আজও দেবী আগমনী সংবাদ দেন সতীপীঠে
প্রাচীন তীর্থের জলাশয়ের উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে প্রতিবছর দুর্গাপুজো শুরুর আগে ভেসে আসে একটি অদ্ভুত শব্দ। ওই শব্দের পরেই শুরু হয় সন্ধিপুজো।
লাভপুর স্টেশন থেকে হাঁটাপথে মিনিট দশেক ফুল্লরাপীঠ। বাসও আসছে বোলপুর থেকে। গাছপালা পরিবেষ্টিত ছায়াচ্ছন্ন পরিবেশ। লোকালয় থেকে একটু দূরে। চারিদিকে ফাঁকা ধুধু করছে ধানক্ষেত। মনোরম বৃক্ষলতা শোভিত এই স্থানটিতে আগে ছিল শ্মশানের পরিবেশ। নরকঙ্কাল পড়ে থাকত ইতস্তত। এখন আর তেমনটা নেই।
প্রশান্ত এই বনময় পরিবেশে ঢুকলে প্রথমে পরে একটি পাকা সিঁড়ি বাঁধানো পুষ্করিণী। এর পাশ দিয়ে একটু এগোলেই মন্দির। মাঝারি আকারের মন্দির। প্রাচীনত্বের ছাপ নেই, সংস্কার হয়েছে। সামনেই প্রকাণ্ড নাটমন্দির। মন্দিরে শিল্পের ছোঁয়া নেই, একেবারেই সাধারণ। দেবী মন্দিরের মুখোমুখি বলির জন্য হাড়িকাঠ।
তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থে সতীপীঠ এই ফুল্লরার কথা উল্লিখিত হয়েছে। প্রজাপতি দক্ষরাজকন্যা সতীর দেহাংশ অধোওষ্ট এখানেই পড়েছিল। একান্ন পীঠের একটি। দেবী এখানে ফুল্লরা আর ভৈরব বিশ্বেশ্বর নামে বিরাজিত।
ফুল্লরার কোনও বিগ্রহ নেই। প্রায় মন্দিরের ভিতরটা জুড়েই বড় একটি পাথরের খণ্ড। পরিস্কার কিছু বোঝা যায় না। একটু ভাল করে লক্ষ্য করলে মনে হয় পাথরের সামনের ভাগটা ওষ্ঠাকৃতি। রক্তবস্ত্রে আবৃত পাথরটি সিঁদুরে টকটকে লাল। এর নিচে আরও একটি কি যেন চোখের আড়ালে রাখা হয়েছে। অলক্ষ্যে চলে এর পুজো স্নানাদি।
সতীর দেহাংশ অধঃওষ্ঠ ওটি, যা পাথরে রূপান্তরিত হয়েছে বলেই পূজারির ধারণা। এটি কতকালের কেউ তা জানে না। অসংখ্য জবা আর বেলপাতায় আচ্ছাদিত। তবে পাথরটি ক্রমশ বড় হচ্ছে বলে জানালেন মন্দিরের নিত্যপুজারি।
দেবী মন্দিরের সামনেই রয়েছে একটি জলাশয়। বাঁধানো ঘাট। প্রাচীন তীর্থের এই জলাশয়ের উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে প্রতিবছর দুর্গাপুজো শুরুর আগে ভেসে আসে একটি অদ্ভুত শব্দ। ওই শব্দের পরেই শুরু হয় সন্ধিপুজো। ফুল্লরাতলার কাছাকাছি আর সব গ্রামের পুজোগুলি থাকে এই শব্দ শুনে পুজো শুরুর অপেক্ষায়। একথা জানিয়েছেন মন্দিরের নিত্যপুজারি ও সেবাইত শ্রদ্ধেয় শ্রীদীপেন উকিল।
বীরভূমের প্রাচীন ফুল্লরাপীঠ ছিল এককালে তান্ত্রিকদের আভিচারিক ক্রিয়াক্ষেত্র। শোনা যায়, বহুপূর্বে যখন লোকসমাগম নেহাতই কম ছিল, তখন এখানে বহু শক্তিমান তান্ত্রিক আসন করে তন্ত্রমতে সাধনা করতেন।
এখন জনসমাগম বেড়েছে তাই ওসবের পাঠও উঠে গিয়েছে। আগে এখানে নিয়মিত শিবাভোগে আগমন ঘটতো শৃগালের। প্রসাদ পেয়ে চলে যেত তারা। এখন আর আসে না।
সাধারণভাবে এখানে নিত্যভোগের ব্যবস্থা আছে। সামান্য অর্থের বিনিময়ে যে কেউ প্রসাদ পেতে পারেন। আমিষ ও নিরামিষ, উভয় ভোগই হয়ে থাকে। ছাগ বলিতেও নিষেধ নেই। প্রতি অমাবস্যায় বিশেষ পুজোর ব্যবস্থা আছে। তবে মাঘী পূর্ণিমাতে বিরাট মেলা আর উৎসবাদি হয় এখানে। দূর দূরান্তের মানুষের আগমন ঘটে। তখন আনন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে ফুল্লরাপীঠের আকাশ-বাতাস। পাল-পার্বণ ছাড়া অতিথি অভ্যাগতের আগমন সংখ্যায় কিন্তু কম নয়। নির্ভাবনায় কেউ রাত্রিবাস করতে চাইলে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। — ছবি – শিবশংকর ভারতী