হলুদ স্নানে কামদহন, হোলিতে মাতোয়ারা ভারত
রাধাকৃষ্ণের দোললীলা বা হোলিকা দহনের পৌরাণিক ঐতিহ্য তো আছেই। সেই সনাতনি আপাত উত্তুরে ঐতিহ্যকে নিজেদের মত করে বরণ করে ঘরে তুলে নেন দক্ষিণের মানুষও।
বসন্ত উৎসব বা দোল যদি বাংলার হয়, তবে ভারতের অন্য প্রান্তের কাছে এটা হোলি। যা এক এক রাজ্যে এক এক নামে রঙের উৎসব বাঁধ ভাঙা রঙিন মনের উচ্ছ্বাসের বার্তা ছড়িয়ে দেয় কোটি কোটি মানুষের অন্তরাত্মায়। উত্তরের কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে কন্যা কুমারিকার জলহাওয়া পর্যন্ত রঙের জাদুছোঁয়ায় মাতোয়ারা হয়ে উঠতে দ্বিধাবোধ করে না।
উত্তরের বাসিন্দারা তো বটেই, এমনকি বিন্ধ্য পর্বতের সীমানা পেরিয়ে ফাগের মিষ্টি গন্ধে আকুল হয়ে ওঠে দক্ষিণী প্রাঙ্গণ। রাধাকৃষ্ণের দোললীলা বা হোলিকা দহনের পৌরাণিক ঐতিহ্য তো আছেই। সেই সনাতনি আপাত উত্তুরে ঐতিহ্যকে নিজেদের মত করে বরণ করে ঘরে তুলে নেন দক্ষিণের মানুষও।
তামিলনাড়ু রাজ্যের কথাই ধরা যাক। এই রাজ্যে হোলির পরিচয় ত্রিবিধ স্রোতে প্রবাহিত। ‘কামবিলাস’, ‘কামন পন্ডিগাই’ এবং ‘কামদহনম’। লক্ষ করুন, হোলির এই তিন প্রকারের নামের মধ্যেই আছে ‘কাম’ শব্দের উল্লেখ। আসলে বৃন্দাবনে যিনি মদনমোহন কৃষ্ণ, তিনিই দক্ষিণে পরিচয় পাল্টে হয়ে গেছেন প্রেমের দেবতা কাম। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, ফাল্গুনি পূর্ণিমার রাতে শ্রীকৃষ্ণের প্রেমবাণে জর্জর শ্রীরাধিকা নিজের সর্বস্বটুকু তুলে দিয়েছিলেন প্রেমিকের হাতে। পরের দিন রাধিকার সর্বাঙ্গে কৃষ্ণের অনুরাগের রঙ আড়াল করতেই সূচনা হয় হোলির। দক্ষিণের ঘরে সেই মিলনকাতর অনুরাগের গল্পে প্রলেপ পড়েছে বিরহের বেদনাঘন রঙের। পুরাণ বলে, সতীর দেহত্যাগের পর মহাদেব নাকি এক কঠিন পণ করেছিলেন। তিনি জীবনে আর কোনও নারীর পাণিগ্রহণ করবেন না। তাহলে মহাদেবের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া দেবী পার্বতীর কি হবে। হরপার্বতীর মিলন নাহলে তো কার্তিকের জন্ম হবেনা। তাহলে কার্তিকের হাতে তারকাসুরের নিধনও হবে না।
দেবলোক ও মর্ত্যলোককে বাঁচাতে অতঃপর ডাক পড়ল মদনের। মহাদেবের মনে পার্বতীর জন্য প্রেমের ভাব জাগানোর কঠিন দায়িত্ব পড়ল কামদেবের ঘাড়ে। পত্নী রতিকে নিয়ে ময়দানে নেমেও পড়লেন মদন। তাঁর জোরাল রিপুবাণ গিয়ে বিদ্ধ করল কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন মহাদেবকে। চোখ খুলতেই হল মহেশ্বরকে। পার্বতীর সাথে শুভদৃষ্টি হল তাঁর। আবার প্রেমে পড়লেন শিব। কিন্তু তপস্যা ভঙ্গ হয়েছে। ফলে ক্রোধে জ্বলে উঠল তাঁর তৃতীয় নয়ন। সেখান থেকে বার হল প্রচণ্ড অগ্নিবাণ। সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন মদন। রতির হাহাকারে আকুল হয়ে উঠল কৈলাসের আকাশ বাতাস। প্রেমী হৃদয়ের সেই হাহাকার এসে পৌঁছল মানবভূমিতেও। কাম ও রতির বিরহের সেই স্মৃতিতে তাই আজও হোলিকা নয়, কামদহন দিয়েই শুরু হয় তামিলনাড়ুর হোলি। অন্ধ্র প্রদেশ বা তেলেঙ্গানাতেও তামিলনাড়ুর মতই হোলির আগে একইভাবে কামদহনের পরেই শুরু হয় মূল উৎসবের।
মহারাষ্ট্রে হোলির দিন ‘মটকি তোড়’ প্রথার জনপ্রিয়তা আবার তুঙ্গে। রঙ মেখে ভূত হওয়ার পালা তো সাঙ্গ হল। এরপরেই রাজ্যের অলিতে গলিতে শুরু হয়ে যায় ‘মটকি তোড়’। ছোটবেলায় বালগোপাল তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে কি করতেন মনে পড়ে? শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর বন্ধুরা নন্দগাঁওয়ের গোপিনীদের তৈরি ননী খালি চুরি করে খেয়ে নিতেন। তাই অতিষ্ঠ গোপিনীরা ননীভর্তি হাঁড়ি একসময় ঘরের একদম টঙে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখলেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের দুষ্টুবুদ্ধির কাছে সব পরিকল্পনাই ব্যর্থ। সপার্ষদ শ্রীকৃষ্ণ গোপবালকদের কাঁধে ভর দিয়ে উঁচুতে তোলা হাঁড়ি থেকেও ডাকাতি করতে লাগলেন ননীর। নন্দদুলালের সেই দুষ্টুমির কথা মাথায় রেখেই প্রতি বছর ‘মটকি তোড়’-এ মেতে ওঠেন মহারাষ্ট্রের কয়েকশো যুবা।
এই উৎসবে প্রথমে ৩ তলা বা ৫ তলা বাড়ির সমান উচ্চতায় লস্যি বা ঠান্ডাইয়ের হাঁড়ি দড়িতে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সেই হাঁড়ির নাগাল পেতে মাটিতে গড়ে তোলা হয় মানব পিরামিড। সেই পিরামিডের গা বেয়ে সাবধানে একজন শক্তপোক্ত চেহারার ছেলে উঠে পড়েন পিরামিডের শীর্ষে। তারপর ‘জয় শ্রীকৃষ্ণ’ নামে লাঠি বা হাত দিয়েই ফাটিয়ে ফেলা হয় হাঁড়ি। দুধসাদা ঠান্ডাইয়ের স্বাদ নিতে হুটোপাটি লেগে যায় নিচে ভিড় জমানো উৎসাহীদের মধ্যে। মহারাষ্ট্রের কোথাও আবার এই হোলির উৎসব স্থানীয় ভাষায় পরিচিত ‘শিমগা’ নামে।
গোয়া ও কোঙ্কণ উপকূলে হোলির পোশাকি নাম ‘শিগমো’। কোঙ্কণের দক্ষিণাঞ্চলে হোলি উৎসবকে স্থানীয় বাসিন্দারা ডাকেন ‘উক্কুলি’ নামে। মালয়ালম ভাষায় এর নাম আবার ‘মঞ্জলকুলি’। ‘উক্কুলি’ বা ‘মঞ্জলকুলি’ এই দুই শব্দের অর্থ ‘হলুদ স্নান’। হোলির দিন মূলত হলুদ গোলা জল দিয়ে একে অপরের গায়ে হলুদ দিয়ে থাকেন সেখানকার মানুষ। প্রাকৃতিক গুণাগুণ ও পবিত্রতার জন্যই হলুদ রং অন্য রঙের থেকে অনেক বেশি নিরাপদ বলে মনে করেন তাঁরা। নানা বর্ণে নানা প্রথায় উত্তরের হোলির জমজমাটি ভাব হয়তো দক্ষিণের হোলিতে পাওয়া যায় না। কিন্তু নিজেদের মত করে রঙের উৎসবের আনন্দরস নিংড়ে নিতে পিছিয়ে নেই দক্ষিণীরাও।