কীভাবে সংকটমোচনের উপাসনা করলে বিপদমুক্তি ও সার্বিক উন্নতিলাভ হয়
হনুমানজির পুজো ও উপাসনার সহজ নিয়ম ও পদ্ধতির কথা শুনেছিলাম ১৯৭২ সালে হরিদ্বারের চণ্ডীপাহাড়ে চণ্ডীমন্দির অঙ্গনে এক রমতা সাধুর কাছে।
মহাবীরের পুজোর ব্যাপারে এক শ্রেণির বাজারি বইতে পুজোর যে ফর্দ, নিয়মকানুন, মন্ত্র ও নানান স্তব ইত্যাদি যা বলা হয়েছে, তাতে হিসাব করলে ষোড়শোপচারে দেবী দুর্গার প্রতিদিন পুজো করলে বোধ হয় খাটনি ও খরচা অনেক কম হবে।
আমি সাধুসন্ন্যাসী ভালবাসি। তাঁদের কথা শুনে চলি, তাঁদের কথা বলি। তবে আধুনিক ভারতের সমস্ত মঠ মন্দির মিশনের সাধু সন্ন্যাসীদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বলি, এঁদের কারও সঙ্গ কখনও করিনি। সারা জীবন প্রায় সাড়ে চার হাজার পথচলতি সাধু সন্ন্যাসী (রমতা সাধু), যাঁদের থাকা খাওয়ার ঠিক নেই, স্থায়ী ডেরা নেই, আজ এখানে, কাল সেখানে, তাঁদেরই সঙ্গ করেছি। তাঁদেরই কথা শুনে চলি, বলি।
হনুমানজির পুজো ও উপাসনার সহজ নিয়ম ও পদ্ধতির কথা শুনেছিলাম ১৯৭২ সালে হরিদ্বারের চণ্ডীপাহাড়ে চণ্ডীমন্দির অঙ্গনে এক রমতা সাধুর কাছে। তাঁর কথা শুনে ও মেনে দেখেছি বিষয়টা ঠিক আছে। সেই সাধুবাবা বলেছিলেন,
– সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সারাদিন কিছু খাবি না, এমনকি জল পর্যন্ত না। একান্ত না পারলে শুধু ডাবের জল চলবে। সূর্য অস্তে গেলে দুনিয়ার ফলমূল কিনতে যাবি না। পোকা খাওয়া আর পচা না হলেই হল, এক ছড়া কলা, তাতে যে কটাই থাক না কেন, ছড়া ভাঙ্গা হলে চলবে না। কোনও মন্দিরে হনুমানজিকে নিবেদন করে, অথবা ঘরে বিগ্রহ কিংবা ফটোতে শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহকারে নিবেদন করে প্রসাদ পাওয়া যেতে পারে। পেট ভরানোর জন্য কলাপ্রসাদ ছাড়াও অন্য যে কোনও ফল খাওয়া চলবে। জলের পরিবর্তে খেতে হবে ডাবের জল।
এ তো গেল সাধুবাবার কথা। হালে কয়েক বছর ধরে শুনে আসছি মেয়েদের নাকি মহাবীরের মূর্তি বা ফটো স্পর্শ করে প্রণাম করতে নেই। শনিবার ও মঙ্গলবারে হনুমানজির পুজো করলে নুন খেতে নেই ইত্যাদি বাজে কথা।
তুলসীদাসের কথায় শনি ও মঙ্গলবার হনুমানচালীসা এবং সংকটমোচন হনুমান অষ্টক পাঠ করে হনুমানজির পুজো করলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। সমস্ত বিপদ আপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। চিন্তাশক্তির স্বচ্ছতা আসে। অসম্ভব উৎসাহ বাড়ে কাজে। একমাত্র মহারাষ্ট্রে শনিবার, বাকি সারা ভারতে হনুমানজির পুজো করা হয় শনি ও মঙ্গলবার।
অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বাধা অশান্তি গ্রহদোষ ও অশুভ আত্মার দৃষ্টি থেকে মুক্তি পেতে প্রতিটা ঘরের দরজার (বাইরে থেকে) হনুমানজির ছবি, দুর্ঘটনারোধে গাড়িতে (হনুমানজির মুখ থাকবে রাস্তার দিকে), বিদ্যালাভের বাধায় ও অসম্ভব মানসিক অস্থিরতায় রুপোর অথবা মীনে করা লকেট লাল কার দিয়ে গলায় (লকেট থাকবে হৃদয়ের কাছে), যে কোনও দুর্ঘটনা ও সঙ্কট থেকে রক্ষা পেতে হনুমানজির লকেট এবং পুজোর বিকল্প এই মুহুর্তে আমার কিছু জানা নেই। লকেট ব্যবহারের আগে দেখে নিতে হবে, মহাবীরের ডান হাতে গদা, বাঁ হাতে যেন পাহাড় থাকে। এর বিপরীতে ফললাভের আশা শূন্য।
নারায়ণ তথা বিষ্ণু কবচ ছাড়া একমাত্র হনুমানজিই পারেন মানুষকে সমস্ত দুর্ভোগের হাত থেকে রক্ষা করতে।
যেখানে রামায়ণ গান অথবা পাঠ হয়, সেখানেই আলাদাভাবে একটা আসন রাখা হয়। বেনারস, অযোধ্যা, নৈমিষারণ্য ও চিত্রকূটে রামায়ণ পাঠ আসরে বিষয়টা নজরে এসেছে। মানুষের শ্রদ্ধাবনত বিশ্বাস, হনুমানজি অবশ্যই আসেন রামগুণকথা শুনতে। সেই জন্যই আসন পাতা।
পুরীর জগন্নাথ দর্শনে যায়নি এমন বাঙালির সংখ্যা নেহাতই কম, যারা গিয়েছেন তাদের মধ্যে শতকরা আটানব্বই জনের নজর এড়িয়ে হনুমানজি দাঁড়িয়ে আছেন বহাল তবিয়তে মন্দিরের প্রবেশদ্বারে।
জগন্নাথ মন্দিরের চারদিকে প্রবেশদ্বার আছে চারটি। পূর্বদিকে সিংহদ্বার, পশ্চিমে খাঞ্জাদ্বার, উত্তরে হস্তীদ্বার ও দক্ষিণে অশ্বদ্বার। অশ্বদ্বারে অশ্ব নেই, বাইরে রয়েছে একটি হনুমানের প্রকাণ্ড মূর্তি। পবনপুত্র যোদ্ধার বেশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন জগন্নাথ মন্দিরকে সমুদ্রের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য।
মন্দিরের সিংহদ্বারের দক্ষিণ দিকে জগন্নাথের পতিতপাবন মূর্তি, এর বাঁ দিকে রয়েছেন সিদ্ধ হনুমান ও রাধাকৃষ্ণ।
হনুমান মন্দিরের আশপাশের জায়গা প্রেতপিশাচের প্রভাব মুক্ত থাকে। মহাবীর স্বয়ং দুর্ঘটনারোধক। ভারতের বিভিন্ন তীর্থ পথে দেখেছি হনুমান মন্দির।
দ্বাপরের কথা। পঞ্চপাণ্ডবের বনবাসকালের ঘটনার প্রেক্ষিতে গন্ধমাদন পর্বতে চলার পথে ভীম এক জায়গায় দেখেন, একটি রুগ্ন বানর শুয়ে আছে পথ আটকে। তখন পথে ছেড়ে দিতে বলে একটু গর্বের সঙ্গে বলেন তিনি অমিত বলশালী।
বানর তখন তাঁর লেজটি সরিয়ে দিয়ে নিজের পথে করে এগিয়ে যেতে বলেন ভীমকে। কিন্তু ভীম তাঁর ল্যাজ কিছুতেই তুলতে পারলেন না। হনুমান তখন নিজের পরিচয় দিতে শ্রদ্ধায় ভীম পবনপুত্র এই অগ্রজ প্রণাম করেন। এ সময় হনুমান সাগর লঙ্ঘনের সময়কার মূর্তি দেখান ভীমের অনুরোধে। আলিঙ্গন করে কথা দেন কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের রথের উপরে বসে শত্রুসৈন্য নিধন করবেন হুঙ্কার দিয়ে। সে কথা রক্ষা করে পাণ্ডবদের যুদ্ধসংকট থেকে রক্ষা ও সংকটমোচন করেছিলেন মহাবীর সংকটমোচনজি।
হনুমানজির চরিত্র ও চারিত্রিক গুণাবলী সবচেয়ে বেশি জানা যায় রামায়ণ থেকে। শ্রীরামচন্দ্রের পরমভক্ত ছিলেন হনুমান। তাঁর প্রতি আনুগত্য, অগাধ ভক্তি, চারিত্রিক দৃঢ়তা মনুষ্যজাতির ইতিহাসে হয়ে আছে অবিস্মরণীয়।
অঞ্জনাপুত্রের ইষ্টনিষ্ঠা বিস্ময়কর। ইষ্টনিষ্ঠা শব্দের অর্থ একজনকে বা একটি লক্ষ্যবস্তুকে ধরে রাখা। কোনও কারণেই তা থেকে বিচ্যুত না হওয়া। যেমন হনুমানজি ও প্রেমিককবি গোস্বামী তুলসীদাসের রাম ছাড়া আর কিছুই ভাবার ছিল না তাঁদের।
কালীঘাটের কালী, শ্যামনগরের (মূলাজোড়) কালী দেখেও মন তাতে এতটুকুও আকর্ষিত হয়নি বামাক্ষেপা বাবার। তারাপীঠের তারা মা তাঁর একান্ত আপন, অন্তরের পরমধন। অন্য কোনও দেবদেবীই স্থান পায়নি হৃদয়মনে। একে বলা হয় ইষ্টনিষ্ঠা। মোটের উপর এক-এ নিবেদিত হওয়া।
বিভিন্ন ঈশ্বরমুখী বিক্ষিপ্ত মনের মানুষের মন একমুখী ঈশ্বর চিন্তায় আপ্লুত হয় একমাত্র মহাবীর উপাসনায়।
সূর্যদেব ও কশ্যপমুনির করুণায় বিভিন্ন শাস্ত্র পাঠ, অগাধ জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য লাভ করেছিলেন হনুমানজি। এঁর উপাসনায় বিদ্যালাভের বাধা দূর হয়। কালক্রমে জ্ঞানলাভ হয় বিভিন্ন শাস্ত্র পুরাণে।
শক্তি, বিদ্যা, বিনয়, দক্ষতা, সংস্কৃতি, আনুগত্য, উপস্থিত বুদ্ধি, প্রচেষ্টায় সফলতা, ধর্মে অনুরাগ, ত্যাগ, ভক্তি, অগাধ বিশ্বাস, শরণাগতি, অনুপ্রেরণা, অন্যের মঙ্গল করার ইচ্ছা জীবনের বিনিময়ে, অফুরন্ত সাহস, উদারতা, এইসবই হনুমানজির সহজাত ও রক্তগত গুণ। এইসবই সহজে নয়, অনায়াসে ও অতি সহজে লাভ করা যায় মহাবীরজির শরণাগত হলে, নিত্য উপাসনায়।