বৈদিক মধুবিদ্যা – দৈবকৃপায় দুর্ভাগ্যের প্রতিকার
জন্মান্তরের কর্মফল প্রারব্ধই হচ্ছে বর্তমান জন্মে অদৃষ্টরূপী ঈশ্বর। যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর ভাইপো ও ভাইঝির বিবাহ দিতে নিষেধ করেছিলেন।
পূর্ব জন্মের পুণ্য ও পাপকর্মের দ্বারা অর্জিত শুভ ও অশুভ ফল ইহজন্মে গ্রহরূপে সংস্থিত হয়েছে। গ্রহ-নক্ষত্র সবই ঈশ্বরের অধীন। জন্মান্তরের কর্মফল প্রারব্ধই হচ্ছে বর্তমান জন্মে অদৃষ্টরূপী ঈশ্বর। কর্মফলরূপী ঈশ্বর তথা জীবাত্মা বা প্রারব্ধ মানুষের জন্মের সময় মানুষকে তাঁদের ভাগ্যের অবস্থা জানাবার জন্য গ্রহ-নক্ষত্রগণকে যোগ-রূপে রাশিচক্রের যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেন।
গর্ভাধানের অর্থাৎ গর্ভসঞ্চারের সময়টি জাতকের সঠিক জন্মলগ্ন। ঐ সময়ে জাতকের কপালে বিধি লিখন হয়ে থাকে। কেউ কোন উপায়ে তা খণ্ডন করতে পারে না। এমন কি স্বয়ং বিষ্ণু ও শিব তা খণ্ডন করতে পারেন না – ব্রহ্মা (নারদ পঃ রাঃ ১/৩/১২ – ১৩, ২৩, ১/১২/৪৫)। এখানে মানুষের কোন হাত নেই। সব পূর্বনির্দিষ্ট হয়ে আছে।
মানুষের ভবিষ্যৎ যে পূর্বনির্দিষ্ট সে কথা গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আমি সকলকেই মেরে রেখেছি, তুমি কেবল নিমিত্তমাত্র – (গীতা – ১১/৩৩)। ভবিষ্যৎ অপরিবর্তনীয়। ভাগ্যের পরিবর্তন করা যায় না। দৈব প্রভাব অখণ্ডনীয় যা খণ্ডন করা যায় না। যা ঘটবার তা ঘটবে, যা হবার তা হবে।
যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর ভাইপো ও ভাইঝির বিবাহ দিতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু সেই নিষেধ অগ্রাহ্য করে তাঁদের বিবাহ দেওয়া হলে ভাইপো অক্ষয়ের অকাল মৃত্যু আর ভাইঝি লক্ষ্মীর অকাল বৈধব্য হয় ফলে তিনি খুব শোকাহত হন। কিন্তু তিনি ঐ দুজনের দুর্ভাগ্য নাশ করার কোন চেষ্টা করেননি। কারণ জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ বিধির লিখন যা কোন ভাবেই খণ্ড করা যায় না। এসব ব্যাপার দৈব নির্দিষ্ট। অর্থাৎ মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্য নির্মাতা।
যদি পাথর, রুদ্রাক্ষ, শিকড়, আংটি ও মালা প্রভৃতি ধারণ করে দুর্ভাগ্য নাশ ও সৌভাগ্য লাভ হত তাহলে যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ এগুলি ধারণ করে বসে থাকতেন এবং ভক্তদেরও ঐ সকল ধারণ করতে উপদেশ দিতেন। কলিতে সদগুরু প্রদত্ত পুরশ্চরণ সিদ্ধ ইষ্টকবচ ধারণ করে সাধনা করলে অবশ্যই সর্বপাপ নাশ হয়। যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ পুরশ্চরণ সিদ্ধ ইষ্টকবচ ধারণ করেছিলেন, সন্ন্যাস দীক্ষা নেওয়ার সময় মা সারদাদেবীকে দিয়েছিলেন এবং সাধনা করার জন্য বলেছিলেন – (কথামৃত)। অর্থাৎ সাধকের সাধনার উপর উপকার নির্ভর করে। এসব সময় না হলে হয় না।
কলিতে বামাক্ষেপার মতন সিদ্ধ কৌলগুরু হলে তবে তন্ত্রের ক্রিয়া সফল হয়। কারণ তন্ত্রের সবটাই গোপন ও রহস্যাবৃত। সিদ্ধগুরুর উপদেশ মত চলতে হয়। নচেৎ পতন হয়। দেবদেবীর মূর্তিগুলি কোন কথা বলে না – কোন কথা শোনে না। কথা শুনতে পেলে তাঁরা অবশ্যই উত্তর দিতেন। এঁদের কথা বলা কেবল মাত্র গল্পে পর্যবসিত হয়ে আছে। এর প্রমাণ হচ্ছে শ্রীরামকৃষ্ণের গলার অসুখ নিরাময়ের জন্য তাঁর পত্নীর তারকেশ্বরে হত্যে দিয়ে ব্যর্থ হওয়া – (কথামৃত)।
রাঁচির বিখ্যাত রাজারাপ্পার ছিন্নমস্তার মূর্তি ভেঙে ডাকাতরা তাঁর দেহের সব মূল্যবান বস্তু নিয়ে পালিয়ে গেছে। আজও কেউ ধরা পড়েনি। ভক্তেরা দেবদেবীর মূর্তিতে নিজস্ব ভক্তি আরোপ করে তাঁদের পূজা করে থাকে মাত্র। তাঁদের ভোগ দেয় নিজেরা ভোগ করবে বলে। এসব ভক্তি টেকে না। চাই জ্ঞানমিশ্র ভক্তি।
যখন ভক্ত জগৎ চৈতন্যময় দেখে তখনই কেবলমাত্র মূর্তি জাগ্রত মনে হয়। যে দেবদেবীর মূর্তিগুলি আত্মরক্ষা করতে পারে না, সেগুলি ভক্তদের রক্ষা করবে কি করে? মানুষ নিজ নিজ সংস্কার ও শ্রদ্ধার বশে ঐগুলিকে পূজা করে থাকে। যেমন গুরুজন ও পিতা-মাতাকে শ্রদ্ধা করে। দৈবের চেয়ে মহাবল আর কিছুই নাই – (মহাভারত)। যা আছে মহাভারতে, তা আছে দেহ ভাণ্ডারে। অর্থাৎ দেহতে ভগবান। সদগুরুই উপাস্য। সেই আত্মজ্ঞান দানকারী গুরুই পূজ্য। আত্মোপলব্ধির পথ সত্য-ত্যাগ-অহিংসা।