রাত তখন ১টা ৪০। ইসরোর বেঙ্গালুরু কন্ট্রোল রুম তখন টগবগ করে ফুটছে। আর কিছুক্ষণের অপেক্ষা। তারপর ইতিহাস। এতদিনের পরিশ্রম সফল হতে চলেছে। মিনিট সাতেক হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও হাজির হয়েছেন। কন্ট্রোল রুমের দোতলায় বসে কথা বলছেন বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। হাতে কাগজ। তাতেই লেখা বিক্রমের নামার খুঁটিনাটি। এক বর্ষীয়ান প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন প্রতিটি পদক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রী মন দিয়ে শুনছেন। মাঝে একবার হাত নেড়ে নিলেন স্কুলের পড়ুয়াদের দিকে চেয়ে। এদিকে ঠিক ১টা ৪০ মিনিটে বিক্রম শুরু করল তার শেষ ধাপ। চাঁদের মাটি থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে থাকা বিক্রম এবার ক্রমশ নামতে শুরু করল মাটির দিকে।
ইসরোর স্ক্রিনে স্পষ্ট ফুটে উঠছে একটি সবুজ ডট। যা ইঙ্গিত করছে ক্রমশ চাঁদের দিকে এগোচ্ছে বিক্রম। এবার ব্রেক কষার পালা। ক্রমশ বিক্রম চাঁদের দিকে এগোতে এগোতে তার ব্রেক কষতে লাগল। তার এক একটি ধাপ সম্পূর্ণ হতেই করতালিতে ফেটে পড়তে লাগল ইসরো। কথা ছিল বিক্রম একদম চাঁদের কাছে পৌঁছে তার গতি প্রায় শূন্যতে নামিয়ে আনবে। তারপর লেজার দিয়ে স্থির করবে কোথায় নামবে। ১২ ডিগ্রি পর্যন্ত ঢালে নামতে সক্ষম বিক্রম তার চেয়ে বেশি ঢালে নামতে গেলে উল্টে যেতে পারে, যাকে সোজা করার কোনও উপায় নেই। তাই পুরোটাই ব্যর্থ হবে। ফলে ইসরো ঠিক করেছিল বিক্রম নিজেই ঠিক করবে কোথায় নামবে। যদি তাদের শেষ মুহুর্তে কোনও তথ্য পাঠাতেই হত তাহলে তা ইসরো পাঠিয়ে দিত নামা নিয়ে।
তখন আর দেড় মিনিট বাকি। কার্যত রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। মধ্যরাতে গোটা দেশ তাকিয়ে টিভির পর্দায়। ইতিহাসের সাক্ষী হতে তৈরি সকলেই। সেই সময় দেখা যায় ইসরোর কন্ট্রোলরুমে দাঁড়িয়ে পড়েছেন অনেকে। তবে কী উত্তেজনা ধরে রাখতে না পেরে দাঁড়িয়ে পড়লেন সকলে। দেখা গেল ইসরোর চেয়ারম্যান কে শিবনও কথাবার্তা বলছেন। এটা তো কথা বলার সময় নয়! তবে কী ঠিক কোন জায়গায় বিক্রমকে নামানো যায় তা নিয়েই কথা হচ্ছে। কিছুই পরিস্কার হচ্ছিল না। সময় কিন্তু গড়িয়ে যেতে থাকে দেড় মিনিট পার করেও আরও প্রায় মিনিট দশেক কাটার পর শিবন দোতলায় উঠে আসেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। প্রধানমন্ত্রীকে কিছু বুঝিয়ে বলেন। তারপরই দেখা যায় প্রধানমন্ত্রী বেরিয়ে গেলেন ইসরো ছেড়ে। মন মানতে না চাইলেও ইঙ্গিতটা তখনই পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল। বিক্রমের ল্যান্ডিং হয়তো বিফল হল!
যে ভয়টার কথা বারবার বিজ্ঞানীরা বলছিলেন যে এই ল্যান্ডিংটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অন্য গ্রহে বা উপগ্রহে যান নামাতে গিয়ে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রেই ল্যান্ডার ঠিকঠাক নামতে পারেনি। মিশন শেষ হয়ে গেছে। রাতে দীর্ঘক্ষণ দেখা যায় বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। মুখে প্রবল উদ্বেগ। অবশেষে চেয়ারম্যান আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেন বিক্রমের সঙ্গে ইসরোর সবরকম সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাকে আর পাওয়া যাচ্ছেনা। তাহলে কী হল বিক্রমের? এখন যে চন্দ্রযান-২ অরবিটার চাঁদের কক্ষে ঘুরছে তার কাছ থেকে তথ্য বা ছবি নিয়ে খোঁজ হবে বিক্রমের। মিশনের কী তবে এখানেই ইতি? অনেকে মনে করছেন হয়তো তাই। গত এপ্রিলেই এভাবে ল্যান্ডিংয়ের আগে শেষ হয়েছে ইজরায়েলের যান। এবার ভারতের বিক্রম হারিয়ে গেল চাঁদের একদম কাছে পৌঁছে। — সংবাদ সংস্থার সাহায্য নিয়ে লেখা