Mythology

ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে দেখা দেন হনুমানজি, শোনেন আর্তি

সেখানে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশে প্রতিদিন আসেন হনুমানজি। ভক্তিভরে শোনেন রামায়ণের রামগুণকথা। একমাত্র তিনিই পথের দিশারি।

প্রেমিক কবি তুলসীদাস গোস্বামী, শ্রীরামচন্দ্রের দর্শনমানসে বারাণসীর পর্ণকুটিরে নয়নজলে বুক ভাসান একাকী। কখনও নির্বিকার তুলসী ঘুরে বেড়ান কাশীর পথে পথে, কখনওবা সংকটমোচন মন্দিরে। তবুও প্রভুর দর্শন মেলে না। কোথায় পাবেন তাঁকে, কে দেখাবে পথ? একদিন অন্তরের আর্তি ও আক্ষেপ বেড়িয়ে আসে তুলসীদাসের কলমে ‘দোঁহা’ হয়ে বানরের মুখ থেকে –

‘কুদকে সাগার উতারা, কোহি কিয়া মিৎ / কোহি ওখড়া গিরি দরখৎ, কোহি শিখায়া নীৎ।। / ক্যা কাহুঙ্গা সীতানাথকো, ম্যায়নে কিয়া চোরি। / সোহি কুল উদ্ভব রো, বেদিয়া খিঁচে ডোরি।।’


‘সেই কপিকুলে জন্মগ্রহণ করে কেউ লাফ দিয়ে অবহেলায় দুষ্পার সাগর অতিক্রম করেছে, কোনও কোনও বানর বীরকুলশ্রেষ্ঠ রঘুপতির সঙ্গে সৌহার্দ্য স্থাপন করে প্রসিদ্ধি লাভ করে গেছে। কেউ বা বাহুবলে বৃক্ষ ও পাহাড় উৎপাটন করেছে, কোনও কপি নীতিবিশারদ হয়ে নীতিশিক্ষা দিয়েছে জগতের মানুষকে। কিন্তু সীতাপতি রঘুবীরকে আমার জিজ্ঞাসা, আমি কি কিছু চুরি করেছি? সেই কুলে তো আমারও জন্ম, তবে কেন বেদে আমার গলায় দড়ি বেঁধে নাচাচ্ছে?’

অবশেষে তুলসীদাসের আর্তি শুনলেন প্রভু, অবসান হল আক্ষেপের। তখনও তুলসীদাস চিত্রকূটে আসেননি। রামপ্রেমিক সাধক কবি যুবক তুলসীদাস। অবস্থান করছেন কাশীতে। নিয়মিত রামভজনে কোনও আলস্য নেই তাঁর। প্রতিদিন শয্যাত্যাগ করেন ভোরে। শৌচকর্ম সারেন। শৌচকর্মের পর অবশিষ্ট জলটুকু ফেলে দেন না এখানে ওখানে। যত্নের সঙ্গে ঢেলে দেন গাছের গোড়ায়। এমনটি করেন তিনি প্রতিদিনই। এই কাজটি তাঁর নিত্যকর্মের অঙ্গ যেন। ভাবেন না কিছু। রাম ছাড়া তুলসীদাসের আর কাউকে নিয়ে ভাবার অবকাশ কোথায়!


ওই গাছেই বাস করত এক প্রেতযোনি। হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করল রামপ্রেমিকের সামনে। আন্তরিকতার সুরে কৃতজ্ঞতা জানায়, প্রতিদিন গাছের গোড়ায় জল ঢালায় সে বড় প্রসন্ন। জিজ্ঞাসা করে, তুলসীদাসের কোনও উপকারে সে আসতে পারে কি না?

এক মন, এক চিন্তা, একই ধ্যানজ্ঞান তুলসীদাসের রঘুপতি রাম। প্রেতযোনির কাছে আকুল হয়ে জানতে চাইলেন, কীভাবে তিনি পেতে পারেন তাঁর প্রাণের আকাঙ্ক্ষিত ধন প্রভু রামের দর্শন?

খুশি হয়ে উত্তরে প্রেতযোনি জানায়, প্রতিদিন রামায়ণ পাঠ হয় দশাশ্বমেধ ঘাটে মতান্তরে সংকটমোচন মন্দিরের কাছে কর্ণঘণ্টায়। সেখানে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশে প্রতিদিন আসেন রামভক্ত হনুমানজি। ভক্তিভরে শোনেন রামায়ণের রামগুণকথা। একমাত্র তিনিই এ পথের দিশারি। তাঁর কাছে গেলে বলে দিতে পারবেন রামচন্দ্রকে লাভ করার সহজ পথটা।

প্রেতযোনির উপদেশে আনন্দে ডগমগ হলেন ভক্তকবি তুলসীদাস। একদিন গেলেন রামায়ণ পাঠ আসরে। দেখা পেলেন মহাবীর হনুমানজির। তপোনিষ্ঠ তুলসীদাস জানালেন তাঁর মনের আকুল আকুতি, প্রভু রামচন্দ্রের দর্শন পেতে চান তিনি।

Hanuman
গোস্বামী তুলসীদাস ও সংকটমোচন, তুলসীদাসের ছবি – সৌজন্যে – উইকিমিডিয়া কমনস, সংকটমোচন – নিজস্ব চিত্র

অর্থের খোঁজে মানুষ ফেরে, রামের খোঁজে ফেরে কই! এমন ভক্তের দেখা পেয়ে নিজেও খুশি হলে মহাবীরজি। প্রসন্নচিত্তে বললেন, শ্রীরামের অবতারলীলা শুরু হয়েছে চিত্রকূট থেকে। তাঁরই পাদস্পর্শে ধন্য চিত্রকূটের জলমাটি, বৃক্ষলতাদি। সাধনজীবনের পক্ষে ওই জীবন অতুলনীয়। চিত্রকূটের মনোরম বনে নিত্য খেলা করেন প্রভু রামচন্দ্র। সেখানে কিছুদিন তপস্যা করলেই মিলবে প্রভুর দর্শন।

আনন্দে বিগলিত হয়ে ওঠে তুলসীদাসের মনপ্রাণ। সেদিনই মনোমন্দিরে গুরুরূপে বরণ করে প্রণাম করলেন মহাবীরজিকে। ফিরে গেলেন ভজনকুটিরে। কাশীতে বাস করলেন আরও কিছুদিন। কর্ণঘণ্টা নামক স্থানের এক গুরুআশ্রমে দীক্ষা ও সন্ন্যাসগ্রহণ করলেন তিনি। তখন বয়স তাঁর একত্রিশ। তারপর একদিন কাশী ছেড়ে পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পৌঁছলেন চিত্রকূটে।

প্রতিদিন সকালে স্নান সেরে ইষ্টপুজো করেন তুলসীদাস। এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না কখনও। রাম নাম-গানে সদাই আত্মমগ্ন হয়ে। তবুও প্রভুর দর্শন পান না তিনি। এই ভাবেই কাটতে থাকে প্রেমিকসাধকের একদিন দু’দিন করে দিনের পর দিন।

চিত্রকূটের বুক চিরে তরতর করে বয়ে চলেছে ছোট্ট নদী মন্দাকিনী। কোনও একদিন সকালে এরই ঘাটে স্নান সেরেছেন তুলসীদাস। ইষ্টপুজোর আয়োজন করছেন ঘাটে বসে। ভাবতন্ময় হয়ে চন্দন ঘষছেন মরমিয়া সাধক তুলসী গোঁসাই।

এমন সময় এসে উপস্থিত হলেন সুদর্শন দুটি বালক। অপরূপ লাবণ্যময় সুঠাম দেহ। কী অদ্ভুত এক আকর্ষণ এই বালক দুটির। এমন রূপ কি কোনও মানুষের হতে পারে! দেখে তন্ময় হয়ে গেলেন আজন্ম ভক্তকবি। কোনও কথা সরল না মুখ থেকে। হঠাৎ বালকদুটি বললেন তুলসীদাসকে, চন্দন দিয়ে তিলকসেবা করে দিতে।

এ কথায় বুঝতে মুহুর্তমাত্র দেরি হল না তুলসীদাসের। তাঁর সামনে আগত এ বালকদুটি আর কেউ নয়, তাঁরই প্রাণের ধন, পরম সাধনার বস্তু, স্ত্রীপরিত্যক্ত হওয়ার পর একমাত্র কাম্য ইষ্টদেব রাম লক্ষণ, এসেছেন দর্শন দিতে কৃতার্থ করতে।

ভাবাবিষ্ট হলেন তুলসীদাস। পরমানন্দচিত্তে প্রেমিকভক্ত তিলক–স্বরূপে বালক দুটির মুখমণ্ডলসাজিয়ে দিলেন চন্দন দিয়ে। গলায় পরিয়ে দিলেন বনফুলের মালা। তারপর আচম্বিতে হারিয়ে ফেললেন বাহ্যজ্ঞান। কেটে গেল অনেকটা সময় সময়ের নিয়মে। জ্ঞান ফিরে এল। দেখলেন, কোথায় যেন অন্তর্হিত হয়ে গেছেন নধরকান্তি বালক দুটি। হতবাক হয়ে তুলসীদাস বসে রইলেন মন্দাকিনীতটে। আনন্দে চোখের জলে বুক ভেসে গেল রামপ্রেমিকের। রামগতপ্রাণ হনুমানজির বাক্য সত্য হল ‘শ্রীরামচরিতমানস’ প্রণেতা প্রেমিক কবি গোস্বামী তুলসীদাসের জীবনে। জীবনমন ও মনুষ্যজন্ম সার্থক হল অঞ্জনাপুত্রের অন্তহীন করুণাধারায়।

চিত্রকূটে মন্দাকিনীর যে ঘাটে বসে শ্রীরামচন্দ্রের দর্শন পেয়েছিলেন তুলসীদাস, সেই ঘাটটি আজও সুখ্যাত রামঘাট নামে। তুলসীদাসের জীবনী থেকে জানা যায়, চর্মচক্ষে তিনি শ্রীরামচন্দ্রের স্থূলমূর্তিতে (রক্তমাংসের দেহে) দর্শন পেয়েছিলেন তিনবার।

Chitrakoot
চিত্রকূটে রামঘাট, ছবি – সৌজন্যে – উইকিমিডিয়া কমনস

তুলসীদাসের জীবনী পড়ে আমার ধারণা, যারা শ্রীরামচন্দ্রের উপাসক ও দর্শন প্রার্থী, তাদের নিত্যপুজপাঠের সঙ্গে হনুমানজির স্মরণ মননে অভীষ্ট সিদ্ধি হবেই।

‘ভক্তমাল’ গ্রন্থ রচয়িতা নাভাজি ছিলেন তুলসীদাসের পরমমিত্র ও সৎসঙ্গী। প্রেতযোনি শ্রীরামচন্দ্রকে লাভ করার জন্য হনুমানের স্মরণ নিতে উপদেশ দেওয়ার বিষয়ে তিনি ভক্তমাল-এ লিখেছেন–

‘তুলসী কহেন তাঁর লাগ পাব কোথায়। / তেঁই কহে কহি শুন লাগি পাবে যথা।। / এই গ্রামে অমুক এক ব্রাহ্মণের ঘরে। / তিনি আসি শ্রীরামায়ণ শ্রবণ যে করে।।’

গোস্বামী তুলসীদাসের জন্ম ১৫৫৪ সম্বৎ, বঙ্গাব্দ ৯০৫ সন, ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দের শ্রাবণ শুক্লা সপ্তমী তিথিতে মূলা নক্ষত্রে। কাশিতে দেহরক্ষা করেন ১৬৮০ সম্বৎ, বঙ্গাব্দ ১০৩১ সন, ১৬২৪ খ্রিস্টাব্দের শ্রাবণ কৃষ্ণা তৃতীয়াতে।

তুলসীদাসের শ্রীরামচরিতমানস গ্রন্থপ্রসঙ্গে তৎকালীন ভারত বিখ্যাত পণ্ডিত শ্রীমধুসূদন সরস্বতী লিখেছেন,

‘এই কাশীরূপী আনন্দকাননে তুলসীদাস হলেন চলমান তুলসী গাছের চারা, তাঁর কবিতারূপী মঞ্জরী অতীব সুন্দর, যার উপর শ্রীরামরূপী ভ্রমর সর্বদা গুনগুন করে বেড়ান।’

মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য হনুমানজির ভক্ত ছিলেন। শ্রীশ্রীচৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থে উল্লেখ আছে, বিজয়া দশমী তিথিতে তাঁর ভক্তদের বানরসেনা সাজিয়ে মহাপ্রভু নিজে হনুবৎ – লীলাভিনয় করেছিলেন। রাবণবধ লীলা দেখে লোকেরা অভিভূত হয়ে করেছিল জয় ধ্বনি –

‘বিজয়া–দশমী–লঙ্কা–বিজয়ের দিনে। / বানর-সৈন্য কৈলা প্রভু লঞা ভক্তগণে।। / হনুমান-আবেশ প্রভু বৃক্ষশাখা লঞা। / লঙ্কা গড়ে চড়ি’ ফেলে গড় ভাঙ্গিয়া।। / ‘কাঁহারে রাব্‌ণা’ প্রভু কহে ক্রোধাবেশে। / জগন্মাতা হরে পাপী, মারিমু সবংশে।। / গোসানঞির আবেশ দেখি লোকে চমৎকার। / সর্ব্বলোকে ‘জয় জয়’ বলে বার বার।। – ম।১৫।৩২-৩৫।।

স্বামী বিবেকানন্দ মহাবীরের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘মহাবীরের চরিত্রকে তোমার জীবনের আদর্শ করে নাও। তাঁর জীবন মৃত্যুর জন্য কোনও চিন্তা ছিল না। তিনি তাঁর নিজের বিচার বুদ্ধি সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন এবং কীভাবে নিজেকে চালনা করতে হবে তা জানতেন। সুতরাং তোমাদের জীবনকেও তাঁর আদর্শে গড়ে তোল যাতে অন্যান্য আদর্শ ও ভালোগুলো জীবনে নিশ্চিত হবে।। গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি আর কঠোর ব্রহ্মচর্য মহাবীরের জীবন সাফল্যের কারণ।’

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বুঝেছিলেন তাঁদের কুলদেবতা রঘুবীরের দর্শন পেতে গেলে মাকে ধরলে হবে না। পাকড়াও করতে হবে রামগতপ্রাণ হনুমানজিকে। ঠাকুরের জীবনকথা লিখতে গিয়ে ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলা প্রসঙ্গে’ গ্রন্থে স্বামী সারদানন্দ জানিয়েছেন – ‘সাধনকালের প্রথম চারী বৎসরে ৺ঠাকুর জগদম্বার দর্শনমাত্র করিয়াই নিশ্চিন্ত ছিলেন না। ভাবমুখে শ্রীশ্রীজগন্মাতার দর্শনলাভের পর নিজ কুলদেবতা ৺রঘুবীরের দিকে তাঁহার চিত্ত আকৃষ্ট হইয়াছিল। হনুমানের ন্যায় অনন্য ভক্তিতেই শ্রীরামচন্দ্রের দর্শনলাভ সম্ভবপর বুঝিয়া দাস্যভক্তিতে সিদ্ধ হইবার জন্য সাধনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। নিরন্তর মহাবীরের চিন্তা করিতে করিতে এই সময় তিনি ওই আদর্শে এতদূর তন্ময় হইয়াছিলেন যে, আপনার পৃথক অস্তিত্ব ও ব্যক্তিত্বের কথা কিছুকালের জন্য একেবারে ভুলিয়া গিয়াছিলেন। তিনি বলিতেন, “ওই সময়ে আহারবিহারাদি সকল কার্য হনুমানের ন্যায় করিতে হইত – ইচ্ছা করিয়া যে করিতাম তাহা নহে, আপনা আপনি হইয়া পড়িত! পরিবার কাপড়খানাকে লেজের মতো করিয়া কোমরে জড়াইয়া বাঁধিতাম, উল্লম্ফনে চলিতাম, ফলমূলাদি ভিন্ন অপর কিছুই খাইতাম না – তাহাও আবার খোসা ফেলিয়া খাইতে প্রবৃত্তি হইত না, বৃক্ষের উপরই অনেক সময় অতিবাহিত করিতাম এবং নিরন্তর ‘রঘুবীর রঘুবীর’ বলিয়া গম্ভীরস্বরে চিৎকার করিতাম। চক্ষুদ্বয় তখন সর্বদা চঞ্চল ভাব ধারণ করিয়াছিল এবং আশ্চর্যের বিষয় মেরুদণ্ডের শেষ ভাগটা ওই সময়ে প্রায় এক ইঞ্চি বাড়িয়া গিয়াছিল” (Enlargement of the Coccyx)। শেষোক্ত কথাটি শুনিয়া আমরা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “মহাশয় আপনার শরীরের ওই অংশ কি এখনো ওইরূপ আছে?” উত্তরে তিনি বলিয়াছিলেন “না, মনের উপর হইতে ওই ভাবের প্রভুত্ব চলিয়া যাইবার কালে উহা ধীরে ধীরে পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক আকার ধারণ করিয়াছে।”

দাস্যভক্তি সাধনকালে ঠাকুরের জীবনে এক অভূতপূর্ব দর্শন ও অনুভব আসিয়া উপস্থিত হয়। ওই দর্শন ও অনুভব তাঁহার ইতঃপূর্বের দর্শন প্রত্যক্ষাদি হইতে এত নূতন ধরণের ছিল যে, উহা তাঁহার মনে গভীরভাবে অঙ্কিত হইয়া স্মৃতিতে সর্বক্ষণ জাগরূক ছিল। তিনি বলিতেন, “এইকালে পঞ্চবটীতলে একদিন বসে আছি – ধ্যানচিন্তা কিছু যে করিতেছিলাম তাহা নহে, অমনি বসিয়াছিলাম – এমন সময়ে নিরুপমা জ্যোতির্ময়ী স্ত্রীমূর্তি অদূরে আবির্ভূতা হইয়া স্থানটিকে আলোকিত করিয়া তুলিল। ওই মূর্তিটিকেই তখন যে কেবল দেখিতে পাইতেছিলাম তাহা নহে, পঞ্চবটীর গাছপালা, গঙ্গা ইত্যাদি সকল পদার্থই দেখিতে পাইতেছিলাম। দেখিলাম মূর্তিটি মানবীর, কারণ উহা দেবীদিগের ন্যায় ত্রিনয়নসম্পন্না নহে। কিন্তু প্রেম-দুঃখ-করুণা সহিষ্ণুতাপূর্ণ সেই মুখের ন্যায় অপূর্ব ওজস্বী গম্ভীরভাব দেবীমূর্তি সকলেও সচরাচর দেখা যায় না। প্রসন্ন দৃষ্টিপাতে মোহিত করিয়া ওই দেবী-মানবী ধীর ও মন্থর পদে উত্তর দিক হইতে দক্ষিণে আমার দিকে অগ্রসর হইতেছেন! স্তম্ভিত হইয়া ভাবিতেছি, ‘কে ইনি?’ – এমন সময়ে একটি হনুমান কোথা হইতে সহসা উ-উপ্‌ শব্দ করিয়া আসিয়া তাঁহার পদপ্রান্তে লুটাইয়া পড়িল এবং ভিতর হইতে মন বলিয়া উঠিল ‘সীতা, জনম-দুঃখিনী সীতা, জনকরাজ নন্দিনী সীতা, রামময়জীবিতা সীতা!’ তখন ‘মা’ ‘মা’ বলিয়া অধীর হইয়া পদে নিপতিত হইতে যাইতেছি, এমন সময় তিনি চকিতের ন্যায় আসিয়া (নিজ শরীর দেখাইয়া) ইহার ভিতর প্রবিষ্ট হইলেন! – আনন্দে বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া বাহ্যজ্ঞান হারাইয়া পড়িয়া গেলাম। ধ্যান – চিন্তাদি কিছু না করিয়া এমনভাবে কোনও দর্শন ইতঃপূর্বে আর হয় নাই। জনম-দুঃখিনী সীতাকে সর্বাগ্রে দেখিয়া ছিলাম বলিয়াই বোধ হয় তাঁহার ন্যায় আজন্ম দুঃখভোগ করিতেছি।”

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button