ব্রজভূমিতে খুনসুটির হোলি, লাঠিপেটা দেখতে হাজারো মানুষের ভিড়
একসময় বৃন্দাবনের পুরুষদের হৃদপিণ্ডের ধুকপুকুনি বাড়িয়ে হাজির হয় সেই দিন। দেশের অন্য পুরুষদের কাছে যে দিন শুধুই হোলি। সেদিন বৃন্দাবনের কাছে বরসানা ও নন্দগাঁওয়ের পুরুষদের কাছে ‘লাঠমার হোলি’।
খেলব হোলি, লাঠি দিয়ে পেটাব না তাই কখনও হয়! হোলির শুভ মহরতের আগে তাই দরকার একটা মোটা শক্তপোক্ত লাঠি। আর প্রয়োজন লাঠির ঘা সামলানোর মত পোক্ত ঢাল। নাহলে মহিলা ব্রিগেডের হাত থেকে হোলির দিন নিস্তার নেই যুবাদের। বছরের একটা দিন আপাত শান্ত ঘরোয়া মেয়েরা কেমন যেন মারমুখী মেজাজের হয়ে ওঠেন। আধুনিক রাধাদের আক্রোশ সামলাতে তাই হোলির আগে থেকেই সাজ সাজ রব পড়ে যায় বৃন্দাবনে।
হোলির দিন মেয়েদের হাতে মার খেতেই হবে। সেকথা ভালমতোই জানেন নন্দগাঁও বা বরসানা গ্রামের এযুগের কৃষ্ণরা। মারের হাত থেকে বাঁচতে এক সপ্তাহ ধরে চলে তারই মানসিক প্রস্তুতি। রঙের দিনে মার খাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে চলে নানারকম ফন্দিফিকির। এইসব কিছুর মধ্যে দিয়ে একসময় বৃন্দাবনের পুরুষদের হৃদপিণ্ডের ধুকপুকুনি বাড়িয়ে হাজির হয় সেই দিন। দেশের অন্য পুরুষদের কাছে যে দিন শুধুই হোলি। সেদিন বৃন্দাবনের কাছে বরসানা ও নন্দগাঁওয়ের পুরুষদের কাছে ‘লাঠমার হোলি’।
চারদিকে আবির, ফুলের পাপড়ি। তার মাঝখানে বসে মাথায় মোটা পাগড়ি আর হাতে পোক্ত ঢাল নিয়ে সার বেঁধে গোবেচারা মুখ করে বসে ছেলেরা। আর তাদের মাথার ওপর ধরা ঢালে আছড়ে পড়ে মজবুত মেয়েলি হাতের লাঠির ঝড়। হোলির দিন বরসানাতে রং খেলতে আসা ছেলেদের কপালে জুটবেই জুটবে লাঠির আছাড়। সেই কবে নাকি একবার শ্রীকৃষ্ণ বরসানাতে গিয়ে রাধাকে রং মাখিয়েছিলেন। ব্যাস, তারপর থেকেই বংশ পরম্পরায় চলছে লাঠমার প্রথা।
মথুরার নন্দগাঁও ছিল শ্রীকৃষ্ণের গ্রাম। তার ঠিক পাশের গ্রামেই বাড়ি শ্রীরাধিকার। ছোটবেলা থেকেই দুষ্টুমিতে কৃষ্ণের জুড়ি মেলা ছিল ভার। বিশেষ করে পাশের গাঁয়ের মেয়ে রাধার সাথে শৈশব থেকেই খুনসুটি করতে ভারী মজা পেতেন শ্যামসুন্দর। রাধার সুন্দর মনোলোভা গাত্রবর্ণকে মনে মনে ভারী হিংসা করতেন তিনি। এমন সুন্দর গায়ের রং তাঁর কেন হল না? মনের সেই দুঃখের কথা জানিয়ে মা যশোদার কাছে একবার নালিশ করলেন শ্রীকৃষ্ণ।
মা যশোদা নয়নের মণির দুঃখ সহ্য করতে পারলেন না। শ্রীকৃষ্ণকে তিনি পরামর্শ দিলেন বরসানায় গিয়ে রাধা ও অন্যান্য গৌরবর্ণা গোপিনীদের রং মাখিয়ে আসার। তাহলেই কৃষ্ণের মনের দুঃখ দূর হবে। মায়ের পরামর্শ মত নন্দগাঁও থেকে রং নিয়ে সদলবলে কৃষ্ণ গেলেন বরসানায়। সেখানে রাধিকা ও বাকি গোপিনীদের রং মাখিয়ে একেবারে ভূত করে দিলেন কৃষ্ণ ও বাকি গোপেরা। এতে বেজায় চটে গেলেন বরসানার মেয়েরা। শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে নন্দগাঁওতে গিয়ে হাজির হলেন রাধিকা ও তাঁর সঙ্গিনীরা। সঙ্গে নিয়ে গেলেন মোটা লাঠি। সেই লাঠির হাত থেকে বাঁচতে শ্রীকৃষ্ণও আঁটলেন ফন্দি। পাল্টা ঢাল দিয়ে ক্রুদ্ধ মহিলাদের আক্রমণ সামলাতে আসরে নামলেন নন্দগাঁওয়ের ছেলেরা।
শ্রীকৃষ্ণ দলবল নিয়ে ফুল আর লাড্ডু ক্ষিপ্ত গোপিনীবাহিনীর দিকে ছুঁড়ে তাঁদের মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। অতঃপর কৃষ্ণের পরামর্শে গোপবৃন্দ মাটি, বেত হাতের সামনে যে যা পেলেন তাই নিয়ে রাধিকাবাহিনীর মোকাবিলায় মাঠে নেমে পড়ে। এই প্রথাই ‘লাঠমার হোলি’ নামে কালক্রমে লোকপ্রিয় হয়ে উঠল ব্রজধামে। রীতি মেনে আজও প্রথমে নন্দগাঁওয়ের ছেলেরা বরসানাতে হোলি খেলতে এসে মেয়েদের লাঠি আক্রমণের মুখে পড়ে।
মূলত বরসানার রাধারানী মন্দির প্রাঙ্গণেই আনুষ্ঠানিকভাবে সূচনা হয় ‘লাঠমার হোলি’-র উৎসবের। লাঠালাঠির আগে রাধা-কৃষ্ণের পূজার্চনা করা হয়। তারপর শুরু হয়ে যায় একে অপরকে লক্ষ্য করে গাঁদা, গোলাপ ইত্যাদি নানা ফুলের বর্ষণ। এই প্রথা পরিচিত ‘ফুল দোল’ নামে। উৎসবে মিষ্টি আবশ্যিক। তাই ফুলের সাথে হোলি উদযাপনকারীদের লাড্ডু দিয়ে করানো হয় মিষ্টি মুখ। সেই লাড্ডুই আবার বৃষ্টির চেহারায় ধেয়ে আসে হোলিতে মাতোয়ারা মানুষজনের দিকে।
এইসব খুচরো আনন্দোৎসবের ফাঁকে ফাঁকেই চলতে থাকে একটানা লাঠির আক্রমণ। যা ঢাল বা লাঠি দিয়ে আপ্রাণ প্রতিহত করার চেষ্টা করতে থাকেন নন্দগাঁওয়ের ছেলেরা। পরেরদিন আবার বরসানার ছেলেরা যান নন্দগাঁওয়ে। একইভাবে নন্দগাঁওয়ের মেয়েরা লাঠি হাতে তাড়া করেন বরসানার পুরুষদের। ঢাল আর লাঠি দিয়ে সেই আঘাত থেকে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান তাঁরা।
একবার যদি ঢাল বা লাঠি ভেঙে যায় তাহলেই বিপদ। হয় মেয়েদের আক্রোশ মজার ছলে ভাঙতে পারে তাদের মাথা বা পিঠ। নাহলে ঢাল ভেঙে যাওয়ার ভুলে পুরুষদের পড়তে হয় চরম ‘অ্যাডামটিজিং’-এর মুখে। মেয়েদের পোশাক পরে প্রকাশ্যে নাচ দেখাতে হয় ঢালহীন লাঠিহীন ‘নিধিরাম সর্দার’-দের। দোল বা হোলির এক সপ্তাহ আগেই শুরু হয়ে যায় ‘লাঠমার হোলি’-কে সফল করার যজ্ঞ। যে যজ্ঞে শামিল হতে বছরের পর বছর ধরে দেশ বিদেশের বহু পর্যটক হোলির আগেই ভিড় জমান শ্রীকৃষ্ণের লীলাধামে।