বাঙালির বহুদিনের প্রথা হল প্রদীপের উজ্জ্বল দীপশিখায় কালীপুজোর উৎসবে মেতে ওঠা। সে রীতিতে বদল ঘটেনি, বদলেছে আদল। কালীপুজো ও দীপাবলি উপলক্ষে দোকান জুড়ে এখন শুধু প্রদীপ আর প্রদীপ। লক্ষণীয় এটা যে সেগুলো শুধুই মাটির প্রদীপ নয়, সাথে আছে আরও অভিনব নক্সার প্রদীপ। মাটির প্রদীপের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে রঙ্গোলী প্রদীপ এবং মোম ও জেল-এর মিশ্রণে তৈরি এক নতুন ধরনের প্রদীপ। কোথায় যেন বাঙালিয়ানার সাথে অবাঙালি সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেছে। আমরা যেমন জন্মদিন পালন করে থাকি মোম ও কেক সহযোগে তেমনই পুজোর প্রদীপে তেলের বদলে ঢুকে পড়েছে মোম। আচ্ছা শুধুই কি সংস্কৃতির স্বাদবদল, নাকি বর্তমান বাজারে তেলের দামের কথা মাথায় রেখে এই পরিবর্তন? এর উত্তর অবশ্য অজানা। তবে ইতিহাস বলে সংস্কৃতির মেলবন্ধন নাকি ভাল দিক। সেকথা মনে রেখেই হয়ত সাদরে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে রঙ্গোলী প্রদীপ।
রাজস্থানী ঘরানার একটি উল্লেখযোগ্য রেওয়াজ রঙ্গোলী। আজ সেই রঙ্গোলীর ছোঁয়া এসে লেগেছে পোড়া মাটির প্রদীপে। ভোরের আকাশে ছড়িয়ে দেওয়া আবিরের মত একটা অনুভব যদি একটা প্রদীপ দিতে পারে তবে সত্যি মনটা ভাল হয়ে যায়। সংস্কৃতি হয়ে ওঠে সার্থক। আলতো হাওয়ায় প্রদীপের নড়ে ওঠা শিখা আজও এক আলো আঁধারি উপহার দেয়। চারপাশ জুড়ে সেই আলতো আলো আর একলা মন সন্ধের শাঁখের আওয়াজে এই গতির দুনিয়ার ইঁদুর দৌড়কে থামিয়ে দেয়। টলটলে তেলে পাকানো সলতেতে মাটির প্রদীপের স্পর্শকাতর অগ্নিশিখা কেঁপে উঠে উৎসবের রঙকে আরও মোহময় করে তোলে।
তবে প্রদীপ এখন তার ধরণে বাহার এনেছে। ভূত চতুর্দশী থেকে কালীপুজো, বাঙালি থেকে অবাঙালি, সকলের ঘরের চৌকাঠ থেকে বারান্দা সবই ভরে উঠছে মাটির প্রদীপের পাশাপাশি মোমবাতি, বাহারি রঙ্গোলী প্রদীপের আলোয়। মাটির চিরাচরিত প্রদীপ ছেড়ে এখন প্রদীপও তার ধরণ বদলে চারপাশে মাটির নক্সার বাহারে সজ্জিতা। মাঝে গোল অংশে জ্বালানি হিসাবে শোভা পাচ্ছে রঙিন মোম। বেশ একটা ট্রেন্ডি মোড়ক আছে। মন্দ কী! ফলে বিক্রিও হচ্ছে দেদার।
কৃষ্ণনগরের পালপাড়ায় অসংখ্য শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করে বানান এই প্রদীপ। যার দাম ৮ টাকা থেকে শুরু করে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। মোমের প্রদীপ পাওয়া যাচ্ছে ৩০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত দামের। মোমের জ্বলন ক্ষমতার ওপর মূল্যের ফারাক। তবে এলাকা বিশেষে দামের পার্থক্যও লক্ষণীয়। যা মরসুমি বাজারের ক্ষেত্রে নতুন কিছু নয়। একই জিনিসের কোথাও দাম বেশি, তো কোথাও কম। রঙ্গোলী প্রদীপ ৩০ টাকা পিস থেকে বিভিন্ন দামের আছে। তবে আসল কথাটা হল গ্রহণযোগ্যতা। যা তার নিজের জায়গায় একশো শতাংশ সফল।
তাহলে কি কোথাও সনাতনি বাঙালিয়ানায় টান পড়েছে? বাঙ্গালির সেই সাবেকি রীতি তার স্বাদ বদলেছে? নতুনের ভিড়ে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে বড় একলা, অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে সাবেকি মাটির প্রদীপ? যতটা আতঙ্কের মনে হচ্ছে, মাটির প্রদীপের দশা বোধহয় এখনও অতটা খারাপ নয়। পৃথিবী গোল। তার সংস্কৃতিও গোল গোল ঘোরে। ফিরে ফিরে আসে পুরনো। আবার নতুনের ভিড়ে হারিয়ে যায়। মলিনতা মুছে দীপাবলির আলোকোজ্জ্বল সন্ধেকে তাই যতই নতুন জাপটে ধরুক না কেন, মাটির প্রদীপ তার নিজস্ব ঐতিহ্য নিয়ে সদর্পে বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকে তার টান। বাঙালির জীবনে, বাঙালির মননে।