাম স্বয়ং ভগবান। শুভার্থী আমাকে গরু না বলে ছাগল বলল কেন? আমার অঙ্ক বুঝি, কিন্তু আমার রক্তের একমাত্র সন্তানের সহজপাঠ, কেন বুঝলাম না? আমি এতটাই গাড়ল!
।।৫।।
কুয়াশামাখা অন্ধকার মুড়ি দিয়ে বিশ্ব সংসার গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। বাসবীও ঘুমিয়ে পড়েছে। বার্ধক্য চাঁদ ঘামতে ঘামতে নাইট ডিউটি দিয়ে যাচ্ছে।
আমার ইহকালের শেষ আশ্রয় ওই তো আমার বাড়ি। ঠিক তো? অন্যের বাড়ি গিয়ে উঠলাম না তো? রজত যে কেন আমার সবকিছু ভুলভাল করিয়ে দিল। কানার মতো হাতড়াতে হাতড়াতে বাড়ির, মানে ঘরের খানিকটা খুঁজে পেলাম। তারপর ঝুম অন্ধকারে মুখ উঁচু করে দিয়ে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো ডাকলাম। হল না আবার। এইভাবে ডাকার ফলে আমার নাকের গোড়া কাঁচালঙ্কা বাটার মতো জ্বলে পুড়ে যেতে লাগল।
লাঠিহাতে কুকুর তাড়ানোর মতো কোথা থেকে সজোরে গম্ভীর আওয়াজ ভেসে এল, -‘কে রে…?’ কাজ হল। অন্ধকার ফাটিয়ে আলো জ্বলে উঠল। বাসবী।
দরজার গোড়ায় মহাকালের মতো দাঁড়িয়ে দৈববাণীর মতো বললাম, ‘ভয় পেয়ো না গো। আমি তোমার একমাত্র গৃহপালিত ছাগল। সরি, স্বামী...।’
বাসবী বড় ভালো মেয়ে, ওর কোনও দোষ নেই। ভূত দেখার মতো চমকে উঠল, তারপর দশভুজার মতো গোটা দরজা আগলে মধুর স্বরে বলল, ‘তুমি! এত তাড়াতাড়ি? ভেবেছিলাম কাল সকালে আসবে।’
ভাবা যায়! আমার ভেতর গুলাম আলির গজল গজিয়ে উঠল। বললাম, ‘ফাংশন শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে গেল। লোডশেডিং।’ এই না বলে ফের সজোরে আবার নাক ডাকলাম বাঘের মতো।
বাসবী চমকে, ভয়ে ক’পা পিছনে ছিটকে গেল। ‘এ কি, তুমি পাগল হয়ে গেলে নাকি?’
আমি আমার মধ্যে নেই। কোলা ব্যাঙের মতো এক লাফে ঘরে ঢুকলাম।
আমার চরিত্রের চিত্র বাসবী সব জানে। খাটে বসে বাসবী ঘুমন্ত ছেলের দিকে একবার তাকাল। আমাকে অদ্ভুতভাবে চিরে চিরে দেখে বলল, ‘এই বুড়ো বয়সে বাঘ হওয়ার আহ্লাদ হয়েছে?’
আমি সুন্দর করে ঠান্ডা মেঝেতে বাবু হয়ে বসে আছি। নেশা আস্তে আস্তে ফর্সা হয়ে যাচ্ছে। তবু মাঝে মাঝে কমার মতে হেলে যাচ্ছি…।
একগাল হেসে বাসবীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘অসম্ভব বলে কিছু আছে নাকি? আস্তে আস্তে সব হবে। বুঝলে গিন্নি, তোমার কথাই ঠিক, ছাগল হয়ে লাভ নেই। এই দু’নম্বরি বাজারে বাঁচতে গেলে বাঘ হতে হবে।’ বলে খুব আনন্দ পেলাম।
বাসবী খাটে বসে কিশোরীর মতো দু’পা দোলাতে দোলাতে মুচকি হেসে বলল, ‘কিভাবে বাঘ হবে?’
বাইরে ঘন অন্ধকার। টুপটুপ করে শিশির পড়ছে। অবিকল শুনতে পাচ্ছি। মন কেমন করা উদাসী বাতাস ভেসে আসছে। একমাত্র আমরা দু’জন সদ্য প্রেমিক প্রেমিকার মতো বসে আছি। যেন আমাদের নতুন করে জানার নবজন্ম হচ্ছে।
আমার ভেতরে মন্ত্রশক্তি ভর করছে যেন। স্বর্গ থেকে মিষ্টি ঠান্ডা বাতাস ভেসে আসছে। চরাচর নিঃশব্দ। ভিতরটা আমার একটু অন্যরকমভাবে জেগে উঠেছে। সাধকের মতো বললাম, ‘কেন, রোজ রাতে তোমরা সবাই ঘুমোলে আমি একা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রিহার্সাল দেব। বাঘের মতো ডাকব। এইভাবে ডাকতে ডাকতে আমি একদিন দি রয়েল বেঙ্গল টাইগার হয়ে যাব। তখন সবাই আমাকে যমের মতো ভয় করবে।’
‘কচু করবে।’ বলে বাসবী হাই তুলল। ‘ঘুম আসছে।’ তুমি যতই চেষ্টা কর কোনোদিনই বাঘ হতে পারবে না। কি হবে জানো?’ বলে বাসবী খাট থেকে নামল।
বাসবীর প্রায় পদতলে চলে গেলাম ভগ্নাংশ নেশায়, তারপর সজোরে নাক ডেকে বললাম, ‘কি?’
‘তুমি হবে আস্ত একটা কাগুজে বাঘ…।’ বলে বাসবী বাথরুমে চলে গেল।
কি উত্তর দেব? বোবা হয়ে গেলাম। এখন আমার জীবজন্তুর মতো দুঃখ অপমান তাচ্ছিল্য হজম করার সময়। ঘুম আসছে। কিন্তু শুলে ঘুম আসবে না। আমার ভেতর আহত বাঘ গর্জন করছে।
‘খাবে?’
বললাম, ‘না।’
‘যা খেয়ে এসেছ, দরকার নেই। শুয়ে পড়’, বলে বাসবী মশার মতো মশারির মধ্যে ঢুকে পড়ল।
আমি কোনোরকমে উঠে দাঁড়ালাম, মনে হল মাটিতে নয় – মহাশূন্যে ঝুলে আছি। টলন্ত অবস্থায় দেখি শুভার্থী বাঘের বাচ্চার মতো বিছানা জুড়ে শুয়ে আছে। হ্যাঁ, এই তো আমার বাঁচার অবলম্বন। মডেল।
আমি মশারির মধ্যে ঢুকে অপাপবিদ্ধ শুভার্থীর ঘুমন্ত মুখের দিকে একটু ঝুঁকে দি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মত সজোরে ডাকলাম –
‘ব্যা ……।’ — চিত্রণ – সংযুক্তা