গজলক্ষ্মী প্যালেস, সবুজের আদুরে প্রেমে মেঘ পাহাড়ের কোলে কাটানো এক না ভোলা ছুটি
শহুরে জীবনের ফাঁকে কয়েকদিনের ছুটি কাটানো নতুন নয়। কিন্তু ছুটিটা যদি চিরদিন মনে রাখার করতে হয় তাহলে গজলক্ষ্মী প্যালেস প্রকৃতির মাঝে এক আদর্শ ঠিকানা।

মেঘের কোলে মেঘ পাহাড়ে তখন সবে ভোর হয়েছে। দিগন্ত ছোঁয়া অফুরান সবুজের ডালি সবে ঘুম ভাঙা চোখে পূবের আলতো আলোয় আড়মোড়া ভেঙে আস্তে আস্তে জেগে উঠছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। শুধু পাখির কুজনে রূপকথার মত ভোরে ঘুমটা ভেঙে গেল। বাকি প্রাসাদটা এই কাকভোরে ঘুমে অচেতন। তাই একাই বেরিয়ে পড়া। প্রাসাদের বাইরেই জঙ্গল। অনন্ত সবুজে মোড়া প্রকৃতির টান উপেক্ষা করতে পারা অসম্ভব। বেরিয়ে পড়লাম ঘর ছেড়ে দুই পা ফেলিয়া আলতো কুয়াশা মোড়া গাছগাছালির কোলে। শহুরে জীবনেও ভোর হয়। কিন্তু এমন ভোর তো দেখা হয়নি কখনও। ভোরের অচেনা মিষ্টি গন্ধ আর হিমেল বাতাস ছুঁয়ে যায়নি এমন আদুরে স্পর্শে! অদ্ভুত একটা ভালোলাগা পেয়ে বসল তৃষ্ণার্ত মনটাকে। প্রকৃতির বুকে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাওয়া আকুল মন সেই সবুজে মিশে কোনও এক অজানা আকর্ষণে এদিক পা বাড়াল। এই খুব ভাল লাগাটা ঠিক লিখে বোঝানোর নয়। তবে ঘুরতে ঘুরতে খালি মনে হচ্ছিল জায়গাটায় প্রথম এলাম ঠিকই, কিন্তু এ জায়গাটা কিছুটা চেনা। কোথায় দেখেছি সেটাই কেবল মনে পড়ছিল না।

কটক স্টেশন থেকে ২ ঘণ্টার পথ। এই পথ শহর থেকে সোজা এনে ফেলে জঙ্গলের মাঝখানে ওড়িশার ঢেঙ্কানলের গজলক্ষ্মী প্যালেসে। প্রাসাদ সন্দেহ নেই। চারিদিকে সবুজের মাঝে অতিকায় শ্বেতশুভ্র এই অট্টালিকা দেখে একটাই শব্দ মনে আসে। এ তো রাজপ্রসাদ! রাজপ্রাসাদ সন্দেহ নেই। যার ভিতরে প্রবেশ করলেই বোঝা যায় এর প্রতিটি কোণায় জ্বলজ্বল করছে রাজকীয় ঐতিহ্য। পুরনো রাজকীয় আসবাব, ঘর সাজানোর জিনিস, এমনকি রাজকীয় কিছু অস্ত্রও দেওয়ালে টাঙানো। এছাড়া দেওয়াল জুড়ে বিশাল সব ছবি, পোট্রের্ট। উপরের দিকে সারি দিয়ে নানা প্রাণির মাথা। খুব সুন্দর করে সাজানো অতিথিদের ঘর। স্বাচ্ছন্দ্যে এতটুকু ত্রুটি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সেই সঙ্গে ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ের মাঝে এ প্রাসাদ বারবার কোনও গল্পে পড়া কল্পনার প্রাসাদের কথা মনে করিয়ে দেয়। রাজ পরিবারের বংশানুক্রমে এই প্রাসাদ এখন জেপি সিং দেও-র। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী নবনীতা সিং দেও এই প্রাসাদের একটি অংশকে এখন হোম স্টে হিসাবে দেশ বিদেশের অতিথিদের ভাড়া দেন। তবে এ কেবলই জঙ্গলের মাঝে এক থাকার জায়গা নয়। গজলক্ষ্মী প্রাসাদে দিন কাটানো এক অন্যই অভিজ্ঞতার নাম। কারণ এখানে উপরি পাওনা আত্মিক আতিথেয়তা, বাড়িতেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাহারি পদের এলাহি খাওয়াদাওয়ার আয়োজন, পরিবারের সঙ্গে নির্ভেজাল আন্তরিকতা, রাজপ্রাসাদে দিন কাটানোর অনন্য সুযোগ আর সবচেয়ে বড় পাওনা চারধার মুড়ে থাকা শুধুই প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যের আবাহন।
ভোরের হাঁটাটা সেরে ফিরেছিলাম প্রাসাদে। সেখানে প্রাতরাশ সারার পর জেপি সিং দেও একটি দোনলা বন্দুক কাঁধে ফেলে আমাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন জঙ্গলটা ঘুরিয়ে দেখাতে। না এখানে যে দিগন্ত বিস্তৃত জঙ্গল ছড়িয়ে রয়েছে তা পুরোটা ঘুরিয়ে দেখানো সম্ভব নয়। তবে আশপাশটা ঘুরিয়ে দেখালেন তিনি। ছবির মত সুন্দর প্রকৃতির মাঝে হাঁটতে গিয়ে পাতার ওপর পা ফেলার শব্দ আর প্রচুর জানা অজানা পাখির ডাক জীবনের সব গ্লানি মুছে হৃদয়ের গভীরে এক প্রাণরসের স্পর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছিল।
প্রাসাদের পিছনেই রয়েছে মেঘা পাহাড়। আশপাশের অনেকগুলি পাহাড়ই কাছে দূরে দেখতে পাওয়া যায়। তবে মেঘা পাহাড়টা এদের মধ্যে বেশ উঁচু। পুরোটা ঘন সবুজে মোড়া। এ পাহাড়কে মেঘা পাহাড় বলা হয় কারণ ওড়িয়া ভাষায় মেঘা মানে মেঘ। এ পাহাড় যখন মেঘে ঢাকা পড়ে তখন তা আরও মোহময় হয়ে ওঠে। তাই এই পাহাড়ের নাম মেঘা পাহাড়। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেঘা পাহাড় আর কাছেই এক বিশাল জলাশয়। মাঝে সবুজ আর সবুজ। সকালে সূর্যের কিরণ পুরো পরিবেশটাকে মোহময় করে তুলেছে। জেপি সিং দেও জানালেন, এ বনে প্রচুর পাখির আনাগোনা লেগে থাকে। এই জলাশয়ের ধারে এসে জড়ো হয় তারা। ফের এগিয়ে যাওয়া। জঙ্গলের মাঝে মাটির সরু পথই এখানে রাস্তা। সেটাই ছোট বড় গাছ, প্রচুর গুল্ম, লতা পাতা, ঘাসের মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে জঙ্গলে হাঁটার পথ তৈরি করেছে। একটু এগিয়ে অনেক আমগাছ নজরে পড়ল। বসন্তকালের সকালে এ জঙ্গল অপরূপ।

জেপি সিং দেও-র কাছেই শুনলাম এ জঙ্গলে হাতির আনাগোনা রয়েছে। তাদের একটি যাতায়াতের পথও রয়েছে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। রয়েছে হরিণ সহ আরও নানাধরনের প্রাণি। শুধু বাঘটা নেই। সকালের মনোরম স্নিগ্ধ পরিবেশে শুকনো পাতা আর শিশিরের ওপর পা ফেলে জঙ্গলে ঘোরার ফাঁকে মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন জেপি সিং দেও। দেখাচ্ছিলেন শাল গাছের সারি বা এক বহু পুরনো কাজু গাছ। চিনিয়ে দিচ্ছিলেন নানাধরনের ফলের গাছকে। এমনভাবেই জঙ্গলটাকে কিছুটা চিনতে চিনতে আমরা এসে পৌঁছলাম খেজুর গাছে ভরা একটি জায়গায়। এখানে প্রথম মানুষের দেখা মিলল। এঁরা সকলেই স্থানীয় শবর গ্রামের বাসিন্দা যাঁরা খেজুর রস সংগ্রহ করে অর্থ উপার্জন করেন। একে বসন্তের আলতো হিমেল সকাল, তায় আবার খেজুর গাছে পাতা রয়েছে হাঁড়ি। দৃষ্টিগোচর হতেই মনের মধ্যেটা রসনা তৃপ্তির অমোঘ ইচ্ছায় উতলা হয়ে উঠল। তাই খেজুর রসের ভুবন ভোলা স্বাদ আস্বাদনের লোভটা কিছুতেই সামলানো গেল না। প্রাণ জুড়িয়ে দেওয়া তাজা খেজুর রস পান করে মনটাকে আরও একবার সতেজ করে আমরা আরও একটু এগিয়ে পৌঁছলাম শবর গ্রামে। এ গ্রামের মানুষ স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। এঁদের উপার্জনের ২টি পথ। একটি হল খেজুর রস বিক্রি করা। আর দ্বিতীয়টি হল ইট তৈরি করা। অনেকটা হাঁটা হয়ে গেছে। তাই একটু বসলে মন্দ হয়না। আমরা ওই গ্রামেরই একটি বাড়িতে গিয়ে বসলাম। সরল সাদাসিধে মানুষ। ততোধিক সরল তাঁদের জীবন। জঙ্গলের মাঝে এই শবর গ্রামের সরল জীবনযাত্রার দিকে চেয়ে অভিজ্ঞতার ঝুলি পূরণ করার পর এবার প্রাসাদে ফেরার পালা। ফেরার পথে জঙ্গলের পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফের একবার মনে হল এই জায়গাটায় আগে না এলেও জায়গাটা চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ল না কেন এমনটা মনে হচ্ছে? যাইহোক খটকা মনের মধ্যে রেখেই আমরা এসে বসলাম প্রাসাদের বসার ঘরে।

গজলক্ষ্মী প্রাসাদে আসার পর থেকে প্রাসাদের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে থাকা রাজকীয় উপস্থিতি আমাকে টানছিল। যে অনুভূতিটা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। কেবল অনুভব করা যায়। এখানে বসেই কথা হচ্ছিল জেপি সিং দেও-র সঙ্গে। তিনি জানালেন, ১৯৩০-এর দশকে এই প্রাসাদ বানিয়েছিলেন তাঁর ঠাকুরদা। কিন্তু এমন জঙ্গলের মাঝখানে একটা প্রাসাদ কেন? তিনি জানালেন, এই সবুজকে রক্ষা করাও তাঁদের পরিবারের একটা লক্ষ্য। এই জঙ্গল, এখানকার বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা করতে তাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কাজ করে চলেছেন। সবুজকে রক্ষার কথা উঠে এল তাঁর স্ত্রী নবনীতা সিং দেও-র গলাতেও।

বসার ঘরটায় সাজানো নানা জিনিসপত্র দেখতে দেখতে নজরে পড়ল একটি বাঘের মাথা। যার চোখ ২টোর দিকে তাকালে আজও হাড় হিম করা এক অনুভূতি হয়। জেপি সিং দেও জানালেন, কোরাপুটে এই বাঘটি একসময় নরখাদক হয়ে উঠেছিল। এক এক করে ৭৬টি মানুষের প্রাণ কাড়ে এই বাঘ। তাঁর বাবা অনেকদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে অবশেষে এই নরখাদককে শেষ করেন।

ঢেঙ্কানলের এই রাজপ্রাসাদে কটা দিন কাটাতে এসে প্রথম থেকেই যে খটকাটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল এই বাঘের গল্পটা শোনার পর সেটা এবার কেটে গেল। মনে পড়ে গেল সত্যজিৎ রায়ের লেখা সন্দীপ রায়ের সিনেমা ‘রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য’-র কথা। ঠিকই তো! সেই সিনেমার শ্যুটিং হয়েছিল এই প্রাসাদ ও তার আশপাশের এই ঘন সবুজ বনানীরে মাঝে। তাই এত চেনা লাগছিল জঙ্গলটার কিছু জায়গা এবং গজলক্ষ্মী প্রাসাদ। সিনেমার পর্দায় যে এগুলো বারবার ফিরে এসেছে চোখের সামনে!

গজলক্ষ্মী প্রাসাদ ও তার চারধার ঘেরা পাহাড়ে জঙ্গলে বিকেল নামে। পেয়ে বসে আর এক অন্য নিস্তব্ধ সৌন্দর্য। চায়ে চুমুক দিতে দিতে উঠে যাই প্রাসাদের ছাদে। এখান থেকে ৩৬০ ডিগ্রিতে পুরো জঙ্গলটা দেখা যাচ্ছে। যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর জঙ্গল। অপার প্রকৃতি যেন পরম আদরে জড়িয়ে আছে আমাকে। স্বর্গীয় রূপের সামনে সময় এখানে থমকে দাঁড়ায়। বইতে থাকা বাতাসে এক মাতাল করা গন্ধ। হারিয়ে যাই ভাল লাগার মাঝে।
সন্ধে নামে। রাতের আকাশ জেগে ওঠে তারা ঝলমলে ক্যানভাস নিয়ে। জঙ্গলে অন্ধকার নেমেছে। মাথার ওপর আকাশ জুড়ে চিকমিক তারাদের আসরে আমিও যোগ দিলাম। কেমন করে সময় কাটতে থাকল বুঝতেই পারছিলামনা। শহুরে জীবনের দৈনন্দিন ছুটে চলা থেকে একটু সময় বার করে এসেছিলাম জঙ্গলের মাঝে প্রাণ মনটা একটু সতেজ করে নিতে। কিন্তু যখন ফেরার সময় এল তখন বুঝতে পারলাম গজলক্ষ্মী প্যালেসে এসে প্রাপ্তির ঝুলিটা প্রত্যাশার ঝুলি ছাপিয়ে গেছে। এ এক অন্যই অভিজ্ঞতা। অনেক জায়গা ঘুরেছি। আরও অনেক জায়গায় যাব। জঙ্গলের মাঝে এ প্রাসাদে কটা দিন কাটিয়ে যাওয়ার আনন্দ এবং রাজপরিবারের উষ্ণ আপ্যায়ন মনের মণিকোঠার এক কোণায় একান্ত সুখস্মৃতি হয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবে।
গজলক্ষ্মী প্যালেসকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি এগোল ফেরার ট্রেন ধরতে। যেতে যেতে আপনা থেকেই একবার পিছন ফিরে তাকালাম। ধবধবে সাদা অট্টালিকা, মেঘ পাহাড় আর চারধারের সবুজে ঘেরা জঙ্গলটার দিকে চেয়ে ভারাক্রান্ত মনটা যেন নিজে থেকেই কথা দিয়ে দিল। কথা দিল ফের সে ফিরে আসবে এখানে। আসবেই আসবে! — অনুলিখিত – তথ্য – সোমশুভ্র দে