যেদিকে দৃষ্টি মেলা যায়, বাহারি উজ্জ্বল রঙের ঝিকিমিকিতে চোখের তারা ওঠে ঝলমলিয়ে। মনে হয়, আকাশের তারা বুঝি মিতালি পাতাতে নেমে এসেছে মর্ত্যের বুকে। শহরটা যখন সবুজহীনতার কঠিন অসুখে ধুঁকছে, তখন মাটির বুকে সবুজ পাইনের ঝড় দেখে মনে পড়ে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথা, ‘তাই বলি গাছ তুলে আনো, বাগানে বসাও আমি দেখি’।
বড়দিনের মরসুমে সত্যি দুচোখ ভরে আলো রং আর সবুজ মাখতে পারবেন আপনিও। হোক না সে সব কৃত্রিম। তবু সে সব কিছুই তো বাঙালির প্রাণের উৎসব বড়দিনের জন্য। সেই উৎসবের আমেজ চেখে দেখতে একবার ঢুঁ মারতেই হবে ক্রিসমাস পসরার চাঁদের হাটে। চেনা নিউ মার্কেটের অন্দরমহলে।
আমিনিয়া রেস্তোরাঁ থেকে একটু এগিয়ে গেলেই ডান হাতে চোখে পড়ে লাল রঙের ঐতিহ্যবাহী হগ মার্কেট। প্রতিবারের মতো এবারেও মার্কেটে ঢোকার মুখ থেকেই বসে গেছে বড়দিনকে সাজিয়ে তোলার রকমারি অলংকারের বিপণি। সস্তায় ক্রিসমাসের বিশাল সম্ভার পেতে হলে কেকের মিষ্টি সুবাস গায়ে মেখে ঢুকে পড়া যায় বাজারের একেবারে পেটের ভিতরে বসা ‘গোল বাজারে’। ১-৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত উৎসবমুখর ক্রেতার পথ চেয়ে বসে সেখানকার পসারিরা। ক্রিসমাস আর নববর্ষ একেবারে দোরগোড়ায়। তাই সাধারণ মানুষের মতই সাজ সাজ রব দোকানগুলিতে। একবার যদি কোনও দোকানে নিজেকে ভিড়িয়ে দেওয়া যায়, নিশ্চিত, হাত খালি করে বাড়িমুখো হতে ইচ্ছা করবে না। সান্তাবুড়োর ঝোলায় থাকা উপহারের মতই নানা আকারের নানা দামের নানা সাজের উপকরণ ভরিয়ে রেখেছে দোকানগুলিকে।
একটা প্যাকেটের ভিতর একসঙ্গে হাসিমুখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সান্টাক্লজের পুতুলগুলোকে দেখলেই মুঠোবন্দি করার সাধ জাগে মনে। আর আছে সান্তাদাদুর ছড়ি, সান্টাক্লজের মুখোশ। নানা রঙের বল, কাগুজে নক্ষত্র, সোনালি ঘণ্টা, রঙিন মোমবাতি, লজেন্স, জুজলসহ আরও কত কি একই ছাদের নিচে আলো মাখামাখি হয়ে বসে ক্রেতার অপেক্ষায়। সব কিছুর দাম সাধ্যের মধ্যে, ২০-৩০ টাকা থেকে শুরু করে আকার ও উপকরণের সংখ্যা ভেদে তার দাম ১০০০ টাকা পর্যন্ত ছুঁয়েছে। এছাড়া আছে বড়দিনের মেজাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ঘর সাজানোর উপকরণ শোলার চিকচিকে বড় ঘণ্টা, দেওয়ালে টাঙানোর স্টিকার, দরজার মুখে বসানোর ‘রিত’, রোলেক্সের কাগজের লম্বা টেনসিল, আলোকিত ক্রিসমাস ট্রি, গাছ-বাড়ি, স্ট্রিমারস ও অন্যান্য। তবে এবারে এসব কিছুর থেকে বিক্রেতাদের কাছে ক্রেতার বেশি দাবি ‘স্নো ম্যান’-কে নিয়ে। সান্তাদাদুকে জনপ্রিয়তায় তুষার মানব যে বেশ টক্কর দিচ্ছে তা স্বীকার করলেন দোকানি লিয়াও হেলেনও। তবে এত সব আয়োজনের মধ্যেও কোথাও যেন মন খারাপের সানাইয়ে বিষণ্ণতার সুর বড়দিনের বড় বাজারে।
১৯৭৮ সাল থেকে ব্যবসা করে আসা বিক্রেতাদের সামনে এই বছরের মতো দুর্দিন আর আসেনি বলে আক্ষেপ তাঁদের। নোট বাতিল, জিএসটি আর ২০০০ টাকা নোট ছাপানো বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় বিক্রিবাটা যে একেবারে তলানিতে ঠেকেছে সে বিষয়ে একমত সকলেই। গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে শপিং মল আর অনলাইনের বাড়বাড়ন্ত আর ছাড় দেওয়ার হিড়িক যে তাঁদের ব্যবসায় শনির দশা এনে ফেলেছে তা নিয়ে ব্যবসায়ীদের আক্ষেপের যেন শেষ নেই। সান্টাক্লজের কৃপাদৃষ্টি এবার তাঁদের উপরেও পড়ুক, বড়দিনের একমাত্র আশা দোকানি নেহা পরভিনেরও। একদিকে পার্ক স্ট্রিট চত্বর বড়দিনের আলোয় হয়ে উঠুক মুখরিত। আরেকদিক অন্যের ঘর সাজানোর আলোর কারবারিদের মনের অন্ধকার দূর হোক। এই আবেদনটাই পৌঁছক বড়দিনের সবপেয়েছির কারিগর সান্টাক্লজের কাছে।