বিড়াট সর্বজনিন দূর্গোতসব পড়িচালনায় – লণ্ডভণ্ড ক্লাব, উদ্বোধনে সানি
সানি এখন সুপার হিট। ওর ফিতে কাটা মানে ফাটাফাটি পাবলিসিটি। দেখার জন্য ভিড়ও হবে ব্যাপক। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা।
লণ্ডভণ্ড ক্লাব। নামের বানানেই ফলের পরিচয়। ছোট ক্লাব। মেম্বার অনেক। এরা সকলের পাশে আছে। কারও কোনও ঝামেলায় মহাপ্রভু হয়ে এগিয়ে আসা, প্রেমের বিয়েতে চাঁদা তোলা, মারা গেলে বডি নিয়ে যাওয়া, তোলা আদায়, সন্ধের পর বোতলবন্দি হওয়া, এদের গুণের কথা আর কত বলব! এখন ‘মতো’র যুগ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে লতার মতো, কিশোরের মতো গলা আনে। সবেতেই কাঁঠালি কলা।
ওই ক্লাবেরই সম্পাদক শ্রী নেপালচন্দ্র গড়াই। একবাক্যে গড়াইবাবু, যাচ্ছিলেন বাজারে। সামনে পুজো। ফিরছিলাম ঘি কিনে। এ বাংলায় এখন সুখ্যাত তাহেরপুর আর ফুলিয়ার খাঁটি পাম ঘি। মুখোমুখি হতেই বেরিয়ে এল বত্রিশপাটি।
– কেমন আছেন?
বিশেষগোত্রের রাজনৈতিক নেতাদের মত ঘাড়টা নাড়ালাম এমনভাবে, ভাল আছি না মন্দ, তা বোঝার উপায় নেই। কি বুঝলেন বুঝলাম না। তবে বললেন,
– সেদিন পুজোর মিটিং হয়ে গেল। এবার বাজেট ৯০ লাখ।
মুচকি হেসে বললাম,
– এ আর নতুন কথা কি! এমন তো হয়েই থাকে।
এবার গড়াইবাবু ডান থেকে ব্যাগটা বাঁ হাতে নিয়ে বললেন,
– এবার পুজো কমিটিতে আপনাকে একটা কাজের ভার দেওয়া হয়েছে। বাড়িতেই যেতাম। তা এখানেই যখন দেখা হয়ে গেল, তখন কথাটা সেরেই ফেলি।
ভাবলাম, হয় নোট, নয় বিজ্ঞাপনের ধান্দা করছে। চুপ করে রইলাম। গড়াইবাবু বললেন,
– আপনাকে একটু ইনভাইট করে আসতে হবে।
জানতে চাইলাম,
– কোনও মন্ত্রীকে ফিতে কাটার ব্যাপারে?
পকেটের স্মার্টটা দেখিয়ে ফিক করে হেসে বললেন,
– ধ্যার মশাই, ওরা তো আমার পকেটে থাকে। আপনাকে পাঠাতে যাব কোন দুঃখে? মন্ত্রী-ফন্ত্রী আউট। এবার ফিতে কাটাব সানিকে দিয়ে। পাবলিক তো ওর ফিতে কাটা দেখবে না। দেখবে ওর ফিগার।
অবাক হয়ে বললাম,
– এত লোক থাকতে…
কথায় বাধা দিয়ে গড়াইবাবু বললেন,
– সানি এখন সুপার হিট। ওর ফিতে কাটা মানে ফাটাফাটি পাবলিসিটি। দেখার জন্য ভিড়ও হবে ব্যাপক। কোচিতে কি কেলেঙ্কারিটাই হল দেখলেন না! বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা। একেবারে ঝিংচ্যাক।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– গড়াইবাবু এখানে আমার…
কথা কেড়ে নিয়ে বললেন,
– কারণ না থাকলে কাউকে গুরুত্ব দিই নাকি? যখন যাকে দরকার, তখন তাকেই, বুঝেছেন। শুনুন দুর্গাম্যামকে একটু ইনভাইট করে আসতে হবে ক্লাবের হয়ে। সপরিবারে। কাগজে লেখেন। আপনার কথা ফেলতে পারবেন না।
ঘেঁটিটা পজিটিভ করলাম। নেগেটিভ করলেই চাঁদার বিলটা পুজোর পর ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের বিলের মত প্রতি বছর এক লাফে যেমন গাছের মগডালে ওঠে, তেমনটা হবে। পরে করে খেতেও দেবেনা। একগাল হেসে বললাম,
– পাড়ায় থাকি। এটুকু তো করতেই হবে। হাতে এখন আর লেখার কাজ নেই।
সেক্রেটারি খুশি হলেন। বাড়ি ফিরে এলাম। কাঁধে শান্তিনিকেতনী চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম স্নান খাওয়া সেরে। কোনও ট্যাক্সি যেতে চায় না মনের মত জায়গা না হলে। দুনম্বরি মিটারের কথা বাদই দিলাম। ওলা-উবারের অতটা হয়নি। তবে এদের বিরুদ্ধেও যাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগটা কিন্তু ছোট অভিযোগ নয়। ওলা বুক করলাম।
ফুটপাথ হকারদের দখলে, নেতাদের সৌজন্যে। লোক নেমে এসেছে রাস্তায়। দু’ঘণ্টার পথ। সময় লাগল ডবল। বেলা প্রায় ২টো। পৌঁছলাম ভগবান শঙ্করের মনোরম আবাসভূমি কৈলাসে। আসার পথে দু’ধারে দেখলাম বস্তি বলে কিছুই নেই। অধিকাংশই বহুতল ফ্ল্যাট।
কয়েক পা এগোতেই বিশাল বাড়ি। বড় লোহার গেট। ভিতর থেকে তালা মারা। প্রবেশপথে লেখা, ‘সিংহ হইতে সাবধান’। এতটুকু কোলাহল নেই। শান্ত মনোরম পরিবেশ। ভিতরে বাগান। ডানপাশে ঘুরঘুর করছে সারাজীবন পরের মাথায় হাত বুলিয়ে খাওয়া তেল চুকচুকে একশ্রেণির সন্ন্যাসীদের মত একটা সিংহ। গলায় বকলেস। বাঁ পাশে একটা খাঁচায় হাঁস, পেঁচা, ময়ূর। প্লেগের বাহনটা একবার এপাশ, একবার ওপাশ করছে উঠোনে। প্রধান ফটকে পাথরের ফলকে লেখা,
‘হরগৌরী ভিলা’, ১ নন্দী-ভৃঙ্গী সরণি,
কৈলাস-৯৯৯৯৯৯৯৯৯।
আলতো করে চাপ দিলাম কলিং বেল-এ। গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে এল দুটো মাফিয়া চেহারা। কুচকুচে কালো। তাগড়া গোঁফ। জবা চোখ। গঞ্জিকাবাবু। ছোটবেলায় মায়ের মুখে শুনেছিলাম নন্দী-ভৃঙ্গীর কথা। এদের দেখে মনে হল এরা তারাই। দেখেই পিলে চমকে উঠল। ভাবলাম মেরে মুখ-টুখ না ফাটিয়ে দেয়। এবার ফাটা বাঁশের আওয়াজ,
– ‘কাকে চাই’?
একটু ভয়ে আমতা আমতা করেই বললাম।
– মা বাড়িতে আছেন। একটু কথা আছে। নিমন্ত্রণের ব্যাপারে।
সঙ্গে সঙ্গেই উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা,
– কিসের নিমন্ত্রণ, কোথায় নিমন্ত্রণ, সেখানে কী লেকচার দিতে হবে?
মুখে হাসির প্রলেপ মাখিয়ে বললাম,
– ব্যাপারটা মাকেই বলব। একান্তই ব্যক্তিগত।
এবার দুজন মাফিয়া মার্কার একজন ধমকের সুরে বলল,
– এখানে ন্যাকামো মারা চলবে না। ওসব বাড়িতে চলবে। আগে আমাদের বলতে হবে। নইলে দেখা করা যাবে না।
ভাবলাম, এতদূর ঠেঙিয়ে এসেছি যখন, দেখা আমি করবই। তাই সমানে তেল মোবিল মাখাতে লাগলাম। কিন্তু কিছুতেই ছাড়ছে না। এবার কাজ হাসিলের একটা দাওয়াই এল মাথায়। এর চাইতে ভাল ওষুধ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। ‘ঘুষ’। অসাধ্য সাধন হয় এতেই। বললাম,
– আমার কাছে পুরিয়া আছে। চলে নাকি?
নন্দী-ভৃঙ্গী দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল,
– পুরিয়া! পুরিয়াটা কি?
একগাল হেসে বললাম,
– ও হো, জানেন না বুঝি ? কৈলাসের গাঁজা মর্ত্যে নেমে হয়েছে পুরিয়া।
কথাটা বলেই সাইড ব্যাগ থেকে বার করলাম খান কয়েক ছোট ছোট প্যাকেট। ওদের হাতে দিতেই মহাখুশি। পারলে পায়ের ধুলো নেয় মাথায়। বুঝলাম, ডেকাড্রনে কাজ হবে।
নন্দী বলল, ‘একটু দাঁড়ান, আমি আসছি’ বলেই চলে গেল। ভৃঙ্গী রইল গার্ডে।
মিনিটখানেক পর ফিরে এসে বলল,
– মা বাথরুমে। আপনাকে বাইরের ঘরে বসতে বলল।
মায়ের অসীম করুণার কথা ভেবে মনটা ভরে গেল। এবার তাহলে দেখা হবে। বসলাম বাইরের ঘরের সোফায়। ঝকঝকে সাজানো ঘর। শ্বেতপাথরের মেঝে। দামী পরদা ঝুলছে দরজায়। দেখে মনে হল না দেশি। দেওয়ালে এলইডি টিভি। বেশ বড়। টেবিলে ত্রিপুরি বাঁশের ময়ূর পেখমধরা। শোকেসে সাজানো শঙ্খ চক্র গদা ত্রিশূল তির ধনুক ইত্যাদি। ঘরের এক কোণে পড়ে আছে বেশ কিছু মড়ার হাড়গোড় খুবরি। পাশে খান কয়েক গাঁজার কল্কে। তারপাশে বেশ কয়েকটা ভরা বস্তা। মনে হল চাল হবে।
কৌতূহল মানুষকে বাঘের মুখেও নিয়ে যেতে পারে। সামলাতে পারলাম না। বললাম,
– ভৃঙ্গীকাকু, এখানে মড়ার মাথা কেন? বস্তায় কি আছে?
মধুর হেসে বলল,
– জ্যান্তর চেয়ে মড়ার দাম এখন অনেক বেশি। দু চার পিস কালেকশানে আছে কোলকাতার লম্পট মদ্যপ ভণ্ড তান্ত্রিকদের জন্য। ভালো মাল্লু দেয়। বস্তায় চাল আছে ২ টাকা কেজির। রেশন দোকান থেকে আমদানি। প্রতিবছর বন্যা এখানে দস্তুর। বুঝতেই পারছিস, নোটটা কেমন কামাবো।
বলে ঠোঁটের ফাঁকে মাধুরী হাসির একটু ছ্যাঁকা দিলেন। প্রসঙ্গ পালটে বললাম,
– বাবা অফিসে বুঝি?
ভৃঙ্গীকাকু বলল,
– না, না পাশের ঘরে ঘুমচ্ছে।
জানতে চাইলাম,
– এই অবেলায়, শরীর খারাপ বুঝি?
হাসতে হাসতে বলল,
– না না, বাবা রাগ করে কয়েকদিন হল অফিস যাচ্ছে না।
রাগের কারণ জানতে চেয়ে বললাম,
– মা বুঝি খুব বকাবকি করে বাবাকে?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তরে ভৃঙ্গীকাকু,
– না না, মা বাবাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। এ যুগের নয়, আগেকার মানুষ যে। আসলে হয়েছে কি, কর্পোরেশন অনেক সময় রাস্তা সাফাই করবে না, অথচ জ্ঞান দেবে শহর পরিস্কার রাখুন, নইলে জরিমানা হবে। প্রয়োজনে পথে গর্ত খুঁড়বে, সারাতে ছ’মাস। বেলা ১০টাতেও অনেকসময় রাস্তার আলো দিব্ব্যি জ্বলে। ফুটপাথ সারায় না। অনেক বেআইনি বাড়ি ভাঙবে না। হকার উচ্ছেদের নামে প্রহসন। প্রয়োজনের তুলনায় জলের সাপ্লাই নেই – এসব অপদার্থতার কোনও প্রতিকারও নেই। এমন হাজারো অপরাধের কোনও শাস্তিরও ব্যবস্থা নেই। অথচ দেখুন, কয়েকদিন আগে মা দু’চারটে আলু, মুলোর খোসা ফেলেছিল রাস্তায়। অমনি সরকারবাবু চোতা ধরিয়ে ফাইন করেছে। জরিমানা দিতে হল বাবাকে। পাড়া বেপাড়া, স্বর্গ মর্ত্যে, সবাই চেনে বাবাকে। মান্য করে। এতে কী বাবার প্রেস্টিজ ঝুলে গেল না, বলুন? সেই থেকে বাবা রেগে কাঁই। পাশের ঘরে শুয়ে আছে। মেজাজ খারাপের আরও কারণ আছে। মাইনে বেড়েছে। অথচ পুরনো অভ্যাসটা যায়নি। অফিস মানে বেলা ১২টা। গাঁজার ধুনকি কাটাতেই ১১টা বাজছে। ফলে রেগুলার লেট মার্ক। রাগটা আরও বেড়েছে ওই কারণেই।’
আর কথা বাড়ালাম না। বিরক্তও করতে গেলাম না বাবাকে। চুপচাপ রইলাম মায়ের অপেক্ষায়।
হঠাৎ পর্দাটা নড়ে উঠল। দেখি অপূর্ব সাজে সজ্জিতা মা। পরনে চওড়া লালপেড়ে শাড়ি। আলতা পরা পায়ে সোনার নূপুর। নাকে নথ। টানা দেওয়া। একঢাল কালো চুল। কোঁকড়ানো। কপালে জ্বলজ্বল করছে সিঁদুরের টিপ। হাতে শাঁখা পলা। লোহাটা পর্যন্ত। মায়ের মতই চেহারা।
মা ঘরে ঢুকতেই উঠে দাঁড়ালাম। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। মাথায় হাত দিলেন। মুখে আশীর্বাদ করে বললেন, সুমতি হোক।
দেখা হল প্রায় বছর ঘুরতে চলল। সামনে সোফায় বসলেন। হাসি হাসি মুখ করে বললাম,
– এত আশীর্বাদ থাকতে তুমি একথা বললে?
মা-ও হাসি মুখে বলল,
– তোরা তো এখন অনেকেই নানান দুর্নীতি রোগে ভুগছিস। তাই। তা সারা বছর ভুলেও তো একবার আমার নামটা মুখে আনিস না, হঠাৎ আজ কি মনে করে?
মায়ের কথায় প্রতিবাদ করার সাহস হলনা। একটু আমতা আমতা করেই বললাম।
– মা, ৫ অক্টোবর তোমার পুজো। লাইট আর ডিজে-তে ফাটাফাটি করব। হুকিং সিস্টেমে কারেন্ট। চমকে চাঁদা। বাংলায় যাকে বলে তোলাবাজি। কোটির কাছাকাছি বাজেট। যা কালেকশন হবে তার ফিফটি ক্লাব সদস্যদের। বাকিটা খরচাখাতে। মা তুমি একবার ভাবো। ব্যাপারটা কেমন হবে। তাই নেমন্তন্ন করতে এলাম।
মা জানতে চাইল,
– কোথায়, কোন ক্লাবে?
একটু ঘ্যামাভাব নিয়ে বললাম,
– পাড়ার পুজো। গত বছর তো গিয়েছিলে। আমাদের লণ্ডভণ্ড ক্লাব।
কথাটা শুনে মা একটু সোজা হয়ে বসলেন। ডান পা-টা বাঁ পায়ের ওপর তুলে দিয়ে বলল,
– ওরে বাবা! এ জম্মে আর যাব না। গতবার প্যান্ডেলে যাওয়ার পথে গর্তে পড়লাম। বাঁ হাতটা ভাঙল। ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে বসিয়েছিল মণ্ডপে। এই তো সেদিন পুজোর মার্কেট করে এল নন্দী। এসে বলল তোদের ওখানে রাস্তায় নাকি অনেক জায়গায় পুকুর হয়ে আছে। সেখানে কোথাও মৎস্য, কোথাও নাকি কুমির প্রকল্প হবে। আমি যাচ্ছি না বাপু। এবার গেলে ঠ্যাংটাই যাবে। যদি বা যাই, তবে গাঁয়ে গঞ্জে কোথাও যাব। ওখানে তো নয়ই।
একথায় একটু দমে গেলাম। তবুও বললাম,
– কেন মা, আমাদের ওপর তোমার এত রাগ কেন?
এবার বেশ উত্তেজিত হয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে বলল,
– রাগ আমার কেন, তোরও হবে। কয়েক বছর আগে যেটা হত সেটা বলছি। তোর মায়ের মূর্তি যদি কেউ ছাগলের নাদি, তেলাপোকার পাখনা, চিংড়িমাছের আঁশ, বাদামের খোলা, ঝাঁটার কাঠি, জুতোর সুকতলা এসব দিয়ে তৈরি করে তবে তোর কেমন লাগবে? তোর মায়ের কি রাগ হবে না? আমার সঙ্গে কারও মায়ের কী কোনও পার্থক্য আছে? তুই বল। গতবার আমার মূর্তি করেছিল ভেলি গুড় দিয়ে। অসহ্য যন্ত্রণা। সেকথা কি জীবনে ভুলি? মাছি আর পিঁপড়ে সাতদিনে ওয়েট কমিয়েছিল ১৫ কেজি। দেহটা ফুলে জয়ঢাক। কাতুর বাবা তো রেগেই ফায়ার। বলে দিয়েছে, কখ্খনো তুমি কৈলাস ছেড়ে কোথাও যাবে না। এ তো গেল কয়েক বছর আগেকার কথা। একমাত্র কিছু বনেদী বাড়ি ছাড়া এখন শিল্পের নামে আমার যে মূর্তি মণ্ডপে মণ্ডপে হচ্ছে, কম্পিটিশনের নামে বাজারি মা করছে। শারদ সম্মান লাভের চেষ্টায় টাকা খরচ করে নিজেরা ফুর্তি করে। তা আমার ইচ্ছা নয়। আমার ইচ্ছা অনেক। বললে তোরা শুনবি না। বলে সময়টা নষ্ট করতে চাই না। তুই দেখ না বাবা শিল্পের নামে ওরা যে মূর্তি তৈরি করে, ওরা জানে ওই মূর্তিতে আমি পুজো গ্রহণ করব না, সেইজন্যই তো পুজো কমিটি আলাদা করে ছোট্ট একটা মূর্তি রাখে। মণ্ডপে যেটা পুজো করে পূজারি। এদের ভিতরে শাস্ত্রীয় নিয়ম বহির্ভূত কাজের অপরাধবোধটা কাজ করে বলেই তো এই বিকল্প ব্যবস্থা।
উত্তর দিতে পারলাম না। চোখকান বুজে বললাম,
– অপরাধ ক্ষমা করে চলো। এবার আর কোনও অসুবিধে হবে না।
মা আরও রেগে গেল। গলা চড়িয়ে বলল,
– মুখপোড়াদের ক্ষমা করব কিরে? তথাকথিত কিছু শিল্পী টাকা নাম আর পাবলিসিটির লোভে এমন মূর্তি বানাচ্ছে। ব্যবসা করছে। মাকে নিয়ে কি কেউ ব্যবসা করে? আমার প্রাচীন রূপ ওরা ভুলে গেছে। শাস্ত্রীয় নিয়মে অনেকেই মূর্তি গড়ে না। গত বছর তো সারু আর লক্ষ্মীকে বিউটি পার্লারে নিয়ে গিয়ে মাধুরী ছাঁট আর ভ্রূ প্লাক করিয়ে এনেছিল। এবার হয়তো জিনস আর শার্ট পরিয়ে প্যান্ডেলে ঢোকাবে।
এই পর্যন্ত একটানা বলে মা থামল। কিছু বলার নেই। তবুও মাথা নিচু করেই বললাম,
– তুমি ওদের…
কথায় বাধা দিয়ে বলল,
– ক্ষমা? প্রশ্নই আসে না। ওরা কত অপরাধ করে জানিস। রাতে অধিকাংশ প্যান্ডেলটা হয় শুঁড়িখানা। আমার সামনে বসেই ওরা মদ মাংস গিলতে থাকে। মনে হয় মুখে ক্যাঁত করে এক লাথি মারি, কিন্তু পারিনে। আমি তো মা। তার উপরে মন্ত্রে বাঁধা থাকি।
এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই। কিছু কিছু পুজো প্যান্ডেলে নিজের চোখেই তো এমনটা দেখেছি। তবুও ব্যাপারটা হালকা করতে বললাম,
– মা ওরা অকেশনালি একটু আধটু খায়। আনন্দ করার জন্য।
এবার আরও ক্ষেপে উঠল। রাগে মুখ লাল করে বলল,
– ঝাড়ুমারি ওদের অকেশনের মুখে। এটা না হয় অকেশনালি, মণ্ডপে ভিড়ের সময় কিছু ছেলের কীর্তিকলাপ, ছিঃ, নিজের মুখে বলতে চাইনে। তুই আমার ছেলের মত। কাতুর চেয়েও ছোট। ওই সব নোংরামির কথা কী করে বলি! আর শুনবি, শব্দদূষণের অর্ডার তো লণ্ডভণ্ড ক্লাব তোয়াক্কাই করেনি। ভগবানের কানের পোকা এখনও অনেকে মেরেই চলেছে সকাল সন্ধ্যে। কৈলাসে ফেরার আগের দিন কানটা দেখাতে গেলাম হাসপাতালে। সকাল থেকে লাইন দিয়ে বসে রইলাম আউটডোরে। দশটায় ডিউটি। ডাক্তার এল বারোটায়। একটা নার্সিংহোমের ঠিকানা দিয়ে বললে, ওখানে যাবেন, কান ঠিক হয়ে যাবে। কী আর করি! জাল ডাক্তারদের পাল্লায় না পড়ে সোজা চলে এলাম প্যান্ডেলে।
একটু থেমে বলল,
– জানিস, গতবার ষষ্ঠীপুজোর সময় পার হয়ে গেল। ফল কাটার লোক নেই। এবার কি তোদের ক্যাটারিং সিস্টেম? আর ভাসানের সময় অশ্লীল নাচ আর কাঁচা খিস্তির জোয়ার চলে সারাটা পথে। পেটে বোতল ভরে। মা বোন জ্ঞান করে না। লক্ষ্মী সরস্বতীর গায়ে ঢলে পড়ে। আমি মা। কোনও দোষ ধরলাম না। ওরা তো যুবতী মেয়ে। লজ্জায় কিছু বলতে পারে না। পাঁচজনের চোখ, তারা কী ভাবে?
লজ্জায় ঘেমে উঠলাম। মাথাটা নত করেই বললাম,
– মা, এবারটি তুমি…
ধমক দিয়ে বলল,
– ওরা তো পাপে তলিয়ে যাচ্ছে। আমি কী করব? ষোড়শোপচারে আমার পূজাবিধি। অথচ কোনও জিনিসই ওরা ঠিক মতো পুজোয় দেয় না। দুই মেয়ে আর আমাকে যে শাড়ি দেয়, তার চেয়ে বস্তাও অনেক পাতলা। ভিখিরিও ছোঁবে না। কাতু গণশার কাপড়! বলতে পারিস ওরা তো এক রকম গামছা পরেই কাটায়। তোর ক্লাব সেক্রেটারিকে জিজ্ঞাসা করিস তো, ওর মা ভাই বোনকে ওই রকম কাপড় দেয় কি না? এদের ফুর্তি করার বেলায় টাকা জোটে আর ঢাকির বেলায় ক্যাসেট? এটা কি আমেরিকা লন্ডনের পুজো! এবার কি তোরা পুরুতের বদলে ক্যাসেটে সারবি?
অভিযোগের যেন আর শেষ নেই। কৈলাসে মা আর সংসারে বউ। মায়ের মন ভোলাতে বললাম,
– এবার গেলে মা তোমায় টোটোয় চড়াব আর মেট্রো তো আছেই।
সঙ্গে সঙ্গে মা ফোঁস করে উঠল,
– প্রায়ই তো শুনছি আগুন লাগছে, দরজা খুলছে না, মাঝপথে থেমে যাচ্ছে। তোদের ধান্দাটা কী বল তো? তাছাড়া বছরে তো একবারই যাই। এক-আধ দিন দু-চারজন আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যাব, তা আর সাহসে কুলোয় না। কাগজে দেখি নিত্যিই ট্রেন ডাকাতি হচ্ছে, লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে থাকছে ট্রেন। কেন মরতে যাব ওখানে বলতে পারিস?
পেরে উঠলাম না। অকাট্য সব কথা। এ সব এড়াতে বললাম,
– মা, দিদিদের সঙ্গে একটু দেখা করে আসছি।
বলে উঠে পড়লাম। পাশের ঘরে উঁকি দিলাম। কানে এল, মার ছক্কা দুই। দেখি খাদ্য আর শিক্ষা দফতরের হেড অফ দ্যা ডিপার্টমেন্ট লক্ষ্মী আর সরস্বতী দিদিমণি লুডো খেলছে। এরা এ যুগের মেয়ে হলেও দেখলাম ফেসবুকে সময় কাটাচ্ছে না, নীলহোয়েল খেলছে না। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। মুখ ঝামটা দিয়ে লক্ষ্মীদি বলল,
– বেরো ঘর থেকে। মরার আর জায়গা পেলি না। এবার তোদের পুজোয় আমরা কেউই যাব না।
সঙ্গে সঙ্গেই বললাম,
– দিদি তোমার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি যে অমন করে মুখ ঝামটা দিচ্ছ?
খেলা থামিয়ে একটু উত্তেজিত হয়ে লক্ষ্মীদি বলল,
– আমার দৌলতে তোরা খেয়ে বাঁচিস অথচ আমার বেলায় জোটে না। নিজেরা মিনিকেট, চামরমণি, বেরেলির বাসমতী গিলছিস, আর ভোগের সময় মোটা মোটা কম দামি পোকাওয়ালা আতপ। কেন রে! তোর পুজো কমিটির সদস্যদের মা বোনেরা এই আতপ খেয়ে থাকে কি না জিজ্ঞাসা করবি তো?
এবার সরস্বতী দিদিমণিকে দেখিয়ে বলল,
– গতবার আমি আর ও প্যান্ডেলে একভাবে কোমর বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বোর ফিল করছিলাম। তাই হাত পা খেলাতে একটু বেরিয়েছিলাম। ও মা, চোখের নিমেষে মোটরবাইকে চড়ে দুটো ছেলে এল। টুক করে গলার হারটা ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেল। ওই পর্যন্তই। বেঁচে গেছি সে যাত্রায়। নন্দী আর ভৃঙ্গীকাকু শুনে তো কি বকাবকি। বাপি তো এই মারে কি সেই মারে।
এ কথার উত্তর জানা নেই। এ সবইতো আমার জানা। এবার সরস্বতী দিদিমণি ফোড়ন দিয়ে বলল,
– আমিও ভাই এবার তোদের ওখানে যাচ্ছিনে। অনেক কষ্টে ইংরাজি চালু করলাম প্রাইমারিতে। পড়াবে কারা – এইট পাস। টিভিতে দেখলাম বইমেলায় হচ্ছে বোতল উৎসব। এই তো তোদের শিক্ষা সংস্কৃতি। অধিকাংশ মাস্টার তো এখন কোচিংবাবা। স্কুলগুলো তো তুলে দিলেই পারিস। প্রশ্নপত্র ফাঁস। অসম্পূর্ণ সাক্ষরতা কর্মসূচি। স্কুল কলেজে ইউনিয়নবাজি। অধিকাংশ বাংলা বা ইংরাজি মিডিয়াম স্কুলে ডোনেশনের ঠেলা। নানা অজুহাতে ছাত্র ছাত্রীদের ওপর চাঁদার জুলুম – এসব দেখেও কী তোদের ওখানে পুজো নিতে যাওয়া যায়?
আমি বললাম, দেখ দিদিমণি…
রেগে কথায় বাধা দিয়ে ভেঙচি কেটে বলল,
– দেখ দিদিমণি, কি দেখবো রে? জানোয়ার কোথাকার। নেমন্তন্ন করতে এসেছে? আয় লক্ষ্মী লুডো খেলি। যতরাজ্যের আঘাটের মরা এসে জুটেছে এখানে। বেশি প্যাঁচাল পাড়লে কিন্তু নন্দীকাকুকে ডেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেব। যাহ, ভাগ এখান থেকে।
কথা বাড়ালাম না। দুই বোনই রগচটা। পারলে ধরে মারে। গেলাম দুটো ঘর ছেড়ে পাশের একটা ঘরে।
লাস্ট ইলেকশনে কৈলাসের এমএলএ পদে জয়লাভ হয়েছে অসুরদেরই। আমাদের একান্ত ঘনিষ্ঠ এমএলএ স্বয়ং অসুরদাই। ঘরে ঢুকে দেখি খাটিয়ায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। ঘরের কোণে পড়ে আছে খানকয়েক রিভলভার, গোটা দশেক হাতবোমা, দুটো নেপালা, একটা কানপুরিয়া। রাম, হুইস্কির খান দশেক ভরা বোতল। কাছাকাছি হয়ে সমবেদনার সুরে বললাম, কি হয়েছে অসুরদা?
পাস ফিরল। মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
– আর বলিস কেন ভাই, সেই যে মা ত্রিশূল দিয়ে খোঁচা মেরেছিল, সেটা নাকি ইনফেকশন হয়ে গেছে। সব ডাক্তারের সব রোগের ওই একই বুলি। ইনফেকশন। আসল রোগটা যে কি তা কেউ বলে না। একজন তো ঘা-টাকে ট্রিটমেন্ট করল ক্যানসার বলে। হাজার রকমের পরীক্ষা রিপোর্ট, সব ওকে। অথচ রোগীর কষ্ট যায়না। ডাক্তার পারেনা রোগ সারাতে। বড় দু-চারজন যাও বা আছে, তাদের কাছে ঘেঁষার উপায় নেই। শুধু টাকার খাঁই। ভাবছি ট্রিটমেন্টটা বিদেশে করাব। এখন তো আমি জনপ্রতিনিধি। গাঁটের কড়ি লাগবে না।
খাটিয়ার পায়ের দিকে বসলাম। প্রণাম করে বললাম,
– অসুরদা তুমি এখন কি করছ?
সাতদিনের বাসি চুপসে যাওয়া বেগুনের মত মুখ। কোঁকাতে কোঁকাতে বলল,
– বলতে পারিস কিসসু না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ডাকাতি, খুন জখম, ধর্ষণ, রাহাজানি, সাট্টাজুয়া, চোলাই, গৃহবধূ হত্যা, বউ পেটানো, দাদাগিরি, তোলা আদায়, মিছিল অবরোধ, কী না করতাম। এ সবই তো তোদের মধ্যে দিয়ে। জাতে অসুর। আসুরিক কাজই তো আমার পেশা। বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি পুলিশ বহুত বাড় বেড়েছে। বহুত ঝামেলা করছে। পেটে লাথ্ মারছে।
ভাবলাম তুমি অসুর হয়ে কিছু করতে পারছ না, আমরা তো কোন ছাড়। আর কথা না বাড়িয়ে বললাম, পুজোয় যাচ্ছ তো? নেমনতন্ন করতে এসেছি।
কষ্টের মধ্যেও এক গাল হেসে বলল,
– নো প্রবলেম। তোদের মধ্যে সব সময়েই আছি। থাকবও। দেখছিস না, কোথাও না কোথাও দাঙ্গা বাঁধিয়ে রেখেছি। বেঁচে আছি তো তোদের জন্যেই। আমরা বলতে তো তোরাই। যাব না মানে, একশো বার যাব। মা যাক বা না যাক, আমি ঠিক সময়েই হাজির হব।
দেখলাম অসুরদার আপত্তি নেই। খুশি হলাম। প্রণাম জানিয়ে গেলাম গণেশদার ঘরে। ঘরে গণেশদা নেই। তারস্বরে ডিজে বাজছে। ডিক্ ডিকা ডিক্…। তাঁর বাহন দেখি শাহরুখের ড্যান্স দিচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম,
– গণেশদা কোথায়?
মুখে কথা নেই। ইশারায় দেখাল উপরে। সিঁড়ি ভেঙে টুকটুক করে উঠে পড়লাম ছাদে। উফ্! কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। মাথার ভেতর কেমন যেন করছে, ছাদটা যেন আওয়াজে দুলছে। দেখলাম, গণেশদা কখনও লাফাচ্ছে, কখনও লম্বা কান দুটো ধরে নিল ডাউন, কখনও গড়াগড়ি খাচ্ছে এ মাথা থেকে ও মাথা, কখনও সমানে বৈঠক। ইশারায় বসতে বলল। খানিক পর ব্যাপারটা শেষ, ডিজে মিউট হল। সামনে বসতেই বললাম,
– এসব কী করছিলে গণেশদা?
শুঁড় দিয়ে পিঠটা একটু চুলকে বলল,
– দু’ঘণ্টায় বিশ ইঞ্চি কমাচ্ছি।
জিজ্ঞাসা করলাম,
– তা এখন কী করছ?
হাসতে হাসতে বলল,
– আমার যা কাজ তাই তো করছি। লাস্ট ইলেকশনে অনেকে টাকা নিয়েছিল। পরে জিনিসের দাম বাড়িয়ে সুদে আসলে তুলে নিয়েছি। সামনেই আবার ইলেকশন আসছে। এবারও দিতে হবে। প্রিপারেশন নিচ্ছি। ওরা মার খেলে যে আমায় উলটে দেবে। ওরাই তো বাঁচিয়ে রেখেছে। দেখছিস না, সমানে সব জিনিসের দাম বাড়িয়ে চলেছি। পাবলিক বুদ্ধু। সবই বোঝে। হাঁদারাম, কিছু করার ক্ষমতা নেই। এই দ্যাখ না, আমি কৈলাসের বাস অটো টোটো টেম্পো ম্যাটাডোর ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশানের জেনারেল সেক্রেটারি। কিছু পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা তো আমাকেই করতে হবে। নইলে আমিও অচল, কৈলাসও। ডিজেলের দাম কমল কিন্তু কোনওটার ভাড়া কেউ কমাতে পেরেছে? গ্যাঁড়াকলটা তো আমার হাতে। একেবারে টুথপেস্ট। বেরিয়ে এলে ঢোকানো যাবে না। হয় গেলো, নয় ফেলো। চেঁচিয়ে লাভ নেই ভাই।
দেখছি গণেশদার গা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। শুঁড় দিয়ে শুষে নিতে নিতে বলল,
– সারা বছর তো খোঁজ নেই, তা হঠাৎ কী মনে করে?
হুট করে আইফোনে টিংটং। কানে ধরল। ও পাশ থেকে কি কথা এল জানতে পারলাম না। গণেশদা শুধু বলল,
– মন্ত্রী রাজি না থাকলে বন্ধ ডাকার কথাটা জানিয়ে দে। একটু পরেই রিং ব্যাক করছি।
ফোনটা রাখল। মুখে হাসির প্রলেপ মাখিয়ে বললাম, ক্লাবের পুজো। তোমাকে যেতে হবে। নেমনতন্ন করতে এসেছি।
একটা বড় হাই তুলল। আঙুলে তিনটে তুড়ি মেরে বলল,
– শিগগির আবার সব জিনিসের দাম বাড়াব। ভাড়া বাড়ানোরও ধান্দা করছি। অনেক মিটিং-টিটিং আছে। সময় দিতে পারব না। দুঃখের কথা কি আর বলব? পাঁচশো হাজার বাতিলের ধাক্কা এখনও সামাল দিতে পারিনি। তার উপর মাসে তিনটে করে জিএসটি রিটার্ন জমা দিতে হবে। আমার বাপ কোনওদিন এসব শোনেনি। এর প্রবর্তক যারা তাদের চোদ্দপুরুষের কেউ কখনও এসব কথা শুনেছে? তুই এখন যা ভাই, আমাকে বেরোতে হবে।
অনেক অনুরোধ করলাম। কিছুতেই রাজি নয়। প্রণাম করে উঠে আসছি এমন সময় বলল,
– হ্যাঁরে, কাগজে দেখলাম তোদের ওখানে নাকি ষাঁড়ের চার্জ বেড়েছে? তা ঘাটতি পড়ে থাকে তো বাপিরটা নিয়ে যা। ওটা তো কোনও কাজই করে না। খেয়ে শুয়ে বসেই কাটিয়ে দেয়।
কথাটা শুনে হেসে ফেললাম। বললাম,
– ওটা ষাঁড় নয়, বিদ্যুতের সার চার্জ। অনন্তকাল ধরে বেড়েই যাবে।
কথা এই পর্যন্ত। আবার টিংটং। কাকে যেন বলল,
– শেয়ার মার্কেট রেকর্ড করল! আবার?
আমি পাশের ঘরে ঢুকে পড়লাম। দেখি কার্তিকদা বসে আছে। সামনেই একটা টেবিল। কাঁচের নিচে ক্যাটরিনা বিদ্যা সোনাক্ষী দীপিকা থেকে সানি পর্যন্ত উঁকি মারছে। মুখখানা শুকনো খেজুরের মতো। হাতের তালুতে বুড়ো আঙুল ডলছে। মাথার সামনের এলাকায় কিছুটা চুল নেই। গোঁফের একটা পাশ মনে হয় যেন চিলে ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়েছে। আগের মতো জেল্লা মারা মুখখানা আর নেই। প্রণাম করে বললাম,
– কেমন আছ কার্তিকদা?
বেশ হতাশার সুরে বলল,
– একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করতাম। ঝাঁপে লাঠি পড়ে গেল। পরে প্রোমোটারিতে নেমে কয়েকটা বেআইনি বাড়িও বানালাম। ভাল ধান্দাও হল। এখন সরকার বলছে ভেঙে দেবে। ফ্ল্যাট দেব বলে অনেকের কাছ থেকে টাকা নিলাম। তারা দৌড় করাচ্ছে। তাই মনটা ভাল নেই। বহুত চিন্তায় আছি। এখন প্রায় বেকার বলতে পারিস।
মাথায় টাক আর ছোঁ মারা গোঁফ দেখে বললাম,
– তোমার টাকে কি পোকা লেগেছে?
উত্তর নেই। খইনির যুগ। ঠাক্ঠাক্ দুটো তালি মেরে এক চিমটি গুঁজে দিল ঠোঁটে। তারপর ফিচিক্। প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম,
– এবার পুজোয় যাচ্ছ তো?
মাথা চুলকে বলল,
– কোন ক্লাব, সেই লণ্ডভণ্ড ক্লাবের কথা বলছিস?
ঘাড় নাড়লাম।পরে মুখেও বললাম,
– হ্যাঁ।
কার্তিকদার মুখখানা ভয়ে আমসি হয়ে গেল। রেগে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
– ওই ক্লাবের মুখই আর দেখব না। গতবারের কথা ইয়াদ আছে? ভাসানের দিন ময়ূরকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি লরিতে। একজন শুরু করল ধুনুচি নাচ। সকলেই তো মাল খেয়ে চুর। হঠাৎ ধুনুচির আগুনটা ঠেসে ধরল আমার মুখে। তারপর, উফ্ কী অসহ্য যন্ত্রণা। আগুন ধরে গেল আমার গোঁফ আর চুলে। লরিতে জল নেই। আগুন তো নেভাতে হবে। একজন সেই সময় গণেশের হাত থেকে গদাটা কেড়ে নিয়ে মাথায় আর গালে মেরে চলল গিদিম গিদিম। আগুন নিভল। তবে মুখের ম্যাপটা পুরো বদলে গেল। নাক মুখ দিয়ে সমানে ব্লিডিং। নরকের বিকল্প হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম মাস খানেক। এর পরেও তুই ওখানে যেতে বলিস?
কিছু বলার নেই। কে যেন লিকোপ্লাস্ট সেঁটে দিল মুখে। বুঝলাম এখানেও সুবিধে হবে না। অগত্যা মধুসূদন। মা ছাড়া গতি নেই। ফিরে গেলাম মায়ের কাছে। সামনেই শীত আসছে। দেখলাম, মা সোয়েটার বুনছে এক মনে।
এবার কোনও কথা নয়। দুম করে পা দুটো জড়িয়ে ধরে বললাম,
– মা আমাদের অপরাধের কোনও সীমা নেই। তুমি নিজ গুণে ক্ষমা করে চলো।
অভিমানের সুরে মা বলল,
– না বাপু, আর না। আমার মনটাকে তোরা একেবারে বিষিয়ে দিয়েছিস।
মায়ের পা দুটো এবার মাথায় নিয়ে বললাম,
– মা, তুমি সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে চলো। আমরা শেষ হতে চলেছি। মা আমাদের, এই মানবকুলের সমস্ত রোগ শোক দুঃখ দৈন্য লোভ হিংসা অভিমান, যা কিছু মলিনতা, কলুষতা, তা থেকে মুক্ত করো। সত্য সরলতা বিশ্বাস দয়া প্রেম সুমতি ও শ্রদ্ধাভক্তিতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে চলো, নইলে ধ্বংস আমাদের অনিবার্য। আমরা শেষ হবই।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে চুপ করে রইলাম। মায়ের মনটা কেমন যেন উদাসীনতায় ভরে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর মুখে হালকা হাসির প্রলেপ মাখিয়ে বলল,
– যা, তোরা পুজোর আয়োজন কর। আমি সবাইকে নিয়ে যাব।
এ কথায় মনটা আমার ভরে গেল এক অপার্থিব আনন্দে। খুশিতে ডগমগ হয়ে বললাম,
– মা, কথা দিয়ে যাচ্ছি, ক্লাব সেক্রেটারিকে গিয়ে বলব তোমার অনুযোগের কথা। তোমাকে নিয়ে ওরা যেন আর খেলা না করে।
মা খুশি হল। প্রণাম করে বেরিয়ে আসছি, এমন সময় পিছু ডাকল। খনার বচনে আছে, ‘আগের চেয়ে পিছে ভাল যদি ডাকে মায়’। মা বলল,
– আমি বাপু তোদের মেট্রোয় যাব না। কখন যে কী হয়! এবার আমি ঘোড়ায় যাব। জেটিগুলো সারিয়ে রাখিস। সেদিনই তো ‘কৈলাস সমাচারে’ পড়লাম জেটি ভেঙে গঙ্গায় কতগুলো লোকের প্রাণ গেল। ফিরব ঘোড়ায়, তবে আধমরা রুগ্ন ঘোড়া রাখিসনে যেন!
(চিত্রণ – বিশ্বজিৎ)
অনেকদিন পর এমন ভাল গল্প পড়লাম। সত্যিই দারুণ লাগল। আরও গল্পের অপেক্ষায় রইলাম। অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালবাসা রইল।