Festive Mood

চড়ক কি, পালনের নিয়ম কি, চড়ক পালনের মাহাত্ম্যকথা

কৃষি প্রধান বাংলায় একমাস ধরে নিজ গোত্র ত্যাগ করে শিবের গোত্র নিয়ে কঠোর অনুশাসনে সন্ন্যাস ধর্ম পালন করেন মানুষজন। একমাসের সন্ন্যাস চড়কে ঘোরার পর পয়লা বৈশাখে শেষ হয়। চৈত্রসংক্রান্তির আগে ৫ দিন চলে শিবের পুজো। নীলষষ্ঠীর দিন শিব-পার্বতীর বিয়ে হয়।

ছাতুবাবু বাজারের চড়কের মাহাত্ম্যই আলাদা। এখনও এখানে চিরাচরিত রীতি মেনে বাজারের মধ্যের বিশাল প্রাঙ্গণ কয়েকদিন আগেই ফাঁকা করা হয়। বিডন স্ট্রিট দিয়ে বাজারে ঢুকলে গেট পার করলেই এই খোলা জায়গাটা নজর কাড়ে। চৈত্রসংক্রান্তির একদিন আগে অর্থাৎ নীলষষ্ঠীর দিন সন্ধেয় চিরাচরিত প্রথা মেনে পাতিপুকুরের দেব বংশের পুকুর থেকে তুলে আনা চড়কগাছ চত্বরের মাঝ বরাবর মাটিতে পোঁতা হয়।

এটি আদপে একটি খাড়া গাছের গুঁড়ি। কালো গুঁড়ি। ডালপালা, মূল-শেকড় বাদ। সুউচ্চ সেই চড়ক গাছের মাথায় থাকে ‘চরকি’। চরকির মাথায় শিবজ্ঞানে দুটি লাল পতাকা ওড়ানো হয়। চরকির সঙ্গে ‘মোচা’ থাকে। মোচা মানে মাটির সঙ্গে প্রায় সমান্তরালভাবে লাগানো বাঁশের গুচ্ছ। সেই বাঁশের গোছার একদিকে ঝোলে পাটের দড়ি। যা চড়ক ঘোরার সময় বাঁধা থাকে সন্ন্যাসীর পিঠে লাগানো লোহার আঁকশিতে। অন্যপ্রান্তের মুখ থেকে ঝোলে একটি মোটা শক্তপোক্ত নাইলনের দড়ি। যা নেমে আসে একদম নিচে। দড়ির ঝুলে আসা প্রান্তটি বাঁধা থাকে চড়ক গাছের নিচের দিকে লাগানো বাঁশের গোছায়। সেটাই হ্যান্ডেলের মত কাজ করে। যা চড়ক গাছের অন্য প্রান্তে ঝুলতে থাকা সন্ন্যাসীকে ঘোরাতে সাহায্য করে।


নিচ থেকে বেশ কয়েকজন যুবক যাঁদের ‘ড্যাং’ বলা হয়, বাঁশের সেই হ্যান্ডেল ধরে ডান দিক থেকে বাম দিকে ঘুরতে থাকেন। সেই ঘোরার গতি যত বাড়ে, ঝুলতে থাকা সন্ন্যাসী ততই জোরে শূন্যে পাক খেতে থাকেন। চড়ক গাছে সন্ন্যাসীকে ঘোরানোর আগে লোহার মোটা আঁকশি আর গামছা বা দড়ি দিয়ে ভাল করে তাঁকে বাঁধা হয়। পিঠে সেই বন্ধনেরও একটা বিশেষ ধরণ আছে। যাতে জোরে ওপরে পাক দিলেও কোনওভাবে তিনি নিচে না পড়ে যান। এ কাজের দায়িত্বে থাকেন ‘ওয়ালী’। কার্যত ওয়ালীই নীলষষ্ঠী থেকে বাসি চড়ক পর্যন্ত এই চড়ক ঘোরানোর সব দায়িত্বে থাকেন।

১২ জন সন্ন্যাসীকে নিয়ে হয় এই চড়ক। যারমধ্যে রামবাগানের ৭ জন ও ছাতুবাবু বাজারের ৫ জন সন্ন্যাসী থাকেন। আসলে চৈত্র এমন মাস যে সময় বাংলায় চাষাবাদ তেমন হয়না। ফলে কৃষি প্রধান বাংলায় একমাস ধরে নিজ গোত্র ত্যাগ করে শিবের গোত্র নিয়ে কঠোর অনুশাসনে সন্ন্যাস ধর্ম পালন করেন মানুষজন। নিজের সংসারের সঙ্গে তাঁদের কোনও সংস্পর্শ থাকেনা। সাংসারিক কোনও কাজ তাঁরা করতে পারেননা। এই একমাসের সন্ন্যাস চড়কে ঘোরার পর পয়লা বৈশাখে শেষ হয়। চৈত্রসংক্রান্তির আগে ৫ দিন চলে শিবের পুজো। নীলষষ্ঠীর দিন শিব-পার্বতীর বিয়ে হয়। সেদিনই সন্ধেয় বসানো হয় চড়কগাছ। প্রসঙ্গত আগে ভবানীপুরের পদ্মপুকুরে, খিদিরপুরের ভূকৈলাসের রাজবাড়িতে চড়ক হত। কিন্তু এখন সেসব ইতিহাস। কলকাতায় এখনও মাথা উঁচু করে পুরাতনী পরম্পরাকে বুকে আঁকড়ে সগৌরবে বেঁচে আছে ছাতুবাবু বাজারের চড়ক।


Charak Puja

ছাতুবাবু বাজারের চড়কের প্রারম্ভ রামদুলাল দে সরকারের হাত ধরে। শোনা যায় ব্যবসায়ী রামদুলালের দ্বিতীয় পত্নি নারায়ণীর বাড়িতে চড়ক পুজো হত। বাগবাজারের সেই বিখ্যাত ষোল চরকি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রামদুলাল দে সরকার তা অব্যাহত রাখতে উদ্যোগী হন। নতুন বাজারের উল্টোদিকের বিশাল মাঠ যা এখন রবীন্দ্র কানন নামে পরিচিত তা একসময়ে কোম্পানি বাগান বলে পরিচিত ছিল। সেখানেই এই চড়ক শুরু করেন তিনি। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই ইংরাজরা সেখানে পাল্কী স্ট্যান্ড বানানোয় সেখান থেকেও সরতে হয় চড়ক পুজোকে। তখন রামদুলাল দে সরকার তাঁদেরই জমি বিডন স্ট্রিটের এই মাঠে চড়ক পুজোর ঘোরা শুরু করেন। ১৭৮০ সাল থেকে রামদুলাল দে সরকারের এই চড়ক চলে আসছে ছাতুবাবু বাজারের এই মাঠে। কখনও কোনও কারণে থামতে হয়নি এই পরম্পরাকে। ২৩৮ বছর পার করে এখনও অমলিন এই চড়ক উৎসব।

চৈত্রসংক্রান্তির বিকেলে সন্ন্যাসীর চড়ক গাছে ঘোরা দেখতে দূরদূরান্ত থেকে এখনও মানুষ ভিড় জমান। চত্বরের চারপাশ ঘিরে বাজারের একতলা ঘরগুলোর ছাদে তখন মিডিয়ার ভিড়। মুভি ক্যামেরা থেকে স্টিল ক্যামেরা। ছবি উঠতে থাকে নিরন্তর। সার্কাসের ট্রাপিজের খেলা ‌যাঁরা দেখান তাঁরা রীতিমত বিষয়টিতে তালিম নেন। নৈপুণ্য আনতে বছরভর অনুশীলন করে ভুল-ত্রুটি শুধরে নেন। কিন্তু শিবের পুজো করে একমাসের সন্ন্যাস জীবন কাটানোর পর আচমকাই এমন এক ভয়ানক আকাশপাক নেহাত মুখের কথা নয়। কিন্তু একমাসের কঠোর সন্ন্যাসধর্ম পালনের পর তাঁরা নির্বিকার ভাবেই পাক দেন চড়ক গাছে। কোনও সংকোচ, ভয় ছাড়া। শুধু পাক দেওয়াই নয়, শূন্য থেকে ছুঁড়তে থাকেন উচ্ছে-পটল থেকে আপেল-কলা, বাতাসা-নকুলদানা থেকে নানা ধরণের মিষ্টি। গেরুয়া বসনের সন্ন্যাসীরা এক মাসের সন্ন্যাসধর্ম শেষে চড়ক গাছে ঘোরাকে পবিত্র ও আবশ্যিক বলে বিশ্বাস করেন। না হলে তো সন্ন্যাসই অপূর্ণ! তাঁদের এই পুণ্য পাকে কাঁধে ঝোলানো থাকে একটি ঝোলা। আর তাতেই থাকে বিভিন্ন আনাজ, ফল, মিষ্টি।

পাক খাওয়ার সময় তাঁদের ছোঁড়া সেইসব আনাজ, ফল, মিষ্টিকে প্রসাদ হিসাবেই গ্রহণ করেন নিচে দাঁড়ান অগণিত দর্শনার্থী। সূর্য ডুবলে শেষ হয় চড়ক পাকও। চড়ক গাছের নিচে বেঁধে দেওয়া হয় রশি। বহু মানুষ সেই অস্থায়ী চড়ক গাছে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করেন। ধূপ, বাতি দিয়ে পুজো করেন। যদিও ছাতুবাবু বাজারের চড়কে ‘বাসি পাক’ হয়। এটাই পরম্পরা। ‘বাসি পাক’ হল পরদিন সকালে পাক খাওয়া। সংক্রান্তির দিন ঘোরেন ৯ জন সন্ন্যাসী। যারমধ্যে ১ জন ‘ওয়ালী’ মনোনীত সন্ন্যাসী থাকেন। পরদিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের সকালে ঘোরেন ৪ জন সন্ন্যাসী সহ ওয়ালী মনোনীত একজন। অর্থাৎ ৫ জন সন্ন্যাসী। ফলে সংক্রান্তির দিন বিকেলে চড়কপাক কোনও কারণে দেখা না হলেও পরদিন সকালে সঠিক সময়ে হাজির হলে এই পাক দেখার সৌভাগ্য হয়।

বিডন স্ট্রিটের এই শতাব্দী প্রাচীন চড়কের আরও এক আকর্ষণ চড়ক মেলা। বিডন স্ট্রিটের রাস্তার ওপর সারি দিয়ে বসে নানা পসরা। মেলা বিডন স্ট্রিট-সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ক্রসিং থেকে শুরু হয়। শেষ হয় হেদুয়া মোড়ে। চড়কের দুপুর থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত এ রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। অগণিত মানুষের ভিড় জমে মেলাকে কেন্দ্র করে। সন্ধে নামলে জ্বলে ওঠে আলো। সারা বছর যে রাস্তার আলোআঁধারি পেরিয়ে বাস, গাড়ি ছুটে চলে গন্তব্যে, এদিন সেই রাস্তাই বধূর বেশে সেজে ওঠে হাজারো দোকানের ঝলমলে আলোতে। মানুষের ভিড় ক্রমশ বাড়তে থাকে, বাঁশি, ভেঁপু, সাবান জলের বল থেকে মানুষের কোলাহলে বদলে যায় গোটা পরিবেশ। চেহারা নেয় এক মিলনোৎসবের।

বিডন স্ট্রিটের চড়কের মেলার বৈশিষ্ট্য কিন্তু নজরকাড়া। এখনও এখানে সামান্য অর্থে নানা রকমের খেলনা পাওয়া যায়। পাওয়া যায় মাটির পুতুল, মাটির ফল-আনাজ, মাটির পাখি। বাচ্চাদের মন ভোলানো মাটির খেলনাবাটির সরঞ্জাম, মাথা নাড়া বুড়ো। চিনে খেলনার রমরমা বাজারে প্রায় হারাতে বসা কাঠের খেলনাও কিন্তু এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ। কাঁচা কাঠের রেলগাড়ি, বাস আরও কত কি! কত হারিয়ে যেতে বসা খেলনা এই মেলায় দেদার বিক্রি হয়। এছাড়া মানুষের ঘরের কাজে লাগে এমন বহু জিনিস, যেমন চাকি-বেলুন, কাঠের বা লোহার হাতা-খুন্তি, বঁটি, কাটারি, নারকেল কুড়ুনি, হামান দিস্তা। আছে প্লাস্টিকের টুকিটাকি নানা ঘরোয়া জিনিস।

এ মেলায় ভিড় জমান সাধারণ মানুষজন। যাঁদের রোজগার বিশাল কিছু নয়। মূলত সেই সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে বিক্রয়যোগ্য জিনিসই এই মেলার প্রধান পসরা। যা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে কাজে আসে, ঘরের ছোট ছোট ছেলেমেয়ের মুখে হাসি ফোটায়। বাবা-মায়ের কিনে দেওয়া ছোট্ট একটা খেলনা একটা শিশুর মুখে কতটা হাসি ফোটাতে পারে তা এই মেলায় না এলে বোঝা যায়না। সেইসঙ্গে মেলা জুড়ে মিলবে লক্ষ্মী-গণেশের জোড়া পিস। পয়লা বৈশাখের সকালে হালখাতা পুজোর দেওয়ার সময় পুজোর ঝুড়িতে মাটির লক্ষ্মী-গণেশ আবশ্যিক। ফলে ব্যবসায়ী মহলে তার চাহিদাও বিশাল।

সেকথা মাথায় রেখে চৈত্রসংক্রান্তিতে কংক্রিটের রাস্তায় বসা এই মেঠো মেলায় লক্ষ্মী-গণেশের পসরা প্রচুর। তবে সব পসরা তো এভাবে লিখে বোঝান যায়না। তা জানতে মেলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত একবার চষে ফেলা সবচেয়ে ভাল। অল্প খরচে কত কিছু যে মানুষের মন জয় করতে পারে তার এক নির্ভেজাল প্রদর্শনীর নাম বোধহয় শহরের বুকে বসা এই বিডন স্ট্রিটের চড়ক মেলা। যেখানে বাঙালির হ্যাপি নিউ ইয়ার হয় রাতজাগা এক আনন্দ‌যজ্ঞে।

গাঁ-গঞ্জে মেলার চল নতুন নয়। আগেও ছিল। এখনও আছে। কিন্তু কলকাতার মত শহরে সারারাত জুড়ে এমন এক মেলা যে বসতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সারারাত ধরে চলে কেনাকাটা। রাত যত বাড়ে এ মেলায় ভিড় তত বাড়ে। সঙ্গে থাকে টুকটাক খাবার দোকান। পয়লা বৈশাখের সকালেও এ মেলায় বিকিকিনি চলে পুরোদমে। বেলা বাড়ে। শহর মাতে পয়লা বৈশাখের আনন্দে। বিডন স্ট্রিটে তখন ভাঙা হাটের নীরবতা। লাভের কড়ি পকেটে পুরে বেঁচে যাওয়া পসরা গুটিয়ে একে একে বিক্রেতারা যে যার ঘরের পানে পা বাড়ান। ফাঁকা হতে থাকে বিডন স্ট্রিট। থামে কোলাহল। ফিরে আসে আর পাঁচটা দিনের বিকেল। যে বিকেলে আর চড়ক ঘোরে না। মানুষের পায়ে পায়ে ঢাকা পড়েনা বাজার চত্বর। সন্ধে নামার কালে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে একাকী নিঃসঙ্গ চড়কগাছ। আগামী বছরের অপেক্ষায়।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button