Business

শুধু কর্পোরেটের স্বার্থ সুরক্ষিত করতেই চালু জিএসটি, দাবি এফটিও-র

একমাস হয়ে গেল দেশে জিএসটি চালু হয়েছে। ফলে হাতেকলমে বিষয়টি খায় না মাথায় দেয় তা আঁচিয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছেন সাধারণ বিক্রেতারা। সেই সাধারণ বিক্রেতা, যাঁদের দোকান কোনও শপিং মলে হয়না। কোনও ঝাঁ চকচকে ব্র্যান্ডও নন তাঁরা। এঁরা নিছকই ছাপোষা ব্যবসায়ী শ্রেণি, যাঁদের সঙ্গে আমজনতার প্রাত্যহিক ওঠাবসা। কারণ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য এখনও এঁরাই আমজনতার প্রধান ভরসা। সে পাড়ার দোকান হতে পারে, হতে পারে তা কাছের কোনও বাজারের। অথবা এমন কোনও বাজার এলাকা যেখানে ব্র্যান্ডেড পোশাক নয়, মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের সাধ্যের মধ্যে পোশাক বিক্রি হয়। এই ব্যবসায়ীদের সংখ্যাই দেশে সর্বাধিক।

এঁদের মধ্যে কিছু বিক্রেতা কম্পোজিশন স্কিমে জিএসটি-র আওতাধীন হয়েছেন। বাৎসরিক ৭৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত টার্নওভার হলে জিএসটি-র এই কোটার অন্তর্গত হতে পারবেন তাঁরা। কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁরা রাজ্যের বাইরে জিনিসপত্র বেচা বা রাজ্যের বাইরে থেকে জিনিসপত্র কেনার সুযোগ পাবেননা। এছাড়া বাৎসরিক পুরো বিক্রির ওপর তাঁদের গুনতে হবে ১ শতাংশ কর।


তবে সাধারণ জিএসটি-র আওতায় থাকা ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম নয়, বরং বিভিন্ন জিনিসের ওপর সরকারের বেঁধে দেওয়া ৫ শতাংশ, ১২ শতাংশ, ১৮ শতাংশ বা ২৮ শতাংশ জিএসটির নিয়ম মেনে চলতে হচ্ছে তাঁদের। এঁদের বছরে ৩৭টি রিটার্ন জমা দিতে হবে। মাসে ৩টে করে রিটার্ন ধরে ৩৬টি এবং ১টি বাৎসরিক রিটার্ন যেমন দিয়ে থাকেন তা জমা দিতে হবে।

এসব তো গেল নিয়মের ঘেরাটোপ। এমন অনেক নিয়ম জিএসটির আওতায় রয়েছে যা এখনও আম ব্যবসায়ীদের কাছে হিব্রুর মত ঠেকাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ফেডারেশন অফ ট্রেডার্স অর্গানাইজেশন বা এফটিও। এফটিও-র সাধারণ সম্পাদক তারকনাথ ত্রিবেদী যারপরনাই ক্ষুব্ধ জিএসটি নিয়ে। সাফ জানালেন কর্পোরেট সেক্টরকে বাঁচাতেই কেন্দ্র জিএসটি চালু করেছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশ থেকে সাধারণ ব্যবসায়ীরা মুছে যাবেন।


তাঁর আরও অভিযোগ দিনের পর দিন এফটিও-র তরফে প্রধানমন্ত্রী থেকে অর্থমন্ত্রী, এমনকি বিজেপি সভাপতি অমিত শাহকে মেমোরান্ডাম পাঠিয়ে ফল হয়েছে জিরো! কোনও চিঠির উত্তর দেওয়ার সৌজন্যটুকু দেখাননি কেউ। তারকবাবুর মতে, জিএসটি-কে এক দেশ, এক কর বলে ব্যাখ্যা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বাস্তবে সেখানে নানা রকম করের অবতারণা রয়েছে। রয়েছে সেন্ট্রাল জিএসটি, স্টেট জিএসটি এবং ইন্টিগ্রেটেড জিএসটি। কর কাঠামোয় ৪টি ভাগ দেখানো হলেও অনেক ক্ষেত্রেই সেস যোগ করে করের অঙ্ক দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ৪০ শতাংশে!

তবে কী চাইছেন তাঁরা? জিএসটি তুলে নিয়ে ফের পুরনো কর কাঠামোয় ফিরে যাওয়া? এটাই কী তাঁদের প্রধান দাবি? তারকবাবু জানালেন ঠিক তা নয়। তাঁরা একথা বলছেন না সরকার জিএসটি চালু করে তুলে নিক। কিন্তু তাঁদের কথাটুকু সরকার শুনুক। তাঁদের সঙ্গে এক টেবিলে আলোচনায় বসুক। তাঁদের সমস্যাগুলো বিবেচনা করুক।

কিছুটা অভিযোগের সুরেই তারকনাথ ত্রিবেদী জানালেন, ফ্রান্সে প্রথম জিএসটি চালু হয়েছিল। সে সময়ে সরকার প্রায় ৩ বছরের কাছাকাছি সময় ব্যবসায়ীদের সুযোগ দিয়েছিল জিএসটি বুঝতে। আর ভারতে তো হুট বলতেই চালু হয়ে গেল জিএসটি। বোঝাবুঝির সুযোগ মিলল কই!

তারকবাবু জানালেন, দেশের ছোট ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘ভারতীয় উদ্যোগ ব্যাপার মণ্ডল’-এর সদস্য এফটিও সহ দেশের ৩৩টি রাজ্যের বিভিন্ন ট্রেডার্স অর্গানাইজেশন। সকলেরই চাহিদা প্রায় এক। এফটিও চাইছে তাদের কথা মাথায় রেখে জিএসটি-র নিয়মকানুনে সরলীকরণ ও আধুনিকীকরণ করুক কেন্দ্র। ইন্সপেক্টর রাজের বাড়বাড়ন্তের সম্ভাবনা বন্ধ করতেও আগাম পদক্ষেপের দাবি তুলেছেন তাঁরা।

তারকবাবুর দাবি, জিএসটি-র নিয়ম বেশ কড়া। ভুলভ্রান্তি থাকলে কারাদণ্ডের সম্ভাবনাও থাকছে। অথচ ব্যবসায়ীরা অনেকেই জিএসটি সম্বন্ধে পরিস্কার নন। অনেকে অত পড়াশোনা জানাও নন। ফলে ভুল তো হতেই পারে। সেক্ষেত্রে জিএসটি-র কঠোর সাজা এড়াতে অনেক ব্যবসায়ীকেই ইন্সপেক্টরদের সঙ্গে সমঝোতার রাস্তায় হাঁটতে হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারকবাবু। যা আদপে তাঁর মতে, ইন্সপেক্টর রাজের জন্ম দেবে। ফলে তাঁদের দাবিতে জায়গা পেয়েছে ইন্সপেক্টর রাজ নিয়ে আতঙ্ক দূর করার আবেদনও।

যেসব দেশে জিএসটি চালু আছে সেখানে কোথাও এক কর নেওয়া হয়না। অন্যান্য সুবিধাও পেয়ে থাকেন ব্যবসায়ীরা। সেগুলি ভারতেও চালু করতে হবে বলে দাবি করেছে এফটিও। এছাড়া তাঁদের দাবির তালিকায় রয়েছে ছোট ব্যবসায়ীদের খরচ বাড়ার প্রসঙ্গও। তারকবাবুর জানাচ্ছেন, সরকার যেভাবে হিসাব রাখতে বলছে তাতে প্রত্যেক দোকানকে একটি কম্পিউটার ও একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট রাখতে হবে। এই অতিরিক্ত খরচের ব্যয়ভার ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের পক্ষে টানা সম্ভব নয়। তাই এফটিও-র দাবি, সেক্ষেত্রে এই অতিরিক্ত খরচের ব্যয়ভার সরকার বহন করুক।

তারকবাবু এদিন স্পষ্ট ভাষায় জানান, দেশ জুড়ে যত সাধারণ রিটেলার রয়েছেন, তাঁরাই দেশে সবচেয়ে বেশি চাকরি দিয়ে থাকেন। অদক্ষ কর্মচারি হতে পারেন, কিন্তু সেসব মানুষের সংসার বিভিন্ন রিটেলারের কাছে কাজ করে চলে যাচ্ছে, জিএসটি-র কোপে যদি ব্যবসায়ী নিজেই ঠিক করে ব্যবসা না করতে পারেন তবে এঁদের টানবেন কীকরে? সেক্ষেত্রে দোকানের কর্মচারিদের চাকরি যাওয়ার একটা বড় সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। যা সরাসরি মাথায় হাত পরার যোগাড় হবে সেই ব্যক্তি সহ তাঁর গোটা পরিবারের জন্য। সেটাও সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবার অনুরোধ করেছেন তিনি। দাবি করেছেন, তাঁদের কথা শুনতে একবার অন্তত আলোচনার টেবিলে বসুক কেন্দ্র। তা না হলে তাঁদের যে বড় আন্দোলনের পথে যেতে হবে সে ইঙ্গিতও প্রচ্ছন্নভাবে দিয়েছেন একসময়ে ভ্যাটের বিরুদ্ধে রাজ্য জুড়ে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলা এফটিও-র সাধারণ সম্পাদক তারকনাথ ত্রিবেদী।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button