একটা দলের দায়িত্ব নেওয়া মানে সেই দলের দুর্দিনে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দলকে খাদের কিনারা থেকে বাঁচিয়ে আনা। কিন্তু এদিন ওভালে দেখা গেল একটু চাপ কিভাবে বিরাটদের যাবতীয় গুমোরের মুখোশ খসিয়ে আসল দুর্বলতাটা বের করে আনে। পাকিস্তান পাহাড় প্রমাণ রানের চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল। কিন্তু সেই রান তোলা যায়না এমন নয়। বল ব্যাটে ভালভাবে আসছিল। একটু সেট হয়ে ঠিকঠাক আক্রমণ তৈরি করলে রান তাড়া করাটা হয়তো কঠিনও হতনা। অন্তত লড়াইটা তো দিতে হবে! কিন্তু ওই রান দেখেই বিরাটদের হাঁটু কেঁপে গেছিল। আর সেটা ধরাও পড়ল। শুরুতেই মাত্র ৭ রান করতে যে দল ২ উইকেট হারায় সেই দলের পক্ষে ট্রফি নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলনা। যোগ্যতাও ছিলনা। ফলে যোগ্য দল হিসাবেই ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল জিতে দেশকে ইদের আগাম উপহারটা দিয়ে দিল পাকিস্তান। আর সেটা যতটা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতা, তার চেয়েও অনেক বেশি ভারতকে দুরমুশ করা। যেটা এদিন ওভালের মাঠে তাদের ঝুলিতে তুলে দিল ভারত। দেখিয়ে দিল কাগুজে বাঘ নীল বাহিনী একটু বড় রানের সামনে কতটা অসহায়। টস জিতে এদিন প্রথমে পাকিস্তানকে ব্যাটিং করতে পাঠান বিরাট কোহলি। এদিন ওভালে যে পিচে ফাইনাল খেলা হয়েছে তার সঙ্গে এই টুর্নামেন্টে পরিচয় হয়নি দলগুলোর। ক্রিকেট বোদ্ধাদের ধারণা পাকিস্তানকে প্রথমে ব্যাট করিয়ে পিচের ধরণধাঁচ বোঝার চেষ্টা করছিলেন বিরাট। না হলে টস জিতে ফাইনালের মত ম্যাচে বড় রান করে চাপ কমিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আর টস জিতে বিরাট তা না করে আসলে টস জিতেও ম্যাচ তুলে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের হাতে। ব্যাট করতে নেমে পরপর ২টো রান আউটের সুযোগ হারায় ভারত। বুমরাহ-র বলে ক্যাচ তুলে ধোনির হাতে ধরা পড়েন ফকর জামান। কিন্তু এখানেও ভাগ্য পাকিস্তানের পক্ষে যায়। নো বলে উইকেট নিয়ে শূন্য হাতে ফের ফ্রি হিটের বল করতে যেতে হয় বুমরাহকে। এরপরই খেলার ধরণ বদলায় পাকিস্তান। শুরু হয় প্রহার। এক এক করে বুমরাহ, অশ্বিন, রবীন্দ্র জাদেজাকে কার্যত তুলোধোনা করতে থাকেন দুই পাক ওপেনার ফখর জামান ও আজহার আলি। আজহার ৫৯ রানে ফিরলেও বাবর আজমকে সঙ্গে করে ফখরের মারকাটারি ব্যাটিং চলতেই থাকে। ১১৪ রান করে আউট হন ফখর। কিন্তু ততক্ষণে পাকিস্তানের রান শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। মহম্মদ হাফিজ রানের গতি অব্যাহত রেখে অপরাজিত ৫৭ রান করেন। প্রথমের কয়েকটা ওভার আর শেষের ৪ ওভার বাদ দিলে এদিন শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের বেদম প্রহার সহ্য করতে হয়েছে বিরাটদের। আরও রান হতেই পারত। কিন্তু শেষের দিকে ভাল রান করতে না পারার জেরে পাকিস্তানের বিধ্বংসী ইনিংস শেষ হয় ৩৩৮ রানে। পাকিস্তানের ইনিংসে এদিন অদৃশ্য ব্যাটসম্যান ছিল এক্সট্রা রান। ৫০ ওভারে ২৫ রান অতিরিক্তের খাতায় জমা দিয়েছেন ভারতীয় বোলাররা। ৩৩৯ রান করলে ট্রফি জিতবে এই অবস্থায় ব্যাট করতে নামে ভারত। রানের পাহাড় তাড়া করতে গিয়ে দুর্বল হৃদয়ের টিম বিরাট নেমেছিল কার্যত হার মেনেই। খেলা শেষ করাটা ছিল নিয়মরক্ষা। প্রথম ওভারের ৩ বলের মাথায় এলবি হয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেন রোহিত শর্মা। এরপর ব্র্যান্ড বিরাট ব্যাট হাতে নামেন। এই ম্যাচে তাঁর হাত থেকেই বড় রান দেখতে চাইছিল গোটা দেশ। কিন্তু স্লিপে ক্যাচ তুলে প্রায় ফেরা নিশ্চিত করেন বিরাট। ক্যাচ ফস্কায় পাকিস্তান। কিন্তু বিরাটও ছাড়ার পাত্র নন। দুরুদুরু বুকে তখন প্যাভিলিয়নে ফিরতে পারলে বাঁচেন তিনি। তাই পরের বলে ফের ক্যাচ। না, এটা হাতছাড়া করেননি পাক ফিল্ডার। যদিও যেভাবে কাঁপা হাতে বিরাট খেলছিলেন তাতে এই ক্যাচ ফস্কালে ফের ক্যাচ দিতেন তিনি। একবার তো ধরা পড়বেনই! এরপর যুবরাজ-শিখর ধাওয়ান হাল ধরার চেষ্টা করলেও দলের ৩৩ রানের মাথায় সরফরাজের হাতে জমা পড়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেন শিখর ধাওয়ানও। নিয়মরক্ষার ম্যাচে ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিংয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুখ পুড়িয়ে ভারত শুরু করে যে করে হোক শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার লড়াই। ৫৪ রানের মাথায় পরপর যুবরাজ ও ধোনির উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ভারত ১০০ রানটাও পার করতে পারে কিনা সেটাই ছিল দেখার। পাকিস্তানের কাছে সবচেয়ে বেশি রানে হারের লজ্জাটাও হজম করার ছিল এই দলের। দলের ৭২ রানের মাথায় আউট হন কেদার যাদব। এরপর হার্দিক পাণ্ডিয়া কিছুটা লড়ার চেষ্টা করেন। পরের পর ছক্কা হাঁকিয়ে খেলার শুরু থেকে ঝিমিয়ে থাকা ভারতীয় সমর্থকদের সামান্য হলেও উৎসাহ দেখানোর সুযোগ দেন। ব্যক্তিগত ৭৬ রানের মাথায় জাদেজার ভুলে তাঁকেও প্যাভিলিয়নে ফিরতে হয় রান আউট হয়ে। মাঠের মধ্যেই জাদেজার ওপর ক্ষোভ দেখিয়ে ফেলেন হার্দিক। প্যাভিলিয়নে ফিরতে ফিরতেও তাঁর উষ্মা প্রকাশ সকলের নজর কাড়ে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও দ্রুত জাদেজাকে ভিলেন বানিয়ে নানা কমেন্ট ঘুরতে শুরু করে। এদিকে হার্দিক আউট হয়ে ফেরার সামান্য সময় পর জাদেজাও আউট হয়ে মাঠকে বিদায় জানান। দলের ১৫৬ রানের মাথায় আউট হন অশ্বিনও। ১৫৮ রানের মাথায় শেষ উইকেট ছিনিয়ে নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হল পাকিস্তান। ভারতকে ১৮০ রানে হারিয়ে দিল সরফরাজের ছেলেরা। পাকিস্তানকে দিল ভারতকে হারানোর আনন্দ আর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ঘরে তোলার গৌরব।