গভীর জঙ্গলে হর-পার্বতীর মিলনক্ষেত্র, অজানা এক মহাতীর্থ
এক অতি প্রাচীন পৌরাণিক তীর্থক্ষেত্র, প্রায় কেউই এর খোঁজ রাখে না। এর দর্শন না করলে এই তীর্থ দর্শন, স্নান ও দানের কোনও ফল লাভই হয় না।
এমনিতেই যারা যায় তারা কেউ কিছু পাওয়ার আশায় নয়, মনের সমস্ত কিছু বিলিয়ে দিয়ে ফিরে আসতে চায়, কিন্তু এমনই কপাল, কিছুতেই খালি হাতে ফেরা হয় না তাদের, অনাবিল আনন্দে দেহমন ভরিয়ে দেয় যে উদার-উদাসীন তীর্থ, তার নাম হরিদ্বার, মহামতি ভীষ্মের তর্পণক্ষেত্র, মহাভারতীয় যুগের গঙ্গাদ্বার।
তীর্থকামী কিংবা ভ্রমণপিয়াসীদের মধ্যে হরিদ্বারে যাননি এমন মানুষের সংখ্যা এখন নেহাতই কম। অথচ হরিদ্বারে গিয়েও দেখা হয়নি বিল্বকেশ্বর মহাদেব, এমন তীর্থযাত্রীর সংখ্যা শতকরা ৯৯ ভাগ। মোক্ষভূমি তীর্থ হরিদ্বারে এর দর্শন না করলে এই তীর্থ দর্শন, স্নান ও দানের কোনও ফল লাভই হয় না। একইরকম ভাবে কাশীতে কালভৈরব, বৃন্দাবনের বংশীবটে গোপীশ্বর মহাদেব, কালীঘাটে নকুলেশ্বর, এদেরকেও দর্শন না করলে তীর্থ দর্শনের ফল পাওয়া যায় না। এগুলি প্রায় সকলেরই বাদ পড়ে যায়, মন্দিরগুলি চলার পথে পড়েও উপেক্ষিত হয় কেবল না জানার কারণে, অথচ সেখানে না যাওয়ারও কোনও কারণ নেই। যেমন হরিদ্বারে বিল্বকেশ্বর মহাদেব।
স্টেশন হরিদ্বার থেকে ‘হর কী পৌড়ী’ ঘাটের দিকে বাঁ-পাশ ধরে কিছুটা এগোলেই বাবা কালীকমলিওয়ালার ধর্মশালা। আর খানিকটা এগোলে অবাংলাভাষিদের কথায় পড়বে ‘চৌরাহা’, এই চৌমাথা থেকে সামান্য এগোলেই ঢালু পিচের রাস্তা চলে গিয়েছে বাঁ-দিকে। পড়বে রেল পোল। তার নীচে দিয়ে একটু গেলেই ‘মেলা চিকিৎসালয়’, আরও কয়েক পায়ের পর ডানদিকে সামান্য চড়াই ধরে শুরু হয়েছে গভীর জঙ্গল, একেবারেই যেন তপোবন। এই তপোবনের পরিবেশেই হরিদ্বারের ক্ষেত্রপাল দেবতা বিল্বকেশ্বর মহাদেবের অধিষ্ঠান। ‘হর কী পৌড়ী’ যাওয়ার প্রধান রাস্তা থেকে হেঁটে খুব বেশি হলে মিনিট পাঁচেক। লোকালয়ের কোলেই এমন একটা পরিবেশ বাইরে থেকে কিছুতেই বোঝার উপায় নেই, যেমন বোঝা যায় না সুন্দর পোশাকে মোড়া অসৎ প্রবৃত্তির বদলোকগুলোর বাইরেটা দেখে।
চারদিকে ঘন গভীর বন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে হরিদ্বারের এই বিল্বকেশ্বর পর্বতে। পরম শ্রদ্ধাস্পদ সাধক ভোলানন্দগিরি মহারাজ কথা প্রসঙ্গে তাঁর ভক্ত শিষ্যদের একসময় বলেছেন, কখনও কনখলে, কখনও হরিদ্বারের বিল্বকেশ্বর পর্বতে, কখনও বা তাঁর তাপস জীবন কেটেছে হিমালয়ের গুহা গহ্বরে। তখন রেলগাড়ি হয়নি। বড় বড় হাতি, বাঘ ভালুক দেখা যেত হরিদ্বারের পাহাড় বনে। তপস্যাকালে অনেক রাতই বিনিদ্র অবস্থায় কেটেছে মহারাজের।
সামান্য চড়াই। তারপর মুখ্য তোরণ পেরোতেই বাঁ-দিকে বিশাল ইঁদারা। সামনেই টিনের ছাউনির ভিতর দিয়ে উঠেছে একটি নিমগাছ। এরই গোড়ায় বিল্বকেশ্বর মহাদেবের অবস্থান। মাঝারি উচ্চতা। শিবলিঙ্গের প্রায় সাড়ে তিন ভাগ পিঙ্গল বর্ণ, বাকি উপরের অংশ গাঢ় খয়েরি রঙের পাশ ঘিরে হালকা সাদা রং। সচরাচর দেখা শিবলিঙ্গের রঙের সঙ্গে এ রঙের কোনও মিল নেই। এই শিবলিঙ্গই বিল্বকেশ্বর মহাদেব নামে হরিদ্বারে প্রসিদ্ধিলাভ করেছে অজ্ঞাত কোনও কাল থেকে।
বর্তমানে নিমগাছের গোড়ায় অবস্থান হলেও একটি প্রাচীন বেলগাছ ছিল এখানে। কালের নিয়মে সেই গাছ গিয়েছে লুপ্ত হয়ে। বেলগাছের নীচে মহাদেবের আবির্ভাব কারণেই শিবলিঙ্গের নাম হয়েছে বিল্বকেশ্বর মহাদেব। এই মহাদেবের সপ্রশংস উল্লেখ আছে স্কন্দপুরাণে। বিল্বকেশ্বর পর্বতের এই ক্ষেত্রটিতেই পুরাণের কালে হিমালয়ের কন্যা পার্বতী তপস্যা করেন মহাদেবকে বিবাহের জন্য। তপস্যায় প্রীত হন মহাদেব। আবির্ভূত হয়ে বিবাহের প্রতিশ্রুতি ও বর প্রদান করেন পার্বতীকে। আবির্ভূত হয়েছিলেন শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে। সেই জন্যে প্রতি বছর ওই তিথিতে বিশেষ পুজো উৎসব হয় বিল্বকেশ্বর মহাদেব মন্দিরে।
হিমালয় ও সুমেরু-দুহিতা মেনকার কন্যা উমা। তাঁর অন্য নাম পার্বতী। পূর্বজন্মে দক্ষরাজার কন্যা ছিলেন। দক্ষের মুখে স্বামীর নিন্দা শুনে তিনি দেহত্যাগ করেন। পরে হিমালয়-রাজের গৃহে জন্মগ্রহণ করে মহাদেবকে স্বামীরূপে পাওয়ার জন্য তপস্যা করেন হরিদ্বারের বিল্বকেশ্বর পর্বতে। কখনও নিদারুণ গ্রীষ্মে, কখনও ভীষণ ঠান্ডায় উমার কঠোর কঠিন তপস্যা দেখে মা মেনকা বলেছিলেন কন্যা পার্বতীকে, উ(হে পার্বতী) মা (না)-তপস্যা কোরো না। এই জন্যেই নাম হয় উমা।
এদিকে তারকাসুরের উৎপাতে উত্যক্ত হয়ে ইন্দ্রাদি দেবগণ শরণাপন্ন হলেন ব্রহ্মার। পিতামহ ব্রহ্মা জানালেন, মহাদেবের পুত্র কার্তিকেয়র হাতে মৃত্যু হবে তারকাসুরের। সেই কারণে মহাদেবের যাতে পুত্র উৎপাদনের ইচ্ছা জন্মে তার চেষ্টা করা প্রয়োজন। শেষ পর্যন্ত দেবতাদের কৌশলে মহাদেবের দ্বিতীয়বার বিবাহ ও মিলন হয় পার্বতীর সঙ্গে। পরে কার্তিকেয় জন্মগ্রহণ করে বধ করেন তারকাসুরকে।
মহাদেবের প্রথম বিবাহ হয় দক্ষরাজকন্যা সতীর সঙ্গে। দ্বিতীয়বার হিমালয়-কন্যা পার্বতীর সঙ্গে। কার্তিকেয়র জন্ম, তারকাসুর বধ, পার্বতীর তপস্যা, শিবকে বিবাহ ইত্যাদি বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত হরিদ্বারে এবং পরিসমাপ্তি ঘটে কামাখ্যায় তারকাসুর বধের পর।
অতীতকে ফিরে দেখা। তখন হরিদ্বারের লালতারাবাগের নিজস্ব আশ্রমে বাস করতেন ভারতবরেণ্য মহাপুরুষ ভোলানন্দগিরি মহারাজ। আশ্রমটি ছিল নিতান্তই অনাড়ম্বর। যখন যেটুকু আহার ও অর্থ সেখানে সঞ্চিত হত তা তখনই বৈরাগ্যবান ভোলানন্দ ব্যয় করতেন সাধুমণ্ডলের ভোজন ও দানে। তারপর বসে থাকতেন পরম নিশ্চিন্তে। এই ভাবেই গঙ্গার বয়ে যাওয়া ঢেউ-এর মতো কেটে যায় দিন থেকে রাত, রাত থেকে দিন।
১৯০২ সালের কথা। কিছুদিন ধরেই ভোলানন্দের চোখে জন্মে এক দুরারোগ্য কঠিন-ব্যাধি। ধীরে ধীরে দুটি চোখই হয়ে পড়ে অকর্মণ্য। ভোলাভক্তরা বহু চিকিৎসা করালেন কলকাতায় এনে, কিন্তু কিছুতেই কোনও ফল হল না। একসময় দুটি চোখেরই দৃষ্টি শক্তি হারালেন গিরিজি মহারাজ।
কলকাতা থেকে ফিরে গেলেন হরিদ্বারে। বাস করতে লাগলেন শান্ত সুন্দর আশ্রমিক পরিবেশে। এতটুকুও খেদ নেই অন্তরে। তখন অন্তর ও সর্বসত্তা তাঁর অন্তর্মুখীন। আত্মবিস্মৃত ভোলা দিবারাত্র নিমজ্জিত থাকেন ব্রহ্মানন্দে।
এই সময় এক তরুণ মাড়োয়াড়ি নিষ্ঠাবান সন্ন্যাসী ব্রতী হলেন ভোলানন্দের সেবায়। এঁর নামও ভোলাগিরি। প্রাণপাত সেবা করতেন সন্ন্যাসী আর সর্বদাই অন্তরে তীব্র বেদনা বোধ করতেন গুরুদেবের দৃষ্টিহীনতার জন্যে। এতে কিন্তু কোনও ভ্রুক্ষেপই ছিল না ভোলানন্দের। নির্বিকার নির্লিপ্ত ভোলানন্দ তবুও ভক্তদের ডেকে বলতেন, ‘আমি বুঝতে পারিনে, কেন তোমরা আমরা জন্য অন্তরে মর্মপীড়া ভোগ করছ? আমি কিন্তু পরমানন্দেই আছি। অন্ন এবং অন্য কোনও সেবা গ্রহণে আমার এতটুকুও অসুবিধে হয় না। আমার একান্ত আপন সেবানিষ্ঠ ভক্ত ভোলা তো সদা সর্বদাই তৎপর হয়ে রয়েছে আমারই সেবায়। পুত্রের চেয়েও বেশি ও আমার সেবা করে যাচ্ছে, অত চিন্তার কি আছে তোমাদের?’
জাগতিক সুখ দুঃখ, লাভক্ষতি, জীবনমৃত্যু সমস্ত কিছুই মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে নির্লিপ্ত এই মহাযোগীর কাছে। এসব তো মহাযোগীর অন্তরের বিষয়, ভক্ত শিষ্যরা তার তল পায় কোথায়? আশ্রমে তাঁদের অন্তরে গুরুদেবের এই দৃষ্টি হীনতার জন্য দুঃখক্ষোভের সীমা পরিসীমা নেই যে!
গুরুমহারাজ ভোলানন্দের জন্য একসময় অত্যন্ত শোকাকুল হলেন সেবাশিষ্য ভোলাগিরি। এর কিছুদিন পরেই দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন শিষ্য নিজে। তাঁর প্রাণরক্ষার জন্য সমস্ত সেবাযত্ন ও চিকিৎসা ব্যর্থ হল আশ্রমিকদের। অন্তিম শয্যায় শায়িত হলেন ভোলাগিরি তবুও তাঁর গুরুজির জন্য দুশ্চিন্তার আর অবধি রইল না। সখেদে বলতে থাকেন, ‘সব চাইতে বড় দুঃখ, আমার গুরুজির অন্ধত্ব মোচন হওয়াটা আর দেখতে পেলাম না। হে মহাদেব, হে আশুতোষ, হে শঙ্কা হরণকারী ভগবান শঙ্কর, তোমার কাছে আমার একটাই আকুল নিবেদন, তুমি করুণা করে ফিরিয়ে দাও তাঁর দৃষ্টিশক্তি, আমার দু-চোখের বদলে ফিরিয়ে আনো তাঁর চোখের আলো। তোমার চরণে আমার অশ্রুধারা দিয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাই করুণাময় প্রভু।’
এর অব্যবহিত পরেই প্রাণত্যাগ করলেন গুরুগতপ্রাণ ভোলাগিরি। গুরুজির রোগমুক্তির আকুল আকুতির মূর্ছনা যেন এর পরেও বারংবার আলোড়িত করে তোলে আশ্রমের আকাশ বাতাস, বহমান গঙ্গার জললহরীকে।
দিন কয়েক পরের কথা। লালতারাবাগের আশ্রমে ধ্যানমগ্ন ভোলানন্দ বসে আছেন আপন আসনে। হঠাৎ ভেসে আসে অপার্থিব এক আবেগমথিত মধুর কন্ঠস্বর। কে যেন বলেছেন, ‘ও ভোলা, একবার চেয়ে দ্যাখ, আমরা কে এসেছি?’
সম্বিৎ ফিরে আসে মুহুর্তে। ধ্যান বিজড়িত চোখ তুলতেই আনন্দ ও বিস্ময়ের আর অবধি রইল না। দেখলেন, দিব্য আলোয় আলোময় হয়ে গিয়েছে চারিদিক। তাঁরই সামনে আর্বিভূত হয়েছেন স্বয়ং হরপার্বতী। বরাভয় দানকারী হাতটি তুললেন আশুতোষ। আশীর্বাদ করলেন, ‘ভোলা, আজ থেকেই একটি চোখের দৃষ্টিলাভ করলি।’
পরমানন্দে মুহুর্তে দেহমন পুলকিত হয়ে উঠল গিরিমহারাজের। সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করলেন প্রাণের আরাধ্য হর-পার্বতীর সামনে। ধীরে ধীরে অদৃশ্য হল দিব্য যুগলমূর্তি। ভক্ত ভোলার প্রাণের আকুল প্রার্থনা মঞ্জুর হল। একটি চোখের দৃষ্টি ফিরে পেলেন আর এক ভোলা। লোকবিশ্বাস, ভোলানন্দ গিরি মহারাজের সেবায় ব্রতী হওয়া সন্ন্যাসী ভোলাগিরির আকুল প্রার্থনায় সাড়া দিয়েছিলেন হরিদ্বারে সদা জাগ্রত করুণাসাগর বিল্বকেশ্বর মহাদেব।
হরিদ্বারের পুণ্যতোয়া গঙ্গাতীরে লালতারাবাগের আশ্রমে সাধকপ্রবর তাঁর সাধন আসন বিছিয়ে বসেছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। এই আশ্রমেই আশুতোষের কৃপাধন্য আর এক আশুতোষ ভারতবরেণ্য মহাপুরুষ পরম পূজ্যপাদ ভোলানন্দগিরি মহারাজ ইহলীলা সম্বরণ করেন ১৯২৮ সালের ৮ মে, কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে। ধন্য গুরুর ধন্য চেলা। ধন্য ভোলা, ধন্য ভোলা, ধন্য ভোলা। — ছবি – শিবশংকর ভারতী
Somnath Bag
46/1/1,Brindaban Mullick Lane
Kadamtala Howrah 711101
Om Namah Shivay……
Harharmahadev