Feature

কালীঘাটের সঙ্গে রয়েছে চড়কের নিবিড় যোগ, প্রায় ২০০ বছরের অজানা ঘটনা

বাদ্যযন্ত্র, অশ্লীল সঙ, সঙ্গীত, অভিনয় আর যথেষ্ট নানান ধরণের অঙ্গ ভঙ্গী। কালীঘটে বাণ ফুঁড়ে গাজনের দল বেরিয়ে পড়ত শহরের পথে পথে।

সেকালে চড়ক উৎসবের গোটা উৎসবটাই শুরু হত কালীঘাটে। কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের গাজন সন্ন্যাসীরা ভোরবেলায় চলে যেতেন কালীস্থানে। এদের সঙ্গে থাকত বাদ্যযন্ত্র, অশ্লীল সঙ, সঙ্গীত, অভিনয় আর যথেষ্ট নানান ধরণের অঙ্গ ভঙ্গী। কালীঘটে বাণ ফুঁড়ে গাজনের দল বেরিয়ে পড়ত শহরের পথে পথে। মোটের উপর এই উৎসবের প্রাণকেন্দ্রই ছিল কালীঘাট।

অতীতের কালীঘাটে কেমন হত গাজন সন্ন্যাসীদের চড়ক উৎসব? আজ থেকে প্রায় ১৮৪ বছর আগে কথা। শহর কলকাতায় শ্রীমতী ফ্যানি পার্কস এসেছিলেন ১৮২২ সালের নভেম্বর মাসে। ইংল্যান্ড থেকে দেশভ্রমণে বেরিয়ে নানা দেশ ঘুরে শেষে এসেছিলেন ভারতবর্ষে। তখন এদেশে ইংরেজদের প্রথম ও প্রধান দর্শনীয় আকর্ষক স্থান ছিল কলকাতা। ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে প্রসিদ্ধ গবেষক বিনয় ঘোষ লিখেছেন ফ্যানির অভিজ্ঞতার টইটম্বুর ভ্রমণ বৃত্তান্ত-এ (১৮২২-১৮২৮) কালীঘাটে চড়ক উৎসবে গাজন সন্ন্যাসীদের বিভৎস ও যন্ত্রণাদায়ক বর্ণনার কথা। এক জায়গায় ফ্যানি লিখেছেন –


“চড়ক পূজা।। একদিন ঠিক করলাম (চৈত্রসংক্রান্তির দিন) কালীঘাটে মন্দির ও জাগ্রত কালী দর্শন করতে যেতে হবে। চৌরঙ্গি থেকে প্রায় মাইল দেড়েক দক্ষিণে কালীঘাটের কালীমন্দির। ঘোড়াগাড়ি করে কালীঘাট যাত্রা করলাম সন্ধ্যাবেলা। পথে এক দৃশ্য দেখলাম, উৎসবের দৃশ্য অবিস্মরণীয়। দেখলাম হাজার হাজার লোক রাস্তায় ভিড় করে রয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিসের ভিড়’? শুনলাম, চড়ক পূজার উৎসব হচ্ছে। দীর্ঘ একটা কাষ্ঠদন্ডের মাথায় হুকবিদ্ধ হয়ে ঘুরপাক খাওয়া চড়ক পূজার প্রধান বৈশিষ্ট্য। কতরকমের লোক যে কত বিচিত্র বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে জড়ো হয়েছে সেখানে তার ঠিক নেই। তার মধ্যে সর্বপ্রথম স্বচক্ষে দেখলাম এদেশের বৈরাগী সাধুদের। সর্বাঙ্গে তাদের ভস্ম মাখা, মাথায় লম্বা লম্বা জটা, পরনে একটুকরো কাপড় জড়ানো, প্রায়-নগ্ন বলা চলে। একজন বৈরাগী তার শীর্ণ হাত দুটি মাথার উপর তুলে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে রয়েছে, অসাড় হয়ে গেছে হাত ও দেহ, পাখির মতোন আঙুলের ধারালো লম্বা লম্বা নখগুলি হাতের পিছন থেকে বিঁধে ফুঁড়ে বেড়িয়েছে ভিতরের তেলো দিয়ে। ভগবান বিষ্ণুর কাছে মানতের জন্য সে এই ভয়ংকর ক্লেশ স্বীকার করছে। নখগুলি প্রথমে বিদ্ধ হবার যন্ত্রণা হয় নিশ্চয়, কিন্তু পরে হাত অসাড় হয়ে গেলে আর কোন যন্ত্রণা থাকে না। এই শ্রেণীর আত্মপীড়নদক্ষ সাধুকে সকলে খুব পূণ্যবান মনে করে, কারণ ভগবানের পরম প্রিয়পাত্র না হলে এরকম কষ্টস্বীকার করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দেখলাম সকলে ভক্তি-গদগদচিত্তে তার সাধুত্বের তারিফ করছে খুব।

Charak Puja
সেকালের কালীঘাটে চড়ক উৎসব, ছবি – বিনয় ঘোষ

আরও কয়েকজন সাধু মাথার উপরে একহাত তুলে চক্ষু উলটে বসেছিল। একদল নীচজাতের হিন্দু বাহুর মাংসপেশী এফোঁড়-ওফোঁড় ছিদ্র করে তার ভিতর দিয়ে বাঁশের লাঠি ও নৌকাশলাকা পুরে ঢোলের বাজনার তালে তালে বীভৎস ভঙ্গিতে তাণ্ডবনৃত্য করছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ লৌহশলাকা দিয়ে জিব ফুঁড়ে বাহাদুরি দেখাচ্ছিল জনতার কাছে। কয়েকগজ দূরে তিনটি বড় বড় কাঠের খুঁটি মাটিতে পোঁতা ছিল। প্রায় তিরিশ ফুট লম্বা এক-একটি খুঁটি, তার মাথায় আড়ে একটি বা দুটি করে বাঁশ বাঁধা। যে খুঁটির মাথায় একটি বাঁশ বাঁধা তার একদিকে একটি লোক ঝুলে রয়েছে,আর একদিকের লম্বা দড়ি ধরে নিচের লোকজন খুঁটির চারিদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে এবং উপরে ঝুলন্ত লোকটিও তার ফলে ঘুরছে বন্ বন্ করে। যে-খুঁটির মাথায় দু’টি বাঁশ ক্রস করে বাঁধা আছে তাতে আরও বেশি লোক ঘুরছে। আশ্চর্য ব্যাপার হল, উপরের লোকগুলি হুকবিদ্ধ হয়ে ঝুলছে ও ঘুরছে, এবং তাদের বুকে ও পিঠে সেই হুকগুলি বিঁধে রয়েছে। উপরের লোকটি খুঁটির মাথায়, বাঁশের ডগায় ঘুরছে তো ঘুরছেই, আর নিচের লোকজন উন্মত্তের মতন তাদের পাক দিচ্ছে তো দিচ্ছেই। ঘোরার শেষ নেই, পাকেরও শেষ নেই। উপরে ঘুরছে যারা তারা বোধ হয় বেশি পুণ্যবান, কারণ একটি থলি ভর্তি করে ফুল-বাতাসা নিয়ে উপর থেকে তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং নিচের লোকজন মহাউল্লাসে সেগুলি কুড়িয়ে নিচ্ছে দেবতার প্রসাদের মতন। কেউ কেউ বুকেপিঠে কাপড় না জড়িয়েই হুকবিদ্ধ হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল। প্রচুর পরিমানে নেশা করে, গাঁজা-আফিম খেয়ে তাদের তাদের চোখেমুখের চেহারা পিশাচের মতন ভয়ংকর দেখাচ্ছিল।


নীচজাতের হিন্দুরা শুনেছি চড়কপূজার অত্যন্ত ভক্ত। পূজা-উৎসবে যোগদানকারীদের মধ্যে তাদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এরকম একটা পৈশাচিক ভয়াবহ উৎসব আর কোথাও দেখিনি। এই ধরনের উৎসবে দুর্ঘটনা ঘটাও স্বাভাবিক। চড়কপূজায় শতকরা তিন-চারজন মারাও লোক মারাও যায়। ধনীলোকেরা টাকাপয়সা দিয়ে গাজনের সন্ন্যাসীদের চড়কপাঠে চরকিপাক খাওয়ান পুণ্যার্জনের জন্য। এইভাবে প্রকসি দিয়েও নাকি পুণ্যলাভ করা যায়।

উৎসবে ছ্যাকরা গাড়ি ভর্তি হয়ে বাইজীরাও এসেছিল অনেক। যেমন তাদের পোশাক তেমনি নাচ-গানের ভঙ্গি। যাঁর রুচি আছে তাঁর পক্ষে বরদাস্ত করা কঠিন। কিন্তু এই বাইজীনাচ দেখার জন্য বহু হিন্দু ভদ্রলোকের ভিড় হয়েছিল উৎসবে।”

১৮৩৩ সালের ২৭ এপ্রিল ‘জ্ঞানাণ্বেষণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল চিৎপুরের রাস্তায় ঢাকের মহাশব্দের সঙ্গে বেরোনো বিশাল গাজনের সঙ-এর কথা। তবে দুর্নীতিগ্রস্ত লোকেদের ঠাট্টা তামাসা, প্রশাসনিক ও পুরসংস্থা প্রভৃতির দুর্নীতি, ধর্মীয় ও শিক্ষাজগতের অনাচার ইত্যাদিকে ভিত্তি করে বিচিত্র সমারোহে পরিকল্পিত নানান ধরণের গান বেঁধে গাইত উচ্চস্বরে। অধিকাংশ গানগুলি ছিল রীতিমতো অশ্রাব্য, অশ্লীল। এ ছাড়াও অতিরিক্ত মদ্যপান, শারীরিক পীড়ন ইত্যাদি বিষয়গুলি জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে থাকে, এমনটা ভেবেই হয়তো প্রতিবছর কালীঘাট থেকে বাণ ফুঁড়ে আসা সঙ ও সন্ন্যাসীদের উদ্দেশে “পোলিসের সুপারিটেন্ডেন্ট এফ ডবলিউ বর্ট, ৩ আপ্রিল ১৮৩৯, ২৫ চৈত্র ১২৪৫”, পথ পরিবর্তনের নির্দেশ ঘোষণা করেন এবং ৬ এপ্রিল ১৮৩৯সালে একটি বিজ্ঞাপনও দেন সংবাদপত্রে –

“বিজ্ঞাপন। সম্বাদ দেওয়া যাইতেছে যে চড়ক পূজা সময় কাঁলীঘাট হইতে যে সন্ন্যাসিরা শহরের মধ্যে দিয়া আসিত তাহারা পূর্ব্ব ২ বৎসরের ন্যায় বর্ত্তমান বৎসরে চৌরঙ্গী ও কসাই টোলার রাস্তা দিয়া আসিতে পারিবে না কিন্তু ভবানীপুর হইতে শহরের মধ্যে আইলে ভবানীপুর হইতে সারকিউলর রোড অর্থাৎ বাহির রাস্তা দিয়া নং ৯ সেদয়ার ফাঁড়ি অর্থাৎ মুনসির বাজার এবং ৮ অর্থাৎ রাজা রামলোচনের বাজার গিয়া গমনপূর্ব্বক চিৎপুর পর্যন্ত্য পঁহুছিবেক তথায় পঁহুছিয়া তাহারা উত্তর দিগে স্ব২ বাটীতে চলিয়া যাইবে।”

মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহের (১৮৪০-১৮৭০) জন্মের অনেক আগেই চড়কপুজোর কদর্যতা নিয়ে সমকালীন পত্রিকাতে কিছু লেখালিখি হলেও এতটুকও হেলদোল হয়নি চড়কিদের প্রচলিত ধর্মাচরণে, প্রশাসনের প্রচেষ্টায়। এই উৎসবের উৎসটা যে সেকালের কালীঘাট ছিল তার প্রমাণ তো সিংহীমশাই-এর ‘হুতোম প্যাঁচার নকসা’ –

…”ক্রমে গির্জ্জের ঘড়িতে ঢং ঢং করে সাতটা বেজে গ্যাল। সহরে কানপাতা ভার। রাস্তায় লোকারণ্য, চারদিকে ঢাকের বাদ্যি, ধুনোর ধো, আর মদের দুর্গন্ধ। সন্ন্যাসীরা বাণ, দশলকি, সুতোশোন, সাপ, ছিপ ও বাঁশ ফুঁড়ে একেবারে মরিয়া হয়ে নাচতে নাচতে কালীঘাট থেকে আসচে।”…

১৮৬৩ মতান্তরে ১৮৬৫ সালের কথা। ছোটলাট বিডন রোধ করলেন এই নাটকীয় প্রথা। এক ইস্তহার জারি করে চড়কের প্রচলিত প্রথা ও মিছিল আইন অনুসারে দণ্ডনীয় বলে ঘোষণা করলেন তিনি। সেই থেকে গাজন সন্ন্যাসীরা চড়কগাছে পাক খেত পিঠে গামছা বেঁধে, কাঁটা ফুঁড়ে নয়। একইসঙ্গে এই উৎসবের মূলকেন্দ্র কালীঘাট ও ভৈরব নকুলেশ্বর মহাদেব মন্দির মুক্ত হল অমানবিক এক নারকীয় প্রথা থেকে। — ছবি – সংগৃহীত

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button