কলিযুগের সমস্ত দোষ থেকে নিস্তার পাওয়ার তন্ত্রে বর্ণিত পথ
তিনিই একমাত্র রক্ষাকর্ত্রী। এই পুজোয় কতটা ভক্তি, আন্তরিকতা, শ্রদ্ধা, সততা, নিষ্ঠা - তাই দেখার। কেবলমাত্র বিড়ালতপস্বী হয়ে থাকলে চলবে না।
‘কলিযুগের মাহাত্ম্যে দেখা যাচ্ছে, মহানির্বাণতন্ত্রের মতে মহাকালীহ’ই একমাত্র রক্ষাকর্ত্রী। সেইহেতু কালীপুজো বা তার শরণাগত হওয়াই একান্ত প্রয়োজন। যদিও কূর্মপুরাণমতে শিবই একমাত্র রক্ষাকর্তা। তিনি নিজেই মহাকাল, তাই মহাকাল শান্ত থাকলে সমস্ত কিছুই শান্ত থাকবে। তাই কলিকালে শিবপুজো অবশ্য কর্তব্য।
আবার বিষ্ণু পুরাণ মতে, সর্বযজ্ঞের নারায়ণ, তিনিই চক্রধারী মধুসূদন, তিনিই কালচক্রকে প্রশমিত করতে পারেন। তাই বিষ্ণুযজ্ঞ ও হরিনাম সংকীর্তনই একমাত্র পথ। কিন্তু প্রশ্ন হল এই পুজো বা এই যজ্ঞ করলেই কি কেবলমাত্র কলির দোষ থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে?
দেখতে হবে এই পুজোয় কতটা ভক্তি, আন্তরিকতা, শ্রদ্ধা, সততা, নিষ্ঠা – তাই দেখার। কেবলমাত্র বিড়াল তপস্বী হয়ে থাকলে চলবে না। কলিযুগে বহুবিধ আশ্রম গড়ে উঠেছে। তবে অধিকাংশ আশ্রমিক গুরু কতটা সত্যনিষ্ঠ, আদর্শনিষ্ঠ, শ্রদ্ধাশীল, আদর্শবাদে বিশ্বাসী তা সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা হামেশাই দেখতে পাচ্ছি। বিভিন্ন গুরুর আচার-ব্যবহার, তাদের নিষ্ঠা এবং ভ্রষ্টাচার, ক্রিয়াকাণ্ড আমাদের আদর্শভ্রষ্ট করে দিয়েছে। প্রজাপতি ব্রহ্মা সৃষ্টির ঊষালগ্নেই ভ্রষ্টাচারে আকৃষ্ট হয়ে সৃষ্টির আপন দেহসম্ভুতা সরস্বতীর ওপর নিজের কামনা-বাসনা নির্বাহ করেন। এটাই সত্যযুগ থেকে কলিযুগ পর্যন্ত চলে আসছে। সেই কারণেই যুগের শেষলগ্নে কলির কোন দোষ দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। শুধু সময়ের রাজতন্ত্র বিকাশ লাভ করছে। ধর্মের নয়।
খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর সন্ধিকালে যখন বঙ্গভূমি বিকৃত তন্ত্রসাধনায় উত্তাল। আরামবাগ ছেড়ে নবদ্বীপের ভাটপাড়া পণ্ডিত সমাজের কাছে আসেন তন্ত্রসাধক পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ, আসল নাম কৃষ্ণানন্দ মৈত্র।
অমাবস্যার এক নিশুতি রাতে ধ্যানমগ্ন কৃষ্ণানন্দের প্রতি দৈবাদেশ হয়, মহানিশা অবসানের পর প্রথম যে নারীমূর্তি তুমি দেখবে, সেই রূপেই মূর্তি গড়ে আমার পুজো করবে। দৈবাদেশ অনুসারে মাতৃসাধক তাই করেছিলেন। প্রতি মাসের অমাবস্যার ভোরে কালীপুজা এবং নিশাবসানে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়।
কঙ্কালমালিনী তন্ত্রে কথিত আছে, ‘কালিকা ভৈরবো দেবো জাগর্ত্তি সদা কলৌ।’ অর্থাৎ কলিকালে কালী শিব সর্বত্র জাগ্রত। কুব্জিকা তন্ত্রগ্রন্থে ‘কালিকা মোক্ষদা দেবী কলৌ শীঘ্র ফলপ্রদান করে। কালীতন্ত্রের ও স্বতন্ত্রতন্ত্রের এই দুটো তন্ত্রগ্রন্থ থেকে তন্ত্রসাধক পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ‘বৃহৎতন্ত্রসার’ গ্রন্থে দেবীর যে রূপ বর্ণনা করেছেন তা বাংলার আদি দক্ষিণাকালী। চেতনাশক্তিই কালী। অর্থাৎ চিদ্-ঘন-কায়। জ্ঞানই ধর্ম, কর্ম ও শক্তি।
যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ সারা জীবন কালী সাধনা করেও সারদাদেবীকে ষোড়শী দেবীরূপে পুজো করেছিলেন। তাঁর সিদ্ধির দ্বার উন্মুক্ত করবার জন্য। শ্রীকুলানন্দ সংহিতায়াং ত্রিপুরাসুন্দরী-ষোড়শীবিদ্যা অনুযায়ী। কারণ জীবাত্মা হচ্ছেন ষোড়শী প্রকৃতিরূপা অহংকার – ঈশ্বরীয় শক্তি। এর উপাদান হচ্ছে পঞ্চভূত – মাটি, জল, তেজ-জ্যোতি বা অগ্নি, বায়ু ও আকাশ বা শূন্যতা। পঞ্চপ্রাণ। আপান, সমান, উদ্যান, ব্যান ও বায়ু। পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় – চোখ, কান, নাক, জিভ, চর্ম এবং মন। এই ষোলটির যেখানে উপস্থিতি, তা-ই ষোড়শী। জীবাত্মা তথা আত্মার শক্তি আদ্যাশক্তি, কালী, দুর্গা, রাম, কৃষ্ণ, শিব প্রভৃতি ঈশ্বরীয় রূপ। এই ষোড়শী হচ্ছেন দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী। এটা সাংখ্য শাস্ত্রের ২৪ তত্ত্বে সমান। বীজমন্ত্রঃ ওঁ ক্রীঁ হুঁ স্বাহা।
দ্রষ্টব্য : কুব্জিকা তন্ত্র – (২/১৮-১৯)। ভাগবতশাস্ত্র মতে কলিযুগের বয়স ৪,৩২,০০০ হাজার বৎসর।
কালি কালি মহাকালি কালিকে পাপহারিণী।
ধর্মার্থ মোক্ষদে দেবি নারায়ণি নমোহস্তু তে।।