রুদ্ধশ্বাস বললেও কম বলা হয়। যে বিশ্বকাপ ফাইনাল এদিন হল তার শেষের দিকের অনেক ওভারই দেখতে পারেননি ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের সমর্থকেরা। দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। ম্যাচ টাই। সুপার ওভারও টাই। অবশেষে ৪ হাঁকানোর নিরিখে বেছে নেওয়া হল বিজয়ী। আর সেই খতিয়ানে এই ম্যাচে বেশি ৪ মেরে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হল ইংল্যান্ড। বিশ্ব পেল নতুন এক ক্রিকেট বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। এর আগে না কোও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ টাই হয়েছে। না তা সুপার ওভারে গড়িয়েছে। এক্ষেত্রে সুপার ওভারে গড়ানো ম্যাচও টাই হয়ে গেল। ৪-এর জোরে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হল ইংল্যান্ড। তবে মাঠে খেলে কেউ কাউকে হারাতে পারল না। তবে এই ম্যাচের সবচেয়ে বড় অধ্যায় হয়তো হয়ে থাকবে ব্যাট অফ গড। যে ব্যাটে লেগে একটা ৪ ম্যাচের মোড় পুরোটাই ঘুরিয়ে দিয়েছিল মুহুর্তে।
বিশ্বকাপের ফাইনালে লন্ডনের লর্ডসের ঐতিহ্যবাহী মাঠে টস জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। সকাল থেকে টানা বৃষ্টির পর ভেজা মাঠে, ভেজা আবহাওয়ায় প্রথমে ব্যাট করা যথেষ্ট সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল। তবে ফাইনালের চাপের মুখে রান তাড়া করার চাপটা বোধহয় কেন নিতে চাননি। ব্যাট করতে নেমে গুপতিল ও নিকোলস জুটি ভাল শুরু করে। প্রথম ম্যাচে ভাল খেলার পর গোটা বিশ্বকাপটা খারাপ গেছে গুপতিলের। তবু ফাইনালে তাঁর ওপর ভরসা রেখেছিল নিউজিল্যান্ড।
এদিন মারমুখী চেহারা নিয়ে ব্যাটিং শুরু করলেও বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি তিনি। ১৯ রান করে ফেরেন গুপতিল। নিকোলস জুটি বাঁধেন অধিনায়কের সঙ্গে। মারকাটারি না হলেও ধরে খেলে রানটা বাড়াতে থাকেন এই দুজন। বল বেশি রান কম। এটাই ছিল তাঁদের ব্যাটিং খতিয়ান। কিন্তু রান তোলার তাড়ায় উইকেট হারাতে চাননি কেউই। ৩০ রান করে ফেরেন কেন। এরপর ৫৫ রান করে ফেরেন নিকোলসও। রান ধীরেই উঠছিল। কিন্তু কিউয়ি ব্যাটসম্যানেরা কিছুটা করে রান করেই দিয়ে যাচ্ছিলেন।
টেলর ১৫ রানে ফেরার পর ল্যাথাম ও নিশাম ম্যাচের হাল ধরেন। নিশাম ১৯ রান করে ফিরলেও ভাল রান করতে থাকেন ল্যাথাম। গ্র্যান্ডহোমকে নিয়ে রানটা আরও বাড়ান তিনি। গ্র্যান্ডহোম ১৬ রান করে আউট হন। ল্যাথাম ফেরেন ৪৭ রান করে। নিউজিল্যান্ড ৫০ ওভারের শেষে ৮ উইকেট হারিয়ে তোলে ২৪১ রান। প্রায় যে রানে ভারতের বিরুদ্ধে শেষ করেছিল তারা। ফলে তাড়া করার জন্য রানটাও ছিল ইংল্যান্ডের জন্য ভারতের মতই। এদিন ইংল্যান্ডের সেরা বোলিংটা করে দেন ক্রিস ওকস ও প্লাংকেট।
বিশাল রান নয়। কিন্তু কঠিন পিচে সেই রান তাড়া করতে নেমে প্রথম থেকেই ধীরে চলো নীতি নেয় ইংল্যান্ড। বড় শটের উপায়ও খুব একটা ছিলনা। যেভাবে বোল্ট, হেনরি বা গ্র্যান্ডহোমরা বোলিং করছিলেন, তাতে হাত খুলে মারতে গেলে ইংল্যান্ডের জন্য হিতে বিপরীত হত। ১৭ রান করে ফেরেন জেসন রয়। জো রুট ৩০ বল খেলে ৭ রান করতে পারেন। তারপর বড় শট নিতে গিয়ে আউট হয়ে ফেরেন। বেয়ারস্টো এদিন বেশ কয়েকবার আউট হতে হতে বাঁচার পর অবশেষে ৩৬ রান করে ফার্গুসনের বলে বোল্ড হন।
অধিনায়ক মর্গানও এদিন ব্যর্থ হন। ২২ বল খেলে মাত্র ৯ রান দলের খাতায় যোগ করে তিনিও ফেরেন। দলের ৮৬ রানের মাথায় ইংল্যান্ডের ৪ উইকেট পড়ে যায়। প্রবল চাপের মুখে পড়ে ব্রিটিশ বাহিনী। এখান থেকে খেলার রাশ কষে ধরেন বেন স্টোকস ও জস বাটলার। ইংল্যান্ড মিডল অর্ডারের এই ২ স্তম্ভকে ভরসা করে ইংল্যান্ড ফের খেলায় ফেরে।
শুধু রাশ ধরাই নয়। খেলার মোড় ঘুরিয়ে খেলাকে প্রায় জয়ের দোরগোড়ায় নিয়ে চলে যান এই ২ ব্যাটসম্যান। কিন্তু ৫৯ রানে বাটলার ফেরার পরই খেলা ফের নিউজিল্যান্ডের দিকে ঝুঁকতে থাকে। উইকেটও পড়তে থাকে। ইংল্যান্ডের শুধু ভরসা ছিল একটাই, বেন স্টোকস। তিনি যতক্ষণ আছেন ইংল্যান্ড ম্যাচে বেঁচে আছে। এখানে শেষ ওভারে তখন ইংল্যান্ডের হাতে মাত্র ১টি উইকেট। ব্যাট হাতে বেন স্টোকস।
প্রথম ২টি বল রান পেলেননা। ১ রান হতে পারত কিন্তু নেননি। শেষ ৪ বলে দরকার ১৫ রান। কার্যত অসম্ভব। এই অবস্থায় ছক্কা হাঁকান বেন। ৩ বল, ৯ রান। এই বলেই ঘটে ম্যাজিক। বেন বল ঠেলে ছোটেন। ২ রানের জন্য প্রাণপণ ছুটতে থাকেন। অন্যদিকে গুপতিল বল ছোঁড়েন উইকেট রক্ষককে। সেই বল ব্যাট ছড়িয়ে ক্রিজে পৌঁছনোর চেষ্টা করা বেন স্টোকসের ব্যাটে লেগে চলে যায় বাউন্ডারির বাইরে। এ যেন ব্যাট অফ গড হয়ে যায়। আসে ৬ রান। শেষ ২ বলে ৩ রান দরকার ছিল। এখানে আবার ২ বলে ২টি রান পায় ইংল্যান্ড। ম্যাচ টাই হয়। বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে প্রথমবার। খেলা গড়ায় সুপার ওভারে। আর সেখানে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ডের বাটলার ও স্টোকস ৬ বলে ২টি ৪ সহ ১৫ রান তুলে দেন।
১৬ রান করলে জিতবে। এই অবস্থায় ব্যাট করতে নামেন নিউজিল্যান্ডের গুপতিল ও নিশাম। বোলিং করতে আসেন জোফ্রা আর্চার। প্রথম বল ওয়াইড করে খেলা দাঁড়ায় ৬ বলে ১৫ রান করলে জিতবে নিউজিল্যান্ড। এখানে একটা ছক্কা হাঁকিয়ে ম্যাচের মোড় ঘোরান নিশাম। শেষ বলে দরকার ছিল ২ রান। কিন্তু দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে আউট হন গুপতিল। সুপার ওভারও টাই হয়ে যায়। ম্যাচ ৪ বেশি মারায় জিতে যায় ইংল্যান্ড।