Story

দুগ্গামা

একা থাকলে বাচ্চাটা খুব কাঁদে। আজও ওকে বেঁধে ওর মা কোথায় চলে গেছে। বাচ্চাটা খুব কাঁদছে। খালি গা। গায়ে পুরু ময়লা। কত মানুষ ওর পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে।

অবাক চোখে ছোট্ট মেয়েটা চেয়েছিল দুর্গা প্রতিমার দিকে। একদৃষ্টে, অপলকে। কি সুন্দর মুখ! কেমন বড়বড় চোখ। দুষ্টু অসুরটাকে খুব মারছে। অসুরটা যে দুষ্টুমি করেছিল, তাইতো দুগ্গামা ওকে মারছে।

না, ও দুগ্গা মায়ের কাছে কিচ্ছুটি চায় নি। মা বলেছিল, ‘শোনো, যখন মা দুগ্গার কাছে যাবে, তখন হাত জোর করে বলবে, ভাল করো মা, বিদ্যা দাও মা।’ ওসব ওর মনে নেই। দুর্গা প্রতিমার দিকে চেয়েই বিভোর বছর ছয়েকের ছোট্ট মেয়েটা। পুজো বলে সবার কত আনন্দ। বাড়িতে এবার পিসিমা, পিসেমশাই এসেছে। ওর জন্য অনেক সুন্দর সুন্দর জামা এনেছে। পিসে বলেছে গাড়ি করে অনেকগুলো ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাবে।


বেশ বেলা হল। দুর্গা পুজোর দিন। তাই এখনও প্যান্ডেলে পাড়ার লোকের ভিড়। বাড়িতে মুকুলকাকু এসেছে। ওদের তিনটে বাড়ি পরেই থাকে। বাবার সঙ্গে কিসব কথা বলছে। টাকাকড়ি নিয়ে কথা। ছোট্ট মেয়েটা ওসব বোঝে না। ও গিয়ে দাঁড়াল বারান্দায়। ওদের বারান্দায় আলো লাগানো হয়েছে। টিউব লাইট। দুর্গা পুজোর আলো। এখন সকাল। তাই আলো জ্বলছে না। ল্যাম্প পোষ্টে বাঁধা চোঙা মাইকে সানাই বাজছে। একটু দুরেই বিশাল প্যান্ডেলটা দাড়িয়ে আছে। রাস্তা দিয়ে কত চেনা অচেনা লোকজন ঘোরাফেরা করছে। ছোট্ট মেয়েটা বারান্দা দিয়ে সব কিছু দেখে চলেছে। বারান্দা থেকে কিছুটা দুরে বড় রাস্তা। রাস্তার মোড়ে তনিমাদের বাড়ি। তনিমাদের বাড়িতে ঢোকার মুখে গেটের পাশে প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে ফুটের উপর অনেকদিন ধরে থাকেন এক মহিলা। ওর মায়ের মত বড়। তার একটা ছোট্ট ছেলে আছে। প্রায়ই ছেলেটার পায়ে দড়ি বেঁধে ওর মা কোথায় যায়। আবার ফিরে আসে। একা থাকলে বাচ্চাটা খুব কাঁদে। আজও ওকে বেঁধে ওর মা কোথায় চলে গেছে। বাচ্চাটা খুব কাঁদছে। খালি গা। গায়ে পুরু ময়লা। কত মানুষ ওর পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। রাহুল, কাঞ্চনরা ক্যাপ-বন্দুক নিয়ে চোর পুলিশ খেলতে খেলতে বাচ্চাটার পাশ দিয়ে ছুটে চলে গেল। বাচ্চাটা কেঁদেই চলেছে। অনেকদিনই বাচ্চাটাকে কাঁদতে দেখেছে ছোট্ট মেয়েটা। কিন্তু আজ ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। বাচ্চাটার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে প্যান্ডেলের দিকে চাইল ছোট্ট মেয়েটা। তারপর মনে মনে বলল, ‘ওই বাচ্চাটার ভাল কর মা, বিদ্যা দাও মা’।

সন্ধেবেলার জামাটা ও এখনই পড়বে। নাছোড় জিদ পেয়ে বসেছে মেয়েটাকে। ওকে ওর ফেভারিট জামাটা এখনই বের করে দিতে হবে। মা বলল, ‘এখন কেন পড়বি? সন্ধেবেলা যখন সবাই বের হবে তখন পরিস।’ কিন্তু ওসব শুনতে রাজি নয় ও। এখনই চাই জামাটা। বাবা বলল, ‘থাকগে জেদ করছে যখন দিয়ে দাও না জামাটা। এতগুলো জামা হয়েছে। সন্ধেবেলা না হয় আর একটা কিছু পরিও।’ জামাটা হাতে পেয়েই ওর নিজের ঘরের দিকে ছুটল ছোট্ট মেয়েটা।


তারপর বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে। ছোট্ট মেয়েটাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। গেল কোথায়? প্যান্ডেলেও তো নেই! অগত্যা সৌগতবাবু বের হলেন মেয়ের খোঁজে। পাওয়াও গেল। তনিমাদের বাড়িতে গিয়েছিল মেয়ে। ‘এখন চল, আবার পরে এসে খেলবে’, বলে মেয়েকে কোলে নিয়ে তনিমাদের বাড়ি থেকে বের হলেন তিনি। হঠাৎ রাস্তার দড়ি বাঁধা ছেলেটার দিকে নজর গেল তাঁর। বাচ্চা ছেলেটার গায়ে নতুন গোলাপি ফ্রক। এক মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালেন সৌগতবাবু। কপালটা নিজের অজান্তেই যেন একটু কুঁচকে গেল। পরক্ষণেই অবশ্য সামলে নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে এগোলেন তিনি। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন সৌগতবাবু, ‘হ্যাঁরে মা, তুই যে নতুন জামা পরবি বলে জিদ করলি, জামাটা পরলি না তো?’ একটু থমকে ছোট্ট মেয়েটা জবাব দিল, ‘এখন নয়, পরে পরব।’ মেয়ের মুখে দিকে চেয়ে সৌগতবাবু মুচকি হাসলেন। তারপর মেয়ের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বাড়ি দিকে এগোলেন। কিন্তু বাড়িতে ঢুকতে গিয়েও কি একটা মনে হতে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। তারপর মেয়েকে কোলে করেই প্যান্ডেলে গিয়ে মায়ের মুখে দিকে বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ চেয়ে রইলেন সৌগতবাবু। কি আশ্চর্য! মায়ের মুখ নয়, তাঁর চোখের সামনে তখন একটাই মুখ ভেসে বেড়াচ্ছে। তাঁর মেয়ের মুখ! — চিত্রণ – সংযুক্তা

Show Full Article

3 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button