ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা
বাঙালি পরিবারে জন্ম অথচ এই লাইনগুলোর সঙ্গে পরিচিত নন, এমন বাঙালি খুঁজে পেলে বুক ঠুকে পুরস্কারও ঘোষণা করা যায়।
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা, যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা! বাঙালি পরিবারে জন্ম অথচ এই লাইনগুলোর সঙ্গে পরিচিত নন, এমন বাঙালি খুঁজে পেলে বুক ঠুকে পুরস্কারও ঘোষণা করা যায়।
বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হিসাবে যে কটি উৎসব সারা বছরে নিজের জায়গায় অমলিন তার মধ্যে অবশ্যই একটি ভাইফোঁটা। দিনটা ভাই আর বোনের সেই চিরন্তন সম্পর্কের গাথাই বহন করে চলেছে। ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় শুদ্ধাচারে তার কপালে চুয়া-চন্দনের ফোঁটা এঁকে দেয় বোন। বাম হাতের কড়ে আঙুল থাকে ভাইয়ের কপালে আর ঠোঁটে থাকে চিরন্তন সেই চার লাইনের পঙতি। যা বাঙালি গড়গড় করে অক্লেশে বলে যেতে পারে।
কথিত আছে, সূর্যের দুই ছেলে-মেয়ে যম আর যমুনা। যমুনার মন একদিন খুব খারাপ। অনেক দিন হল সে তার ভাই যমকে দেখেনি। তাই যমকে বাড়িতে ডেকে পাঠাল যমুনা। মৃত্যুর দেবতা যম বোনের ডাকে সাড়া দিয়ে তার বাড়িতে হাজির হল। আনন্দে ভাইয়ের সুরক্ষা কামনা করে তার কপালে ফোঁটা এঁকে দিল যমুনা। সেদিন থেকেই কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে পালিত হয় ভাইফোঁটা।
ভাই-বোনের এই পবিত্র দিনে সকাল থেকেই বাড়িতে বাড়িতে শাঁখের আওয়াজ। উলুধ্বনি। ভোর থেকেই সাজো সাজো রব। এখন ইন্টারনেটের জামানায় দূরে থাকা ভাই বা বোনও স্কাইপের কৃপায় ফোঁটার আনন্দটা দূর থেকেই ভাগ করে নিতে পারে। আর কাছে থাকলে তো সশরীরে হাজিরা।
শুরুতেই মাঙ্গলিক খাজা আর সঙ্গে থালা ভরা সুস্বাদু মিষ্টি। এই দিনটাকে মাথায় রেখে মিষ্টির দোকানগুলো সারা বছর কিছু নতুন করার ভাবনা চালিয়ে যায়। ফলে প্রতি বছরই ভাইদের পাত আলো করে পুরাতনী চেনা মিষ্টির পাশাপাশি জায়গা করে নেয় আধুনিক ফিউশন মিষ্টি বা নয়া স্বাদ ও চেহারার অচেনা মিষ্টান্ন।
ভাইফোঁটার সঙ্গে উপহার আদান প্রদান আর ভূরিভোজেরও একটা নিবিড় সম্পর্ক সনাতনি। ভাইকে ফোঁটা দেওয়ার পর তাই সকাল থেকেই বাড়িতে বাড়িতে রান্নার তোড়জোড়। রান্না সুগন্ধে ম ম করে আশপাশ। চিংড়ি, ইলিশ, পাবদা, ভেটকির সঙ্গে চিকেন বা মটনের বাহারি রেসিপি। সঙ্গে আছে নানা পদ।
ভাজা, শুক্তো, মাছের মাথা দিয়ে ডাল, পায়েস। সব মিলিয়ে এলাহি আয়োজন আর কব্জি ডুবিয়ে রসনা বিলাস। দুপুরে পরিবারের সকলে বসে জমাটি আড্ডা বা সিনেমা দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলে তো সোনায় সোহাগা।
দিনভর খুশি, আনন্দ, খাওয়া দাওয়া, খুনসুটি। সব মিলিয়ে ভাইফোঁটা ছিল, আছে, থাকবে। বাংলায় যা ভাইফোঁটা, উত্তর ভারতে তাই পালিত হয় ‘ভাই দুজ’ নামে। পশ্চিম ভারতে আবার সেটাই ‘ভাউ বিজ’। আর পূর্ব ভারত ও নেপালে সেটাই ‘ভাই টিকা’। স্থান ফেরে নাম বদলেছে। কিন্তু উৎসবটা একই রয়ে গেছে। যা আদপে ভারতের সনাতনি ইতিহাসেরই ধারক ও বাহক।