Festive Mood

হোলি আয়ি, হোলি আয়ি, হোলি আয়ি রে

মনের রঙ শুধু মনেই নয়, প্রকৃতির বুকেও লাগে। দেশ কালের সঙ্কীর্ণ সীমারেখা ছাড়িয়ে প্রকৃতির অবাধ বিস্তার। অপার বিস্তৃত প্রকৃতি রঙ্গরাজের শোভা বাড়াতে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে নিজেকে আসমুদ্রহিমাচল ছড়িয়ে দেয় বসন্তের দূত ফাগ। ফাগ বা আবিরের রঙে আপামর দেশবাসীর সারা অঙ্গ, সমগ্র চেতনা হয়ে ওঠে বর্ণময়। বসন্ত পূর্ণিমার সকালে মিঠে রোদ আর ভুতুড়ে রঙ, আবিরকে সঙ্গী করে আনন্দে কলকলিয়ে ওঠেন বঙ্গ সন্তানরা। দোল পূর্ণিমায় একই দিনে রঙের জোয়ারে গা ভাসায় প্রতিবেশি রাজ্য ওড়িশাও।

ঝুলনদোলায় রাধাকৃষ্ণের মিলনের স্মৃতিকে স্মরণ করে মেতে ওঠেন আট থেকে আশি সকলেই। বসন্তের ফাল্গুনি তিথিতেই নাকি যুগাবতার শ্রী চৈতন্যদেব পুরী থেকে ভক্তদের নিয়ে বাংলার বুকে দোল উৎসবের প্রবর্তন করেছিলেন। সেই তত্ত্বই রঙের মহোৎসবে ওড়িশা ও বাংলাকে এক দেহ এক প্রাণে মিলিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশি বিহারেও রঙের উৎসবের চেহারাটা অনেকটা একইরকমের। হাতে পিচকারি, মুঠোভর্তি গুলাল আর রঙ গোলা জলের বালতি নিয়ে হোলির দিন ময়দানে নেমে পড়েন বিহারবাসীও। তবে বিহারের হোলি প্রাকৃতিক রঙ কাদামাটি ছাড়া একেবারেই জৌলুসহীন। ভোজপুরি উৎসবে রঙকে মাহাত্ম্যগুণে ফিকে করে দেয় সহজলভ্য কাদামাটি।


কাদামাটির রঙের নেশা আরও গাঢ় করতে সঙ্গে দোসর হয় দুধ ও মশলা সহযোগে ভাং। সেই ভাং পেটে পড়তেই শুরু হয় ঢোলক বাজিয়ে উদ্দাম নাচ গান। রঙ নিয়ে দিনভরের এই উদ্দামতাই বিহারবাসীর আদরের ‘ফাগুন’। বিহারে হোলির দিন আবার রঙ খেলার শেষে একে অপরের পরনের কাপড় ছিঁড়ে দেন। যা কাপড়াফাড় হোলি নামে বিখ্যাত। বিহারের অনেক সেলেব্রিটিকেও এই কাপড়াফাড় হোলিতে অংশ নিতে দেখা গেছে।

বঙ্গ, বিহার বা উত্তরপ্রদেশ, এই ৩ রাজ্যই পবিত্র গঙ্গার প্রবাহে বিধৌত। তাই দোল বা হোলির উৎসবের মেজাজ এই ৩ রাজ্যেই একরকম। রাধাকৃষ্ণের লীলাভূমি বৃন্দাবন মথুরায় রঙ ছোঁড়াছুঁড়ি তো সাধারণ ব্যাপার। এর পাশাপাশি নারী ও পুরুষদের একে অপরকে ফুলের পাপড়ি বা গোটা গোটা লাড্ডু ছুঁড়ে মারাও হোলি উদযাপনের অন্যতম অঙ্গ। বরসানার ‘লাঠমার হোলি’ তো এখন সর্বজনবিদিত। আবার যদি কানপুর বা বারাণসীতে গিয়ে রঙ খেলতে ইচ্ছা হয়, তাহলে অন্য অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকতে হবে সকলকে। কানপুরে হোলি ‘জাতীয়তাবাদী গঙ্গা মেলা’ হিসেবে উদযাপিত হয়। আর সারা গায়ে কাদামাটি মেখে কুস্তি না হলে হোলির দিনটাই বৃথা গেল বলে মনে করেন বারাণসীর বাসিন্দারা। মধ্যপ্রদেশে আবার হোলি ‘রঙ্গপঞ্চমী’ নামে খ্যাত।


গাঙ্গেয় সমভূমি ছেড়ে যদি উত্তরমুখী হওয়া যায়, সেখানে আবার হোলির মেজাজ ভিন্ন লয়ের। পঞ্জাবের কথাই ধরা যাক। সেখানকার বাসিন্দারা শুধু শরীরে নয়, নিজেদের ঘরকেও হোলির প্রাক্কালে করে তোলেন রঙিন। এইসময় গ্রামের পঞ্জাবি মেয়েরা কাপড়ের ওপর নতুন নকশা কাটেন। সেইসব রঙিন সুতোর খেলা দেখে মনে হয়, প্রকৃতির রঙ মনের মাধুরীর সাথে মিশে গেছে মননেও। হোলির পার্বণে রঙিন সুতোর বয়নের সেই খেলা ‘চক পুরানা’ নামে পঞ্জাবে প্রসিদ্ধ।

গুজরাটে আবার হোলির রেশের স্থায়িত্ব ২ দিনের। উৎসবের সূচনায় সেখানে হোলিকার আগুনে প্রথমে নারকেল ও ভুট্টা আহুতি দেওয়া হয়। তারপর ২ দিন ব্যাপী চলে ব্যাপক নাচগান, খাওয়াদাওয়া আর রঙ খেলা। আসলে ফাল্গুন মাসে গুজরাটের পল্লিগ্রামের ঘরে ঘরে মজুত হয় পাকা রবি শস্য। গোলা ভর্তি শস্য আর ঘর ভর্তি ফসল। তাই রঙের ছলে আনন্দের পরিমাণ হয়ে ওঠে মাত্রাছাড়া। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের আনন্দ হোলির সময় হয়ে ওঠে দ্বিগুণ। শ্রীকৃষ্ণের দুষ্টুমির গল্পে আশকারা পেয়ে এইসময় ‘ননীভাণ্ড’-র দখল নিয়ে চলে লড়াই। সেই লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে নবীন যৌবনের প্রাণোচ্ছ্বাস।

রাজস্থানের রয়্যাল হোলিতেও বসন্তের প্রাণোচ্ছ্বলতা প্রকাশিত হয় একেবারে রাজকীয় ঢঙে। চন্দ্রের পূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশের দিন মরুদেশে সকলে মিলে একত্রিত হন রঙিন হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষায়। ‘বনফায়ার’ জ্বালিয়ে সূচনা করা হয় হোলির। তারপর জল আর আবির দিয়ে একে অপরকে রঙ মাখানোর আনন্দে মেতে ওঠেন সকলে। আবার উত্তরে হোলির পনেরো দিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় কাউন্টডাউন। স্থানীয় বাসিন্দারা মূল উৎসবের আগে হোলিকা রাক্ষসীর কাঠামো তৈরি করেন। সেই কাঠামোকে পাহাড়ি মানুষরা ডাকেন ‘চীর বন্ধন’ নামে। হোলির মাহেন্দ্রক্ষণে পোড়ানো হয় অশুভ শক্তির কুশপুতুল। তারপরে রঙ নিয়ে মাঠে ঘাটে নেমে পড়েন উৎসবপ্রেমীরা। সেই হোলি-ধুলান্দিকে ঘিরে বছরের পর বছর ধরে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন উত্তর ভারতের পাহাড়ের কোলের বাসিন্দারা।

মণিপুরে আবার বসন্ত উৎসব শুরু হয় পূর্ণিমার ৫ দিন আগে। মণিপুরবাসীর আঞ্চলিক আরাধ্য দেবতা পাখাংবা-কে উৎসর্গ করে শুরু হয় হোলি উৎসব। স্থানীয় ভাষায় এর নাম ইয়োলশ্যাং। ছোট ছোট কুটিরে রঙ খেলার পাশাপাশি চলে পাখাংবা-র পুজো অর্চনা।

Show Full Article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button