Mythology

সহজ কিছু কাজ করলেই দেখা দেন হনুমানজি

রক্তমাংসের দেহে এদের দর্শন পাওয়া যায়, কথা বলা যায়। এঁরা চির অমর। আজও বেঁচে আছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে, নির্জনে।

পৌরাণিক যুগের সাতজন চিরঞ্জীবীর মধ্যে হনুমানজি সহ আর ছ’জন হলেন বিভীষণ, অশ্বত্থামা, পরশুরাম, মহাবলী বালি, মার্কণ্ডেয়, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব। রক্তমাংসের দেহে এদের দর্শন পাওয়া যায়, কথা বলা যায়। এঁরা চির অমর। আজও বেঁচে আছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে, নির্জনে।

আনুমানিক ১২৮৬ বছর আগের কথা। আচার্য শঙ্করের সঙ্গে উত্তরকাশীতে দেখা ও কথা হয় বিশালবপু কৃষ্ণবর্ণ মহামতি ব্যাসদেবের। তাঁর আশীর্বাদে আচার্যের আয়ু বৃদ্ধি হয় ষোলো বছর। নির্দিষ্ট কাজকে তিনি সম্পূর্ণ করে তোলেন। আমার শাস্ত্রীয় শিক্ষাগুরু স্বর্গীয় জ্ঞানদাপ্রসাদ চৌধুরীর সঙ্গে একসময় তারকেশ্বর মহন্ত মহারাজ স্বামী জগন্নাথ আশ্রমের অত্যন্ত হৃদ্যতা ছিল। স্বামী জগন্নাথজি একবার রক্তমাংসের দেহে দর্শন করেছিলেন রামায়ণী যুগের বিশালদেহী বিভীষণকে। এই বিস্ময়কর দর্শনের কথা তিনি বলেছিলেন মাস্টারমশাইকে।


১৯৭৮ সালের কথা। এখনকার মতো ভৈরবঘাটি চটি থেকে গঙ্গোত্রীর পথে পুল ছিল না। হাঁটাপথে এ সময় এক কেরলদেশীয় উদাসীন সম্প্রদায়ের বৃদ্ধ সাধুবাবার সঙ্গলাভ হয়। কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে বলেছিলেন, নেপালে পশুপতিনাথ দর্শন করে হেঁটে ফেরার সময় এক জঙ্গলের কাছে রক্তমাংসের দেহে দর্শন পেয়েছিলেন অশ্বত্থামার। বর্ণনায় বলেছিলেন বিশাল দেহ, গায়ের রং কালো। তাঁদের এসব দর্শন ও কথায় আমার আঠারো আনা বিশ্বাস।

মহাবীর হনুমানজিকে সচক্ষে জীবন্ত দেখেছেন এমন মহাপুরুষদের মধ্যে আছেন, ভারতবরেণ্য সাধক মাধবাচার্য (ত্রয়োদশ শতাব্দী), শ্রীরামচরিতমানস গ্রন্থপ্রণেতা উত্তর ভারতের প্রসিদ্ধ প্রেমিক কবি তুলসীদাস গোস্বামী (ষোড়শ শতাব্দী), শ্রীরামদাস স্বামী (সপ্তদশ শতাব্দী), রাঘবেন্দ্র স্বামী (সপ্তদশ শতাব্দী), স্বামী রামদাস (বিংশ শতাব্দী) এবং শিরডির সাঁইবাবা (বিংশ শতাব্দী)।


১৯৮০ সালের কথা। তখন আমার নেই কাজ তো খই ভাজ দিন চলছে। একাই গিয়েছিলাম অযোধ্যায়। অযোধ্যা স্টেশন আছে। সেখানে নামিনি। নেমেছিলাম ফৈজাবাদে। এখান থেকে অযোধ্যায় যাওয়ার সুবিধা বেশি। যাইহোক, অযোধ্যায় যা যা দেখার ছিল তা সবই দেখলাম পায়ে হেঁটে। দেখার জায়গাগুলি সব পাশাপাশি। এরপর সাধু খুঁজতে খুঁজতে এসে গেলাম সরযূতীরে রামঘাটে। দেখেছি, রামায়ণের সরযূ আজও বয়ে চলেছে একইভাবে, আপনমনে। এত বয়সেও পূর্ণযুবতী। এতটুকু টোল খায়নি, ভাটা পড়েনি দেহে। যেন যৌবনের বান ডেকে চলেছে সরযূর ভরা বুকে। মনের সমস্ত মলিনতাই ধুয়ে মুছে যায় সরযূর সঙ্গে দেহমিলনে। পবিত্র নির্মল সরযূ। অযোধ্যানাথ শ্রীরামের পাদস্পর্শে আরও পবিত্র হয়ে উঠেছে ভক্তিভূমি অযোধ্যা।

Hanuman

শ্রীরামের নামানুসারেই সরযূতীরে রামঘাট। ছোট ছোট হোগলাপাতার ঘর কিছু আছে স্নানের পর যাত্রীদের বস্ত্র পরিবর্তনের জন্য। এরই এক পাশে সারি দিয়ে সাধুদের ছোট বড় অসংখ্য ডেরা। সেগুলিও সব হোগলার। এখানে যাঁরা আছেন তাঁরা প্রায় সকলেই বৈষ্ণব সাধু। কপালে গোপীচন্দনের চওড়া তিলক। স্বল্পবস্ত্র। ভ্রুক্ষেপ নেই। মুখে শুধু একই নাম – সীতারাম, সীতারাম। স্নান সেরে কেউ ফিরছে হোগলার ডেরায়, কেউ চলেছে রাম মন্দিরে।

সরযূকে ডানপাশে রেখে চলেছি পাড় ধরে। বাঁদিকে সাধুবাবাদের ডেরা। এসে দাঁড়ালাম বাঁশের খুঁটি দিয়ে তৈরি একটা ঝুপড়ির সামনে। বাঁশের বেড়া, ছাউনি হোগলাপাতার। বেশ বোঝা যায় শীতকালে ঠান্ডা ঢোকে হু হু করে। এক পাল্লার দরজা। সেটাও বাঁশের চটার। ঝুপড়ির উচ্চতা এমন, মাথা একটু নিচু করেই ঢুকতে হয়।

একটায় ঢুকলাম। দেখলাম এক বৃদ্ধ সাধুবাবা বসে আছে আসনে। প্রশস্ত কপাল জুড়ে চওড়া তিলক। সারা দেহের বিভিন্ন অংশে চন্দনের ছাপ, চিতা বাঘের মতো। চেহারায় ও চোখেমুখে শান্ত সৌম্যের প্রতীক যেন। মাথার মাঝামাঝি পর্যন্ত টাক। পিছনে সামান্য চুল। গালের দাড়ি পেট পর্যন্ত। ধব ধবে চুলদাড়ি থেকে একটা কালো বের করে কার সাধ্যি। বয়সের জন্য রোগা ভাবটাই চোখে পড়ে বেশি। বুক পেট সমান। পেটমোটা হাত-পা সরু, মদমার্কা চেহারা না। চোখে মুখে উজ্জ্বলতার ছাপ। রামায়েৎ সম্প্রদায়ের সাধু। তিলক দেখেই বুঝলাম। খালি গা হাঁ করে আছে। পাকা লোমে বুক ভরা। দয়ার চেহারা। বয়স পঁচাত্তরের উপরে ছাড়া কমে নয়। আয়ত চোখ। মাঝারি মাপের টিকালো নাক। এক নজরে দেখছি প্রয়োজনের জিনিসপত্র সামান্যই। যেটুকু না থাকলে নয়। সাধুবাবার বাঁপাশে ছোট্ট একটা আসন।

ঝুপড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই বললেন,

– বয়ঠো বেটা, বয়ঠো।

বলেই একটুকরো ছেঁড়া চট পেতে দিলেন। দেয়ার মতো আর কিছু ছিল না তাঁর। তবে কণ্ঠে ছিল আপন করে নেওয়ার সুর। এ সুর শুধু নিঃস্বার্থ সাধুদেরই হয়, গৃহীদের নয়। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বসলাম। নানান বিষয় নিয়ে টানা কথা হয়েছিল প্রায় ঘণ্টাতিনেক। কথায় কথায় একসময় জানতে চেয়েছিলাম,

– বাবা, গৃহত্যাগের পর থেকে বলতে গেলে সারাটা জীবনই তো কেটে গেল অযোধ্যায়। রামের নামে পড়ে রইলেন রামঘাটের হোগলার ঝুপড়িতে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় এ ঝুপড়িতে থাকা না থাকা সমানই। এত কষ্ট করে অযোধ্যায় পড়ে থেকে শ্রীরামচন্দ্র কিংবা হনুমানজির করুণালাভ কি কিছু হল?

একথা শুনে সাধুবাবা মুখের দিকে চেয়ে রইলেন শূন্যদৃষ্টিতে। একটা কথাও সরল না মুখ থেকে। মিনিটখানেক কেটে গেল এইভাবে। মাথাটা সামান্য নিচু করে বসে রইলেন। লক্ষ্য করলাম চোখের জল নেমে এল কপোল বেয়ে। বুঝলাম, একটা কিছু ঘটেছে। আরও মিনিটখানেক কাটার পর ঢুকরে কেঁদে ফেললেন। আমি কিছু বললাম না। সাধুবাবা বললেন,

– বেটা, তাঁর করুণার কথা বলেও শেষ করতে পারব না। একবার বেশ কয়েকদিন ধরে শরীর খারাপ যাচ্ছিল। তেমন গুরুত্ব দিলাম না। সেদিন ভোর রাত থেকেই শুরু হল মুষলধারায় বৃষ্টি। ঝুপড়ি থেকে বেরয় কার সাধ্যি। বৃষ্টির মধ্যেই তেড়ে এল জ্বর। পাশের ডেরায় কোনও সাধুকে যে একটু খবর দেব, সে সুযোগ হল না বৃষ্টির জন্য, বিছানা ছাড়ার সামর্থ্য রইল না জ্বরের কারণে।

একটু থামলেন। তাকালেন আমার মুখের দিকে। কোনও কথা বলে ছেদ টানলাম না সাধুবাবার কথায়। তিনি বললেন,

– আকাশ বৃত্তিতে আমার জীবন চলে (আকাশ বৃত্তি হল কেউ দিলে খাওয়া হয়, না দিলে অভুক্ত)। পথে বেরলে রামজির দয়ায় কিছু না কিছু জুটে যায়। সেদিন শরীরের অনড় অবস্থা আর তুমুল বৃষ্টি, ঝুপড়ি থেকে বেরতে পারলাম না। প্রবল জ্বরের সঙ্গে খিদের জ্বালায় এক সময় জ্ঞান হারালাম। গভীর রাত। তখনও বৃষ্টির বিরাম নেই। হঠাৎ মাথায় একটা লোমশ হাতের স্পর্শ, সঙ্গে চামরের মতো কী একটা যেন মাথা থেকে পা পর্যন্ত বুলিয়ে গেল। মুহুর্তে ঘুম ভেঙে গেল। পূর্বচৈতন্য ফিরে পেলাম। আনন্দের এক হিল্লোল বয়ে চলল সারা দেহমনে। জ্বর বলে আর কিছু নেই দেহে। লম্ফটা ধরালাম। দেখলাম ঘরে কেউ নেই। কলা আপেল আঙুর সমেত নানান ধরনের পাকা সুমিষ্ট একগাদা ফল পড়ে আছে রামজির আসনের পাশে। বৃষ্টিভেজা পায়ের ছাপ দেখলাম দরজা থেকে খাট পর্যন্ত।

এই পর্যন্ত বলে সাধুবাবা হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন। এরপর আরও অনেক অনেক কথা হল তাঁর ফেলে আসা জীবনপ্রসঙ্গে। একসময় প্রণাম করে ফিরে এলাম একডালি দিব্য আনন্দপসরা নিয়ে। সার্থক হল আমার রঘুবীরের অযোধ্যাদর্শন।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button