Mixed Bag

স্কুল পড়ুয়াদের গড়েপিটে তৈরি করছে ‘প্রয়াস’

লেখাপড়া করার প্রধান উদ্দেশ্য আদতে শেখা। পরীক্ষায় কে কত বেশি নম্বর পেল, তা কিন্তু লেখাপড়া করার গৌণ ফলাফল। খুব ভালো ফল করলেই সেই ছাত্র কিংবা ছাত্রীটি যে ভবিষ্যতে সুন্দর মানুষ হবে, তা মোটেও নয়। নম্বরের সঙ্গে মানবিক বিকাশের কোনও ধরনের সম্পর্কই নেই। তাও নম্বর পেতেই হয়। তবে রথ দেখা, কলা বেচা যদি একসঙ্গে হয়, সেই বা মন্দ কী! ডক্টর বি সি রায় মেমোরিয়াল কমিটি গত তিন বছর ধরে এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করতে এক নতুন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। কমিটির প্রধান উদ্দেশ্য কিশোর-কিশোরীদের মেধার বিকাশ ঘটানো।

উল্টোডাঙার কাছেই বিধানচন্দ্র শিশু উদ্যান। সেখানে মেমোরিয়াল কমিটির অফিস। কমিটি হরেক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। যেমন, অঙ্কন প্রতিযোগিতা, যোগাসন প্রতিযোগিতা, স্বল্প খরচে বিদেশি ভাষা শেখানো ইত্যাদি। কমিটি মনে করে, কিশোর-কিশোরীদের মেধার বিকাশে কম্পিউটারের চেয়ে অনেক উপযোগী যোগাসন। বাচ্চাদের মানসিক উৎকর্ষের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে বছরভর কমিটি নানান ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উদ্যোগ নিয়ে থাকে।


প্রকাশিত হচ্ছে খেয়ালখুশি নামে একটি ছোটদের পত্রিকা। সম্পাদক বিশিষ্ট সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। এছাড়া, মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের সহায়তা করার জন্যে প্রকাশিত হয় প্রয়াস নামে আর একটি পত্রিকা। দুটি পত্রিকাই ছাত্রছাত্রী মহলে জনপ্রিয়। উপকৃত হয়েছে বহু মেধাবী পড়ুয়া। মেমোরিয়াল কমিটির অন্যতম কর্তা নঈমূল হক জানালেন, নিয়মিত প্রয়াস পড়ছে ১২ হাজার স্কুল পড়ুয়া। কলকাতা ছাড়াও দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গে ক্রমেই চাহিদা বাড়ছে কাগজের।

২০১৬ সালে বাঁকুড়া জেলা থেকে মাধ্যমিকের মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া ছাত্র অর্ঘ্য পাল বলেছেন, তিনি প্রয়াস নিয়মিতভাবে পড়তেন। এই বইটি তাঁকে নানাভাবে উপকৃত করেছে। হুগলি কলেজিয়েট‌ স্কুলের ছাত্র অর্চিষ্মান পাণিগ্রাহীর নাম ২০১৫ সালে মাধ্যমিকের মেধা তালিকায় ঠাঁই পেয়েছিল। এবার সেই অর্চিষ্মানই উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম স্থানাধিকারী। অর্চিষ্মান জানিয়েছেন, তিনিও নিয়মিত প্রয়াস পড়তেন। উপকৃত হয়েছেন এই বইটির মাধ্যমে।


নঈমূল হক জানালেন, গত তিন বছর ধরে ছাত্রস্বার্থে নেওয়া এক অভিনব উদ্যোগ ধারাবাহিকতা বজায় রেখে কাজ করে চলেছে। তা হল মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষার প্রস্তুতিতে প্রতিটি বিষয়ের জন্যে মক টেস্টের ব্যবস্থা করা। এই উদ্যোগটিও ছাত্র ও শিক্ষক মহলে শুরু থেকেই সাদরে গৃহীত। এরও একাধিক কারণ আছে বলে জানালেন নঈমূল হক। প্রথম কারণটা অবশ্যই গুণমান বজায় রেখে অপেক্ষাকৃত স্বল্প খরচে ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজন মেটানো। এখানে মোট সাতটি বিষয়ের মক টেস্ট দেওয়া যাচ্ছে অতি স্বল্প খরচে। তাছাড়া, গোটা প্রক্রিয়াটির সঙ্গে যুক্ত কলকাতা-সহ সারা বাংলার অন্ততপক্ষে ১০০০ শিক্ষক-শিক্ষিকা। ওই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সকলেই কোনও না কোনও সরকারি স্কুলে কর্মরত।

মেমোরিয়াল কমিটির সেক্রেটারি কিংবা মেমোরিয়ালের তরফে প্রকাশিত পত্রিকার সম্পাদক নঈমূল হক – দুজনেই পেশায় শিক্ষক। গৌতমবাবু পেশায় অঙ্কের মাস্টারমশাই। ওঁরা বললেন, আগাগোড়াই আমাদের উদ্দেশ্য টাকা কামানো নয়। অতুল্য ঘোষ বা দাদুর আদর্শে কাজ করি। টাকাপয়সায় লাভজনক কিছু করতে চাইনি।

প্রয়াসের সঙ্গে বেশ কিছু সংখ্যক অভিজ্ঞ শিক্ষাকর্মী যুক্ত ছিলেন। তাঁরা কাগজটা চালাতে সর্বতোভাবে সহায়তা করে আসছিলেন। ওঁরা নামমাত্র দক্ষিণায় বছরের পর বছর লিখছেন। কমিটির কাছ থেকে আর্থিক কোনও সুবিধা না পাওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র ছাত্রছাত্রীদের ভালোবেসে অতিরিক্ত সময়টা ওঁরা এ কাজে দেন। মক টেস্টের প্রশ্নোত্তর তৈরি করা থেকে শুরু থেকে খাতা দেখে দেওয়া – পরীক্ষার্থীদের ভুল শুধরে দেওয়ার কাজের সঙ্গে সঙ্গে টেস্টে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক পরীক্ষার্থীকে তাঁদের মানোন্নয়নে সহায়তা করার জন্যে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ার কাজটিও করে থাকেন এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আংশিক সময়ের জন্যে যুক্ত শিক্ষাকর্মীরা।

বিধানচন্দ্র শিশু উদ্যানে দেখা মিলল বেশ কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষিকার। কলকাতার নামী সরকারি স্কুলগুলিতে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতা করছেন। এঁদেরই একজন শিখা বালা। শিখাদেবী বরানগর মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকা। বিষয়, বায়োলজি। কথা হল বায়োলজি শিক্ষিকা স্বাগতা বসাকের সঙ্গে। তিনি চেতলা গার্লস হাইস্কুলে পড়ান। রাজারহাটের রোহন্ডা হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক মিজানুর রহমান, সুজিত সরকার কিংবা ইংরেজির অভিজ্ঞ শিক্ষক রাহুল সেনগুপ্তের মতো অনেকেই এখানে জড়ো হয়েছেন ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের মঙ্গল কামনায়। শিখাদেবী বললেন, নম্বর পাওয়াটাই এখানে বড় কথা নয়। বড় কথা শেখাটা।

নঈমূলবাবু বললেন, ছেলেমেয়েদের ভিতর শেখার‌আগ্রহ তৈরি করে দিতে পারলে ওঁরা কম নম্বর পেলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কোনও একটি ক্ষেত্রে জীবনে দাঁড়াতেও তাঁদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আগেও এমনটা দেখা গেছে। ইংরেজির শিক্ষক রাহুলবাবু ১৯৮৭ সাল থেকে সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। কথাপ্রসঙ্গে তিনি বললেন, এখন অনেককেই বেশি বেশি করে নম্বর পেতে দেখা যাচ্ছে। আমাদের সময়ে প্রচুর নম্বর পেত স্বল্প সংখ্যক ছেলেমেয়ে। মনে রাখা দরকার, নম্বর বেশি পেলেই শেখার ক্ষমতা বাড়ে না। শেখার ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে গেলে লেখাপড়াটাকে ভালবাসতে হয়।

এই রাজ্যের প্রতিটি জেলাতেই বছরের নানা সময়ে মক টেস্টের আয়োজন করা হয়। নঈমূল বললেন, মাধ্যমিক পরীক্ষাটার ওপর আমরা ভেবেচিন্তেই জোর দিয়েছি। এই পরীক্ষাটি জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা। সে হিসাবে ছেলেমেয়েদের অনেকের ভিতরই নানান ধরনের ভীতি কাজ করে। আমরা এই ভীতিটাই কাটিয়ে দিতে চাই। সেটা সম্ভবপরও।

১৯৭৬ সালে অতুল্য ঘোষ যখন বিধানচন্দ্র শিশু উদ্যানকে কেন্দ্র করে সামাজিক কাজকর্মের সূত্রপাত করেন, সেইসময়েই তিনি এ জাতীয় কর্মকাণ্ডের বীজ ছড়িয়ে গিয়েছিলেন। ছেলেমেয়েদের পড়ানোর ব্যবস্থা চালু করেছিলেন অতু্ল্যবাবু। পড়ানো হত উদ্যান সংলগ্ন এলাকায়। জানা গেল, সে যুগের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের হাতে ছাত্রছাত্রীদের তৈরি করার ভারটা সঁপে দিয়েছিলেন অতুল্যবাবু। যেমন, বাংলা পড়াতেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, রসায়ন পড়াতেন অপরেশ ভট্টাচার্য, প্রভাতকুমার পালিত পড়াতেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ফিজিক্স পড়াতেন অরূপ রায়। এছাড়াও যুক্ত ছিলেন আরও অনেক বিশিষ্ট শিক্ষক।

মাঝে শিশু উদ্যানের দুঃসময় গিয়েছে কিছুদিন। নানা বিপর্যয়ে প্রতিষ্ঠানটি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সেই অবস্থা কাটিয়ে ওঠা গিয়েছে। প্রয়াস ও খেয়ালখুশির কার্যনির্বাহী সম্পাদক এখন নঈমূল হক। ওঁর কাছে জানা গেল প্রতিষ্ঠানের শুভানুধ্যায়ীদের অবদান সম্পর্কে। নঈমূলবাবুর কথায়, বছরভর মক টেস্টে ১২ হাজার ছাত্রছাত্রীর পরীক্ষা নেওয়ার জন্যে ১০৪টি কেন্দ্র আমাদের সঙ্গে যুক্ত। প্রতিটি কেন্দ্র জেলাগুলিতে এক-একটি করে স্কুল। প্রয়াস বা খেয়ালখুশিও জেলাগুলিতে বিপুলভাবে সমাদৃত হচ্ছে।

তিনি আরও জানালেন, প্রয়াসের সঙ্গে অন্ততপক্ষে ৪০ জন রয়েছেন, যে মানুষগুলি উত্তরবঙ্গ কিংবা দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা। এই মানুষগুলি নিতান্ত সাধারণ হয়েও অসাধারণ। অনেকেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা স্বল্প। কেউ হয়তো ছোট ব্যবসায়ী কিংবা দোকানি। এঁরা আমাদের বই ছাত্রছাত্রীদের হাতে পৌঁছে দেন, এছাড়াও জনসংযোগের দরকারি কাজগুলি সেরে দেন বিনি পয়সাতেই। কারণটা কিছুই নয়, আমরা যে নিছক ব্যবসা করতে নামিনি – বরং জনস্বার্থ বা সমাজের স্বার্থের সঙ্গে আমাদের কাজগুলি বরাবর যুক্ত থেকেছে – এই ঐতিহ্যই ওঁদের মতো অনেক আপাত সাধারণ মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে। ফলে শিক্ষক-শিক্ষিকারাও যেমন স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন, ওঁদের অবদানও তেমন ফেলনা নয়।

মক টেস্টে নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে কেজিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীরা পরে সহজে দেখে নিতে পারবেন কোন প্রশ্নে সে কত নম্বর পেয়েছে। খাতা ফেরত পাওয়ার পরে কেজিং পদ্ধতিতে প্রাপ্ত নম্বর দেখার জন্যে তাকে উত্তরপত্রের প্রতি পৃষ্ঠা না উল্টালেও চলবে। ডক্টর বি সি রায় মেমোরিয়াল কমিটির তরফে আয়োজিত স্বল্প খরচের মক টেস্টে ছেলেমেয়েদের বসানোর সুযোগ পাওয়ায় অভিভাবকদের অনেকেই স্বস্তিতে। অভিভাবকদের অনেকের পক্ষে ৪-৫ হাজার টাকা খরচ করে ছেলেমেয়েকে মক টেস্টে বসানোর ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব নয়। রোজগার কম হলে ইচ্ছা থাকলেও উপায় থাকেনা। এই পরিস্থিতিতে নিম্নবিত্ত পরিবারের পড়ুয়াদের জন্যেও সুযোগ তৈরি করেছে ডক্টর বি সি রায় মেমোরিয়াল কমিটি। যে সময়ে সবকিছুই মুনাফার চেহারা নিচ্ছে, সেই পরিস্থিতিতে এই প্রয়াস সাধুবাদযোগ্য তো বটেই!

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button