সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্য বৃদ্ধিতে গণেশ পুজোর পদ্ধতি
গণেশজি হলেন এক মহাশক্তি ও সাফল্যের দেবতা। তিনি মানুষের জাগতিক ও পারমার্থিক পথের বাধা ও বিপত্তিনাশক। অহংকার, স্বার্থপরতা ও গর্ববোধের বিনাশক।
কথায় বলে, সর্বঘটে কাঁঠালি কলা। এই কাঁঠালি কলা আর পার্বতীর প্রিয়পুত্র গণেশের পজিশন অনন্তকাল ধরে কী কৈলাস, কী মর্ত, ত্রিভুবনে হাই লেভেলে। যে কোনও পুজোয় কাঁঠালি কলা মাস্ট, নইলে পুজো অসম্পূর্ণ। ভগবান গণেশজির ব্যাপারটাও তাই। যে কোনও দেবদেবীর পুজোর আগে গণেশস্মরণ অর্থাৎ প্রথমে গণেশ পুজো, পরে অন্যের। মহাদেব-পার্বতীর পুজো করতে গেলেও আগে ব্যাটার পুজো, পরে বাপ-মায়ের। কিন্তু কেন?
অপ্রত্যাশিত কারণে ঘটনার প্রেক্ষিতে গণেশের মাথা গেল। এল হাতির মাথা। এই মাথার জন্য গণেশ যাতে সকলের কাছে অনাদৃত না হন, সে জন্য দেবতারা নিয়ম করলেন, প্রথমে গণেশের পুজো না হলে তাঁরা কেউই পুজো গ্রহণ করবেন না। নির্বিচারে এ কথাই মেনে নিলেন সকলে। তাই প্রত্যেক দেবকার্যে ও পিতৃকার্যে প্রথমে পূজিত হন গনেশজি, পরে অন্যেরা।
এক এক পুরাণ গণেশকে নিয়ে এক এক কথা ও কাহিনিতে মশগুল। কথা ও কাহিনিগুলি আলাদা হলেও তার মানে কিন্তু একটা আছে। কালী ও কেষ্টঠাকুরের মতো গণেশজিও নামে একশো টপকে গেছেন। তবে বাবা মহাদেবকে টপকাতে পারেননি। মহাভারতে মহাদেব এক হাজার নাম ‘শো’ করে গিনেসবুকে রেকর্ড বানিয়ে গণেশজিকে মাটিতে লেটে দিয়েছেন।
এই নাম-কীর্তন করতে গিয়ে বামন পুরাণ বলেছে, বিনায়ক মহাদেবের পুত্র গণেশের অন্য নাম। মহাদেবের নাম নায়ক। মহাদেব-পত্নী উমাজির দেহমল থেকে জন্ম হয়েছে গণেশজির। অর্থাৎ নায়ক তথা মহাদেবের সাহায্য ব্যতীত গণেশের জন্ম বলে তাঁর নাম বিনায়ক।
এ তো গেল বিনায়ক প্রসঙ্গ। এবার ‘গণপতি বাপ্পা’-র কথা। শিব ও পার্বতীর অনুচরদের বলা হয় গণ। গণেশের মুণ্ডু তো উড়ে গেল। কৈলাসে তো মারদাঙ্গা বাঁধে আর কী। ব়্যাফ নামার আগেই ভগবান শঙ্কর গণদের পাঠালেন মুণ্ডুর সন্ধানে। মানুষের মাথা পাওয়া গেল না। তারা নিয়ে এল হাতির মাথা। তা-ই লাগানো হল গণেশজির কাঁধে। প্রাণ ফিরে পেলেন ভগবান বিষ্ণুর অন্তরমন্দাকিনীর করুণাধারায়। এরপর গণেশজি হলেন গণদের কর্তা বা পতি। নাম হল গণপতি। এ সময়ই পার্বতী ও মহাদেবের বরে গণেশ গণের অধিপতি, বিঘ্নবিনাশক ও গণ্য হলেন সর্বসিদ্ধিদাতারূপে।
যাইহোক, শ্রীবিষ্ণুর অপার অনন্ত করুণায় প্রাণ ফিরে পেলেন গণেশ, তবে মাথা পেলেন হাতির। পুত্রের এমন রূপে চিন্তিত হলেন পার্বতী। মহাদেবকে বললেন, এই রূপ দেখে দেহমানব সবাই অবহেলা করবে গণেশকে, উপহাস করে হাসবেও। তখন গণেশের কী হবে?
উত্তরে মহাদেব জানালেন, একই সঙ্গে বর দিলেন, সেসব কিছুই হবেনা। সকলের আদৃত, অতিবলশালী ও বুদ্ধিমান হবে গণেশ। অধিপতি হবে সমস্ত গণের। তিনি আরও বললেন, যে গণেশকে স্মরণ করে কাজ করবে তার কাজে সাফল্য আসবে।
এ কথায় আশ্বস্ত হলেন পার্বতী। উপস্থিত ছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা, ভগবান বিষ্ণু ও লক্ষ্মীদেবী। একে একে এগিয়ে এলেন সকলে। ব্রহ্মা আশির্বাদ করে বর দিলেন, যুগ যুগ ধরে মানুষের কল্যাণও করবেন গণেশ। ভগবান বিষ্ণু বর দিলেন, এই বালক বিদ্যা ও বুদ্ধিদাতা হবে। প্রতি ঘরে মানুষ স্থাপন করবে গণেশকে, ভোগও দেবে। আশির্বাদ ও বরদানে দেবী লক্ষ্মীও কম গেলেন না। জানালেন, তিনলোকে যখন যেখানে যে কোনও শুভ কাজ হবে, যেখানে যে দেবতারই পুজো হবে সবার আগে পুজো হবে গণেশর। তা না হলে শুভকাজ ও পুজোর উদ্দেশ্য হবে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ও নিষ্ফল। এ সময় দেবদেবীরা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলেন দেবী লক্ষ্মীর প্রদত্ত বর ও সম্মতি দিলেন নির্বিচারে।
পুরাণের কথায়, শিব ও পার্বতীর প্রিয়পুত্র গণেশ সিদ্ধিদাতা। সমস্ত কর্মের প্রারম্ভে পুজো করা হয় গণেশের। গণেশজি মঙ্গল ও সিদ্ধির জনক বলে সমস্ত দেবতার আগে পূজিত হন।
সর্বার্থসিদ্ধিপ্রদ গণেশের রূপ বর্ণনায় বৃহৎ তন্ত্রসার গ্রন্থের কথা, ‘সিন্দূরের ন্যায় রক্তবর্ণ, ত্রিনয়ন এবং স্থূলোদর। হস্তচতুষ্টয়ে দন্ত, পাশ, অঙ্কুশ এবং ইষ্টা ধারণ করিয়াছেন, বালচন্দ্রদ্বারা কপালদেশ উজ্জ্বল, হস্তীর ন্যায় মুখ এবং মদবারিদ্বারা গণ্ডস্থল আর্দ্র রহিয়াছে। সর্বাঙ্গে সর্পভূষণ এবং রক্তবস্ত্র পরিধান।’
বামন পুরাণে আবার গণেশের বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘খর্বাকৃতি দেহ, চার হাত, হাতির মতো মাথা, চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম। মূষিক এঁর বাহন। কারণ, এই মূষিক বৃষরূপধারী ধর্মের অবতার। মহাবল ও পূজাসিদ্ধির অনুকূল।’
শিবনন্দন গজাননের দেহটা মানুষের, মাথাটা হাতির। সম্পূর্ণ দেহের বিভিন্ন অংশ এক একটি আধ্যাত্মিক প্রতীক হিসাবে ধরা হয় যেমন – মাথা আত্মার প্রতীক। মানুষের অস্তিত্বের সর্বশেষ সত্যতা তথা পরমাত্মা। হাতির মতো মাথা এখানে জ্ঞানের প্রতীক। গণেশের গলার পর থেকে মানুষের দেহ অর্থাৎ মায়া। মানুষের পার্থিব অস্তিত্বের প্রতীক। শুঁড় হল মহাজাগতিক সত্যতা অর্থাৎ ॐ-এর প্রতীক। যোগ্যতার সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা।
উপরের ডান হাতের কুঠার সমস্ত পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্ত করে শাশ্বত সনাতন সত্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতীক। বাঁ হাতে দড়ির ফাঁস বিভিন্ন কাঠিন্যকে বেঁধে ফেলে বাধাবিঘ্ন অপসারণের প্রতীক। গণেশজির ভাঙা দাঁতটি কলমের মতো ধরে আছেন নিচের ডান হাতে। মহাভারত লেখার সময় দাঁতটি ভেঙে কলম হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। পুরাণান্তরে আছে, পরশুরামের সঙ্গে যুদ্ধের সময় কুঠারাঘাতে গণেশের একটি দাঁত উৎপাটিত হয় সমূলে।
এক সময় শিব ধ্যানস্থ অবস্থায় থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে কৈলাসে দেখা করতে যান পরশুরাম। শিবের আদেশে গণেশ দেখা করতে বাধা দিলেন পরশুরামকে। বাধা দিতে উভয়ের মধ্যে বেধে যায় যুদ্ধ। যুদ্ধ চলাকালীন পরশুরাম ছোঁড়েন পরশু (শিবের কুঠারকে পরশু বলে)। পার্বতীপুত্র পিতা মহাদেবের সম্মানরক্ষার্থে অস্ত্র ব্যর্থ হতে দিলেন না। নিজের দাঁতের উপরে আঘাত নিলেন। একটি দাঁত ভেঙে যায় পরশুর আঘাতে। সেই থেকে শিবনন্দন এই ত্যাগস্বীকারের জন্য তিনলোকে সুখ্যাত হলেন একদন্ত নামে। দাঁতটিকে ধরা হয় ত্যাগের প্রতীক।
বড় বড় কান, যা কোনও কথা শুনতে বাদ দেয় না। মর্তবাসী মানুষের সমস্ত অভাব অভিযোগ ও আর্তি বেশি করে শোনার জন্য। জপমালা, জ্ঞান আহরণ সমানে চলতে থাকে। নিচের বাঁ হাতে লাড্ডু হল আত্মার মধ্যে নিহিত যে চিরন্তন সত্যরূপ মিষ্টতা তথা আনন্দ, তাকে আবিষ্কার করার প্রয়াস। সাধনার ফল আনন্দ। কোমরে সাপ মহাজাগতিক শক্তি কুলকুণ্ডলিনী তথা জ্ঞানের অনন্ত বিস্তারের প্রতীক। ছোট মুখ সংযত বাক ও ছোট চোখ একাগ্রতার প্রতীক। গণেশজির হাতের অঙ্কুশ বিশ্বসংসার পরিচালনার প্রতীক। গণেশের প্রসাদ হল প্রসন্নতা, যে প্রসন্নতা পৃথিবী জুড়ে। ভগবান প্রসন্ন হলে মানুষের জীবন হয়ে উঠবে আনন্দময়।
সমস্ত দিক থেকে বিশাল হওয়া সত্ত্বেও গণেশজি বাহন করেছেন ইঁদুরকে। সীমাহীন ও উদার অন্তরের প্রতীক ইঁদুর। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম অবহেলিত জীবকে স্থান দিয়েছেন বাহনের। বাহক ইঁদুর হল কীভাবে ছোট ছোট বিষয়কে একজন জ্ঞানী গুরুত্ব দেয় তার ধারক।
একটি দাঁত ভালোকে বজায় রেখে অশুভকে দূরে ফেলার প্রতীক। লম্বোদর হল সমস্ত জগতের ওখানেই স্থিতি। সহ্যক্ষমতা, ধীরে ধীরে শান্তিপূর্ণভাবে ভালোমন্দকে গ্রহণ করার প্রতীক। একটি আশির্বাদী হাত পরমাত্মার কাছে পৌঁছনোর জন্য আধ্যাত্মপথকে রক্ষা করার প্রতীক। দুটি পায়ের একটি সিদ্ধি তথা সাফল্যের, আর একটি বুদ্ধির।
গণেশজি হলেন এক মহাশক্তি ও সাফল্যের দেবতা। তিনি মানুষের জাগতিক ও পারমার্থিক পথের বাধা ও বিপত্তিনাশক। অহংকার, স্বার্থপরতা ও গর্ববোধের বিনাশক। পার্বতীপুত্র শিক্ষা, জ্ঞান, মেধা, প্রবল ইচ্ছাশক্তি, বুদ্ধি, সাহিত্য, কাব্যরস, কলা, স্থাপত্যশিল্প ও সম্পদের দেবতাও বটে। আরাধনায় প্রসন্ন হলে গণেশ এসবই উপাসককে দান করেন অকাতরে। পাঁচজন প্রধান দেবতার মধ্যে অন্যতম বলা হয় গণেশকে। অন্য চারজন হলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও দুর্গা। এঁদের একত্রে পুজো করাকে পঞ্চায়তন পুজো বলে। বারাণসীতে এ পুজোর আজও যথেষ্ট প্রচলন আছে। প্রেমিক কবি গোস্বামী তুলসীদাস কাশীতে পঞ্চায়তন পুজো করতেন নিয়মিতভাবে।
জাতিগত বিভেদ থাকা সত্ত্বেও সমস্ত হিন্দু গণেশের পুজো করে, শ্রদ্ধাতেও কার্পণ্য নেই। মহাদেবপুত্র গণেশই হলেন হিন্দুধর্মের শুরু। সেই জন্যই তো তাঁকে আন্তরিকভাবে মান্য করে হিন্দুধর্মের সমস্ত সম্প্রদায়, মত, বিশ্বাস ও ভাবধারা।
সত্ত্ব তমো রজোগুণসম্পন্ন পার্বতীপুত্রকে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা দিয়েছিলেন পাশ, অঙ্কুশ, পরশু ও পদ্ম। পইতা দিয়েছিলেন গৌতম মুনি। নানান রত্ন অলংকার ও বসনে সর্বাঙ্গসুন্দর ও সুসজ্জিত করেছিলেন ভগবান শ্রীবিষ্ণু এবং পিতা স্বয়ং ভগবান শঙ্কর।
দুর্গানন্দন গণপতি বাবাজির অত্যন্ত প্রিয় রক্তপুষ্প। যূথিকা (যূথী), চামেলি (জাতিপুষ্প) ও মল্লিকা গণেশ পুজোর বিহিত ফুল। কুন্দ, টগর, অশোক ফুল, তুলসী ও বেলপাতা নিষিদ্ধ। শিবের রুদ্রাক্ষ, বিষ্ণুর তুলসী আর গজাননের প্রিয় চন্দনকাঠের মালা। গণেশজির প্রিয় ও মনপসন্দ একমাত্র মোদক (সুগন্ধী খই)।
প্রতিদিন গণেশ পুজো বা আরাধনা করলে জাগতিক উন্নতি ও পারমার্থিক পথের বাধা দূর করে গণেশজি বাঞ্ছিত আশার উপাসনায় অন্তরে আনন্দবৃদ্ধি, কামনাপূরণ, বিদ্যার্থীর বিদ্যালাভে বাধা কেটে বিদ্যালাভ, অর্থবৃদ্ধি, সন্তানহীনের সন্তানলাভ, চলার পথের বিঘ্ননাশ, অবিবাহিতের মনোমতো স্ত্রী বা স্বামী লাভ, এমন জাগতিক সমস্ত আশা বা প্রার্থনাই মঞ্জুর করেন একদন্তজি।
শ্রাবণ, ভাদ্র, অগ্রহায়ণ কিংবা মাঘ মাসে শুক্লপক্ষের চতুর্থী তিথিতে গণেশের বিগ্রহ নির্মাণ করে পুজো করলে সমস্ত বাসনা বা কার্যসিদ্ধি হয়। গণেশের জাঁকালো পুজোয় মুম্বইয়ের কেরামতি জগৎছোঁয়া।
পরিশেষে শিবপার্বতীর প্রিয়পুত্র সর্বসিদ্ধিদাতা সিদ্ধিবিনায়ক গজাননজিকে প্রণাম জানাই –
একদন্তং মহাকায়ং লম্বোদরং গজাননম্।
বিঘ্নবিনাশকং দেবং হেরম্বং প্রণমাম্যহম্।
Aneek vul ache post tai…shib vogoban noi….Krishna mane vishnu ekmatro vogoban…shib durga parvati brahma sobai deb debi..
want to contact with Sibsankar Bharati. How Is It Possible?